# প্রাণ
কাজী অফিসে বিয়ে টা সেরে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছি শাহেদ এর আব্বা-আম্মার সামনে। তাদেরকে সালাম করার মত সাহসটা পাচ্ছিনা। আমি আর শাহেদ দুজনেই ব্যাচমেট কেবলমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। অনেক মেয়ের এই সময় বিয়ে হয়ে গেলেও ছেলেরা সাধারণত এই কাতারে পড়ে না। কিন্তু আজকে শাহেদকে আমার জন্য এই পরিস্থিতিতে পড়তে হলো।
আমার মামাতো ভাই রাসেল এসেছে কানাডা থেকে, বাসার সবাই চাইছিল বিয়েটা সেরে ফেলতে ।আবার কবে আসবে না আসবে তার তো কোন ঠিক নেই। বাধ্য হয়ে আজকে আমাকে এই কাজটা করতে হয়েছে। শাহেদের বাবা-মা দুজনেই চমকে গেছেন । আসলে তারা ভাবতেই পারেননি যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত শাহেদ তাদের পরামর্শ ছাড়া নিতে পারে।
যাইহোক আল্লাহর অসীম রহমতে শাহেদের বাবা মুখ খুলে অস্ফুট স্বরে শাহেদ কে বললেন “যাও বউ নিয়ে ভেতরে যাও”
আমরা দুজনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
পরদিন থেকেই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম শ্বশুর শাশুড়ির মন জয় করার জন্য । শাহেদ তাদের একমাত্র সন্তান। ভোরে উঠে নাস্তা বানানো শুরু করলাম,
আমার শাশুড়ি বললেন,
-তোমার এসব করা লাগবেনা বুয়া আছে, সে সামলে নেবে।আমি খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম তারমানে এখনো তিনি আমাকে মন থেকে মেনে নেননি।
-এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? যাও ঘরে যাও ইউনিভার্সিটি তে যেতে হবেনা , রেডি হও গিয়ে।
আমি সরে আসলাম বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মনে হলো হয়তো তারা আমাকে পরিবারের একজন ভাবতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যায় চা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন দেখি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কি নিয়ে যেন আলোচনা করছেন , তাদের মুখ বিষাদমাখা। আমাকে দেখেই থেমে গেলেন। তবে কি আমি ভুল ভেবেছি, আমাকে কি তারা এখনো মেনে নিতে পারছেন না , আমি কি তাদের মনে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?
বাসায় ফিরে যাবার কোন উপায় নেই যে মনের কষ্টগুলো অন্য কারো সাথে শেয়ার করবো, রাত অনেক হয়ে গেছে ঘুম আসছে না। এদিকে শাহেদ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘরের মধ্যে কেমন হাঁসফাঁস লাগছে, ভাবলাম ছাদে গিয়ে হেঁটে আসি।
রাত প্রায় বারোটা, ছাদের এক কোনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি চমকে উঠলাম । ভালো করে লক্ষ্য করলাম আমার শাশুড়ি মা। আমি ধীর পায়ে তার কাছে গেলাম, উনার চোখ টকটকে লাল । বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছেন।
-মা আপনি এত রাতে এখানে!
-তুমি এখানে কি করো? মা প্রায় চমকে গিয়ে বললেন
-আমার ঘুম আসছিল না , তাছাড়া গরম লাগছিল তাই ভাবলাম একটু ছাদ থেকে হেঁটে আসি
-ও আচ্ছা । বলে মা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন
-কি হয়েছে মা আপনার? মায়ের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মা কাঁদতে শুরু করেছেন।
-কিছু না বৌমা
-বৌমা না আমাকে আমার নাম ধরে ডাকুন। আমিতো আপনার মেয়ের মত ।বলুন না মা কি হয়েছে?
-বলতে পারবো না মা ,আমাকে মাফ করে দাও
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
মায়ের কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেন উনি অত্যন্ত সংকুচিত, ভীত কোন একটা বিষয় নিয়ে।
– গত সপ্তাহে আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম ।আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিল ,ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা দিল , করার পর দেখা গেল আমার প্রেগনেন্সি রেজাল্ট পজেটিভ। এখন আমি কি করবো রে মা এই সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে? শাহেদকে কি বলবো? ওর সামনে দাঁড়াবো কি করে?বয়স হয়ে গেছে পিরিয়ড বন্ধ ছিল গত চারমাস আমি ভেবেছি এটা বয়স জনিত কারণ কিন্তু শেষে দেখা গেল..
মা যেন আর কিছু বলতে পারছেন না হু হু করে কেঁদে চললেন।
-ডাক্তার বলেছে এখন বাচ্চাটা নষ্ট করা সম্ভব কিন্তু এতে আমার প্রাণের ঝুঁকি আছে । আমি আর তোমার শ্বশুর মিলে কিছুই ঠিক করতে পারছিনা কি করবো।
-আপনি ঘুমাতে যান মা ।না সব ঠিক হয়ে যাবে আসুন আমার সাথে আমি মাকে নিয়ে নিচে নামলাম
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে, সবাই যখন নাস্তা করছিল আমি শাহেদ কে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-শাহেদ কংগ্রাচুলেশনস ,তুমি ভাই হতে যাচ্ছো, বড় ভাই
-শাহেদের হাত থেকে পাওরুটির টুকরো পড়ে গেলো। কি বলছো তুমি?
বাবা মা দুজনেই থতমত হয়ে মাথা নীচু করে বসে আছেন
-যা বলেছি ঠিক বলেছি। মা আমার দিকে তাকান , আপনাদের এতটা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই , আপনারা কোনো অপরাধ করেননি , কোন পাপ করেননি। জন্ম-মৃত্যুর উপর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারোর কোন হাত নেই। আপনি কেন নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আরেকটি প্রাণ কে ধ্বংস করে দেবেন, তা কিছুতেই হবে না।
পাড়া-প্রতিবেশী দু’চারদিন কানাঘুষা করবে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আজ যদি আপনারা সেটা করেন তাহলে সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবেন আর আল্লাহ না করুক যদি আপনার কিছু হয়ে যায় তাহলে বাবা কি পারবে নিজেকে ক্ষমা করতে? আর আমরাই বা আপনাকে ছাড়া থাকবো কি করে?
শাহেদ এতক্ষণে পুরো ঘটনাটা বুঝে গেছে ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো । আমি একটু চমকে উঠলাম, এই বয়সে ছেলেরা সাধারণত খুব বেশী সেনসিটিভ হয়।
আস্তে-ধীরে ও মায়ের কাছে গেল পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো
– অযথা কেন নিজেকে ছোট ভাবছো মা? আমি তো ছোট থেকেই জেদ করতাম আমার জন্য একটা পুতুল এর মত বোন এনে দাও। অবশ্য এখন বড় হয়েছি বোন না হয়ে ভাই হলেও চলবে। এখন একটু হাসো তো।
মুহূর্তে যেন বাবা-মায়ের বুকের সমস্ত ভার নেমে গেলেন দুজনে অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসছেন
মা এই প্রথম আমার মাথায় হাত রাখলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন “আল্লাহ তোমাদেরকে অনেক সুখ শান্তি দান করুন।”