#শারমিন আঁচল নিপা
অবিচ্ছন্ন ভাবনা গুলো আমাকে ভীষণ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অনন্যা কী সত্যিই আত্ম/হত্যা করেছিল? আপার জন্য আজকে আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে৷ আপা কী সত্যি খু/ন হয়েছে? আপার খু/নের সাথে কী বাবা মায়ের কোনো সম্পৃক্ততা আছে?
পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কী ভাবছি এসব আমি! শত হলেও বাবা আর মা তারা তো আর সন্তানকে খুন করতে পারবে না। এসব কেনই ভাবছি আমি? কিন্তু সে মেয়েটা কে? আমার চোখ মিথ্যা হতে পারে তবে বাবার চোখ তো মিথ্যা হতে পারে না। বাবাও তো দেখেছে তাকে। সবার আগে আমার সেই মেয়েটা খুঁজে বের করতে হবে। কীভাবে তার দেখা পাব আমি? এসব ভাবতে লাগলাম।
দিন পেরিয়ে রাত নেমে গেল। আমার ভাবনা গুলো আমার ভেতরে আরও প্রখর হলো। রাতের আকাশে অমাবস্যা। অন্ধকারে চারদিকে ছেয়ে আছে। এ আঁধার ঘুটিয়ে কখন আলোর খোঁজ মিলবে সেটাই ভাবছি। আপা যদি সত্যিই বেঁচে থাকে তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি অন্য কেউ হবে না। আচ্ছা আপার আত্মা কী ঐ মেয়েটা? ভাবনা গুলো যেন কোথায় থেকে গিয়ে কোথায় ডানা মেলছে তার অন্ত নেই। কখন যে ঘুমেরা এসে চোখে ডানা মেলল বুঝতে পারিনি।
পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। ঘরটাতে আর ভালো লাগছে না। তাই একটু হাত মুখ ধুয়েই বাইরে বের হলাম হাঁটতে। হাঁটতেই হাঁটতেই আবার আপাকে দেখলাম। আপাও হাঁটছে আমার পাশে পাশেই। এটা সেই মেয়েই যাকে সেদিন দেখেছিলাম। এই সুযোগ তার সাথে কথা বলার। আমি হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে তাকালাম। আচমকা তার হাতটা চেপে ধরলাম। বেশ উত্তেজিত আর অস্থির গলায় বললাম
“আপনি আমার বড়ো আপার মতো হুবুহু দেখতে। একটা মানুষের সাথে একটা মানুষের এত মিল কী করে হয়? আপনার সাথে আপার কোনো অমিল নেই। আমার আপা মারা গেছে বারোটা বছর হয়ে গেছে। তাহলে আপনি কে? কেনই বা আপনি আমার বাবাকে বলেছেন আপনি এসেছেন প্রতিশোধ নিতে? আপনি কী আপাকে চিনতেন? কে আপনি? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার আপার সাথে কী আপনার কোনো যোগসাজোগ আছে? প্লিজ বলেন।”
সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আমার হাতটা কী ঠান্ডা নাকি গরম?”
আমি তার হাতটা চেপে ধরে বললাম
“একদম ঠান্ডা।”
সে আরেকটু হেসে বলল
“জীবিত মানুষের হাত কী এত ঠান্ডা হয়? এখনও কিছু বুঝছিস না ফিয়না?”
আমি ভয়ে হাতটা ছেড়ে দিলাম। তাহলে সে কী আপার আত্মা? আমি ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম
“কে তুমি? আমার নাম জানলে কী করে? আমার আপার মতো সবকিছু।”
সে এবার হেসে জবাব দিল
“কাউকে কী পুরোপুরি কপি করা যায়। আমি তোর আপা। যাকে তুই জাম গাছে ঝুলতে দেখেছিলি। সেদিন আমার দেহটা দেখেছিলি কষ্টটা দেখিস নি। অন্তরটা কতটা বিক্ষত দেখবি?”
