#শারমিন আঁচল নিপা
আনহারির সোজা সাপটা উত্তর
“সেটা তো আপনারা খুঁজে বের করবেন। আমরা তো কেউ বলতে পারব না। যার মালিকানায় গাড়ি সে তো এখন মৃত। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় মালিহা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। নাহয় আমিই তাকে জেলে পঁচিয়ে মারতাম। আমার মায়ের সাথে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতাম। আপনার যদি আরও কিছু বলার থাকে বলতে পারেন। আপাতত এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাচ্ছি না আমি।”
আলবিদ সাহেব আনহারির কথা শুনে তাকেই সন্দেহের প্রথম তালিকায় রাখছেন সেটা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তবে তথ্য প্রমাণের অভাবে কিছুই করতে পারছেন না। তিনি কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আনহারিকে জিজ্ঞেস করলেন
“যতদূর জানি আপনি দুই বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন। মর্গে আপনার লাশের ময়না তদন্তের রিপোর্টও আছে। ডেড সার্টিফিকেটও আছে৷ তাহলে আপনি কে?”
আনহারি কপালটা কুচকে জবাব দিল
“আমার ফিংগার প্রিন্ট ম্যাচ করেছে। আমার সিগনেচার ম্যাচ করেছে তাহলে আমি কী করে মৃ/ত হই। আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আমার মা আমাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে ১ মাস। আমি সুস্থ হওয়ার পর শুনি আমার লা/শ দাফন হয়ে গেছে। আমাকে মৃত হিসেবে সবাই জানে। আমারও বেশ অভিমান চাপে। মাকে বলেছিলাম এখান থেকেই আমি অন্য দেশে যাব। তারপর সেখানে পড়াশোনার শেষ করে দুই বছর পর আসব। বাবার উপর অভিমান ছিল বলে মা কে বলেছিলাম আমার ব্যাপারে বাবাকে যেন কিছু না বলে। কারণ বাবা কাকে না কাকে দাফন করে ফেলল নিজের মেয়ে বেঁচে থাকার পরও । তাই বাবাকে মেয়ে হারানোর যন্ত্রণা বুঝাতে চেয়েছিলাম। তবে এখন বুঝতে পারলাম তার কোনো যন্ত্রণা হয়নি বরং রাশলীলা কাজ করেছে তার মনে। আমি মৃত নই। তখন কাকে মৃত বলে আমার বাবা চালিয়েছে সেটার খোঁজ নিন আপনারা। আমাকে এ বিষয়ে আর জড়াবেন না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।”
শেষের কথা গুলো বেশ জোরে জোরে বলে সে জোরে দম নিতে লাগল। আলবিদ সাহেব আনহারিকে শান্ত করার জন্য বলল
“আপাতত আর কেনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। ঘটনার রহস্য ভেদ করেই যোগাযোগ করব আবার।
ভালো থাকবেন।”
আলবিদ সাহেব চলে গেলেন। আমি আনহারির পাশে গিয়ে তাকে স্পর্শ করলাম। আমার স্পর্শ পেয়ে সে কেঁদে দিয়ে বলল
“আমি তো এসব জানাতাম না কিছুই। বাবা কেন মরল? কীভাবে মরল? তারপরও আমার দিকে কেন প্রশ্ন ছুড়া হচ্ছে। আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি। আর ভালো লাগছে না। ছন্নছাড়া লাগছে। যতই হোক তিনি আমার বাবা ছিলেন। খারাপ তো লাগছেই আমার। নিজের বাবা খারাপ হলেও হত্যা করা যায় না ফিয়না। অথচ দেখো বাবার মৃ/ত্যুর দায়টা ঘুরে ফিরে আমাকেই দেওয়া হচ্ছে।”
