বিয়ে_বিড়ম্বনা (প্রথম পর্ব)
আমার বিয়ে নিয়ে রাজ্যের মানুষের আগ্রহ, পাকাপাকিভাবে কুয়েট চুকিয়ে ঢাকায় ফিরতেই তা টের পেলাম। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রী পেয়েছি, তার চাইতে আমাদের সম্পত্তির উপরই যে লোকজনের ঝোক সেটা বোঝার মতো আমার এখন যথেষ্ট বয়স। এ বাসায় কিছুদিন পরপরই নানা রকমের বিয়ের প্রস্তাব আসছে। কিছু কিছুতো রীতিমতো হাস্যকর। এই যেমন আব্বার কলিগ কাশেম সাহেব তার এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষ পড়ুয়া মেয়ের মাধ্যমে আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার ভীষণ আগ্রহে!
বিয়ে করার কোনরকম ইচ্ছে নেই, পরিবারকে কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে একটা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে ট্রেইনি ডেভলপার হিসেবে জয়েন করলাম। চাকুরী জীবন শুরু হতেই ভীষণ ভালো লাগা অনুভবে। সবচাইতে বড় কথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা আসলো বলেই। মাঝে মধ্যে নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করি, পরিবারের অন্যদেরকেও এটা সেটা দেওয়ার আনন্দে। অফিস, বাসা আর বন্ধু বান্ধব সব মিলিয়ে আমার সময় বেশ ভালোই যায়।
মূল কাহিনীটা শুরু করার আগে প্রাসঙ্গিক ভাবেই আমার পরিচয়টা ছোট্র করে জানিয়ে রাখছি।
আমি আশিকুর রহমান, ডাক নাম আশিক। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচাইতে ছোট। আমার বড় দুই বোন আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। বছর দশেকের বড় মিলা আপু বিয়ের পর থেকেই লন্ডন প্রবাসী। আমার দুটো ফুটফুটে ভাগ্নিও রয়েছে। এরপর নিলা আপু। মিলা আপুর পিঠেপিঠি নিলা আপু দেশেই থাকেন। বছর দশেক আগে বিয়ে হয়েছে, তিন ছেলে মেয়ে আর স্বামী সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এমনকি ধানমন্ডির শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাদের উত্তরার বাসায় আসা হয় কালেভদ্রে।
আমার বাবা সিদ্দিকুর রহমান, বছর তিনেক আগে রিটায়ারমেন্টে গেছেন। সরকারের একসময়ের আয়কর বিভাগের উচ্চপদস্হ কর্মকর্তা ভীষণ একটিভ এই লোক চাকুরী শেষেও বসে থাকেন নি। একটা বিদেশী উন্নয়ন সংস্হায় কনসালটেন্সি করে যাচ্ছেন। আমার মা নাজমা রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা, তিতুমীর কলেজ থেকে রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার প্রস্তুতিতে।
আব্বা প্রায় বিশ বছর আগে উত্তরা ছয় নম্বর সেক্টরে পাওয়া পাঁচ কাঠার সরকারি প্লটটায় বাড়ির কাজ শুরু করেন। একটু একটু করে করা ছয়তলা এই বাড়ির পুরোটা শেষ হয় রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার পর। বাড়ির দোতলার পুরো অংশটায় আমরা নিজেরা থাকলেও তিন তলা থেকে ছয়তলা ভাড়া দেওয়া। এদের মধ্যে ইপিজেডে কাজ করে এরকম কিছু বিদেশীও রয়েছে।
সব মিলিয়েই আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। আর এ পরিবারের একমাত্র পুত্র হয়ে জন্মানোটা যেন আমার জন্য কাল। নিজের অজান্তেই মোস্ট এলিজেবল একজন ব্যাচেলর। যদিও বিষয়টি আমার জন্য মোটেও সুখকর নয়।
চাকুরীর মাস ছয়েক হতে না হতেই বিয়ের বিষয়ে পরিবারের ফের অনুরোধটায় রীতিমতো বিরক্ত হলাম। বড়পা লন্ডন থেকে ফোন করে ওর জায়ের ছোট বোন কিংবা ছোটপার বান্ধবীর কাজিনকে দেখার অনুরোধ, এসব চলছেই। সবচাইতে অবাক হলাম ছোট দুলাভাইয়ের ষড়যন্ত্রে, বসের মেয়েকে দেখানোর জোর চেষ্টায়। দুলাভাইয়ের প্রমোশন দরকার তা জানতাম, তাই বলে আমাকে বিয়ে দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টাটায় খানিকটা কষ্ট হলো।