আমার ভয়টা আরও বেড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললাম
“মৃ/ত মানুষ ফিরে আসে কী করে? আপনি কে সত্যি করে বলুন।”
সে আবার জোর গলায় বলল
“আমিই তোর আপা। আমার বিক্ষত হওয়া ক্ষতটা দেখবি না? এই দেখ আমার ক্ষত।”
বলতেই তার মুখটা পুরোপুরি বিভৎস কালো হয়ে গেল। এত ভয়ংকর হয়ে গেল যে আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। বুকটা ধুকধুক করছে। তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। এসব ভেবে ঘুমিয়েছিলাম তাই এমনটা দেখেছি। আমার সারা শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠেছে। পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে আমি পানি খেলাম। পানি খাওয়ার পর ভাবতে লাগলাম এই কী স্বপ্ন দেখলাম আমি। সত্যিই কী এই স্বপ্নের কোনো ব্যখ্যা আছে৷ আমি আর ভাবতে পারলাম না। আবারও ঘুমিয়ে গেলাম।
সকাল ৯ টা বাজে। মা আমাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলল। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে। পাশের বাড়ির সোনিয়া গলায় দঁড়ি দিয়েছে, আমাদের বাসার সামনে থাকা আম গাছে। আমি দৌঁড়ে গেলাম সেখানে। মেয়েটি আমগাছে ঝুলছে। আমার আবার আপার কথা মনে হলো। তবে মেয়েটিকে দেখার পর আমার মাথায় অন্য একটা প্রশ্নের উদ্ভব হলো। এ মেয়েটার গলায় নিজের নখের দাগ। তার মানে মেয়েটা দঁড়ি দেবার পর নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। যতদূর জানি সকল গলায় দঁড়ি দেওয়া মানুষেই এ কাজ করে। কিন্তু আপার ক্ষেত্রে এমন ছিল না। আপার শরীরে কোনে নখ বা খামচির দাগ ছিল না। গলায় কোনোরকম দাগ ছিল না। তবে মাথার পেছনটা বেশ ফোলা ছিল। যতদূর বুঝতে পারছি হয়তো কেউ আপাকে জোরে আঘাত করেছে। তখন অল্প বয়স হওয়ায় এসব নিয়ে চিন্তাও করিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপাকে খু/ন করা হয়েছে৷ আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম খু/নের রহস্য আমি উদঘাটন করবই যে করেই হোক।
এর মধ্যেই পুলিশ এসে সোনিয়াকে নামাল। সোনিয়া বেশ চটপটা আর হাসিখুশি ছিল। তার সাথে আমার অন্তরঙ্গতা না থাকলেও পরিচয় ছিল ভালো। সে একটা ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসত। আর ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করে। এ বিষয়টা মানতে না পেরে আত্মহ/ত্যা করে। এ দুনিয়ায় এরকম হাজারও মেয়ে আছে যারা প্রিয়জন হারিয়ে জীবনমৃত হয়ে বসবাস করছে। দুনিয়াটা বড়োই অদ্ভুত। কিছু মানুষ হাজার হাজার টাকা খরচ করে সুস্থতার পেছনে,, বেঁচে থাকার জন্য। আর কিছু কিছু সুস্থ মানুষ নিজেকে শেষ করে দেয়.. না পাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য।
সোনিয়ার লাশটা পুলিশ নিয়ে গেল। সবকিছু যেন কাকতালীয় ভাবে পর্যায়ক্রমে হচ্ছে। এটা কীসের ইঙ্গিত? মায়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম মা কাঁদছে। অনেকদিন পর মাকে কাঁদতে দেখলাম। মাকে হালকা৷ গলায় জিজ্ঞেস করলাম
“কাঁদছো কেন?”
মা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বলল
“অনন্যার কথা খুব মনে পড়ছে। আমার মেয়েটাও তো এভাবে চলে গিয়েছিল। এভাবেই আমার মেয়েটা ঝুলেছিল। আমার মেয়েটাকে হারিয়ে কেমন লেগেছিল আমি জানি। তবে বাস্তবতা তো মেনে নিতেই হবে। আমরা তো দোষী ছিলাম ওকে বিয়ে দিয়েছি। তবে সে কী পারত না একটু রয়েসয়ে সংসার করতে। সংসার হয়নি ঠিক আছে তাই বলে এরকম করে আমাদের গ্রাম ছাড়া করবে। মেয়েটা মরেও আমাদের শান্তি দিল না।”
মায়ের কথা শুনে আমার গা টা আবার জ্বলে গেল। বজ্রকণ্ঠে বললাম
“ঘুরে ফিরে সব আপার দোষ। আর তোমরা তো দুধে ধুয়া তুলসি পাতা। আপার মরার জন্য তোমরা দায়ী। যত্তসব।”
কথাটা বলেই আমি হাঁটতে লাগলাম আনহারি ভবনের দিকে। আমার একটাই চিন্তা সেটা হলো যে করেই হোক আমি সেই মেয়ের সাথে দেখা করব। আমি জানব মেয়েটা কে? কে এই মেয়ে যে আমার আপার সকল কিছু বহন করছে। আমি চলে গেলাম আনহারি ভবনের কাছে। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। মেয়েটার নাম জানি না। তবে দেখতে অনেক সুন্দীর। চোখগুলো স্রোতসীনি হরিণের বাক। নাকটা বেশ খাড়া। আপা দেখতে যেমন ঠিক তেমনটায় বর্ণণা করেছি।
লোকটি এবার যে তথ্য দিল তা শুনে আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম।
[আমি ভীষণ ব্যস্ত তাই আজকের পর্বটা একটু বেশি ছোটো হয়ে গেল। এজন্য আমি দুঃখিত]
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার