#শারমিন আঁচল নিপা
আনহারির ফিংগার প্রিন্ট ম্যাচ করেছে। আগের ফিংগার প্রিন্ট এর সাথে এখনের টা হুবুহু ম্যাচিং। ভোটার আইডি কার্ড করার সময় সে এ ফিংগার প্রিন্ট দিয়েছিল। আজকে সেটার সাথে একদম মিলে গেছে। একজনের ফিংগার প্রিন্ট আরেকজন কপি করতে পারে না। সবকিছু মিলে বুঝায় যাচ্ছে এ মেয়ে আনহারি। তাহলে আমি এটা নিশ্চিত ঐদিন আমার বড়ো আপায় মারা গেছে। তবে দুই বছর আগে আমজাদ সাহেব কাকে মেরেছে সেটা এখনও ধোয়াশায় রয়ে গেছে। ডি এন এ টেস্টের আর দরকার পড়েনি। এতেই প্রমাণ হয় তারা দুজন এক।
আমি প্রবেশ করতেই আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন
“এই মেয়ে কে?”
লাবনী জোহা উত্তর দিলেন
“আনহারির বান্ধবী।”
আমজাদ সাহেব আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন। একে তো আমি বয়সে আনহারির অনেক ছোটো তার উপর ভালো কাপড়চোপড় পরা নেই। এমন মেয়ে কী করে আনহারির বান্ধবী হয় সেটাই হয়তো তিনি ভাবছেন। আমার দিকে কয়েকবার তাকালেন। তারপর ক্লান্ত একটা মন নিয়ে উনার রুমে চলে গেলেন। লাবনী জোহা আমাকে দেখে বললেন,
“আমি জানি না তোমার বোন কে? তার সাথে কী হয়েছিল। জানার আগ্রহও আমার নেই। কারণ এসব আমার ভীষণ প্যারা লাগে। আনহারিকে ফিরে পেয়েছি এটাই আমার জীবনের সব। বাকি সব আমার কাছে কেবল মলিনতা ছাড়া কিছু নয়। আনহারির যেহেতু জানার আগ্রহ আছে। তুমি আনহারিকে সবটা বলতে পারো। এ বিষয়ে আমি না জানলেও চলবে।”
বুঝতে পারলাম লাবনী জোহা আনহারিকে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর কিছুতে তার কিছু আসে যায় না। এদিকে আমার মনে অনেক কিছুই ঘুরছে। দুই বছর আগে কে মারা গেল। আনহারি আর বড়ো আপার মধ্যে এত সাদৃশ্য কেন। সবমিলিয়ে ভাবনার অতল গহ্বর থেকে যেন আমি বের হতে পারছি না।
লাবনী জোহা সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। আনহারি আমাকে ডেকে বলল
“আমার সাথে আমার রুমে এসো। এরপর নাহয় তোমার বড়ো আপার কথা শুনব। এখন আগে বলো কী খাবে? আমি মদিনাকে বলছি তা করে দিতে।”
আনহারির চারিত্রিক বৈশিষ্ট একদম মিশুক প্রকৃতির। এত বড়ো ঘরের মেয়ের ব্যবহার এত অমায়িক সেটা দেখে মনটা ভরে উঠল। বড়োলোকদের প্রতি একটা ধারণা আমার পাল্টে গেল। বুঝতে পারলাম সব বড়োলোক এক নয়। হাতের আঙ্গুল যেহেতু সমান না সেহেতু সব বড়োলোকের আচার ব্যবহারও সমান না। অনেকেই আছে দুলাভাইয়ের মতো নির্দয়, কঠোর আবার অনেকেই আছে আনহারির মতো স্নিগ্ধ, সজীব আর মিশুক।
আনহারির কথার প্রেক্ষিতে আমি বললাম
“আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। কিছুই খাব না। আপনার কিছু খেতে ইচ্ছা করলে খেতে পারেন। আমার জন্য ভাববেন না।”
“তা বললে হবে না। আচ্ছা তোমার জন্য মদিনাকে বলি গুড়ের পায়েস করে দিতে। এটা তো তোমার পছন্দ তাই না?”
আনহারির মুখে এ কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। উনি কী করে জানলেন আমার এটা পছন্দ। আমি আমতা আমতা করে বললাম
“আপু আপনি জানলেন কী করে এটা আমার পছন্দ? আমি তো আপনাকে বলিনি। বড়ো আপা জানত। বড়ো আপা তো গত হয়েছে সেই বারো বছর আগে। আর আপনার মা বলল আপনার জন্ম বিদেশে তাই আপনারা জমজ কেউ ছিলেন এটাও বলা যায় না। কারণ আমার বোনের জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আপনিই আমার বড়ো আপা। আর আপনার এ কথাগুলো আমাকে মনে করতে বাধ্য করে। আচ্ছা পূর্ণজন্ম বলে কী কিছু আছে?”
আনহারি আমার কথা শুনে হাসলেন। হেসেই জবাব দিল
“পূর্ণজন্ম বলতে কিছু নেই। আমি শুধু আন্দাজে এ কথাটা বলেছিলাম। আমার ভীষণ পছন্দ তো তাই। যাইহোক তোমার বড়ো আপা আমি নই তবে আমাকে ভাবতে পারো। যেহেতু দেখতে দুজন এক। আবার বলছো আচার আচরণেও বেশ সাদৃশ্য আছে। সুতরাং আমাকে বড়ো আপা বলেই ডেকো। এখন আমার রুমে এসো। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো। আর কত দাঁড়িয়ে থাকবে?”
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই আনহারির সাথে তার রুমে প্রবেশ করলাম। পুরো রুমটা সুসজ্জিত। আমি রুমের আনাচে কানাচে দেখতে লাগলাম ভালো করে। হঠাৎ করে আমার চোখ পড়ল একটা ময়ূরের পালকের উপর। এ পালকটা আমি বড়ো আপার কাছেও দেখেছিলাম। বড়ো আপা বলেছিল এটা তার ভীষণ প্রিয়। বইয়ে নাকি এরকম পালক রেখে দিলে নতুন পালক গজায়। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। যেখানে প্রমাণিত সে আনহারি সেখানে অনন্যা প্রমাণ করাটা বোকামি। তবে এ মেয়ের সবকিছু আমার বড়ো আপার সাথে মিলে। জমজ না হয়েও এতটা মিল আমি সত্যিই মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে এতে অনেক বড়ো রহস্য লুকিয়ে আছে তবে রহস্য ভেদ করতে পারছি না। আমি কেবল চুপ হয়ে বসে পড়লাম। মনের ভেতরে থাকা প্রশ্ন গুলো মনের মধ্যেই গেঁথে রাখলাম। এর মধ্যেই আনহারি বলে উঠল
“এবার তোমার বড়ো আপার কাহিনি বলো কী হয়েছিল।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। তারপর হালকা গলায় প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলে উঠলাম। আপা কীভাবে মারা গেল। আপার কেন জানাজা হলো না। আমরা কেন গ্রামে থাকতে কেন পারলাম না। নিজেদের একটা ভিটা থাকার পরও কেন ভোগ করতে পারলাম না।
সব শুনার পর আনহারির চোখের জল থই থই করছিল। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম। গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের উল্টে পিঠ দিয়ে মুছে নিল। তারপর হালকা গলায় বলল
“আমিও চাই তোমার বড়ো আপার খুনীদের শাস্তি হোক। তোমার বড়ো আপা আত্মহত্যা করলেও এ খুনের জন্য পরোক্ষভাবে তারা দায়ী। আর এমনও হতে পারে তাকে খু/ন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বিষয়টা একটু ঘাটা দরকার। অপরাধীর শাস্তি পাওয়া দরকার। তবে আমি কোনো পুলিশ বা কিছু নিয়ে যাব না। তিলে তিলে মারব।”
আনহারির কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“তিলে তিলে মারবেন মানে?”
“মানে তারা যেন আতঙ্কে থাকে, ভয়ে থাকে। আমি সেখানে অনন্যা সেজেই যাব। আর বলব সেদিন যে খুন হয়েছিল সেটা অনন্যা না অন্য কেউ। দাবার কোর্টে রাজাকে যেভাবে চেক দেয়। আমিও ঠিক সেভাবেই তাদের চেক দিব।”
আমি আর কোনো মতামত দিলাম না। এটাই হয়তো বেষ্ট হবে। আমি কেবল মাথা নাড়লাম। দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম কালকেই কুঁড়গাও যাব। দীর্ঘ বারো বছর পর সে গ্রামে পা রাখব ভাবতেই যেন মনটা উতলা হয়ে যাচ্ছে। আপার করবটা দেখতে পারব। আপার স্মৃতি জড়িত জায়গা গুলো স্পর্শ করতে পারব। এটা ভেবেই আমার ভেতরটায় অদ্ভুত একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বুকটা ফেটে কান্না আসছে৷ আপাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে ঝেঁকে ধরেছে। আমি কেন জানি না নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আনহারিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।
কান্নার এক পর্যায়ে মদিনা প্রবেশ করায় আমি থেমে গেলাম। গুড়ের পায়েস চলে এসেছে। পায়েস খাই না অনেকদিন হয়ে গেল। মা রান্না করে না। অভাবের সংসারে এতকিছু হয়ে উঠে না। আনহারি মদিনার থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। এবং সে তার নিজের জন্যও এক বাটি পায়েস নিল। তারপর মদিনাকে বিদায় করে দিল। আমি চামচ দিয়ে পায়েসটা মুখে নিলাম। নিজের পছন্দের খাবার টা খেয়ে যেন তৃপ্তি অনুভব করলাম। কার রিজিক কখন আল্লাহ কোথায় লিখে রাখে… এটা বুঝা সত্যিই অনেক কঠিন। দুদিন আগে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এখানে এসে কিছু খাব।
এসব ভাবতে ভাবতে কয়েক চামচ মুখে নিয়ে আনহারির দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম এটা কী দেখছি। এটা সত্যিই নাকি আমার মনের ভুল?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার