- পারিবারিক বিয়ের গল্প, অচেনা (ধারাবাহিক)
- নতুন বিয়ের গল্প।
- অনেক রোমান্টিক গল্প।
- কাল্পনিক রোমান্টিক গল্প।
- বেস্ট রোমান্টিক গল্প।
১.পারিবারিক বিয়ের গল্প
ধারাবাহিক
অচেনা পর্ব ১
সাতদিন পর আমার বিয়ে। আমার মনটা খুবই খারাপ। বাড়ি ছেড়ে যাবো, অন্যের বাড়িতে যেতে হবে এসব কারণে না। আমার মন খারাপ অন্য কারণে। খুবই লজ্জাজনক কারণ। কাউকে বলা সম্ভব না। তবে মন খারাপ করার জন্য কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন। আমাদের বাড়িতে তা সম্ভব না।
বাড়িতে আমার বাবারা তিন ভাই থাকে। আমরা ছয় ভাই বোন আছি। সাথে আমাদের মা, চাচী মিলিয়ে সর্বমোট বারোজন সদস্য। এছাড়া দুইটা কাজের মেয়ে যাওয়া আসার মধ্যে থাকে। কেউই বেশিদিন টিকে না। কিন্তু গত ছাব্বিশ বছর ধরে আমার মা ও দুই চাচী রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য্য নিয়ে এই আশায় আছে যে একবার একসাথে দুইটা কাজের মেয়েকে দুই মাস রাখবে। শিখিয়ে পড়িয়ে নিবে। ব্যাস এরপর উনারা পায়ের উপর পা তুলে খাবে। মেজচাচী নাকি প্রতিদিন তখন বেড টি খাবে। সাথে এক স্লাইস পাউরুটি মাখন। কিন্তু সেইদিন এখনো আসেনি।
এরকম ভরা বাড়িতে দু:খ করার জায়গা পাওয়া মুশকিল। এছাড়া বিয়ে যতই ঘনিয়ে আসছে আমার দুই চাচীর উত্তেজনায় টেকা যাচ্ছে না। আমরা খুবই মধ্যবিত্ত ধরনের পরিবার। “দিন আনি দিন খাই” টাইপ অবস্থা। অতএব আমার বিয়েতে এখনকার মতো আয়োজন বাদ্য বাজনা কিছুই হবে না। পরের শুক্রবারে ছেলে পক্ষ আসবে। বিয়ে পড়াবে। তারপর আমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই সময়টাকে স্বরণীয় করতে আমার দুই চাচী জানপ্রাণ দিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের বাড়িটা খুব পুরানো দিনের ধাঁচের। একতলা বাড়ি। টিউব লাইট কোন ঘরেই নেই। সন্ধ্যার পর বালবের ধিকিধিকি আলো জ্বলে সব ঘরে। এই আলো আমাদের দুর্বল আর্থিক অবস্থাকে প্রকট করে তোলে।ঘরগুলো বেশ বড় আকারের। চারটি ঘর আছে। এছাড়া বারান্দা বসার ঘর মিলিয়ে আমরা থাকি। বিয়ে উপলক্ষ্যে আত্মীয় স্বজন আসবে। তখনও থাকার তেমন সমস্যা হবে না। মিলেমিশে থাকার মতো গুণ আমাদের সবারই আছে।
এরকম বাড়ির মেয়েদের বিয়ের বাজারে বেশ কদর থাকে। আমার হয়েছে সেই অবস্থা। নিউমার্কেটে ফুচকা খেতে গিয়ে ছেলের মা আমাকে দেখেছে। আমরা একই দোকানে ফুচকা খাচ্ছিলাম। উনি আর আমি দুইজনেই মিষ্টি টক চেয়েছিলাম। কিন্তু ফুচকাওয়ালা আমার হবু শাশুড়িকে দিয়েছিলো ঝাল টক। এরপর আমি লক্ষী মেয়ের মতো উনাকে আমার মিষ্টি টক দিয়েছি। এই হলো আমার বিয়ের পেছনের কাহিনী। এই ঘটনার কিছুই আমার মনে নেই। কিন্তু সেই মহিলা কিভাবে কিভাবে জানি আমার বাসার ঠিকানা ও জীবন বৃত্তান্ত বের করেছে। এরপর একদিন যথাসময়ে উনার প্রবাসী ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
তারপর থেকেই আমার মনটা খারাপ। আমি মুখ কিছুটা ভোঁতা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বিষয়ে কেউ কিছু মনে করছে না। বিয়ের কণ্যার মন খারাপ থাকাই স্বাভাবিক। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ালেই সবাই অবাক হতো বরঞ্চ। আমার মন খারাপের বিষয়টা একটু অদ্ভুত। আমার জীবনে খুব প্রেম করার শখ ছিলো। প্রেম মানে যেনতেন প্রেম না। গভীর প্রেম। আমার জন্য কেউ গভীর রাতে কিংবা কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাকে অন্য কোন ছেলের সাথে দেখলে হিংসায় কি করবে ভেবে পাবে না আবার ভদ্রতা করে কিছু করতেও পারবে না। যখন আমার জ্বর হয় তখন বারবার মনে হয় কেউ যদি অস্থির হয়ে ফোন করতো বা জোর করে টেস্ট করতে পাঠাতো। বুদ্ধি করে সেইসব টেস্টের টাকা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতো! কিন্তু সেইসব কিছুই আমার জীবনে হলো না!! এখন আমার কানাডা প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে যার নাম আমিনুল ইসলাম। তার ফেসবুক নেই, দশ বছর বয়সের পর বাসায় কোন ছবি পাওয়া যাচ্ছে না অতএব চেহারা দেখার উপায় নেই। কোন কারণে সে একবার কথা বলারও চেষ্টা করেনি। তার মায়ের পছন্দই নাকি তার পছন্দ। সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা ব্যক্তির সাথে আমার বিয়ে হতে চলেছে।
(চলবে)
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক একসাথে
https://kobitor.com/category/uponnaslink/ochena/
২.নতুন বিয়ের গল্প
বাসর রাতের টেনশন এবং তারপর
——————————————
এখন রাত প্রায় একটা।ঝুমুর বাসর ঘরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।অথচ ফরহাদ সাহেবের কোন খবর নেই।বাসর ঘরের এক কোনে বসে রহিমা খালা পান চিবুচ্ছেন আর কেরোসিনের স্টোভে চা বানাচ্ছেন।উনি এই বাসায় অনেক বছর যাবত কাজ করেন।উনার সবচেয়ে মজার বিষয় হল, উনি কথা বলার সময় সাধু-চলিত-আঞ্চলিক সব মিলিয়ে কথা বলেন।ঝুমুর অবাক হয়ে রহিমা খালার কাজ দেখছে। সে বুঝতে পারছে না তার বাসর রাতে এসব কি হচ্ছে। ঝুমুর এ বাড়িতে আসার পরপরই তার শাশুড়ি তাকে বলেছিলেন,
-“মা আমার ছেলেটা একটু বেশি সহজ সরল।তুমি একটু ওকে তোমার মতো করে গড়ে নিও।ও খুবই ভালো ছেলে।”
ঝুমুর মাথার ঘোমটা টা নামিয়ে ফেলল। এইভাবে দীর্ঘ সময় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতে থাকতে তার ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। ঘোমটা নামিয়ে ঝুমুর জিজ্ঞেস করল,
-“খালা,আপনি এখানে কেন ?”
-“আমি চা বানাইতাছি।বাবাজী কইছে আজ সারারাত এইটা আমার ডিউটি।”
-“মানে কি ! আপনি কি সারারাত এখানেই থাকবেন !”
-“জি,আমি সারারাত এইহানে থাহুম।আপনার কোন সমেস্যা আছে ?”
-“অবশ্যই সমস্যা আছে। এটা আমার বাসর ঘর। এখানে আপনি থাকেন কিভাবে ?”
-“মা জননী, আমি রাইতে দুই হাত দুরের জিনিসও ঠিকমতো দেহি না।তাই আমি এইহানে থাকলেও আপনাগো কোন সমস্যা হইতো না।”
বলেই পিচ করে পানের পিক ঘরের মধ্যে ফেলে মুখ চেপে হাসতে লাগলেন।
-“রহিমা খালা আপনি এটা কি করলেন ! আপনি ঘরের মধ্যে নোংরা পানের পিক ফেললেন কেন ? “
-“এটা কি কইলেন মা জননী ! পিক নোংরা হইব কেন ? এটা তো আমার মুখেই ছিল।নোংরা হইলে কি এই জিনিস আমি রহিমা খালা মুখে রাখতাম ? রাখতাম না।আমি বড় বংশের মাইয়া।”
-“বুঝলাম আপনি বড় বংশের মেয়ে,কিন্তু তাই বলে ঘরের মধ্যে পানের পিক ফেলবেন !”
-“জি,বড় বংশের মাইয়ারা ঘরের মধ্যেই পানের পিক ফেলায়।আর একটা কথা আম্মা আপনে হইলেন নতুন বউ, চুপচাপ থাকবেন।নতুন বউ এর বেশি কথা বলাটা ঠিক না।”
-“ঠিক আছে কম কথা বলব।তা আপনি কি জানেন ফরহাদ এখন কোথায় ?”
-“নাউজুবিল্লা।মা জননী এইটা কি করলেন ? সোয়ামীরে নাম ধইরা ডাকলেন।তওবা করেন। স্বামীরে ডাকতে হইবে শোদ্ধার সাথে।”
-“ঠিক আছে শ্রদ্ধার সাথেই ডাকব।তা আপনাদের জনাব মো: ফরহাদ সাহেব, উনি এখন কোথায় ?”
-“বাজান বাসায় নাই।একটা খুবই দরকারী জিনিস কিনতে ঔষুধের দোকানে গেছেন।”
-“আপনি জানেন সে কিনতে গেছে !”
-“জানবো না কেন ? সে তো আমার কাছেই প্রথম জিনিসটা খুজছিল। আমি বলছি নাই। তখন সে বলল, খালা এটা কি বললেন, আজ আমার বাসর রাত,আজ যদি এই জিনিস না থাকে তাহলে তো আমার বাসর রাতই নষ্ট হইয়া যাবে।”
ঝুমুরের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।মনে মনে বলল,এর তো আসলেই মাথায় সমস্যা আছে। না হলে বাসার কাজের বুয়ার সাথে কেউ কি ঐ জিনিসের কথা আলোচনা করে ?”
-“বউমার মুখ দেখি লজ্জায় একবারে লাল হয়ে গ্যাছে ।”
-“আপনি না বললেন আপনি দুরের জিনিস ভালো দেখেন না।তাহলে কিভাবে বুঝলেন আমি লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেছি ?”
-“মাঝে মাঝে দেহি আবার মাঝে মাঝে দেহিনা।সবই কপাল। আফসোস আল্লাহ কেন যে গরীব মাইনেষেরে এমন রোগ দেয় বুঝিনা।”
একটু পর ফরহাদ সাহেব বাসর ঘরে ঢুকলেন।তার পরনে শেরওয়ানি। তারমানে উনি শেরওয়ানি পরেই ঐ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কিনতে গিয়েছিলেন।ঝুমুরের লজ্জায় ও রাগে পুরো শরীর কাঁপতে লাগল।ঝুমুরের পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। সে ঘোমটার ভিতর থেকেই বলল,
-“তুমি এত রাতে বাইরে গিয়েছিলে কেন ?”
ফরহাদ সাহেব নতুন বউ এর মুখে তুমি সম্বোধন শুনে কিছুটা চমকে গেলেন।
-“একটা খুবই দরকারী জিনিস কিনতে গিয়েছিলাম।”
-“বুঝলাম,তা এই পোশাকে কেন গিয়েছিলে ?”
-“এই পোশাকে কি সমস্যা ? অবশ্য গরমের কারণে আমি একবার ঠিক করেছিলাম লুঙ্গি পরে যাবো।কিন্তু খালা বললেন, বিয়ের দিন বর লুঙ্গি পরে বাইরে যাবে এটা কেমন কথা।বিয়ের দিন বর যেখানেই যাবে শেরওয়ানি পরেই যাবে।ভেবে দেখলাম খালার কথায় যুক্তি আছে।উনি খুবই জ্ঞানি মহিলা।”
-“তাই বলে তুমি বিয়ের পোশাকে দোকানে ঐ জিনিস কিনতে যাবে ? তোমার কি একটুও লজ্জা লাগল না ? দোকানদার কি ভাবল ? নিশ্চয় দোকানদার হাসছিলো।”
-“তা অবশ্য হাসছিলো।দোকানদার বলল, ফরহাদ ভাই আপনে নতুন বউরে বাসর ঘরে একলা রেখে এই জিনিস কিনতে আসছেন ?
