ডিভোর্সের পর আমার বোন আমাদের বাসায় এসে উঠলো। ভাবলাম এবার হয়তো বোনটা একটু সুখে থাকবে। কিন্তু না, আমার সেই ধারনা ছিলো পুরোপুরি ভুল। মাস পেরোতে না পেরোতেই বাড়ির পরিস্থিতি বদলে যেতে লাগলো। মার সাথে ইতির প্রায়ই কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হতে লাগলো।
একটা মেয়ে তার এই চরম দুঃসময়ে নিজের মাকেই সবচেয়ে কাছের চায়, পাশে চায়। এই চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার বোনের বেলায় হলো সম্পূর্ণ উল্টোটা। মা কেনো যেনো দিনকে দিন ওকে আর সহ্যই করতে পারছিলো না। রোজই কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হতো। মার আচারণে ইতির চেয়ে বেশি অবাক হলাম আমি। অন্য কেউ হলে মানা যেতো, কিন্তু নিজের মেয়ের এমন বিপদে মার এই আচরণ একবারেই অপ্রত্যাশিত।
ইতি রোজ রাতে দরজা বন্ধ করে কাঁদে। আমার সব ভাইবোনের মধ্যে এই বোনটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার জন্মের পর মার মধ্যে কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তখন ডাক্তার আমাকে মার থেকে দূরে দূরে রাখতে বলে। এইজন্য আমার সবকিছুই করতো ইতি। বলতে গেলে আমি ওর কাছেই বড়ো হয়েছি। মার আদর- স্নেহ, ভালোবাসা সবকিছু ওর কাছ থেকেই পেয়েছি। তাই ওর প্রতিটা সুখে যেমন আমি বেশি সুখী হই, তেমনিভাবে ওর দুঃখগুলোও আমাকেই বেশি ছুঁয়ে যায়।
আমি নিজেও বেকার। সবে পড়াশোনা শেষ করেছি, এখনো চাকরি বাকরি কিছু পাইনি। বাপের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছি। সংসারে কোনো পয়সা কড়ি দিতে পারছি না, এইজন্য তেমন কিছু করতে বা বলতেও পারছি না। বললেও সে কথা কেউ কানে তুলছে না।
বেলা বাজে নয়টা। এগারোটায় টিএসসিতে এক ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা করার কথা। অনলাইন ভিত্তিক একটা বিজনেস আছে তার। সেখানে কন্টেন্ট ডেভোলপার হিসেবে পার্টটাইম একটা কাজ নিয়ে কথা হবে তার সাথে। সোজা কথা এই কাজ আমি পারবো কি না, ভদ্রলোক সামনা-সামনি তাই বাজিয়ে দেখতে চান আরকি।
টিউশনি করে যা পাই তার প্রায় সবই আমার নিজের হাত খরচে চলে যায়। এখন থেকে বাড়তি কিছু টাকা দরকার ইতির জন্য। কিছু না পারি মাসে মাসে অন্তত কিছু টাকা হাতে দিতে পারলেও ওর খুব কাজে আসবে। টাকার একটা আলাদা ক্ষমতা আছে।
আব্বা দ্বিতীয় শ্রেণির একটা সরকারি চাকরি করতেন। অবসরে যাওয়ার পর মাসে মাসে সেখান থেকে কিছু টাকা আসে। সেই টাকা আর গ্রামে আমাদের কিছু জায়গা জমি আছে তার ইজারা বাবদ যা পাই এই দিয়েই কোনমতে আমাদের সংসারটা চলে।
পুরো মাসের বাজার খরচ,আব্বা- মার ওষুধ খরচ এবং সংসারের অন্যান্য খরচ করে এই টাকা দিয়ে মাস কাবার হতে চায় না। মাস শেষে ধার দেনা করা লাগে। মুদি দোকানে বাকি পড়ে, পরের মাসের শুরুর দিকে তা শোধ করা হয়। মাস শেষে আবারো সেই বাকির ফিরিস্তি লম্বা হয়। এই চক্রটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কোনভাবেই আর বের হতে পারছি না এখান থেকে।
তার উপর এখন সব জিনসের যা দাম বেড়েছে তাতে ইনকাম না করলে সংসার আর কোনভাবেই চালানো যাবে না। এরমধ্যে হুট করে সংসারে অতিরিক্ত দুইজন মানুষ স্থায়ী হওয়ার কারণে যদি কোনো অশান্তির সৃষ্টি হয় তাহলে তাকে খুব বেশি অস্বাভাবিক ব্যাপারও বলা চলে না। ইতির মেয়েটা ছোটো, বয়স এক বছর দুই মাস। তারজন্য দুধ কেনা লাগে। মাসে মাসে দুধ কিনতেও অনেকগুলো টাকা দরকার।
এই সব সমস্যার একটাই সমাধান, সেটা হলো টাকা। এখন আমার একটা চাকরি দরকার। মাসে মাসে অনেকগুলো টাকা আসলে হয়তো অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু চাকরি তো আর মুখের কথা না যে, চাইলাম আর পেয়ে গেলাম। চাকরির কয়েকটা পরীক্ষা দিয়েছি , এরমধ্যে প্রাইমারির ভাইভা আছে এই মাসে। বাড়িতে অবশ্য জানাইনি যে প্রাইমারির রিটেনে পাশ করেছি। এই চাকরিটা হয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে।
কাপড় পারছিলাম, এমন সময় ইতি রুমে আসলো। আমি বললাম, কিছু বলবি আপা? ও বললো, না তেমন কিছু না। মুখে তেমন কিছু না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি কিছু একটা বলতেই এসেছে। আমি ঘুরে তাকালাম ওর দিকে। আমার চাঁদমুখি বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকর ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। চেহারার সেই লাবন্য আর নেই। মায়া মায়া চোখ দুটোর নিচে কেমন কালি পড়ে গেছে। কতো রাত যে ঘুমায় না, কে জানে!
আমি ইতির কাঁধে হাত রেখে বললাম; আপা, রাত যখন খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন এতে ভয় পেতে হয় না, কারণ তার একটু পরেই সব অন্ধকার দূর করে সকালের আলো ফোটে। এখন আমরা যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সে সমস্যা একদিন থাকবে না। আমি একটা চাকরি পেলেই তোর, আমার, আমাদের- সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। আমি ইতির চোখের পানি মুছে দিলাম, ও আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
কী আশ্চর্য ব্যাপার, ছোটবেলায় কেউ আমাকে শক্ত কিছু বললে বা খেলায় না নিলে, কিংবা কোনো কারণে দুঃখ পেলে আমি সোজা এসে আপার কোলে এভাবে ঝাপিয়ে পড়তাম। আদর দিয়ে, স্নেহ দিয়ে আপা আমার সব দুঃখ নিমিষেই ভুলিয়ে দিতো। কিন্তু আমি ওর কোনো দুঃখই নিজের মধ্যে নিয়ে ওকে একটু ভালো রাখতে পারছি না। আমরা বড়ো হয়ে যাই কেনো? ছেলে বেলায়ই ভালো ছিলো। একজনের দুঃখ আরেকজনের বুকে গিয়ে ঝেড়ে ফেলা যেতো।
মানিব্যাগে হাত দিয়ে দেখলাম তিনশো কুড়ি টাকা আছে। আড়াইশো টাকা ইতির হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম বাবুর জন্য দুধ কিনিস। একটা পার্ট টাইম কাজের কথাবার্তা বলতে টিএসসি যাচ্ছি এখন, দোয়া করিস।
আমার এই বোনটা আমার চেয়ে নয় বছরের বড়ো। তবুও ও আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। ওর পরে আমার আরেকটা বোন আছে, তার বিয়ে হয়েছে বাগেরহাটে। আমাদের থানার পাশের থানা মোল্লারহাটে। তার নাম সাথী। আমার ছোটো একটা ভাই আছে। তার নাম শাকিল।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বাসায় বসে। এক সন্ধ্যায় দেখলাম বাবার সাথে তার অফিস থেকে কয়েকজন লোক এলো। মা নাশতা পানি জোগাড় করলো। খাওয়া দাওয়া শেষে মা আপাকে সাজিয়ে গুজিয়ে চা নিয়ে তাদের সামনে পাঠালো। এরা আসলে পাত্রী দেখতে এসেছিলো। পাত্রও তাদের সাথে এসেছিলো। দেখে তাদের পছন্দ হলো, আংটি পরিয়ে দিলো।
মুরব্বি গোছের এক লোক বললো, শুভ কাজে দেরি করে লাভ কী? আজই বরং আকদ্ হয়ে যাক। পরে আয়োজন করে অনুষ্ঠান করা যাবে। এই লোকটা ছিলো আব্বার অফিসের জিএম এবং সম্পর্কে পাত্রের খালু। এই লোকটাই আব্বার সাথে অফিসে বসে বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক করেছে। আমরা এর কিছুই জানতাম না। মা আর আব্বা শুধু জানতো।
সেই রাতেই কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হলো। এরমধ্যে এদের কয়েকজন গিয়ে এলিফ্যান্ট রোড থেকে পয়নামার বাজার সদাই কিনে আনলো। ছেলের দুলাভাই গিয়ে ছেলের মা আর বোনকে নিয়ে আসলো। তারা সাথে করে কিছু অর্নামেন্স নিয়ে এলো। চোখের সামনে ভোজবাজির মতো ঘটে গেলো বিয়েটা।
আমরা সব ভাইবোন মিলে এই বিয়ের বিরোধিতা করলাম। বড়ো বোনের বিয়ে হবে এমন হুটহাট করে, বরকে চিনি না জানি না, তেমন কোনো খোঁজ খবরও নেওয়া হলো না। তা ছাড়া কোনো আনন্দ উৎসব হবে না, এটা কিছুতেই মানা যায় না।
আব্বা অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, তোদের কাছে বাপ হয়ে আমি অনুরোধ করছি তোরা কোনো ঝামেলা করিস না। বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। নইলে আমরা সবাই খুব বিপদে পড়বো। আব্বার এই কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না তখন। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি।
আব্বা সারাজীবন কাজ করেছে ক্যাশ সেকশনে। বরাবরই সে ছিলো হিসেবে পাক্কা। এক পয়সাও এদিক ওদিক হয়নি কোনদিন। কিন্তু কীভাবে যেনো এ্যাকাউন্ট সেকশন থেকে এর কয়েকমাস আগে প্রায় তিন লাখ টাকা গায়েব হয়ে গেছে। কে করেছে, কীভাবে করেছে তা কেউ জানে না। সব দায় এসে পড়লো আব্বার উপর।
আব্বা সহজ সরল মানুষ দেখে সবাই তাকে চেপে ধরলো। তদন্তে আব্বার চাকরি চলে যাবে এমন একটা অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে আব্বাকে চাকরিতে বহাল রেখেছেন তার অফিসের জিএম সাহেব। তিনিই পাত্রের খালু।
কথা ছিলো বিয়ের পর দুই পরিবারের সুযোগ সুবিধা বুঝে একটা অনুষ্ঠান করা হবে। আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করে খাইয়ে ধুমধাম করে তারা মেয়ে তুলে নিয়ে যাবে। দিন যায়, মাস যায় সেই সুযোগ সুবিধা আর আসে না। আব্বাও তেমন গুরুত্ব দেয় না ব্যাপারটাতে, কারণ অর্থনৈতিক দৈন্যদশা তাকে আজীবন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিলো। আমরাও বলতে বলতে একসময় খেই হারিয়ে ফেললাম।
যার সাথে আপার বিয়ে হয়েছিলো তাকে আমার কখনোই ভালো লাগেনি। আমাদের প্রতি কখনো তার চোখে নিখাঁদ স্নেহ-মমতা লক্ষ্য করিনি, তারপরও শুধুমাত্র আপার জন্য যেতাম ওই বাড়িতে। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে তাদের নিজেদের বাড়ি।
ওবাড়ির কেউই আমাদেরকে আত্মীয় হিসেবে কখনো তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এর কারণ সম্ভবত আব্বার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। বিয়েতে তাদের ছেলেকে কিংবা ঘর সাজানোর মতো তেমন কিছুই দেওয়া হয়নি।
তারপরও যেভাবে যা যাচ্ছিলো তাতে অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু করোনার সময় দুলাভাইর বিজনেস অফ হয়ে গেলো। বাবু বাজারে একটা রেস্টুরেন্টে ছিলো তাদের। বিজনেস বন্ধ, হাতে কাজকাম নেই, এই সময় বাজে কিছু বন্ধু জুটলো। আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়লো। ক্যাসিনোতে যাতায়াত শুরু করলো। জমানো টাকা সব শেষ করলো অল্প দিনে। বাড়ির সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো।
একে একে বিজনেসের সবকিছু বিক্রি করে দিলো। বোনকে বলতো বাপের কাছ থেকে টাকা এনে দিতে। আমরা কোনো টাকা দিতে পারেনি। ঝগড়া ঝাটির পর বউর গায়ে হাত তোলা আরম্ভ করলো। একসময় কথায় কথায় সে আপার গায়ে হাত তোলা শুরু করলো। সহ্য করতে না পেরে আপা মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি চলে আসতো। পারিবারিকভাবে বসা-বসি হতো। ক্ষমা চেয়ে বউ নিয়ে যেতো, আবার সেই একই কাহিনি।
পুলিশে কমপ্লেন করা হলো, কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাত্রের আত্মীয়স্বজন এতোটাই ক্ষমতাধর ছিলো যে থানা পুলিশ আপোষ মিমাংসা ছাড়া অন্য কোনো সমাধান দিতে পারেনি।
শেষমেশ সবাই মিলে তাকে রিহ্যাবে ভর্তি করলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। সুস্থ হয়ে বের হওয়ার কিছু দিন পর আবার যা তাই। ছেলের খালুকে বলা হলো, সে পারিবারিক মিটিং করে মিটমাট করে দিয়ে ধৈর্য ধরতে বলে, কিন্তু ধৈর্য ধরতে ধরতে বোন আমার প্রায় মরার উপক্রম! কয়েকবার সুইসাইড এ্যাটেম্প করলো। সবশেষে বাধ্য হয়ে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা কামরাঙ্গির চরের একটা একতলা বাসায় থাকি।এখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিকশা ভাড়া আগে ছিলো পঞ্চাশ টাকা। যদিও রিকশা করে খুব কম যাওয়া আসা করেছি, কিন্তু একবারেই যে যাইনি তা না। পকেটে আছে সব মিলিয়ে সত্তর টাকা। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে রিকশায় গেলে সব টাকা শেষ হয়ে যাবে এখানেই, বীণার জন্য একটা ফুল কিনতে হবে। প্রায় সপ্তাখানেক পর তার সাথে আজ দেখা হবে, একটা ফুল অবশ্যই সাথে করে নিতে হবে।
লেগুনায় করে নীলক্ষেত যাওয়া যায়, ওখান থেকে হেটে টিএসসি যেতে বেশি সময় লাগবে না। লেগুনা স্ট্যান্ডে যেয়ে দেখি আজ তাদের আধা বেলা স্ট্রাইক চলছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে যাত্রী ভাড়া বাড়িয়েছে, কিন্তু যাত্রিরা নাকি বাড়তি ভাড়া দিতে চাচ্ছে না। এই নিয়ে ক্যাচালের এক পর্যায়ে এক যাত্রির মার খেয়ে লেগুনার ড্রাইভারের মাথা ফেটেছে, এর প্রতিবাদে স্ট্রাইক।
নিরুপায় হয়ে একটা রিকশা ডাকলাম। রিকশাওয়ালা মামা ভাড়া চায় একশো টাকা। তেলের দাম বাড়তি, সব জিনিসের দাম বাড়তি, সবচেয়ে বড়ো কথা এরা বুঝে ফেলেছে লেগুনা বন্ধ। মানুষের শেষ উপায় রিকশা। ফট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাধ্য হয়ে হাটা শুরু করলাম। লালবাগের ভেতর দিয়ে পলাশি হয়ে জহুরুল হক হলের ভেতর দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যাবে। হাটাও হলো, পয়সাও বাঁচলো।
বাইরে আজ প্রচন্ড রোদ। গরমে ঘেমে শার্ট ভিজে জবজবা অবস্থা। একটা কোক খেতে পারলে হতো, কিন্তু সেই উপায়ও নেই। আড়াইশো মিলির একটা কোকের দাম এখন পঁচিশ টাকা! হাটতে হাটতে জহুরুল হক হলের পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল ফুটে হুলুস্থুল অবস্থা! মনে হচ্ছে যেনো গাছ জুড়ে আগুন লেগে গেছে। সেই আগুনের ছায়া পড়েছে পুকুরের পানিতে।
আরেকটু সামনে ছোট্ট একটা কাঠগোলাপ গাছ। লাল টুকটুকে কাঠগোলাপ হয়েছে বেশকিছু। কয়েকটা কাঠগোলাপ কুড়িয়ে পকেটে পুরলাম। বীণাকে চমকে দেওয়া যাবে এই কাঠগোলাপ দিয়ে।
টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় যেয়ে দেখি ওই ভাই আগে থেকেই বসে আছে। আমার ইউনিভার্সিটিরই সিনিয়র। পড়ালেখা শেষ করে উদ্দোক্তা হয়েছেন। তার বিজনেসে এ্যাসিস্ট করতে আমাকে নিয়োগ দিতে চান। কাজ হলো কন্টেন্ট আর গ্রাফিক্সের। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কিছু কাজ করে দেখালাম, তার পছন্দ হলো। পার্টটাইম চাকরিটা কনফার্ম হলো। বেতন আট হাজার টাকা। ফোন এবং ইন্টারনেট খরচ বাবদ আরো এক হাজার টাকা।
বীণাকে খবরটা দিলাম। সে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। আপার এবং আমাদের বাসার পুরো ব্যাপারটা সে জানে এবং এই চাকরির পরামর্শ সেই আমাকে দিয়েছে। চাকরির খোঁজটাও তারই দেওয়া।
বীণা আজ জরজেটের একটা শাড়ি পরেছে। সাদা শাড়ির উপর হলুদ আর নীল রঙের লতাপাতা। কালো ব্লাউজের উপর কী যে সুন্দর মানিয়েছে শাড়িটায় তাকে! মনে হচ্ছে অষ্টাদশী কোনো একটা পরী পথ ভুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় চলে এসেছে।
তার কানে লাল কাঠগোলাপ গুঁজে দিয়ে বললাম কাছে আসো একটু থুথু দিয়ে দেই যাতে নজর না লাগে। সে বললো কার নজর লাগবে? আমি বললাম, বাইরের কারো দরকার নেই, আরেকটু তাকালে আমার নজরই লেগে যাবে। যে সুন্দর লাগছে তোমাকে! এই কথায় সে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এতো চমৎকার সেই হাসির শব্দ! বারবার মনে হয় শব্দটা রেকর্ড করে রাখতে পারলে ভালো হতো।
মেয়েটা আজ কাজল পরেছে চোখে। মনে হচ্ছে ডান চোখে যেনো মায়ার পদ্মা আর বাঁ চোখে প্রেমের যমুনা বইছে। চোখে চোখ রেখে বললাম,
“কাজল চোখের মেয়ে,
আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।”
বীণা বললো, তুমি লিখেছো কবিতাটা? আমি বললাম না, সাদাত হোসাইন নামের এক কবি লিখেছে। সে না লিখলে অবশ্যই আমি লিখতাম। বীণা আমার কাঁধে মাথা রেখে বললো, তুমি অনেকদিন হলো আমার জন্য কবিতা লেখো না। আমি চমকে উঠলাম, আসলেই তো তাই। অনেকদিন কোনো কবিতা লিখি না!
বক্সে করে নুডুলস রান্না করে নিয়ে এসেছে বেচারি। এই জিনিসকে শুধু নুডুলসও বলা যাচ্ছে না। বেহেশতি নুডুলস বা এই জাতীয় কিছু একটা বলতে পারলে হতো। এরমধ্যে মুরগির মাংস, ডিম, সবজি, গাজড়সহ আরো কী কী যেনো দেওয়া! মুখে দিলে স্বাদে-গন্ধে আর আরামে চোখ বুজে যায়। মেয়েটার এই এক স্বভাব, দেখা করতে আসলে কিছু না কিছু রেঁধে আনবেই আনবে।
খেয়েদেয়ে দুইজনে চারুকলার পুকুরপাড়ে বসলাম। বাসার পরিস্থিতি সব শুনে সে বললো, “প্রাইমারির চাকরিটা হলে সবাই মিলে গ্রামে চলে যাবো। চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম এই কাজটাও করা যাবে।বাগেরহাটে আমাদের যে জায়গা জমি আছে ওগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে মাছের প্রোজেক্ট করবো। উপরে মাচাং করে হাঁস – মুরগির ফার্ম হবে। নিচে থাকবে মাছ। প্রোজেক্টের চারপাশে থাকবে সবরকম শাক সবজির চাষ। প্রাথমিকভাবে দুইটা গরু পালা হবে। একটা গাই গরু আর একটা ষাড়। পর্যায়ক্রমে এর পরিধি বাড়বে।”
এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করবে বীণা আর বড়ো আপা । এতে করে আপা নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটা উপলক্ষ খুঁজে পাবে। এর পাশাপাশি সম্ভব হলে অনলাইন ভিত্তিক একটা বিজনেস দাঁড় করানো যায় বাগেরহাটের ট্রাডিশনাল কোনো পণ্যের। সেই বিজনেসটা চাইলে আপাকেও দিয়ে দেওয়া যায়। সবকিছু শিখিয়ে দিবে বীণা। কারণ অনলাইন ভিত্তিক বিজনেস বীণা অনেক আগে থেকেই করছে, এখনো করছে।এই লাইনে তার খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে।