বিয়ে করার জন্য আত্মীয় স্বজনদের এসব পীড়াপীড়ির মধ্যে যখন বাসার দারোয়ানের মারফতও বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, আমার তখন মাথা নষ্ট হওয়ার মতো অবস্হা। ভাগ্য ভালো ছোট সফটওয়্যার ফার্মটায় কোন মেয়ে কলিগ নেই। কিন্তু তারপরও রিসেপশনে থাকা অবিবাহিতা মেয়েটার দেওয়া উদাস দৃষ্টিটায় আমার অস্বস্তিই হয়।
চাকুরী করছি, ঘুরছি ফিরছি, বেশ ভালো আছি। পুরনো ভক্সওয়াগন গাড়ি চালানো আমার শখ। ঢাকাতে এ ধরনের একটা ক্লাবের সাথেও আমি একটিভলি ইনভলভড। ছুটির দিনে বিভিন্ন ইভেন্ট অর্গানাইজ করি। এছাড়া রোটারী ক্লাব করার পাশাপাশি কিছু সমাজসেবা করারও চেষ্টা করি। সব মিলিয়ে আমার ব্যস্ত সুখী জীবন।
আবার এরই মধ্যে বিদেশে মাস্টার্স করার প্রস্তুতিতে, জিআরই করে এডমিশনের চেষ্টায় আছি। সব মিলিয়ে আমার ব্যস্ততা কিন্তু খুব ভালো একটা সময়। এসবের মধ্যে আশেপাশের মানুষদের দেওয়া বিয়ে করার চাপটাতে একটা সময় পর বিরক্তি চলে এলো। তবে আব্বা আম্মা আমার মনোভাবটা বুঝতে পারে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করলো।
আমি যে ছোট খালার মেয়ে মানে আমার একমাত্র খালাতো বোন এশার জন্যও টার্গেট, এটা এবার খালার বাসায় বেড়াতে না গেলে জানতে পারতাম না। রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় ছোট খালার বাসাটা ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভাইবোনদের বেড়ানোর জন্য প্রিয়। ছুটিছাটায় খালার বাড়িতে বেড়ানো আমাদের রুটিন।
ছোট খালার পীড়াপীড়িতে তিনদিনের ছুটিতে আম্মাকে সাথে নিয়ে ছোট খালার বাড়িতে গিয়ে অন্যরকম এক খালাকে আবিষ্কার করলাম। আমাকে দেওয়া জামাই আদর আর সারাক্ষণ এটেনশনে মনে মনে বিরক্তি চলে এল। এশাকেও দেখি আমার দিকে কেমন কেমন করে তাকায়। এশাকে করা আমার আজীবন “তুই” সম্বোধনেও ছোট খালার দেওয়া আপত্তি, সন্দেহটা আরো বেড়ে গেল।
আর সেদিন রাতেই আম্মা এশাকে পছন্দ হয় কিনা জিজ্ঞেস করতেই আকাশ থেকে পড়লাম। এশাকে সবসময়ই নিজের ছোট বোন বলে মনে করেছি, অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ নেই। তার উপর মেয়েটা আমার চেয়ে কম করে হলেও সাত বছরের ছোট হবে, মাত্রই রাজশাহী ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া। আম্মাকে খুব শক্তভাবে না করে দিলাম, বিষয়টি যাতে আর না এগোয় সেই অনুরোধটা জানিয়ে।
তবে এই ছোট খালার বাসাতেই আমার সর্বনাশের শুরু। এশার এক ফুপাতো বোন রুনার সাথে পরিচয় হওয়ার পরপরই। রাজশাহী ভার্সিটির রসায়ন বিভাগের ছাত্রী রুনা অনার্স পরীক্ষা শেষ করে ওর মামার বাসায় ছুটি কাটাচ্ছে। মানুষের মন কতোই না অদ্ভুত, মেয়েটার সাথে এক দুবার কথা বলার পরই ওর প্রতি তীব্র টান অনুভব করতে লাগলাম। যদিও রুনা আমাকে “ভাইয়া” বলেই সম্বোধন করছে, স্বাভাবিক কথোপকথনে। কিন্তু মনের মধ্যে রুনা ঝড়টা টের পেলাম, ছুটির দ্বিতীয় দিনটাতেই। আপাত দৃষ্টিতে মফস্বলের সাধারণ এই মেয়েটাই এখন আমার চোখে রাজকন্যা। জীবনের প্রথম প্রেম।
#বিয়ে_বিড়ম্বনা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।)
রুনার প্রতি বাড়তি আগ্রহটা ছোট খালার রাডারে দ্রুতই ধরা খেয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনের রাতের খাবার টেবিলে রুনাকে দেখতে না পেয়ে বুঝলাম, এ বাসায় বাংলা সিনেমার একটা সিন কমপ্লিট। ছোট খালা রুনাকে সরিয়ে দিয়েছেন, আমার চোখের আড়াল করতেই। কিন্তু খালাতো আর জানে না, আমার মনে উথাল পাতাল রুনা ঝড় বইছে।
