আমার শাশুড়ি আম্মা বললেন, আমার পা’দুটো নাকি সাপের মতো। মানুষের পা কখনো সাপের মতো হয়? গায়ের রং পাতিলের তলার মতো সেই পর্যন্ত মানতে পারছিলাম কিন্তু সাপের সাথে তুলনা!
এই কথা শুনে আমার চোখের সামনে বিভিন্ন রকমের ছোট বড় সাপ কিলকিল করতে লাগলো।
মন খুঁজতে লাগলো কোন সাপের পা আছে! পা ছাড়া সরীসৃপ দেখলেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। আর এখন এর অদৃশ্য পায়ের সাথে আমার পায়ের তুলনা! আমার গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। ননদ নদী কাছেই বসে ছিল। সে জিজ্ঞেস করলো কি হলো ভাবি, শরীরে ঝাঁকুনি হলো কেন?
আমি একটু হেসে বললাম-
—নিজেকে সাপ সাপ মনে হচ্ছে।
আমার এই কথায় আম্মা বললেন-
—কি দেয়াদপরে বাবা ! বাপ মা কিছুই শিখায় নাই?
—কি আশ্চর্য আম্মা ! আমি তো আপনাকে কিছুই বলিনি, বেয়াদবি হলো কিভাবে?
—না আছে রুপ না আছে ব্যবহার। এই জন্যই চাই নাই এই মেয়ের সাথে আতিকের বিয়ে হোক।
এই কথা শুনে আমার একটু ধাক্কা লাগলো।বিয়ের দিন থেকেই আমার সাথে আতিকের যে শীতল ব্যবহার মেলাতে পারছিলাম না, তাহলে কি তারও আমাকে পছন্দ হয়নি?
কিন্তু আমার ভাসুর আর ভাবির যে আগ্রহ আর আন্তরিকতা ছিলো আমাকে এই বাড়িতে বৌ করে আনার – সেই সব তাহলে কেন? কোন কিছু পরিষ্কার ভাবে আমার মাথায় আসছে না।
আমাকে কেউ দেখতে আসলে আম্মা সবাইকে বলছেন ,’ এই মেয়ে আমাদের পছন্দ ছিলো না, শাহেদ যে কিসের জন্য আতিকরে এইখানে বিয়ে করাইলো?’ উনার দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখ শুনে সবাই ভাববে এই বাড়িতে কিছুক্ষণ আগে কারো মৃত্যু হয়েছে। আমার এক ননদ,অন্য কিছু আত্মীয় বসে যায় আমার গুণগান গাইতে। আরেক ননদ শ্বশুর বাড়িতে, সে থাকলে হয়তো সেও বসে যেতো তাদের সাথে।
গতকাল আমার শাশুড়ির মামাতো বোন এসেছিলো আমাকে দেখতে।তিনি আমেরিকা থাকেন।তিনি চলে যাওয়ার পর থেকেই আম্মার মেজাজ খুব খারাপ।এই খালা শাশুড়ি নাকি আমেরিকান সিটিজেন এক মেয়ের সাথে আতিকের বিয়ের কথা বলেছিলো। ভাসুরের জন্য হয়নি।সেই আফসোস তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
দেশে এসে খালা শাশুড়ির প্রধান কাজ নাকি ছিল আমাকে দেখতে আসা। তিনি আমাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হয়ে বললেন-
—ও আল্লাহ বৌ দেখি একদম কালো, ছবিতেতো
ফর্সা লাগে। মেকাপ করা ছবি তো তাই গায়ের কালার বুঝা যায়নি। এই কালারের শাড়িতো ওকে একদম মানাবে না। আগে জানলে এই কালারের শাড়ি একদম আনতাম না।
আমার জন্য যেই শাড়িটা এনেছেন সেটা কয়টা শপিং মল ঘুরে ঘুরে কিনেছেন, সেটার দাম কত ডলার, সবাই দেখে কি কি বলেছে সেই ফিরিস্তি দিতে লাগলেন। শাশুড়ি চা বানিয়ে আনতে বললেন আমাকে। আত্মীয়রা একেবারে রাতের খাবার খেয়ে যাবেন, তাই এখন একটু হালকা নাস্তার আয়োজন হবে,আম্মা এটা আগেই বলে রেখেছেন।
আম্মা আমার হাতে শাড়ির প্যাকেটটা দিয়ে বললেন আমার রুমে রেখে দিতে। এই শাড়ি আমাদের দেশে খুব একটা দাম দিয়ে কিনতে হয় না। এমন কটকটা শাড়ি দুধে আলতা গায়ের রংয়ের মেয়েদেরও পরতে দেখা যায় না।
এর পরে তাদের মধ্যে আমাকে নিয়েই অনেক কথা চলল। তাঁরা এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি শুনতে পাই। টেবিল ভরা খাবার খেয়ে উনারা আমার রান্নার প্রশংসা করলে আম্মা বলে উঠলেন,’নদী এর চাইতে অনেক ভালো রান্না পারে।’
আমি মনে মনে হাসলাম, আমার সব ভালো গুণ আমার গায়ের রঙের নিচে চাঁপা দিয়ে দেয় তারা! আমি সাত দিনের ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে তাঁদের সম্পর্কে আমি ভালোভাবে জানি আর তাঁরা আমার সম্পর্কে জানুক, সম্পর্কটা দুই দিক থেকেই ভালো হোক। কিন্তু তাঁরা আমাকে তাদের সার্কেলের বাইরেই রেখে দিয়েছে কিছুতেই ওখানে ঢুকতে দিবে না আমাকে।
আমার পা সাপের মতো শুনে আজ আর চুপ থাকতে পারলাম না।একবার ভাবলাম চুপ থাকি কিন্তু আমার সচেতন মন ভাবলো কয়েকটা দিন তো চুপই থাকলাম আর না । আজও যদি চুপ থাকি সারাজীবন এখানে আমার চুপ করেই থাকতে হবে। শুরু যখন হয়েছে শেষটা দেখা উচিত।
আমি বললাম-
—আম্মা, আমাকে আপনাদের পছন্দ হয়নি, বিয়ে করাতে চান নি তাহলে কি আমরা আপনাদের বাধ্য করেছিলাম ।
আম্মা প্রায় গর্জে উঠলেন-
—আরে শাহেদের জন্যেই তো আমরা কেউ কিছু বলতে পারি নাই।ওর এক কথা ‘বংশিও মেয়ে শিক্ষিত, পরিবারের অবস্থা ভালো , গায়ের রং একটু চাপা হইলে কি আর সব দিক থেকে এক নাম্বার এমন মেয়েই আতিকের জন্য যোগ্য, এখানেই বিয়ে হবে।’
কি জাদু করছিলা বল তো, শাহেদরা যখন দেখতে গেছিলো তখন নিশ্চই কোন বশীকরন জাদু করছ।
—ঐ সব জাদু ফাদু করতে জানলে আপনারা বাকি থাকতেন কেন , এখানে এসেই সবাইকেই বশ করে ফেলতাম।
—কি মেয়েরে বাবা একটা কথাও মাটিতে পড়ে না!
—আম্মা আপনারা যদি ভেবে থাকেন আপনাদের অযৌক্তিক কথা শুনে আমি স্টার জলসার নায়িকার মতো চুপ করে থাকবো আর চোখের পানি ফেলবো, সেটা আপনাদের ভুল ভাবনা। আমার বাবা-মা আমাকে মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী করে বড় করেছেন। তাঁরা জানতেন একটা কালো মেয়েকে এই রূঢ় সমাজে কত কিছুর মোকাবেলা করে চলতে হবে । তাইতো কিভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে শিখিয়েছেন আর সেভাবে যোগ্য করে বড় করেছেন।
এখন আমার গায়ের রঙের জন্য এখানে আমাকে মাথা নত করে চলতে হবে সব সময়, আমাকে এই ভাবতে হবে আপনার ছেলে আমাকে বিয়ে করে ধন্য করেছে, তাহলে ভুল করবেন। আমি কারো দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, ভালোলাগা,সম্মান,ভালো বোঝাপড়া যদি না থাকে সেখানে সংসার করার মানেই হয় না।
এখন জানতে পারলাম আমাকে নিয়ে আপনাদের এত সমস্যা, যদি আপনার ছেলেরও সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আমার বাবা-মা,ভাসুর সবাইকে নিয়ে বসার উচিত। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করা উচিত। একতরফা ভাবে সম্পর্ক হয় না। এক তরফা সম্পর্ক আর কত দূর টেনে নেয়া যায়?
এর পরে আম্মা কাঁদতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন আতিকের অপছন্দের মেয়েকে নিয়ে সারাজীবন কিভাবে সংসার করবে? ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার ভাসুর থাকেন তিন তলায়।এই বাড়িটা উনারই। আম্মা থাকেন দ্বিতীয় তলায়। মনে মনে ভেবে রাখলাম আগামীকালই ভাবির সাথে কথা বলবো এর পরে বাবা-মাকে জানাবো।
আতিক অফিস থেকে ফিরে বাসার পরিবেশ যে থমথমে বুঝতে পারলো কারণ সে নদীকে জিজ্ঞেস করছিলো কি হয়েছে? নদী জানিয়েছে কিছু হয়নি।
খাবার টেবিলেও শুনশান নীরবতা।
বিছানায় বসে আতিক মোবাইলে স্ক্রল করছিলো। আমি সরাসরি জানতে চাইলাম-
—আমাকে পছন্দ না হলে বিয়ে করলে কেন? বিয়ে সারাজীবনের একটা পবিত্র বন্ধন। তোমার মতামত ছাড়া তো বিয়ে করানো ঠিক হয়নি। আরো যেটা জরুরি, পাত্র- পাত্রীকে আলাদা কথা বলতে দেয়া উচিত। তাদের মতামত আর রুচি , মন মানসিকতা বুঝতে দেয়া উচিত। বাবা বলেছিলেন এই কথা, শাহেদ ভাই বলেছেন উনার মতই তোমার এবং সবার মত।আর এখন দেখ আমাকে নিয়ে এত সমস্যা।কেউ আমার ছায়াও পছন্দ করছে না।এভাবে আমি কিভাবে জীবন কাটাবো?
আমার কথা শুনে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
আমি বললাম-
— কোন সমস্যা নেই যেই কথা মনে লুকানো আছে বলতে পার,আমি কিছুই মনে করবো না। তোমার কথার উপরেই নির্ভর করবে আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত।
—সত্যি বলতে প্রথমে দেখে তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি। আর মা,বোনদের কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়েছিলো। কেউ কোন কথা বলতে পারেনি ভাইয়ার কথার উপরে। কারণ ভাইয়ার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। আজ আমরা যা কিছু সেটা ভাইয়ার জন্যই। বাবা যখন মারা যান তখন ভাইয়া কলেজে পড়ে তখন থেকেই ভাইয়া টিউশনি করে। অনেক কষ্ট করে ভাইয়া নিজের এবং আমাদের পড়ালেখা চালিয়েছে।
—তাহলে তো কথা শেষ। আমাকে তোমার পছন্দ না।
—আগে শেষ করতে দাও আমার কথা। এই কয়দিন থেকেই তোমাকে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করছি আমি আর তোমার সব কাজ আমার ভালো লাগছে।নিজেই অবাক হচ্ছি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসার জন্য মন অস্থির হয়ে থাকৈ । হেসে হেসে যখন মোবাইলে কথা বলছ ভালো লাগছে, বিছানাটা যখন গোছাও ভালো লাগে, কাপড়গুলো যখন ভাঁজ কর ভালো লাগে,কপালে একটা হাত দিয়ে যখন ঘুমাও ভালো লাগে। গত শুক্রবার যখন গোসল করে বের হলে তোমার লম্বা চুল বেয়ে একটু একটু পানি ঝরছিলো দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তোমার সব কিছু সহ সর্বোপরি তোমাকে ভালো লাগছে।এক অদ্ভুত টান তোমার জন্য অনুভব করছি।
এই সব শুনে আমার একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিলো।
—কই কখনো তো আমার দিকে তাকাতেই দেখলাম না, মিথ্যে বলার আর জায়গা পাও না।
—মিথ্যে না সত্যি বলছি।এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।
এই বলে সে আমার একটা হাত তার হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে আমার আরো কাছে চলে এলো। একদম কাছে।তার হাতের বাঁধনে আমাকে এমন ভাবে বেঁধে ফেলল যে, আমি একদম ছুটতে পারছিলাম না আর আমার ছুটতে ইচ্ছেও করছিলো না।
কত কালো মেয়ের কষ্টের গল্প পড়েছি – কিন্তু আমি সব সময় ভাবতাম আমার এমন একজন জীবন সঙ্গী হবে যে আমাকে আমার গায়ের রং ছাপিয়ে আমার আত্মাকে ভালোবাসবে।
মন থেকে চাইলে সৃষ্টি কর্তা কখনো খালি হাতে নাকি ফেরান না- মা সব সময় এই কথা বলতো। আমি মাকে মনে মনে বললাম-‘মা তুমি ঠিকই বলতে। ‘
আস্তে আস্তে আতিক আম্মাকে বুঝিয়ে বলল, আমাকে বিয়ে করে সে সুখী।একজন মায়ের কাছে সব চাইতে বড় পাওয়া হলো তার সন্তান সুখে থাকা। তাই আম্মার আমাকে নিয়ে অখুশি হওয়া উচিত নয়।
মানুষের স্বভাব সহজে পাল্টায় না। আম্মার খুব বেশি পরিবর্তন হলো না আতিকের আড়ালে এটা সেটা বলতেন। আমার গায়ে লাগতো না কারণ আতিক আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছে আর সে আমার হৃদয়টা যেভাবে আলোকিত করেছে কোন অন্ধকারই কাছে ঘেঁষতে পারবে না।
আম্মার পায়ে কেমন যেন কালো কালো খসখসে শক্ত আবরণের মতো হয়েছে, খুব চুলকায়। চুলকানোর পরে রস বের হয়। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হলো।মুখে খাওয়ার ঔষধ,লাগানোর জন্য ঔষধ চলতে লাগলো।
কিছুতেই কিছু হলো না , আরো বাড়তে লাগলো।
একদিন আম্মার রুমে কেউ ছিলো না, আমাকে একা পেয়ে আম্মা বললেন-
—আমার পাশে একটু বস।
আমি বসার পরে আমার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আমার হাত দুটো ধরে বললেন-
—তোমারে অনেক কটু কথা বলছি,কষ্ট দিসি। আমি একদিন বলছিলাম তোমার পা সাপের মতো মনে আছে? আজকে দেখ আমার পা সাপের আঁশটের মতো হয়ে যাইতেছে। আমার কথা আমার কাছেই ফেরত আসছে। এইটাই প্রকৃতির বিচার। উপরওয়ালার বিচার থাইকা কেউ রক্ষা পায় না।
অনেক কষ্ট পাইতেছি এই পায়ের জন্য। তুমি আমারে ক্ষমা কর মা।
এই বলে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
—আম্মা এই সব বলবেন না।আপনাকে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, দরকার হলে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো , খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন আপনি। বলতে বলতে আমার গলাটাও ধরে এলো।
উনার কান্না দেখে, কষ্ট দেখে আমিও কষ্ট পাচ্ছি, অনেক কষ্ট পাচ্ছি।
মন থেকে সৃষ্টি কর্তাকে বললাম,”আম্মাকে আপনি সুস্থ করে দিন।”
(সমাপ্ত)
#গল্প
#প্রকৃতির_বিচার
#ফাহমিদা_লাইজু
.