শাক-সবজি , তরি-তরকারি, মাছ- মাংস – কিছুই বাহির থেকে কিনতে হবে না। বিল থেকে পাওয়া ভাগের ধানে বছরের চাল হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে সম্মিলিত প্রোচেষ্টায় খুব অল্পতেই অভাবকে ঝেটিয়ে বিদায় করা যাবে। আর অভাব দূর হলে পারিবারিক অশান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যাবে।
বীণা আর আমার সম্পর্কের কথা বাড়ির সবাই জানে। ও থাকে নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। ওর বাবা মা নেই, মামা মামির কাছে মানুষ হয়েছে, তাদেরও এ বিয়েতে আপত্তি নেই। আমার বাড়িতেও কারো আপত্তি নেই। চিন্তা করেছি যেদিন চাকরি পাবো, সেদিনই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ওকে বাসায় নিয়ে যাবো। হোস্টেল মোস্টেল বাদ।
আমি চোখ বন্ধ করে বীণার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। দেখছি আপা সারাদিন হাঁস – মুরগির ফার্মে ছুটাছুটি করছে। অনলাইন বিজনেস নিয়ে তার ব্যস্ততার সীমা নেই। আব্বা মা ইতির মেয়েকে নিয়ে সুখের সময় পার করছে। মার সাথে ইতির সম্পর্কটা আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
আমি নিশ্চিত, বীণা যদি আমার পাশে থাকে তাহলে ও যা যা বলেছে তা বাস্তবে রূপ নিবেই নিবে। ও হচ্ছে কচ্ছপ স্বভাবের মেয়ে। একবার যা বলে, তা করেই ছাড়ে। আর ওর বুদ্ধি খুব পরিস্কার। ওর উপর আমার শতভাগ আস্থা আছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম। মাগরিবের আজানে ভাবনায় ছেদ পড়লো। দেখি বীণা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আজানের জন্য সে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়েছিলো। এখনো আছে। তাকে বউ বউ লাগছে। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেই। অনেক কষ্টে ইচ্ছাটাকে সংবরন করলাম।
চারুকলা থেকে বের হয়ে ছবির হাট দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে হাটতে হাটতে কালী বাড়ির গেট দিয়ে বের হয়ে গেলাম কার্জনে। সেখান থেকে হেটে ডাকসুতে। রাতের খাবার শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই। অনেকদিন ডাকসুর কুড়ি টাকার ভাত তরকারি খাওয়া হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা লাইন দিয়ে টোকেন নিয়ে খাচ্ছিলো, আমরাও খেলাম।
কলাভবন হয়ে মল চত্ত্বর দিয়ে বের হয়ে হাটতে হাটতে ওর হোস্টেলে গেলাম পৌঁছে দিতে। এই সময়টাতে আমার খারাপ লাগে। ওকে রেখে আসতে ইচ্ছে করে না। হাত ছাড়তে মন চায় না। ইচ্ছে করে আলতো করে হাতটা ধরে হাটতে হাটতে কাটিয়ে দেই ছোট্ট একটা জীবন।
হোস্টেলের গেটের পাশে আজ পুরোপুরি ফাঁকা। গেট দিয়ে ঢোকার আগে ও পার্স থেকে কিছু টাকা বের করে আমার পকেটে গুঁজে দিলো। আপা আমাদের সংসারে আসার পর থেকে ও এই কাজটা করে। অনলাইন বিজনেস থেকে যা ইনকাম হয়,সেখান থেকে আমার জন্য আলাদা করে রাখে। এই টাকা নিতে আমার খুব সংকোচবোধ হয়। অনেকবার দিতে না করেছি, তবুও দেয়। সে বলে এটা নাকি আমার কাছে জমা রাখছে। বিয়ের পর একবারে নিবে।
ওকে রেখে রাস্তায় নেমে হাটা আরম্ভ করলাম। না গুনেও বলা যাচ্ছে পকেটে অনেকগুলো টাকা আছে। বাবুর জন্য চক বাজার থেকে কয়েকটা খেলনা নেওয়া যায়। আপার জন্য কিছু একটা নেওয়া যায়। উপহার পেলে তার মন ভালো হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম এক লিটারের একটা ভ্যানিলা আইসক্রিম নিয়ে যাবো। এটা ওর অনেক পছন্দের।
আকাশে কেমন মেঘ করেছে। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। গুমোট একটা ভ্যাপসা গরম শুরু হয়েছে। আজিমপুর মোড় পর্যন্ত আসতেই বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করা একজন হকারের কাছ থেকে একটা পলিথিন নিয়ে তাতে মোবাইল আর মানিব্যাগ ঢুকিয়ে পকেটে রেখে আবার হাটা শুরু করলাম।
চিন্তা করলাম বাসায় যেয়ে আপাকে বাবুর খেলনা আর আইসক্রিমটা দিয়ে প্রথমে পার্ট টাইম চাকরির খবরটা দিবো। তারপর বীণার সব প্লান খুলে বলবো। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবো; আপা, তোকে যে আমি ঠিক কতোটা ভালোবাসি তা তুই কোনদিনও বুঝতে পারবি না। আর অল্প কয়টা দিন সময় দে, তোর সব কষ্ট দূর করে দিবো। আবার আমরা সুখের পৃথিবীতে ফিরে যাবো। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এলাম।
রাত বাজে সাড়ে বারোটা। এতো রাতে আমাদের বাসায় কখনো আলো জ্বলে না। বিশেষ করে বাইরের লাইটটা তো না-ই। বিদ্যুতের যা দাম!
আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম গেটের ভেতরে অনেক মানুষ। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমার ছোট ভাইটা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো; ভাইয়া, বড়োপা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। হঠাৎ করে আমার পার নিচ থেকে যেনো সব মাটি সরে গেলো। আকাশটা যেনো ভেঙে আমার ঠিক মাথার উপর পড়লো। হুট করেই যেনো নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেলো।
খেলনা আর আইসক্রিমের ব্যাগ ফেলে আমি ঘরে ঢুকলাম। মেঝেতে আপা আর ওর মেয়েকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পা থেকে মাথা একটা বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা। আমি মাথা থেকে চাদরটা সরালাম।
মনে হলো ও আমাকে বলছে; বাবু, এতো সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছিলো না আমার। কিন্তু কী করবো বল, পৃথিবীটাই আমার জন্য অনেক বড়ো নরক হয়ে গিয়েছিলো। তারপরও আর কটা দিন একটু হাসি আনন্দে তোদের সাথে কাটানোর ইচ্ছে ছিলো, আর কেউ না হোক, তুই কেনো আমার বুকের কষ্টগুলো তোর বুকে নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলি না? কেনো পারলি না ভাই আমার?
মুখের উপর চাদরটা টেনে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। আবারো বৃষ্টি নেমেছে। গেট দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না।
কিছুক্ষণ হাটার পর মনে হলো আমি একা হাটছি না। আমার ডান পাশে বীণা আর বাঁ পাশে আপা হাটছে। বারবার আপার হাত ছেড়ে ওর মেয়েটা সামনে চলে যাচ্ছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির বদলে সাদা তুলোর মতো বরফের ফুল ঝরছে। ও ছুটাছুটি করে সেই ফুল কুড়াচ্ছে। বীণা বললো, চলো বাড়ি ফিরে যাই হাঁস-মুরগির ফার্মের দরজা দিতে হবে, গোয়ালে আলো জ্বেলে গরুর মশারি খাটাতে হবে। সন্ধ্যা মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, আজ আমি আর কোথাও যাবো না।
নীল ফানুস
Torikul Islam
১২/ ০৮/ ২২
শ্রাবণধারা ৩৭৫, জহুরুল হক হল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।