এবার রুনার পরিচয়টা দেই। মেয়েটার মতো দূর্ভাগা এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে। মাত্র এগার বছর বয়সে বাবা মা দুজনকেই সড়ক দূর্ঘটনায় হারায়। নওগাঁ রাজশাহী সড়কে মাইক্রোবাস – ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে রুনা অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। এরপর থেকেই বাবা মা হারানো রুনার যাযাবর জীবনের শুরু। বাবা মা দুজনেই নওগাঁর একটা কলেজে শিক্ষকতা করতেন। দেখভালের জন্য আপন বলতে তখন শুধুমাত্র রুনার মামারাই এগিয়ে আসে।
আমার ছোট খালু, রুনার মেজো মামা। তবে রুনা বড় হয়েছে ওর বড় মামা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রফিকুল ইসলামের কাছেই। ছোট খালুর বাসাতেও রুনার প্রায়ই আসা থাকা। তবে রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রচন্ড আত্মসন্মানবোধ সম্পন্না রুনা ভার্সিটির হলেই থাকতে শুরু করে, মন্নুজান হলের আবাসিক ছাত্রী। শুরু থেকেই রুনা ছাত্রী প্রাইভেট পড়ায় এমনকি আমার খালাতো বোন এশাও যে ওর ছাত্রী ছিল, এটা পরে জানতে পারি।
তৃতীয় দিন রাতে রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফেরার আগেই মন্নুজান হলে গিয়ে রুনার সাথে দেখা করি। রুনা তখনই কনফার্ম হয়েছে আমার দূর্বলতাকে। কিন্তু আশ্চর্য মেয়েটা বলতে গেলে আমাকে উপেক্ষাই করলো, এমনকি ওর মোবাইল ফোন নাম্বারটাও দেয়নি। সম্ভবত অল্প বয়সে বাবা মা হারানো এই মেয়েটা তার জীবনে অহেতুক ঝামেলা আনতে চায় না বলেই। মন্নুজান হলের ল্যান্ড ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে, ওর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললাম “ভালোবাসি”। জীবনে প্রথমবারের মতোই কোন মেয়েকে বলা, ভীষণ আবেগ নিয়ে।
রুনা সম্ভবত এত দ্রুত “ভালোবাসি” কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমার বলা কথাটার উত্তরে ওর কিছুটা অবিশ্বাস আর ভয় মেশানো চাহনীটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। হল গেটের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে দাড়ানো রুনা আমাকে বেশিক্ষণ সময় দেয়নি।
মেয়েটার হাত পা কাঁপছে, গলার স্বর ভারি হয়ে আসছে, ঠিকই বুঝতে পারলাম। ওর মামার পরিবার মানে আমার খালা জানতে পারলে বিপদ হবে, খুব ভয়েই কথাটা মনে করিয়ে দিল। ভবিষ্যতে যোগাযোগ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওর দ্রুত হলের ভিতরে চলা যাওয়াটা আমার হৃদয়কে ভেঙ্গে চূড়ে দিয়ে গেল।
ছোট খালা সম্ভবত রুনার সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে, বিষয়টি অনুমান করে নিলেন। নিজ মেয়েকে দিয়ে বিয়ে করানোর পরিকল্পনাটা যে আর বাস্তবায়ন যোগ্য নয়, এটা ঠিকই বুঝে নিলেন। আমার খালাতো বোন এশা কিন্তু আমাকে ঠিক আগের মতো করেই দেখছে। ওর কাছেও বড় ভাই হিসেবেই আমি অনেক কমফোর্টেবল।
ভারাক্রান্ত মনে ঢাকায় ফিরতেই নিজেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হিসেবে আবিস্কার করলাম। যে আমি সবসময়ই হাসি খুশি আর উচ্ছলতায় থাকি, তারই কিনা রীতিমতো মন খারাপ করে থাকা। বিষয়টি অফিস কলিগ কিংবা বন্ধু মহলে খুব সহজেই আলোচনার একটি বিষয় হয়ে গেল।
প্রেম সংক্রান্ত জটিলতায় পড়েছি বলে অনেকের আগ বাড়িয়ে বলা মন্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। সত্যি বলতে কি রুনাকে চাওয়া কিন্তু আমার পক্ষ থেকে, এক তরফা। যদিও সবকিছু মিলিয়ে রুনাকে পাওয়া অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছিল।
আমার খালাতো বোন এশাই শেষ পযর্ন্ত ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হল। অল্প বয়সী মেয়ে, প্রেম ভালোবাসায় বিশাল আগ্রহ। রুনার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মেছে, বিষয়টি জানতে পেরেই এ বিষয়ে ওর আগ্রহের কোন কমতি নেই। আমার পক্ষ হয়ে বিপুল উৎসাহে কাজ শুরু করে দিল, স্বপ্রনোদিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।
এশার মাধ্যমে রুনার সাথে কথা হতেই ভীষণ হতাশ হলাম। ওকে আমার ভালো লাগার বিষয়টি ও নিছকই পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়েছে। বরঞ্চ আমি যেন ওর সাথে যোগাযোগ না করি ওটারই পুনঃ অনুরোধ করলো, বেশ সিরিয়াসভাবে।
ছোট খালা যে বিষয়টিতে এতোটা গোয়েন্দাগিরি করছেন, এটা কিন্তু মোটেও বুঝতে পারিনি। এশাকে ব্যবহার করে রুনার সাথে যোগাযোগ, আমার মা বোনদের জানিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি। রুনাকেও ডেকে শাসালেন। এরপর থেকে রুনার সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ নেই। সত্যি বলতে কি অনেক চেষ্টা করেও রুনার সাথে আর কথা বলতে পারিনি।
এদিকে আমার জীবনে রুনা বিষয়ক একটা জটিলতা তৈরী হয়েছে। এ আতংকেই আমার মা বোনেরা, আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। এবার বড়পার জায়ের ছোট বোনের সাথে আমার বিয়ের কথা বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়ে গেল। এমনকি আমাকে অন্ধকারে রেখে পাত্রী দেখার তোরজোরও চলছে।
পাত্রী তিশা একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা, ইন্টার্নি শুরু করেছে। অতি উৎসাহি বড়পা পাত্রীর ফোন নাম্বারটা দিল। ভনিতা না করে পাত্রীকে সরাসরি আমার পছন্দ থাকার কথাটা জানিয়ে দিলাম। তিশা হঠাৎ করে বলা এ কথাটায় অবাক হলেও, অকপট স্বীকারোক্তিকে এপ্রিশিয়েটই করলো। মেয়েটা স্মার্ট, জীবনে অহেতুক ঝামেলায় যেতে অনাগ্রহী। তাইতো বিয়ের এই প্রস্তাবটা নিজ উদ্যোগেই ভেঙ্গে দিল। আমি অবশ্য এতে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছিলাম।
এদিকে রুনার কারণে এত ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব ভেস্তে গেছে। আমার মা খালা আর বোনদের সব ক্ষোভ এখন নিদোর্ষ এই মেয়েটার উপর। বড়পা লন্ডন থেকে আমাকে ফোনে অনেক রাগারাগি করলো। ওর জায়ের ছোট বোনের মেয়ের সাথে বিয়ে না হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে এখন ওর মুখ দেখানোই দায় হয়ে গেছে। আরো অনেক কিছু ইত্যাদি ইত্যাদি কথা বলে ওর কান্নাকাটিটা মোটেও ভালো লাগেনি।
তবে সেদিন বড়পার বলা শেষ কথাটায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম “তুই নাকি ঐ অপয়া মেয়েটাকে পছন্দ করিস? এখনো বিয়ে করতে চাস?” রুনার দূভার্গ্য, মেয়েটা অল্প বয়সে বাবা মাকে হারিয়েছে। কিন্তু এতে ও কিভাবে অপয়া হয়, এটা কিছুতেই মাথায় আসলো না। তাইতো রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বড়পার ফোনের লাইনটা কেটে দিতে বাধ্য হলাম।
তিশার সাথে বিয়ের প্রস্তাবটা না এগুলেও, আমার পরিবার কিন্তু রণে ভঙ্গ দেয়নি। বিপুল উৎসাহে আরো পাত্রী দেখে যাচ্ছে আর সেই সাথে আমাকে টানা কাউন্সেলিংয়ে। তবে বেশিরভাগই রুনার বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে বলা অবান্তর সব কথা। এই যেমন মেয়েটার নাকি অন্য ছেলের সাথে মাখামাখি আছে, ও লোভী, অনেক উচ্চাভিলাষী স্বার্থপর এইসব আর কি! আমি অবশ্য এসব কথা শুনে মনে মনে হাসি। মেয়েটা যে উল্টো আমাকেই পাত্তা দেয় না, এই কষ্টের কথাটা যে আমার মা বোনদের এখনো অজানা!
এসব পারিবারিক নাটক সিনেমার মধ্যেই মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমার টিচিং এসিসট্যান্টসহ এমএস প্রোগ্রামে ভর্তির অফার এলো, লুফে নিলাম। সত্যি বলতে কি সবকিছু মিলিয়ে পরিবারে এমনকি দেশে থাকতেই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। ততোদিনে আমাদের পরিবারে “রুনা” নামটাই নিষিদ্ধ। সবমিলিয়ে পারিবারিকভাবে রুনাকে বিয়ে করাটাও অসম্ভব বলে মনে হল।
এদিকে শীঘ্রই আমেরিকা চলে যাচ্ছি, এটা শুনে আমার বোনেরা বিয়ে দেওয়ার জন্য আবারো উঠেপড়া লাগালো। আবারো মহাবিরক্ত হলাম। এবার ছোট দুলাভাই তার বসের মেয়েটাকে একটিবার দেখার জন্য করা জোর অনুরোধটায়, আপনজনদের স্বার্থপরতা ফুটে উঠলো। নিজের অজান্তেই পরিবারের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো।
এদিকে পরিবারের সবাইকে অন্ধকারে রেখে, আমেরিকা যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে সকালের এক ফ্লাইটে রাজশাহী চলে এলাম।
রুনা আমার সব খোঁজই রাখে, সম্ভবত এশার বদৌলতে। দুদিন পর আমেরিকার ফ্লাইট, আমাকে দেখে ওর ভিমরি খাবার দশা হল। সেদিনই প্রথমবারের মতো ওর চোখে ভালোবাসার আভাটা দেখলাম। ঐদিন বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে আসার আগ মুহুর্তের প্রতিটা ক্ষণই ছিল আমার জীবনের সেরা।
পদ্মা পাড়ের রোমান্টিক পরিবেশে জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসার মানুষটার হাতে হাত রাখলাম, আলতো ভাবে। অন্যমনষ্কা রুনার কেপেঁ উঠা, নিঃশব্দে ঝরে পড়া ওর কয়েক ফোটা অশ্রু যেন হাজারো দিনের ভালোবাসার কথামালা। পদ্মার পাড়ে রুনাকে দেওয়া ঐ দিনের প্রতিশ্রুতিটাকে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার পরও এক মুহুর্তের জন্যও ভুলিনি। রুনার সাথে আজীবন থাকার শপথ।
আমার প্ল্যান ছিল এমএস শেষ করে দেশে এসে রুনাকে বিয়ে করবো। ততোদিনে রুনারও মাস্টার্স শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বিধিবাম, মিশিগানে যাওয়ার পরদিন থেকেই দেশ আমাকে তীব্র ভাবে টানছে। রুনার সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছাটা যেন বেড়ে গেল হাজারো গুন। প্রথম সেমিস্টারটা বহু কষ্টে শেষ করলাম, ফলাফল ভালো হল না। তাইতো অস্হিরতা থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে তড়িঘড়ি করে দু সপ্তাহের জন্য দেশে চলে এলাম।
হঠাৎ করে দেশে ফিরেছি। এতে আমার পরিবারের টনক নড়লো। বাবা এবার আমার পক্ষে শক্ত অবস্হান নিলেন। “আমার জীবন, আমার সিদ্ধান্ত।” আমার মা বোনদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আমার আম্মা অবশ্য বিষয়টি বুঝতে পারলেও, আমার দুবোন আমার নেওয়া সিদ্ধান্তটায় ভেটো দিয়ে গেল।
আমি অবশ্য ওদের এসব কথায় কান দিয়ে সময় নষ্ট করলাম না। ওদের জায়ের ছোট বোনের মেয়ে কিংবা বসের মেয়েকে আমাকে ধরিয়ে দিতে না পারার কষ্টটা আর কেউ না বুঝলেও, আমি ঠিকই বুঝি। জীবন একটাই আর সে জীবনে পছন্দের মানুষের সাথে না থাকতে পারার কষ্ট, অন্ততপক্ষে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
শেষ পযর্ন্ত আমার বাবা দুদিনের মধ্যেই পুরো পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেন। আমার দেশে ফেরার চতুর্থ দিনের মধ্যেই অল্প কয়েকজন বরযাত্রী নিয়ে কনের বড় মামার বাসায় তাড়াহুড়ো করে আমাদের বিয়েটাও হয়ে গেল। সেদিন বিকেলের ফ্লাইটেই রুনাকে নিয়ে আমরা সবাই ঢাকায় চলে এলাম। এরপর আমি রুনাকে শুধুই অপলক দৃষ্টিতে দেখি। সবকিছু তখনো অবিশ্বাস্য। আমি “অবশেষে তাহাকে পাইলাম” অনুভূতিতে।
এরপর অফিসার্স ক্লাবে তড়িঘড়ি করে করা একমাত্র ছেলের বিয়ের রিসেপশনটায়, আমার বাবা কোন কিছুরই কমতি রাখেননি। সবাই আমাদের প্রাণভরে দোয়া দিয়েছে। সবচাইতে বড় কথা আমার বাবা মা রুনাকে খুব দ্রুতই আপন করে নিলেন। আর রুনাও অল্পদিনেই নিজেকে মানিয়ে নিল। তবে মিশিগানে যাওয়ার আগে রুনার একটানা কান্না আমাকে প্লেনের পুরোটা পথ বিষন্ন করে রেখেছিল।
মাস ছয়েক পর রুনার মাস্টার্স শেষ হতেই ও মিশিগানে আমার সাথে যোগ দেয়। সেই থেকে টোনাটুনির সংসার যাত্রার শুরু। আর আট দশটা প্রবাস যোদ্ধার মতোই কঠিন সেই জীবন। তবে এরমধ্যেও আমাদের ভালোবাসায় কখনো চিড় ধরেনি। এমনকি বিয়ের পাঁচ বছর পরও আমাদের স্বাভাবিক ভাবে সন্তান জন্ম না হওয়াতেও। দুজনেই ধৈর্য ধরলাম, চিকিৎসা চললো। মাঝেমধ্যে রুনার কষ্ট প্রকাশ পেলেও, আমি কিন্তু চুপ থাকতাম। পদ্মা পাড়ে রুনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটা সবসময়ই মনে পড়তো। আজীবন ভালোবাসার শপথ।
মহান সৃষ্টি কর্তা কিন্তু শেষ পযর্ন্ত আমাদেরকে নিরাশ করেনি। আইভিএফ টেকনোলজির মাধ্যমে আমরা জমজ দুটো মেয়ের বাবা মাও হলাম, বিয়ের ঠিক ছয় বছরের মাথায়। সে বছরই আমার পিএইচডি ডিগ্রী প্রাপ্তি, টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে এসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগদান। এ যেন আমাদের সুখের সাগরে ভাসা। চারিদিক থেকে খুশির সংবাদ।
আজ ঊনিশে জুলাই আমার দু কন্যা জারা ও সারার তৃতীয় জন্মবার্ষিকী। এরই মধ্যে দেশে বাচ্চাদের নিয়ে একবার ঘুরে এসেছি। ফুটফুটে বাচ্চাগুলোকে দেখতে আমাদের আত্মীয় স্বজনরা ভেঙ্গে পড়েছিল। এমনকি আমার বড়পাও লন্ডন থেকে দেশে এল। নাতনীদের দেখতে এরপর আমার বাবা মা আমেরিকায় একবার বেড়িয়েও গেছেন। নাতনী দুটো বলতে গেলে বাবা মায়ের জান।
সবকিছু মিলিয়েই রুনার প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ। আমাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসাময় একটা জীবন উপহার দেওয়ার জন্য। আর রুনা মাঝে মধ্যে খুশি মনে আমাকে জিজ্ঞেস করে “আশিক, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?” এ প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবারই আমি ওকে চিমটি কাটি, আলতো ভাবেই।
END