#শারমিন আঁচল নিপা
তবে বিড়ালটাকে আবার গাড়ির সামনে দেখলাম। একইভাবে এসে মিলিয়ে গেছে। কতশত প্রশ্ন মনে আসছে তবে সেটাকে একদম পাত্তা দিলাম না। পাত্তা দিলেই প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে যাব তাই। নিজেকে সামলে নিলাম। গাড়িটা আপন গতিতে চলছে। ঢাকা থেকে কুড়গাঁও বেশ দূরে। সীমান্ত ঘেষে কুড়গাঁও গ্রামের অবস্থান। বেশ সাজালো গুছালো পরিপাটি গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ লোকেই গরীব। দুলাভাইরাই ছিল গ্রামের সবচেয়ে ধনী লোকদের মধ্যে একজন। তবে আপার সুখ মেলে নি। টাকায় কখনও সুখ হয় না। সুখ কপালে থাকা লাগে। সুন্দরী মেয়ের কপাল যে সুন্দর হবে তার কোনো ভরসা নেই। জগতে অনেক কালো মেয়েকে দেখেছি বড়ো ঘরে বিয়ে হতে, স্বামীর ভালোবাসা পেতে, শ্বশুড়বাড়ির সম্মান পেতে। কিন্তু অনেক ফর্সা, সুন্দর মেয়েকেও দেখেছি বড়ো আপার মতো যন্ত্রণা পেতে।
এ সমাজে আরেকটা ভুল প্রচলিত। সবাই মনে করে মেয়ে ফর্সা মানেই কপাল ভালো। ভালো ঘরে বিয়ে হবে। কালো মানেই এ মেয়েকে নিয়ে অনেক ভুগতে হবে। অথচ কপাল আল্লাহ লেখেন। সুখ, দুঃখ কালো ফর্সায় হয় না। বিয়েও কালো, সাদার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে আল্লাহর উপর। যার রিজিক যেখানে আছে সেখানেই হবে। এটা নিয়তির লেখা। এটা খন্ডানো যাবে না। এই যে আমি দেখতে দুধে আলতা। আমার গায়ের রঙ একদম ফর্সা। পড়াশোনায়ও ভালো আমি। রেজাল্টও ভালো আমার। চাকুরির প্রস্ততি নিচ্ছি, চাকুরি হয়তো হয়েও যাবে। তবে এ সব গুলো গুণ ঢাকা পড়ে গেছে আমার বড়ো আপার মৃ/ত্যুকে ঘিরে। মনে হচ্ছে বড়ো আপার ডিভোর্স মৃ/ত্যুটা ভুল। অথচ যারা বড়ো আপার এ হাল করেছে তারা দিব্যি ভালো আছে। তাদের কোনো ভুগান্তি নাই। ভুগান্তি যেন সব আমাদের।
ভাবনায় ছেদ পড়ল গাড়ির জোরে ব্রেকে। আনহারি এতই জোরে ব্রেক কষেছে যে আমি সামনের দিকে হেলে পড়েছি। হঠাৎ এত জোরে ব্রেক কষার কারণ খুঁজতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সামনে একটা কালো কুকুর ছিল। আর সেটাকে বাঁচাতে গিয়েই সে এত জোরে ব্রেক কষেছে৷
আনহারি গাড়ির ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে বসে রইল স্থির হয়ে কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“ব্যথা পেয়েছো?”
আমি কেবল মাথা নেড়ে না করলাম। সে আমাকে পুনরায় বলল
“অনেকক্ষণ হলো কিছু খাইনি। আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। যতদূর বুঝতে পারছি এটা একটা বাজার। এখানে হয়তো খাবার দোকান থাকবে। চলো গাড়ি থেকে নেমে কিছু খেয়ে আসি আগে। এরপর আবার রওনা দিব।”
আমিও সম্মতি দিয়ে বললাম
“হুম চলেন আপু।”
দুজনেই গাড়ি থেকে নামলাম। এ রাস্তা দিয়ে আমি বারো বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম আর বারো বছর পর এখন আসলাম। কিছুই চিনি না আমি এখানের। শুধু চারপাশটা দেখতে লাগলাম। বাজারটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দোকানগুলো বেশ সাজানো গুছানো। আনহারি বলে উঠল
“এ গ্রামের মানুষ বেশ স্মার্ট তাই না? কত সুন্দর করে সবকিছু পরিষ্কার রেখেছে। সচরাসচর গ্রামের বাজারগুলো এত পরিষ্কার হয় না। আমি তো মোটামুটি অনেক গ্রামেই ঘুরেছি। বাজারটা বেশ ভালোই লাগছে কী বলো?”
উত্তরে আমি বললাম
“আপু আমাদের গ্রামটাও পরিপাটি ছিল। এখন জানি না কেমন আছে। বারোটা বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে হয়তো।”
“বারো বছরের মধ্যে কখনও ঐ গ্রামে যাও নি?”
“না আপু যাইনি। এত অপমান করেছে যে ঐ গ্রাম আমরা যাওয়ার সাহসেই পাইনি। আপনি পাশে আছেন বলে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি। নাহয় হয়তো আপার জন্য আমার মনটা কুড়ে কুড়ে ক্ষত হত কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়া হত না। সবাইকে যোগ্য শাস্তি দেওয়া হত না।”
আনাহরি হাত দিয়ে সমানের দিকটা নির্দেশ করে বলল
“চলো ঐ খাবারের দোকানটায় বসি। তারপর কিছু অর্ডার করি। যা পাই তাই খেয়ে নিব।”
আনহারি আর আমি দুজনেই খাবারের দোকানটায় বসলাম। এর মধ্যেই মাঝ বয়সী এক লোক এসে আনহারিকে বলে উঠল
“অনন্যা মা কেমন আছো? পাঁচ বছর আগে তুমি যে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলে সেটা দিয়েই আমাদের এ হোটেলটা এত বড়ো হয়েছে। বাজারের সবচেয়ে ভালো হোটেল এটা। তোমার নামেই নামকরণ করেছি। তোমার সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি তবে তুমি আমাকে ঠিকানা বা যোগাযোগ রক্ষা করার মতো কিছু দাওনি বলে পারিনি।”
লোকটির বয়স চল্লিশের উর্ধ্বে হবে। মাথায় কাঁচা পাকা চুলের সন্নিবেশ। একটি হাত নেই। এক হাতেই তিনি পুরো হোটেল পর্যবেক্ষণ করছেন। অবশ্য কয়েকজন কর্মচারীও রেখেছেন। আমি লোকটির কথা শুনে হোটেলের সাইনবোর্ডটা লক্ষ্য করে দেখলাম তাতে লেখা
“অনন্যা বিলাস বাঙ্গালি রেস্তোরা”
আমি চমকে গেলাম লোকটি আনহারিকে অনন্যা ডাকাতে। লোকটি যদি আনহারি ডাকত তাহলে আমার মনে কোনো সংশয় বা প্রশ্ন আসত না। কারণ আনহারি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে। তার পক্ষে এখানে এসে ঘুরে কাউকে ৫০ হাজার দিয়ে সাহায্য করাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আনহারিকে অনন্যা বলাতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে। আনহারি কী করে অনন্যা হয়? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার মাথায়।
আমার মাথায় কেবল বাজছে,
বারো বাছর আগে কে মারা গেল? দুই বছর আগে কার এক্সিডেন্ট হলো? মালিহার কাছে সাদা গাড়িটা কীভাবে গেল? আমজাদ সাহেব কীভাবে মারা গেল? আর এ আনহারিই বা কে? সে কী অনন্যা?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি কবে পাব জানি না। এর মধ্যেই আনহারি চাচাকে বলে উঠল
“আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আনহারি। অনন্যা আমার নাম নয়। অনন্যা হয়তো আপনাকে সাহায্য করেছে। সে ও দেখতে আমার মতো। আর আমি তো এ গ্রামে এ প্রথম এসেছি। আপনি হয়তো ভুল করছেন। এটা হলো অনন্যার বোন।”
চাচাও চুপসে গেল আনহারির কথা শুনে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“ওহ আচ্ছা। দুজন দেখতে একই রকম তো তাই হয়তো ভুল করে ফেলেছি।”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“তোমার বোনকে অবশ্যই নিয়ে আসবে। অনন্যা বিলাসে খাওয়া তার হক। আমি তোমার বোনকে একটা বেলা খাওয়াতে চাই। একহাত না থাকায় কেউ কাজ দিচ্ছিল না। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছি। তখন তোমার বোনের কাছে ভিক্ষা চাওয়ায় রেগে যায়। সে আমাকে ভিক্ষা দেয় নি৷ কতগুলো কথা শুনিয়ে আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল। আর বলেছিল মানুষের কাছে চেয়ে খাওয়ার চেয়ে কিছু করে খাওয়া শ্রেয়। এ টাকায় যা পারেন করবেন। নিজে কিছু করে খাবেন।”
তার কথাগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আজ আমার এ হাল। এখন আমার দোকানেই কাজ করে মানুষ। এ পরিবর্তন আল্লাহ তোমার বোনের হাত দিয়েই করেছে।
যাইহোক তোমার বোনকে আমার সালাম দিও। আমি তোমাদের জন্য আমার রান্না করা স্পেশাল হাঁসের মাংস, গরুর কলিজা ভুনা নিয়ে আসছি। “
কথাগুলো বলে তিনি চলে গেলেন। আমি আনহারির দিকে তাকিয়ে বললাম
“আপু আমার বোন তো বারো বছর আগে মারা গেছে। তাহলে সে কী করে পাঁচ বছর আগে সাহায্য করবে? আর আমরা তো হতদরিদ্র ছিলাম। আমাদের পক্ষে কী ৫০ হাজার দিয়ে সাহায্য করা সম্ভব। আপনি কোনোভাবে তাদের সাহায্য করেছিলেন? হয়তো আনহারি শুনতে গিয়ে তারা অনন্যা শুনেছে। যেহেতু দুটি নামের শব্দ প্রায় পাশাপাশি।”
আনহারি মাথা নেড়ে বলল
“এত চিন্তা কেন করো তুমি? আমি যখন বলেছি এ গ্রামে আমি আসিনি তার মানে আসিনি। আমি একটা কাজ করব সেটা তো আমার নাম নিয়ে তাই না? অনন্যার নাম নিয়ে কেন করব? আর অনন্যাকে তো আমি চিনতামেই না। তোমার মাধ্যমে চিনেছি। সে যাকেই দেখুক দেখেছে৷ হতে পারে আমাদের পথভ্রষ্ট করার জন্য শত্রুপক্ষ এমন করছে। এসব বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে যা খাওয়ার সেটা খেয়ে চলো। যত বেশি চিন্তা করবে তত বেশি বিষয়গুলো এলোমেলো লাগবে।
চাচার নাম খয়বর আলী। খয়বর আলী তার এক হাত দিয়েই আমাদের জন্য খাবার পরিবেশন করছে বেশ উৎসাহ এবং ভালোবাসা নিয়ে। তার এ আবেগে আমি কোনো কমতি দেখছি না, মিথ্যা দেখছি না। আমি যতই ভাবছি ততই গুলিয়ে ফেলছি সব। খয়বর আলী সব এনে আমাদের সামনে দিয়ে বলল
” আরও কিছু লাগলে বলবেন।”
আনহারি হেসে জবাব দিল
” এ খাবারেই তো খেতে পারব না।”
আমি খাওয়া শুরু করলাম। সে ও শুরু করল। খাওয়াটা বেশ মজার ছিল। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে অমৃত খাচ্ছি। আমি বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। আনাহারির ক্ষত্রেও তাই। খাওয়া শেষে আনহারি বিল দিতে নিলে তারা বিল নেয় নি। জোর করেও তাদের দেওয়া যায়নি। তাই বিল না দিয়েই আমরা চলে আসলাম। গাড়িতে উঠে আবারও রওনা দিলাম কুড়গাঁও এর পথে।
গাড়িটা চলতে চলতে কুড়গাঁও এ থামলো সন্ধ্যায়। গ্রামটা একদম বদলে গেছে। পুরো গ্রামের হালতেই বদলে গেছে। আনহারি আর আমি গাড়ি থেকে নামতেই মাগরিবের আযান পড়ল। আর সে সাথে গল্পের নতুন মোড় নিল।
শারমিন আক্তার