আনহারির কথা শুনে আমি নিজেও একটা অনুসূচণায় ভুগতে লাগলাম। এখন কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না আনহারি আমজাদ সাহেবকে খুন করেছে। বড়ো আপাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে জীবনের মোড় এমন বাঁকে এসে থামবে কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। আমি রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আরও রহস্যে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমি আনহারিকে স্বান্ত্বণা দেওয়ার ভাষা পেলাম না। চুপ করেই তাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি এমনিই ঠান্ডা হয়ে গেল। আনহারির বাবার মৃ/ত্যুর খবর তাদের আত্মীয় স্বজন জেনেছে অনেক আগেই। তবে বেশির ভাগ আত্মীয় দেশের বাইরে থাকায় আসতে পারেনি। আর সব আত্মীয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক ও এত গভীর না। তার কোনো মামা নেই। নানা, নানী মারা গেছে অনেক আগে। তার বাবারও কোনো চাচা নেই। এক ফুফু ছিল সেও করোনায় মারা গেছে। আনহারির খালা কানাডায় থাকেন। সব মিলে মৃত বাড়ি হলেও বাড়িটা একদম নীরব। মনে হচ্ছে বড়োলোকদের মধ্যে আত্মীয়তা ভাবটা ভীষণ কম। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত হলে এতক্ষণে বাড়িঘর ভরে যেত। সবাই মিলে কান্নার রোল পড়ত। একে অপরকে স্বান্ত্বণা দিত। কেউ কেউ আবার রান্না করে নিয়ে আসত।
আনহারিও আরও একটু স্বাভাবিক হলো। স্বাভাবিক হয়ে মদিনাকে ডেকে বলল কিছু খাবার যেন কাউকে দিয়ে কিনে আনে। মদিনা মাথা নেড়ে টাকা নিয়ে খাবার কিনতে গেল। সে নিজে যাবে না। বাইরে অনেক কাজের মানুষ আছে সেখান থেকে কাউকে পাঠাবে। এখানের প্রতিটা কাজের লোক একদম নিশ্চুপ। বড়োলোকদের ব্যাপারে তারা যেন নির্বাক। তাদের কাজ নিয়েই তারা ব্যস্ত। আনহারি সোফাতে বসলো। আমিও পাশে বসলাম। সে হালকা গলায় বলল
“মদিনা যা আনবে খেয়ে নিও। না খেলে তোমার শরীর খারাপ করবে। মা উঠলে মাকেও খাইয়ে নিব।”
আমি কথার প্রতি উত্তরে বললাম
“আপনিও কিছু খেয়ে নিয়েন।”
“খেতে তো হবেই। দুনিয়া তো কারও জন্য থেমে থাকে না। ময়না তদন্তের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। না জানি বাবাকে কেমনে কাটা ছেড়া করছে।”
বলেই হালকা কেঁদে দিল। সব মিলে যেন তার ভেতরে হাহাকার টা এখন বাইরে আসতে লাগল। সকালের আনহারি আর এখনের আনহারির মধ্যে বিস্তর তফাৎ।
গোটা একটা দিন কেটে গেল। আমজাদ সাহেবের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ময়না তদন্তে তার আত্মহত্যায় এসেছে। সে সকাল ৫ টা নাগাদ গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তার মোবাইল কনভারসেশন ঘেটে বুঝা গেল সে মালিহার সাথে শেষ যোগাযোগ করেছে রাত তিনটেয়। মালিহার জন্য সে নিজেই ট্রাকে করে সাদা গাড়িটা গিফট পাঠায়। গাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেপিং করে গিফট পাঠায়। তাই ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় গাড়িটা। রাত হওয়ায় সিসি ক্যামেরায় ট্রাকের নম্বর পাওয়া যায়নি। তবে ট্রাক কে চালিয়েছে সেটা পাওয়া গেছে। রাতে আমজাদ সাহেব নিজেই সে লোককে ২০ হাজার টাকা দিয়ে গাড়িটা নিয়ে মালিহার বাসায় পাঠাতে বলেছে আর্জেন্ট। আর একটা শর্ত দিয়েছে গাড়িটা সাজিয়ে পাঠাতে হবে। ট্রাক ড্রাইভার ও সে অনুযায়ী কাজ করে। এখানে তার কোনো দোষ না পাওয়ায় সাধারণ জিজ্ঞাসা করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মালিহার একটা গোপন ভিডিও আসে রাত ২ টা ৩০ মিনিটে। যে নম্বর থেকে আসে সেটাও মালিহার নামে রেজিস্টার করা। ধারণা করা গেছে মালিহার সাথে রাত কাটানো ছেলেটায় ভিডিও টা পাঠিয়েছে। ছেলেটার খোঁজ এখনও মিলেনি৷
ভিডিও দেখেই হয়তো মালিহাকে খুন করার জন্য গাড়ির ব্রেক কেটে তাকে গিফট করেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে খুন করার প্ল্যান করে নিজেও জীবন দিয়েছে।
এতটুকুই ধারণা এবং তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করা গেছে। আমি এসব শুনে ভাবতে লাগলাম মানুষের ধারণা আর সত্যের মধ্যে কত ফারাক। অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি আমজাদ সাহেব গাড়ির ব্রেক কেটেছে আনহারিকে মারার জন্য। অথচ সকাল হতে না হতেই ঘটনার কী রোমাঞ্চকর মোড় নিল। মন চাচ্ছে মুখ ফুটে আমি সবটা বলি। তবে সাহসে কুলাচ্ছে না। থানা পুলিশ আমি ভীষণ ভয় পাই।
আলবিদ সাহেব আনহারিকে সকল তথ্য দিয়ে লাশ হস্তান্তর করে চলে গেলেন। আমজাদ সাহেবের লাশ দাফনের জন্য কবরস্থানে নেওয়া হলো। স্বাভাবিক নিয়মেই তার লাশ দাফন হলো। অথচ আপার লাশটা জঙ্গলে কবর দিতে হয়েছিল। সে করুন দৃশ্য আমার চোখে ভাসতেই আমার চোখ গড়িয়ে পানি নামে। টাকার কাছে যেন সবাই নত হয়।
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেল। লাবনী জোহা তার স্বামীর মৃত্যুতে যতটা না কাঁতর তার চেয়ে বেশি কাঁতর তার স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায়। পরিস্থিতি এখন অনেকটা স্বাভাবিক। আমার পরিবারের সাথে আমার যতবার কথা হয়েছে আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলেছি। তাদের বুঝিয়েছি আমি আমার চাকুরীর জায়গায় ভালো আছি।
এবার আমাদের কুড়গাঁও যাওয়ার পালা। কাল সকালেই কুঁড়গাও যাওয়ার জন্য রওনা দিব আমরা। পরিকল্পনা তো আগেই সেট ছিল এখন একটু মডিফাই করা হয়েছে কেবল। আমার মনে এটাই বাজছে আপার ছবিটা যে পাঠিয়েছি সে কী এখন কুড়গাঁও আছে? তার নাম কী? সেখানে গেলে কী তাকে খুঁজে পাব? আনহারিকে গ্রামের মানুষ দেখে কীভাবে নিবে? কী হবে? আপার অত্যাচারকারীরা কেমন আছে? গ্রাম টা কী আগের মতোই আছে?
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল টা শুরু হলো এক কাপ চা দিয়ে। চা, নাস্তা করে লাবনী জোহাকে বলে আমরা বের হলাম। গাড়িটা রওনা দিয়েছে কুড়গাঁও এর দিকে। ঠিক সে সময়েই গাড়ির পাশ ঘেষে সেই কালো বিড়ালটা দৌড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল। আমার ভেতরে প্রশ্ন জাগল এ বিড়ালটাকে কেন আমি বারবার দেখছি? এটা কিসের সংকেত?
ঠিক তখনই গাড়িটা চলতে শুরু করল। আর….
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার