#বিচ্ছেদ পর্ব ৮
অফিসে বসে কাজ করছিল আশিক।
মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ রিকোয়েস্ট আসলো। ওপেন করতেই আশিকের দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় !
‘রায়না আশিক’ তাকে টেক্স করেছে।
এক লাইনের ছোট্ট মেসেজ।
Baba, salam.
আশিক বার বার পড়লো মেসেজটা।
কিছুতেই সাধ মিটছে না।
দুই শব্দের লেখা মেসেজ। তবুও কতো মিষ্টি করে লেখা। রায়না আশিক তার মেয়ের নাম ?
রিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ হলো মনে মনে।
রিয়া তার মেয়ের নামের সঙ্গে তার নামকে
অস্বীকার করেনি। আশিকের মনে হলো, এতো সুন্দর মেসেজ তাকে এই জীবনে কেউ লেখেনি।
রিয়া সম্ভবত; রায়নার নামে এই আইডি খুলে দিয়েছে। যাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
আশিক মেসেজের উত্তর লিখলো,
Love you ma.
মেয়েটা কি তার মেসেজের উত্তর এখনই লিখবে ? কিভাবে লিখবে ?
এখন তো বাংলাদেশে রাত।
তার মেয়েটা নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে !
আশিক অপেক্ষা করতে লাগলো।
আশিক মেসেজ পেলো রাতে যখন বাংলাদেশে
দিনের শুরু।
‘বাবা,আমি স্কুলে য়াচ্ছি।
ফিরে এসে টেক্স করবো।’
আহা.. এতো শান্তি কেনো লাগে মেয়ের টেক্স পেলে ! আশিক কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
সে ইভাকে মেসেঞ্জারে টেক্স করলো।জানালো রায়নাকে ফিরে পাওয়ার কথা।তার অনুশোচনার কথা।
রায়নার আইডি পাঠালো ইভাকে।
যোগাযোগ করতে বললো।
তার জীবনের অবাঞ্চিত দিনগুলোর কথা জানালো। বার বার সে ভুল করেছে। নিজের মেয়ে,মা, ভাই বোনকে উপেক্ষা করেছিল যে শান্তির আশায়, তা সে পায়নি।ছোট বোনের কাছে অকপটে সব কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলো,
— তোরা আমাকে ক্ষমা করিস।
ইভা বললো,
—আমরা তোমাকে খুব ভালবাসি, ভাইয়া। তুমি ভুল করছিলে। আমরা কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু অপেক্ষা করেছি, একদিন তুমি তোমার মেয়ের কাছে ফিরবে নিশ্চয়। আমি খুব খুশী তুমি ফিরেছো।
আনন্দে ইভা কাঁদতে লাগলো।
আশিকের মেইলের জবাব পাঠিয়েই রিয়া রায়নার নামে একটা আইডি খুলে দিল।
কারণ রায়নার সঙ্গে আশিকের যোগাযোগটা সরাসরিই হোক। যদিও রিয়াই একাউন্টটা টেককেয়ার করবে। রিয়া সরাসরি আশিকের সাথে সংযুক্ত হতে চায়নি।
রায়না তার বাবাকে প্রথম মেসেজ পাঠিয়ে খুব একসাইটেড ছিল। আজ সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মেসেজ চেক করছিল।
তার বাবা তাকে ‘Love you ma’ লিখেছে।
রায়নার ঠোঁঠের কোনায় মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো।
রিয়া রেডী হতে হতে রায়নাকে লক্ষ করছিল।রায়না তার বাবাকে ছোট্ট একটা টেক্স পাঠিয়ে মায়ের সঙ্গে স্কুলে রওনা হলো।
রিয়া খেয়াল করলো রায়নাকে বেশ খুশী খুশী লাগছে। রিয়া জানতে চাইলো, কি লিখলে বাবাকে ?
স্কুল থেকে ফিরে এসে বাবার সঙ্গে কথা বলবো। সেটাই লিখে জানিয়েছি।
আশিক তার মেয়েকে লিখলো,
তুমি কেমন আছো মা ? আমি কি তোমাকে ফোন করতে পারি ?
রায়না তার উত্তরে লিখলো,নিশ্চয় বাবা।
আশিক ফোন করে তার মেয়ের কন্ঠ শুনে আপ্লুত হয়ে পড়লো। নিজেকে সংযত রখতে পারছেনা।
দু’চোখ ভিজে যাচ্ছে।
এই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে সে দূরে ঠেলে দিয়েছিল ? রিয়ার উপরে রাগ করে ?
কতো সুন্দর করে ‘বাবা সালাম’ বললো।
বললো,আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ?
আশিক বললো,আমাকে আপনি করে বলছো কেনো, মা ? তুমি করে বলো।
রায়না জানালো,আমি তো শুধু মাকে তুমি করে বলি। আর কাউকে না।
আশিকের খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ নিজের মেয়ের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে অনুভব করলো মেয়ের জীবনে বাবা হিসেবে তার অবস্থান কোথায়।
নরম গলায় বললো, মা আমি তো তোমার বাবা। আমাকেও ‘তুমি’ করে বলো। আমার খুব ভাল লাগবে।
রায়না হাসলো মিষ্টি করে।
বললো, আচ্ছা বলবো।
কিন্তু পরক্ষনেই বললো,আপনি ডিনার করেছেন ? আমেরিকায় এখন রাত ?
আশিকের মন খারাপ হলো কিন্তু তবুও গাঢ় স্বরে বললো,ডিনার করেছি মা।
পরদিন আশিক আবার ফোন করে মেয়ের সঙ্গে কথা বললো। রায়নার স্কুল,পড়াশোনা,বন্ধুদের কথা জানতে চাইলো।রায়না টুক টুক করে বেশ খানিকক্ষণ কথা বললো। স্কুল,পড়াশোনা বন্ধুদের কথা বললো।
মেয়েটা খুব মেধাবী হয়েছে।
আশিকের খুব গর্ব হলো মনে মনে।
রায়না আমেরিকা সম্পর্কে জানতে চাইছিল।তার নাকি ডিজনি-ওয়ার্ল্ড দেখার খুব শখ।
আশিক বললো,যখন তুমি আমেরিকায় আসবে তখন আমি তোমাকে ডিজনি-ওয়ার্ল্ডে ঘুরতে নিয়ে যাবো মা।
শুনে খুব খুশী হয়েছিল রায়না।
আশিক নিজেকে ধিক্কার দিল মনে মনে।
সে কিভাবে এই পুতুলের মতো মেয়েটার সঙ্গে এতো অন্যায় করেছে ?
মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো, নেয়নি।
কারণ, রিয়া তার মেয়ের মনে আশিক সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনা দেয়নি। সে নাকি চেষ্টা করেছে সবসময় রায়নার সামনে তার বাবার সম্পর্কে ভালো ধারনা দিতে।এটা হয়তো তারই ফল যে রায়না তাকে এতো ভালোভাবে গ্রহন করেছে।
তবে রায়না একটু চুপচাপ। কম কথা বলে।
আশিকের সঙ্গে সময় লাগছে সহজ হতে।
লাগবেই তো !
আশিক তো তার কাছে পুরোই অচেনা একজন মানুষ।
একজন অচেনা মানুষকে এতো সহজে বাবার জায়গাটা মনে হয় দেয়া যায়না।
অথবা ছোট্ট মেয়েটা তো জানেই না বাবা মানে কি ?
বাবা কেমন হয় ? তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় ? কেমন করে আহ্লাদ করতে হয় ?
আশিক বিষর্ন্ন হয়ে উঠলো। কি করেছে সে তার জীবনটাকে।একেই কি বলে জীবন নিয়ে খেলা !
আশিক তার জীবন নিয়ে খেলেছে।
যখন মা রিয়াকে ফিরিয়ে নিতে বলেছিল তখন মায়ের কথায় শোনা উচিৎ ছিল।
তাহলে হয়তো আজ নিজের সন্তানের কাছে তাকে বাবা হয়ে ওঠার প্রমাণ দিতে হতো না।
নিজের সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে এতো ভাল লাগে ! আশিকও তো জানতো না নিজের রক্ত..নিজের সন্তানকে কাছে পাওয়ার আনন্দ এতটা।
যদিও এখনো মেয়েকে বুকে টেনে নেয়ার সুযোগ পায়নি। আশিক ছটফট করে উঠলো রায়নাকে বুকের ভেতরে নেয়ার জন্য !
নিজের জেদ, রাগ এগুলোকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েেছে সে।একবারও এই শিশুটার কথা গভীর ভাবে ভাবেনি।
ভাবলে রায়না আজ এতো না পাওয়া নিয়ে বড় হতো না। সব তার দোষ।
প্রথম যখন ডিভোর্স হলেছিল,তখন ওরা দু’জনই দায়ী ছিল। কিন্তু সাত বছর আগে তো মায়ের উদ্যোগে রিয়া এগিয়ে এসেছিল।
সে তখন রিয়াকে ক্ষমা করতে পারেনি এবং কমিটেড ছিল নীলার কাছে।
মা- বাবা যে সবসময় সন্তানের ভালোটা বুঝতে পারে, আজ আশিক মর্মে মর্মে তা অনুভআ করতে পারছে। মা বেঁচে থাকলে আশিক গ্লানিমুক্ত হতে পারতো। মায়ের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে পারতো।
মাকে খুব কষ্ট দিয়েছে আশিক।
আজ হয়তো সেজন্যেই এত কষ্ট পাচ্ছে আশিক।
সেদিন ইভার কাছে শুনেছে, রায়না স্কুলে হেঁটে যায়। আগে বেশ খানিকটা দূর থেকেই আসতে হতো। বৃষ্টির দিনে খুব কষ্ট হতো।বৃষ্টির মধ্য কাফরুলের রাস্তার জল-কাঁদায় একাকার হয়ে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া-আসা করতো রায়না। এখন ক্যাম্পাসে বাসা হওয়ায় দূরত্ব কমেছে।
তবে রায়না গাড়ীতে ঘুরতে খুব ভালবাসে। যদিও,বেড়ানো বা যেকোন প্রয়োজনে কোথাও যেতে হলে ওদেরকে বাস বা ট্যাক্সি করেই যেতে হয় সব জায়গায়।
এটা জানার পর সারারাত আশিক কেঁদেছে।
তার নিজের মেয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় আর এখানে তার দামী গাড়ীতে করে নীলা তার ছেলেকে নিয়ে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছে।
এটা মনে হলেই যন্ত্রনায় ছটফট করছে আশিক।
কেন এমন করেছে আশিক ?
কেন হুটহাট জীবনের সিদ্ধান্ত গুলো নিয়েছিল সে ?
কেন আরো ধর্য্য ধরেনি ?
অপেক্ষা করেনি ?
কেন দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে পারেনি।
জীবনটাকে জটিল করে তুলেছে সে।
যার মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতি মূহুর্ত্যে।
আশিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো,সে দেশে যাবে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে।অফিসে ছুটির জন্য আবেদন করলো জরুরী কারণ দেখিয়ে।
যেহেতু দীর্ঘদিন দেশে যায়না আশিক তাই ছুটি পেয়েও গেল এক মাসের জন্য।
আশিক অস্থিরবোধ করছে।
কবে মেয়েকে দেখতে পাবে!
আগে টিকিটের ব্যবস্হা করতে হবে।আজই টিকিট বুকিং দিতে হবে। আশিক মনে মনে ভাবলো টিকিট কনফার্ম হলে রায়নাকে জানবে।
খুব খুশী হবে রায়না ? নিশ্চয় খুশী হবে।
আশিক মনে মনে ভেবে রেখেছে,দেশে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরবে-বেড়াবে।
ঢাকায় গিয়ে মেয়েকে প্রতিদিন গাড়ীতে করে
ঘুরবে। একটুও হাঁটতে দেবেনা।
রাতেই টিকিট কনফার্ম করে ফেললো আশিক। রায়নাকে মেসেজ করলো,
মা আমি আসছি। তোমার কাছে।
রায়না উত্তর পাঠালো, Is it true baba ?
are you coming ??
yes ma. Im coming.
love u ma.
পরের দিন রায়নাকে ফোন করলো আশিক।
রায়না উৎফুল্ল গলায় বললো,আপনি কবে আসবেন ? আমি খুব হ্যাপি। আমার সব বন্ধুকে বলেছি,আমার বাবা আসবে আমেরিকা থেকে।
আশিক হাসলো, তাই নাকি ?
আচ্ছা মা, আমি তোমার জন্য কি কি নিয়ে আসবো US থেকে আসার সময় ?
রায়না মিষ্টি করে হাসলো।
মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর।
আশিকের মন ভরে গেল।
—-একটা রিস্টওয়াচ..মা কিনে দেয়না, রায়না বললো।
আশিক হেসে বললো, আমি তোমার জন্য রিস্টওয়াচ নিয়ে আসবো মা। আর কিছু আনতে হবেনা ?
তখন রায়না বললো, আমি কি একটা জিনিস চাইতে পারি ?
আশিকের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো রায়নার বলার ভঙ্গিতে।
কি দূর্ভাগ্য ! মেয়ে তার বাবার কাছে আবদার করছে অথচ সৌজন্যতা বজায় রেখে।
আসলে মেয়েটা তো মা ছাড়া কোনদিন কারো কাছে কিছু যে চায়নি। চাওয়া যায় এটায় হয়তো জানেনা।
আশিক গাঢ় স্বরে বললো,
— মা তুমি সবচেয়ে বেশী পারো। প্লিজ বলো..তোমার কি লাগবে ?
রায়না আনন্দিত গলায় বললো,
— বাবা আমার খুব প্লে-স্টেশন পছন্দ। মাকেও বলেছিলাম।
আশিক রায়নাকে বললো, Its alright ma. Your mom did a great job for you what I supposed to do. I’m greatful to her. I’ll buy everything for you.
রায়না খুশী হয়ে উঠলো, You are great baba.my dad is the best dad in the world. love you baba.
আশিক রাতে ঘুমোতে পারলো না।
শিশুরা কত নিষ্পাপ। কত উদার।কত অল্পতেই ওরা ভালোবাসতে পারে।একটা খুব পছন্দের খেলনা কিনে দিতে চেয়েছে আশিক তাতেই রায়না তাকে বেস্ট ড্যাড বললো !
আহা.. যদি রায়না তার এই ছোট্ট জীবনের শুরু থেকেই তার বাবাকে পাশে পেতো !
আশিক মনে মনে ভাবলো, আর কষ্ট পেতে দেবে না সে তার মেয়েকে। বুক দিয়ে আগলে রাখবে।
রিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করলো আবারও।
আশিক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,একদিন তার মেয়ের বেস্ট ড্যাড সে হবেই।
(চলবে
বিচ্ছেদ পর্ব ১-১০
https://kobitor.com/category/uponas/bissed/page/2/
.