-“তা তোমার ঐ দরকারী জিনিস আগে কিনলে না কেন ?”
-“আমি তো জানতাম না ঐ জিনিস আজই লাগবে। পরে খালাই বুদ্ধি দিলো। বলল এ জিনিস না হলে বাসর রাত মাটি।”
ঝুমুর অবাক হয়ে ভাবল,এই বদমাশ ব্যাটা বলে কি ! এর তো চরিত্র মন সবই নোংরা।
-“তোমাকে তো আমি সহজ সরল ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমার চরিত্র তো পুরাই নষ্ট।তুমি খালার সাথে ঐ জিনিস নিয়ে আলোচনা করলে কিভাবে ?
-“ মানে কি ? ওরস্যালাইন নিয়ে আলোচনা করলে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় নাকি ? বিশ্বাস করেন এই তথ্য আমার জানা ছিল না। থাকলে অবশ্যই আলোচনা করতাম না।”
-“ওরস্যালাইন ! তুমি ওরস্যালাইন কিনতে গিয়েছিলে ?”
-“জি।হঠাৎ করেই পেট টা খারাপ হয়ে গেল ? কেন আপনি কি ভেবেছিলেন ?”
-“আমি ভেবেছিলাম…. না কিছু না।তা তোমার হঠাৎ পেট খারাপ হলো কেন ? উল্টোপাল্টা কি খেয়েছ ?”
-“আমি আসলে…..সরি উত্তর দেওয়ার সময় নাই । “
বলেই ফরহাদ সাহেব টয়লেটের দিকে দৌড় দিলেন। ঝুমুর বোকার মতো টয়লেটের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।মনে মনে বলল,ব্যাটা বলদ তুই আর পেট খারাপ করার সময় পাইলি না। বাসর রাতে কারও পেট খারাপ হয় !
ফরহাদ সাহেব টয়লেট থেকে বের হয়ে খালাকে বললেন,
-“খালা শোনেন, প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর চা দেবেন।কোন ফাঁকি ঝুঁকি চলবে না। আর খেয়াল করে পানের পিক ফেলবেন, যেন চায়ের মধ্যে না পরে।তা হলে নতুন বউ এর সামনে মান-সন্মান থাকবে না। “
-“বাজান আপনে নিশ্চিত থাকেন, নতুন বউরে পানের পিক দিতাম না।আমনে যান,বউ এর কাছে গিয়া বসেন।আমি চা আনতাছি।”
ঝুমুর ঘোমটার ভিতর থেকেই ধৈর্য নিয়ে দুই জনের কান্ড-কারখানা দেখছে। সে ঠিক করলো আরও কিছুক্ষণ এই পাগলামী দেখবে,তারপর যা করার করবে।কিন্তু কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।ফরহাদ সাহেব বিছানার এক কোনায় পা ঝুলায়ে বসলেন।রহিমা খালা দুই কাপ চা এনে বিছানার উপর রাখলেন। ফরহাদ সাহেব বললেন,
-“খালা আপনার চা কোথায় ? যান নিয়া আসেন।তিনজনে মিলে বিছানায় বসে আরাম করে চা খাব।”
খালা চা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন।তারপর পিরিচে চা ঢেলে আওয়াজ করে চা খাওয়া শুরু করলেন।ঝুমুর ঘোমটার আড়াল থেকে খেয়াল করল, ফরহাদ সাহেবও খালার মতো করেই চা খাচ্ছে।ঝুমুর প্রথমে ভেবেছিল খাবেনা।পরে কি মনে করে সেও ওদের মতো পিরিচে চা ঢেলে আওয়াজ করে চা খাওয়া শুরু করল।ফরহাদ সাহেব ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কি,মজা না ? আসলে খালার চায়ের কোনো তুলনা হয় না। খালার হাতের চা খেলে মনে হয় শ্রীমঙ্গলে চা বাগানে বসে চা খাচ্ছি।একেবারে অমৃত।”
প্রকৃতপক্ষে ঝুমুর চা খেয়ে কোন মজাই পায়নি। কারণ এটা কোন ভাবেই চায়ের পর্যায়ে পরে না। অথচ এই বলদ এ চায়ের প্রশংসায় গদগদ। ঝুমুরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল।এইভাবে চা খেয়ে বাসর রাত নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। ঝুমুর ঘোমটার আড়াল থেকে বলল,
-“খালা আপনাকে আর চা বানাতে হবে না। রাত অনেক হয়েছে,আপনি যেয়ে শুয়ে পরেন।দরকার পরলে আমি চা বানিয়ে নেব।”
-“আমনের বানান চা বাজান খাইতো না। বাজান আমার হাতের চা ছাড়া অন্যের চা খায় না।”
-“খালা কিন্তু সত্য বলেছেন।”
ফরহাদ সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন।
-“শোনো,আমিও খুব সুন্দর চা বানাই। আমার বানানো চা খেলে তোমার মনে হবে তুমি শ্রীমঙ্গল না,দার্জিলিং এ বসে চা খাচ্ছো।আর তাছাড়া তোমার এখন চা না,তোমার দরকার ওরস্যালাইন খাওয়া।”
খালার বাসর ঘর ছেড়ে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ঝুমুর বুঝল এভাবে হবে না।সে বিছানা থেকে নেমে খালাকে হাত ধরে এক প্রকার জোর করেই রুমের বাইরে রেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।তারপর এসে বিছানায় উঠে বসল।ঝুমুর এখনো ঘোমটা দিয়েই আছে। ঝুমুর বিছানায় গিয়ে বসতেই ফরহাদ সাহেব বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর দরজার দিকে দৌড় দিলেন।দরজার ছিটকিনি খুলতে যাবেন,তখন ঝুমুর শাসনের সুরে বলে উঠল,
-“তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ ? তুমি যদি এখন রুমের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা কর,আমি তোমার মাথা বাঁশ দিয়ে মেরে ফাটিয়ে দেব।”
-“আপনি নিশ্চয় ভয় দেখাচ্ছেন ? “
ফরহাদ সাহেব ভয় পেয়ে বলল।
-“না,আমি মোটেও ভয় দেখাচ্ছি না।আমি একশত ভাগ সিরিয়াস।”
-“কিন্তু আমাকে তো একটু দোকানে যেতেই হবে।একটা খুবই দরকারী জিনিস কিনতে ভুলে গেছি ? “
-“তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।তোমার ঐ দরকারী জিনিস আমার ব্যাগের মধ্যেই আছে।”
ফরহাদ সাহেব বুঝলেন না,ঝুমুর কোন জিনিসের কথা বলছে।আসলে ফরহাদ সাহেব কোনো কিছু কিনতে যাচ্ছিলেন না। উনি আসলে পালাতে চাচ্ছিলেন। উনি রুম থেকে বের হতে পারলে আজ আর এই বাসায় ফিরতেন না।ফরহাদ সাহেব বুঝতে পারছেন, এই মেয়ে ডেঞ্জারাস টাইপের মেয়ে।এর সাথে এক রুমে থাকা কোনভাবেই নিরাপদ নয়।উনি এখন বুঝতে পারছেন বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা তার ভুল ছিল।
-“এদিকে আস,আমার সামনে এসে বসো।”ঝুমুর গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
ফরহাদ সাহেব ঝুমুরের সামনে গিয়ে বসলেন।ঝুমুর মিষ্টি করে বলল,
-“এবার আমার ঘোমটা খোলো, তারপর আমার মুখ দেখে বল আমাকে কেমন লাগছে।আমার পক্ষে আর ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা সম্ভব না।”
ফরহাদ সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে ঝুমুরের ঘোমটা নামিয়ে দিলেন। ঝুমুর লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল।সে অপেক্ষা করছে আর ভাবছে তার স্বামী এখন তার চিবুক ধরে বলবে, তুমি এত সুন্দর কেন ? কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল ফরহাদ সাহেবের কোন সাড়া শব্দ নেই। বিরক্ত হয়ে ঝুমুর চোখ খুলে দেখল,ফরহাদ সাহেব জ্ঞান হারিয়ে বিছানার উপর কাত হয়ে পরে রয়েছেন। ঝুমুরের জানা মতে বাসর রাতে স্ত্রীর চেহারা দেখে জ্ঞান হারানোর নজির সম্ভবত আর নেই।ঝুমুর বুঝতে পারছে, এই বলদরে লাইনে আনতে তার যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে।ঝুমুর ফরহাদ সাহেবের চোখে-মুখে পানির ছিটে দিলেন।ফরহাদ সাহেব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন।তারপর উঠে বসলেন। ঝুমুর নরম সুরে বলল,
-“ তুমি কি টয়লেটে যেয়ে যেয়ে দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়েছ, নাকি আমার রূপ দেখে জ্ঞান হারিয়েছ ?”
-“জানিনা আফা।” ফরহাদ সাহেব দূর্বল কন্ঠে বললেন।
-“তুমি আমাকে আপা বলছো কেন ?”
-“জানিনা আফা।”
-“মানে কি ?”
-“আফা আমার বউ কই ?” ফরহাদ সাহেব রীতিমত ঘামছেন।
-“তোমার সমস্যা কি ? আমিই তোমার বউ।”
-“প্রশ্নই আসে না।আমার বউ যথেষ্ট কালো আর তার চোখ টেরা।”
ঝুমুর খিলখিল করে হেসে উঠল।তারপর বলল,
-“শোনো তুমি যার কথা বলছো সে হচ্ছে শেফালি, আমার খালাত বোন।তুমি যখন আমাদের বাসায় আমাকে দেখতে গিয়েছিলে, তখন ঐ রুমে আমি না গিয়ে ওকে পাঠিয়েছিলাম তোমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য।তবে তুমি যে ওকে দেখেও বিয়েতে রাজি হবে এটা আমি ভাবিনি। আচ্ছা বাদ দাও, এবার আমাকে ভালো করে দেখ, তারপর বল আমি সুন্দর কিনা।”
-“এক মিনিট, এখুনি আসছি।”
বলেই ফরহাদ সাহেব আবার টয়লেটের দিকে দৌড় দিলেন।ঝুমুর অলরেডি বুঝে গেছে তার বাসর রাত শেষ।একটু পর ফরহাদ সাহেব টয়লেট থেকে বের হয়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কালো একটি সানগ্লাস বের করে চোখে পরলেন।
-“তোমার সমস্যা কি ? তুমি রাতের বেলা সানগ্লাস পরলে কেন ? সানগ্লাস পরলে তুমি তো আমাকে আবারও কালোই দেখবে। সানগ্লাস খোলো।”
-“সানগ্লাস খোলা যাবে না।সমস্যা আছে।”
-“কি সমস্যা ?”
-“মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে আমার লজ্জা লাগে।”
-“মাইগড বলো কি ? বউ এর মুখের দিকে তাকাবে সেখানেও তোমার লজ্জা ! তুমি কি জানো বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রী আর কি কি করে ?”
-“ জানি,তাই তো আরও বেশি লজ্জা লাগছে।”
-“শোনো লজ্জা পেলে তো আর বাসর রাত হবে না।এখন সানগ্লাস টা খুলে ফেল, তারপর আমার চোখের দিকে তাকাও।আমি দেখতে চাই তুমি কতোটা রোমান্টিক।”
ফরহাদ সাহেব চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ঝুমুরের চোখের দিকে তাকালেন। মা আর রহিমা খালা ছাড়া জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের দিকে উনি সরাসরি তাকালেন।
-“বল আমাকে কেমন লাগছে ?”
ফরহাদ সাহেব বুঝতে পারছেন, ভয়ে উনার শরীর কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে।
-“আমি পানি খাবো।”
-“এখন পানি, চা, বিষ কিছুই তুমি পাবেনা। তুমি শুধু এখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।চোখের পলকও ফেলতে পারবে না। “
-“আমি টয়লেটে যাব।”
-“প্রয়োজনে তুমি বিছানায় টয়লেট করবে।তবুও আমার সামনে থেকে কোথাও যেতে পারবে না।ফাজিল ব্যাটা আমার বাসর রাত নষ্ট করার ধান্দায় আছে। আমি সারা জীবন এই বাসর রাত নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখেছি,আর এই বদ ব্যাটা এই রাতে পেট খারাপ করে বসে আছে। তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও।”
ফরহাদ সাহেব টয়লেটের বেগকে কন্ট্রোল করার জন্য পুরো শরীর খিঁচে বসে রইলেন। তারপর ভয়ে ভয়ে আবার ঝুমুরের চোখের দিকে তাকালেন।
-“জি, আপনার চোখের দিকে তাকিয়েছি।”
-“ভেরিগুড। বল কি দেখছো ?”
-“আপনার চোখ দেখছি।”
-“তা তো বুঝলাম চোখ দেখছো। কিন্তু চোখের মাঝে তুমি কি দেখছো ? একটু গভীর ভাবে আবেগ দিয়ে তাকালেই অনেক কিছুই দেখতে পাবে।”
ফরহাদ সাহেব আরেকটু কাছে ঝুঁকে এসে নিজের চোখ দুটি যথা সম্ভব বড় করে ঝুমুরের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
-“জি, আমি এখন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি।”
ঝুমুরের এখন খুশিতে উড়তে ইচ্ছে করছে।কারণ এই গাধাটার মধ্যে ও রোমান্টিকতা ঢোকাতে পেরেছে।
-“ভেরিগুড । বলো কি দেখতে পাচ্ছ ?”
-“চোখের পাতায় ছোট ছোট কালো কালো চুল দেখতে পাচ্ছি।”
-“কালো কালো চুল ছাড়া আর কি দেখছ ? “
-“সাদার মধ্যে দুইটা কালো কালো মনি দেখছি।”
-“ঐ ব্যাটা তুই শুধু চোখের মধ্যে কালো কালো চুল,আর কালো কালো মনি দেখিস, আর কিছু দেখিস না ? মাইগড আমি এটা কারে বিয়ে করলাম।এর মধ্যে তো কোন আবেগই নাই।”
ফরহাদ সাহেব বুঝতে পারছেন না,তার নতুন বউ কেন রাগ করছে।সে তো খারাপ কিছু বলেনি। যা দেখেছে তাই তো বলেছে।
-“আমি বুঝলাম না ।আপনি চেতলেন কেনো ? আমি কি মিথ্যা বলেছি ? “
ঝুমুর কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে থাকে । একটু পর একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“সবাই বলে আমার চোখ দুটো নাকি অপূর্ব সুন্দর। কতো স্বপ্ন ছিল, বাসর ঘরে আমার বর আমার চোখের গভীরে হারিয়ে যাবে। মুগ্ধ হয়ে আমার হাত ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো রোমান্টিক কবিতা বলবে।অথচ…..।”
-“মন খারাপ করছেন কেন ? আপনার হাত ধরে কবিতা বলতে হবে ? এটা কোন ব্যাপারই না।”
বলেই ফরহাদ সাহেব ঝুমুরের একটি হাত ধরে চোখের দিকে তাকালেন। চার চোখের সরাসরি মিলনে এক রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হলো বাসর ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে।ঝুমুর অতি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে স্বামীর কাছ থেকে মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো কোন কবিতা শুনবে বলে। হঠাৎ করেই ফরহাদ সাহেব উচ্চ স্বরে আবৃত্তি করে বললেন,
“ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গা, ঐখানেতে বাস করে কানা বগির ছা…..।”
এ পর্যন্ত বলেই থেমে যান ফরহাদ সাহেব। কারণ তিনি খেয়াল করলেন, তার স্ত্রী এখন আর রোমান্টিক ভাবে তাকিয়ে নেই।তার স্ত্রী এখন তার দিকে ভুরু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছেন।
-“আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন ?”
-“ঐ দেখা যায় তালগাছ তোর রোমান্টিক কবিতা ! তুই কি আমার সাথে ফাজলামি করোছ ? “
-“এটা আপনার পচ্ছন্দ হয়নি ? তাহলে অন্য একটি বলি।”
ফরহাদ সাহেব আবার ঝুমুরের হাত ধরে চোখের দিকে তাকালেন। তারপর প্রচন্ড আবেগে গলা কাঁপিয়ে সুর করে বলে উঠলেন,
“ঐখানে তোর দাদীর কবর, ডালিম গাছের তলে…।”
ঝুমুর ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত তুলে ফরহাদ সাহেবকে থামিয়ে দিলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন,
-“মাইগড, তোমার তো আসলেই মাথায় সমস্যা আছে।”
-“কি বলেন ! আমার মাথায় কোন সমস্যা নেই। একদম ফ্রেশ ।”
-“তুই বললেই তো আর হবে না।তোর মাথায় অবশ্যই সমস্যা আছে।সমস্যা না থাকলে পৃথিবীর কোন সুস্হ মানুষ বাসর রাতে স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগে ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ ‘ কবিতা পড়বে না।”
-“আসলে আমি শুধু এই দুটো কবিতাই মুখস্হ পারি।সরি ভুল হয়ে গেছে।আরও একটা মুখস্হ পারি,আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি..।আপনি যদি চান তাহলে শোনাতে পারি।”
-“খবরদার । তুই যদি বাসর রাতে এখন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার চেষ্টা করিস আমি তোরে স্রেফ খুন করে ফেলবো।”
-“বুঝলামনা আপনি আমাকে তুই তুই করে বলছেন কেন ?”
-“শোন তোর ভাগ্য ভালো,বাংলা ভাষায় তুই এর নিচে কিছু নাই, থাকলে তোরে তাই বলতাম। বদমাশ ব্যাটা আমার বাসর রাতটাই নষ্ট করে দিয়েছে।একে তো তোর পেট খারাপ, তারউপর তোর রুচি খারাপ।ঐ ব্যাটা দুনিয়ায় এতো দিন থাকতে এই দিনে তোর পেট খারাপ হয় কি করে ?”
ঝুমুর রেগে গিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বলল।
-“শোনেন আপনার অভিযোগ গুলি সঠিক। কিন্তু আমি তো আর ইচ্ছে করে পেট খারাপ করিনি। আর একটি কথা আমি কখনো মেয়েদের সাথে মিলামেশা করিনি, প্রেম করিনি তাই প্রেমের কবিতাও পড়া হয়নি।আর আজ পর্যন্ত কোন মেয়ের চোখের দিকে তাকাইনি। তাই জানিনা চোখের মাঝে কি দেখা যায়।আপনি কি আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন ?”
ফরহাদ সাহেবের কথাগুলো শুনে ঝুমুরের মনটা একটু নরম হলো।ভাবলো সত্যিই তো বেচারার কি দোষ।সে মিষ্টি করে বলল,
-“তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও।”
ফরহাদ সাহেব ঝুমুরের চোখের দিকে তাকালেন।চার চোখের আবার মিলন হলো।ঝুমুর বলল,
-“তুমি জানো আমি এখন তোমার চোখের মাঝে কি দেখছি ? আমি তোমার চোখের মাঝে শান্ত একটি নদী দেখছি।আর দেখছি,ঐ নদীর পাড় দিয়ে একটি ঘোড়া প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে।”
-“কি বললেন ! আমার চোখের মধ্যে ঘোড়া দৌড়ায় ! মাইগড, সমস্যা তো আমার মাথায় না, সমস্যা তো আপনার মাথায়।”
-“কি বললা ? আমার মাথায় সমস্যা ? তোমাকে আমি রোমান্টিক বানানোর চেষ্টা করছি আর তুমি আমাকে বলছো, আমি পাগল ? তুমি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে দুর হও।আমি এই রাতে তোমারে আর আমার সামনে দেখতে চাই না।”
ফরহাদ সাহেব মলিন মুখে উঠে দাঁড়ালেন । তারপর ধীর পদক্ষেপে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। ঝুমুর ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
ঝুমুরের এই এক সমস্যা।অল্পতেই রেগে যায়। রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা।ঝুমুর ঠিক করেছে আজ রাতে ও আর কিছুতেই দরজা খুলবে না। এই বলদরে দৌড়ের ওপর রাখতে হবে।না হলে একে মানুষ করা যাবে না।
ফরহাদ সাহেব রুম থেকে মলিন মুখে বের হয়ে আসলেও আসলে সে মনে মনে খুবই খুশি।নিজেকে এখন তার স্বাধীন মনে হচ্ছে। খেয়াল করে দেখল তার মায়ের রুম অন্ধকার। সম্ভবত মা এবং রহিমা খালা ঘুমুচ্ছেন।ফরহাদ সাহেবের এ মুহূর্তে বাসায় থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। উনি ঠিক করলেন আজ রাতটা পার্কে গিয়ে কাটিয়ে দেবেন।
প্রায় ভোর পাঁচটার দিকে ঝুমুরের ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসল। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই,
-“ঝুমুর আপনি কি ঘুমিয়ে পরেছেন ? সরি আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম। আসলে একটা ছোট্ট সমস্যা হয়ে গেছে।মাকে বলাটা ঠিক হবে না। আপনি কি একটু রমনা থানায় আসতে পারবেন ?”
-“মানে কি ! তুমি কোথায় ?
-“আমি এখন রমনা থানায় ।”
-“তুমি বাসা থেকে বের হলে কখন ? “
-“ভাবলাম আপনি যখন রুম থেকে বের করে দিয়েছেন, তাহলে পার্কে গিয়ে হাটাহাটি করি।রমনা পার্কে গিয়ে হাটছি, এমন সময় পেটটা মোচর দিলো। পার্কে টয়লেট পাবো কোথায়,একটা গাছের নিচে বসে পরলাম।হঠাৎ দেখি পুলিশ পার্কের ভিতর ঢুকছে। আমি পুলিশ দেখেই দিলাম দৌড় ।পুলিশও আমার সাথে দৌড় দিল।”
-“তুমি দৌড় দিলে কেন ?”
-“জানিনা কেন জানি পুলিশ দেখেই দৌড় দিতে ইচ্ছে হল।এখন পুলিশ বলছে আমি নাকি ছিনতাইকারি।এতো করে বললাম আজ আমি বিয়ে করেছি।আজ আমার বাসর রাত।এই দেখুন আমার পরনে শেরওয়ানি।কিন্তু ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করলো না।আমি পুলিশ কে বললাম, স্যার আপনারাই বলেন, এই পোশাকে কি কেউ ছিনতাই করে ? পুলিশ বলল,অবশ্যই করে।আমি বললাম,স্যার কে করে ? পুলিশ বলল, তুই করোস।”
-“ওরা কি তোমাকে মেরেছে ?”
-“এটা আপনি কি বললেন ! বাংলাদেশের পুলিশ ধরবে আর মারবে না, এটা কেমন কথা।”
-“ওরা কি তোমাকে বেশি মেরেছে ?” ঝুমুরের গলাটা ধরে এলো।ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।”
-“আপনি কি কাঁদছেন ? আমি তো বেশি ব্যাথা পাইনি।আপনি কাঁদছেন কেন ?”
-“কেন কাঁদছি ? সেটা তুমি বুঝবে না।কারণ ওটা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”
ফরহাদ সাহেব আসলেই বুঝতে পারছেন না, ঝুমুর কেন কাঁদছে।ওর মাও বিনা কারণে ওর জন্য প্রায় কাঁদে ।আসলে মেয়েরা জানি কেমন।একটু আগেই ওকে রুম থেকে বের করে দিল,অথচ পুলিশ ওকে মেরেছে একথা শুনেই এখন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।ফরহাদ সাহেব মনে মনে ভাবল,এই দুনিয়া আসলেই বড় বিচিত্র জায়গা।
বি: দ্রষ্টব্য :
ভাবছেন এমন বলদ স্বামী নিয়ে ঝুমুর কেমন আছে ? ওরা ভালো আছে, সুখে আছে।ওদের একটি মেয়ে হয়েছে।সেটা অবশ্য বড় খবর না। বড় খবর হলো মেয়ের বয়স মাত্র সাত মাস, এর মধ্যে ঝুমুর আবারও প্রেগন্যান্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্যের বিশেষ দ্রষ্টব্য:
স্বামী বোকা না চালাক সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো সে আপনাকে ভালোবাসে কিনা। আর এটাই জীবনে বেশি দরকার।
ইমদাদ বাবু
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৩.অনেক রোমান্টিক গল্প
বাসর রাত এবং সেফটিপিন
আমি সুঁই জিনিসটাকে ভীষণ ভয় পাই। তাই বলে বাসর রাতে আমাকে এতোটা হেনস্থা হতে হবে ভাবতেই পারিনি। সবার কপালে জুটে রোমান্টিক বাসর রাত আর আমার কপালে জুটলো কিনা সুঁইময় বাসর রাত!
সংসার, বিয়ে নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না। পড়াশোনা শেষ করে চাকুরিতে ঢুকে যা একটু আগ্রহ জন্মাচ্ছিলো বন্ধুবান্ধবদের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখে এই পথ আমি সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলছিলাম। খুব কাছের বন্ধু জশু (জামশেদ) আর তরুর বিয়ে দিলাম ধুমধাম করে। এত্তো আয়োজন আর বাহারি অনুষ্ঠান, শ পাঁচেক মেহমান, হলুদ, মেহেদি সন্ধ্যা, বিয়ে বৌভাত সবখানেই জৌলুস সাজ সজ্জা সব মিলিয়ে এলাহি কারবার। অথচ এক সপ্তাহ না যেতে দুজন দেখি দুই বাড়িতে। প্রথমে দুজনই মুখ খুলছিলো না, ঝেড়ে কাশছিলো না। দুজনেরই বিভিন্ন জায়গায় দাগ বিশেষ করে গাল, গলা, ঘাড়ে.. আমরা এসব দেখে মুখ টিপে হাসাহাসি করছিলাম পরে শুনি এসব ওসব কিছুর দাগ না। দুজন নাকি পুরোপুরি ডব্লিউ ডব্লিউ এফ খেলেছে। এগুলো মাইরের দাগ! সাতদিনেই সংসার সুতার উপর দাঁড়িয়ে। যখন তখন ছিড়ে যাবার অবস্থা!
আবার বছর খানেক আগে আতা (আতাউর) আর রেশমী বিয়ে করলো পালিয়ে। একবছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখি সবাইকে না জানিয়ে দুজন তালাক নিয়ে নিয়েছে। আতা তো একরকম পালিয়ে দেশ ছাড়লো। রেশমী এখনো দেশেই আছে তবে আমাদের কারো সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করছে না।
বন্ধুদের পাঁচ বছরের তুমুল প্রেম! রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরম সব ঋতুতেই জমজমাট প্রেম। বিয়ের দুই বছর না যেতেই প্রেম জানাল দরজা সব কিছু দিয়ে ফুরুত! কতো শত ডায়লগ, তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, তুমি না থাকলে আমি থেকে কি হবে? জন্ম আমাদের যেখানেই হোক মৃত্যু হবে একসাথে.. আশা-ভরসা, স্বপ্ন সব কিছুই ফিকে হয়ে গেলো খুব দ্রুতই।
এসব ঘটনা দেখে আমার বিয়ে ভীতি শুরু হয়েছিলো। তাই সব বন্ধুরা বিয়ে করলেও আমি সুচতুর ভাবে এই অধ্যায়টা পাশ কাটিয়েই যাচ্ছিলাম। বয়স ত্রিশ ছাড়ালেও ফেসবুকে সিঙ্গেল লিখেই চলছিলাম। সমস্যা বাঁধালো বড় আপা। ইংল্যান্ড থেকে এবার এসে এয়ারপোর্টে নামতে বাকী অথচ ঘোষণা দিলো, রুপুর বিয়ে এবার দিয়েই যাবো।
ওহ আমিতো আমার পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। আমার নাম রুপু (রুম্মন হক)। বয়স একত্রিশ ছুঁলো ক’দিন আগেই। পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানির একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে চাকুরি করছি। অফিস-বাসাতেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ আর কালেভদ্রে বন্ধুদের আড্ডায় উপস্থিত থাকি। সিগারেট বিড়ির অভ্যাস নাই, একটাই বদ অভ্যাস আর তা হলো সিনেমা। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই বসে যাই সিনেমা দেখতে। অবশ্য পছন্দের তালিকায় ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, তেলেগু, কোরিয়ান সবই আছে। অনেক সময়তো সামনে যেটা পাই সেটাই দেখি।
যাক যা বলছিলাম, আপু এসেই তোড়জোড় শুরু করে দিলো। অনলাইনে নাকি কয়েক ঘটকের সাথে যোগাযোগ করে এরই মধ্যে বেশ কজন মেয়েকে ভার্চ্যুয়ালী দেখেছেও! আমাকে তিন চারটা ফেসবুক প্রোফাইল লিংক দিয়ে বললো, এরমধ্যে থেকে একজন পছন্দ কর, নয়তো নাম্বারিং কর ১,২,৩,৪। আমি আমতা আমতা করছিলাম কিন্তু আপুর রাম ধমক খেয়ে চুপসে গেলাম। রাতে ঘরে বসে প্রোফাইল গুলো ঘাটাঘাটি করছিলাম। প্রত্যেকেই যথেষ্ট কোয়ালিফাইড এবং দেখতে শুনতেও খারাপ না। দুজনকে তো ডানা কাটা পরী লাগছিলো তবে আমি বেশি সুন্দর মেয়ে বিয়ে করবো না ঠিক করেছি। পরে সবাই তারদিকে তাকিয়ে থাকবে আর আমার পাহারা দিতে দিতে জীবন শেষ! একেকজনের ছবি, পোস্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা পোস্টে! মেয়েটার নাম হৃদিতা আমান। মাস্টার্স শেষ বর্ষে পড়ছে। দেখতে আহামরি সুন্দরী বলা যাবে না তবে হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর। তাকানোতেই কেমন দুষ্টু দুষ্টু ভাব। কিন্তু ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেয় বেশ ভাব নিয়ে। সেই পোস্টে যেমন লিখেছে, “জামা দামী নাকি সস্তা সেটা বড় বিষয় না। পরিধানে আরাম কিনা? দেখতে ভালো লাগছে কিনা? সেটাই বড় কথা। একই কথা জামাই এর বেলায়ও। ধনী গরীব হবার চাইতে পাশে দাঁড়াতে কমফোর্টেবল কিনা এটাই বড় কথা।” পোস্টটা দেখে কেন যেনো ভালোলাগা কাজ করলো। মনে হলো মেয়েটা বুদ্ধিমতী আবার সমঝদার হবে। তেমন কিছু আর না ভেবেই আপুকে ওর কথাই বললাম।
আপু খুশি হয়ে ধিন তা না করে নাচতে নাচতে বাসার সবাইকে জানিয়ে দিলো রুপুর মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়ে দেখা পর্ব সারলো ওই সপ্তাহেই আর দুই সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে। আমার সাথে সরাসরি দেখা হয়েছে পাঁচ মিনিটের মতো আর কথা হয়েছে গুনে গুনে তিনদিন। বোঝাবুঝির আগেই বিয়ে হয়ে গেলো।
বিয়ের দিন রাতে সাড়ে বারোটার পর আমাদের এক ঘরে ঢুকিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিলো। আমিও নির্লজ্জের মতো দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দিলাম। সারাদিনের ব্যস্ততায় ওর দিকে ঠিকমতো তাকানো হয়নি। শেরওয়ানি খুলে একটু হাল্কা লাগছে। ওর দিকে দৃষ্টি পরতেই অবাক হলাম। ওকে বউ সাজে একেবারেই অন্যরকম দেখাচ্ছে। পরিপাটি সাজ সাথে লাল শাড়ী, সোনালী ওড়না সব মিলিয়ে অপ্সরাও ফেইল। প্রথমে অস্বস্তি কাজ করছিলো একেবারেই অচেনা থেকে সবচেয়ে আপন হওয়াটা এতোটাই দ্রুত যে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি বলবো? কি করবো?
ওকে শাড়ি ছেড়ে ঘরের কাপড় পরতে বলে আমি ফ্রেশ হয়ে টিশার্ট ট্রাউজার পরে এলাম। হৃদিতা বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করলো ওড়না খুলতে। কোথায় যেনো গিট্টু লেগে গেছে। শেষে আর না পেরে আমাকে ডেকে বললো, এই যে শুনছেন, একটু এদিকে আসবেন! আমি কোন ভাবেই খুলতে পারছি না। একটু খুলে দিন না। আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম সরাসরি খোলা খুলি! পরে কাছে গিয়ে বুঝলাম ওড়নায় লাগানো পিন কিভাবে যেনো আটকে গেছে। সেটা খুলে দিতে বলেছে।
আমি সুঁই ভয় পাই আগেই বলেছি। আর যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। প্রথম পিন খুলতে গিয়েই আঙুলে খোঁচা খেয়ে এক দুই ফোটা রক্ত বিসর্জন দিলাম সাথে ছোট খাট আহ উহ তো আছেই। এই কি হলো? দেখি দেখি, আঙুলে বিধালেন কিভাবে??
ও এমন কিছু না (ভেতরে ভয়ে চুপসে আছি) বলে আরেকটা পিন খুললাম। দুই তিন করে গোটা বিশেক পিন খুলে ওড়না ছাড়ালাম। এবার ও একটু আহলাদি গলায় অনুরোধ করলো চুলে লাগানো ক্লিপ গুলো খুলে দিতে। আমিও গদগদ ভাব নিয়ে, খুলছি বলে কাজ শুরু করে দিলাম। হায় হায় একি অবস্থা! চুলের যেখানে হাত দেই সেখানেই ক্লিপ। কোনটা ডান থেকে বামে আবার কোনটা বাম থেকে ডানে। কিছু ক্লিপতো একটার উপর দিয়ে আরেক দিকে রওনা দিয়েছে। একটা একটা করে ক্লিপ খুলছি আর বিছানায় রাখছি। এক পর্যায়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এতো ক্লিপ মাথায় নিয়ে বসে ছিলে কিভাবে? প্রায় আধা ঘন্টা লাগিয়ে ক্লিপ খুললাম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়েছিলাম ক্লিপের সাথে চুল পেচিয়ে একাকার অবস্থা। ক্লিপ টান দেই সাথে চুলও। ও আহ উহ করে উঠে। আমিতো লজ্জায় অস্থির। বাহির থেকে কেউ আওয়াজ পেলে না জানি কি ভেবে বসে! ওর সিল্কি চুল তাই তাদের বশে রাখতে প্রচুর স্প্রে করেছে। রেশমী চুল পুরাই খড়খড়ে হয়ে আছে। মোটামুটি চুল ছাড়ানো হলে গুনে দেখি ৮৩ টা ক্লিপ লাগিয়েছিলো মাথায়। দোকানে সরি পার্লারে মনে হয় যতো ক্লিপ ছিলো ওর মাথাতেই লাগিয়ে দিয়েছে।
রাত বাজে দেড়টা ও খুব টায়ার্ড হয়ে পরেছে৷ শাড়ির সেফটিপিন খোলা শুরু করে ক্ষান্ত দিলো। সারাদিনের ধকলে মাথা ব্যথা করছে। আমি নিজেই বললাম, থাক তুমি বসো আমি সেফটিপিন খুলে দিচ্ছি। এই উছিলায় কাছাকাছি, নিঃশ্বাস টের পাওয়া দূরত্বে এলাম। অবাক হয়ে উপলব্ধি করলাম শাড়ির কতো আনাচেকানাচে জায়গায় যে সেফটিপিন লাগানো! আচল, কুঁচির ভাঁজে ভাঁজে পিন লুকিয়ে লাগানো। আমি সেফটিপিন খুলতে পারলেও পিন আটকাতে গিয়ে বারবার খোঁচা খাই। এই পিন খুলতে খুলতে মোটামুটি আমার রাত কাবার। প্রায় এক ঘন্টার চেষ্টায় ওকে পিন মুক্ত করলাম। এবার গুনে দেখলাম ৩৮ টা সেফটিপিন লাগানো পুরো শাড়িতে।
ও লাজুক পায়ে ফ্রেশ হতে গেলো। আমি বিছানায় বসে শদেড়েক পিন, ক্লিপ আর সেফটিপিন সব গুছিয়ে একটা বক্সে রাখলাম।
প্রায় পয়ত্রিশ মিনিট পর ও যখন বেরিয়ে এলো রাতের পোশাকে! আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর স্নিগ্ধ মুখটার দিকে। বউ সাজা হৃদিতার চাইতে এই সাজ হীন হৃদিতা অনেক বেশি সুন্দর। আমার হা করে থাকা দেখে খোঁচা দিয়ে বললো, হা বন্ধ করেন নয়তো মশা ঢুকে যাবে!
আমি হুম হাম কিছু একটা উত্তরে বলেছিলাম হয়তো। এরপর সেই রাতে আরও অনেক কিছুই হয়েছে! কিন্তু আমার চোখে ভাসে শুধু পিন আর সেফটিপিন!!!
END