এক দোকানে গেছি। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। ফুটপাতে ভাসমান স্পঞ্জ স্যান্ডেলের দোকান।
আমার স্যান্ডেলের দাম ৬০ টাকা। নিলাম। কাছে ভাংতি নেই। হাজার টাকার নোট।
দোকানি নিজে থেকেই বললেন- “দেন”।
আরো কিছু কাস্টমার স্যান্ডেল দেখছে।
আমার একটা কল আসে মোবাইলে। আমি কথা বলতে বলতে দোকানীর দেয়া বাকি টাকাটা পকেটে গুজে চলে আসি।
মোবাইলে কথা বলতে যেয়ে অন্যমনস্ক ছিলাম। অবশ্যই টাকাটা গুনে নেয়া উচিৎ ছিল।
বাসায় আসি রাত ১১ টায়। আমার একটা জটিল ব্যারাম আছে।
টাকা মানিব্যাগে রাখি না। ক্ষুদ্র কারণও আছে। আমি প্যান্ট পরি একটু লুজ টাইপের।
চিকন মানুষ তাই লুজ প্যান্টে মোটা দেখায়।
পেছনে বড় পকেট। মানিব্যাগ কখন কে বের করে নেয় খেয়াল রাখা একটু টাফ। ফলে পকেটে রাখি টাকা। মানিব্যাগ জাস্ট শো হিসেবে।
আজকাল অনেকেই যেমন মোবাইলে টাইম দেখে তবুও হাতে ঘড়ি লাগায়- ফর শো।
আমি পকেট থেকে টাকা বের করে দেখি তিনটা পাঁচশত টাকার নোট।
সর্বনাশ!
ওই স্যান্ডেলওয়ালা স্যান্ডেলের দামতো রাখেনইনি উল্টো আরো পাঁচশ টাকা বেশি দিয়েছে।
আমি আসলে এত সৎ না। কিছুটা খুশি হলাম।
কিন্তু কয়েক মিনিট পর থেকেই আমার ভেতরে খারাপ লাগতে শুরু করে।
লোকটার সারাদিনের দীর্ঘসময়ের লাভ হয়তো এই পাঁচশ টাকা। যা আমার কাছে। সারাটাদিন তার যে পরিশ্রম গেছে তার ফল জিরো।
দৌড়ে বের হলাম বাসা থেকে। লোকটাকে বের করতেই হবে।
আধাঘন্টার মত খুঁজলাম। পেলাম না। এ শহরে গলিতে গলিতে শত্রুর দেখা পাওয়া যায়, কিন্তু হারানো মানুষের দেখা পাওয়া যায় না।
প্রচণ্ড অপরাধবোধ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঘুম হলো না তেমন।
সকালে উঠে আবার গেলাম। পেলাম না।
তবে সৃষ্টিকর্তার রহমতের শেষ নেই। লোকটাকে পেয়ে গেলাম দুপুরে । টাকাটা ফেরত দিয়ে চলে এলাম।
লোকটার মুখে যে হাসি দেখলাম টাকা পেয়ে- তা স্পষ্টই বলে দেয় গতরাতে তিনিও হয়তো অনেক হিসাব কষে এই টাকা মেলাতে পারেননি। অতঃপর মিলে গেছে আমার দেখা পেয়ে৷
এরপর কেটে গেল তিন মাস।
ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। রাস্তায় বাসের যাত্রা বিরতীতে এক হোটেলে খেতে নামলাম।
খেয়ে বাসে উঠলাম। বাস সেখান থেকে চলে এসেছে কয়েক মাইল দূরে। আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।
সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আমি আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ রেখে এসেছি সে হোটেলে৷ তাতে ছিলো প্রায় দশ হাজার টাকা আর একটা মোবাইল।
আমি বাস থেকে নেমে পড়ি। সে হোটেলে ফিরি প্রায় ৪০ মিনিট পর। দুশ্চিন্তায় আমি অস্থির। ব্যাগ পেলাম না৷
দু’চোখ ভিজে যাচ্ছে প্রায়। অনেকদিনের গোছানো সে টাকা।
মন খারাপ করে বসে ছিলাম। কেটে গেল আরো দু ঘন্টা। ব্যাগ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম। গাড়িতে উঠতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে এক ছেলে আমাকে ডাকে…
বয়স চৌদ্দ কি পনের।
তার হাতে আমার ব্যাগ। সে নাকি আমাকে অনেকবার ডেকেছিল। ততক্ষণে আমাদের বাস ছেড়ে দিয়েছিল।
যাহোক ব্যাগটা ফিরে পেলাম।
হিসাব মেলাচ্ছি- হয়তো সেই স্যান্ডেলওয়ালার উপকারের প্রতিদান পেলাম আরেকজনের মাধ্যমে।
কারো উপকার করলে কখনো বৃথা যায় না। যার উপকার আপনি করছেন আজ সে আপনার উপকার করতে না পারলেও দেখবেন অন্য আরেকজনের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন।
উপর থেকে কেউ একজনতো কলকাঠি নাড়ছেন তাই৷ না? বিশ্বাস রাখুন।
আলী ইমরান