#শারমিন আঁচল নিপা
বুঝতে পারলাম কলিংবেল চাপছে কেউ। আনজুমানের চুলগুলো ছেড়ে দিল আনহারি। আনহারি আমাকে ইশারা দিয়ে বলল দরজার খোলার জন্য। আনজুমান মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে গেলাম দরজার দিকে। দরজা খুলতেই আমার চারপাশটায় হিমেল বাতাস বইতে লাগল অফিসার মাহিদকে দেখে। চোখ শীতলকারী মানুষ আমার সামনেই দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে হার্টবিটের স্পন্দন দ্রূত হচ্ছে। মনের ভেতর জলোচ্ছাস বয়ে চলছে। সমুদ্রের আঁচড়ে পড়া ঢেউগুলো ভীষণভাবে হানা দিচ্ছে। নড়বার শক্তিও যেন পাচ্ছি না। সারা শরীর হালকা বৈদ্যুতিক শকের মতো কেঁপে উঠল। গায়ের লোমগুলো এ গরমেও দাঁড়িয়ে গেল। জিহ্বাও নড়ছে না। প্রথম দেখায় কী সত্যিই ভালোবাসা হয়? এটা কী আমার ভালোবাসা নাকি আমার নেশা। মাতালের মতো লাগছে কেন এত? বেহায়া দৃষ্টি কেন বারবার তার দিকে তাকিয়ে থাকতে চায়। এ মন কেন তাকে ঘিরেই ভাবতে চাচ্ছে৷ বাংলা সিনেমার মতো গান বেজে উঠছে মনে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি আর সে সুখের কাব্য রচনা করব। আগে যখন বাংলা সিনেমা দেখতাম তখন ভাবতাম সুখ বা দুঃখের মুহুর্তে গান আনার কী দরকার? এখন মনে হয় এ গানটায় হলো সে সিনগুলোর মূখ্য প্রতিফলন। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। মাহিদ সাহেব আমার দিকে কপাল কুচকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন
“এক্সকিউজ মি! কী দেখছেন এভাবে? কিছু বলবেন?”
আমি একটু নড়েচড়ে গেলাম। ভাবনা আর কল্পনার রোমাঞ্চকর মূহুর্ত থেকে বের হয়ে আসলাম। খানিকটা স্বাভাবিক হলাম। নিজের আসন্ন আবেগটাকে দমিয়ে নিয়ে বললাম
“না কিছু না। আমি হুট করে আপনার দিকে তাকিয়ে একটা চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলাম। আপনি এ সময় আবার আসলেন? কিছু দরকার?”
“ফিংগার প্রিন্ট নিতে এসেছি দীপক এবং অনন্যার। আচ্ছা আপনি অনন্যার কে হন?”
মাহিদ সাহেবের এ প্রশ্নের উত্তর আমি কী দিব বুঝে উঠার আগেই আনহারি পাশ থেকে বলে উঠল
“আমার পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট। কেন কোনো সমস্যা?”
মাহিদ সাহেবর উত্তর
” নো। ওর নাম কী?”
“ওর নাম ফিয়না। ওর বাসা ঢাকায়। আর কিছু জানার আছে এ বিষয়ে? থাকলে সোফায় বসুন বলছি। আর আমাকে কী করতে হবে বলুন। দীপক ঘরেই আছে তাকে ফিয়না ডেকে নিয়ে আসতেছে।”
অফিসার মাহিদ সোফায় বসলেন। আনহারিও সোফায় বসলো। আনাহারি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“দীপককে ডেকে নিয়ে এসো তো।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম শুধু। এ জায়গা থেকে একদম নড়তে মন চাচ্ছে না। চুম্বকের মতো এ জায়গাটা আমাকে আকর্ষণ করছে। এ আকর্ষিত বল ত্যাগ করে দীপকের রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। মনে হচ্ছে মাহিদ ইলেক্ট্রন আমি প্রোটন আর নিশ্চল ভাবে বসে থাকা আনহারি নিউট্রন। তার মধ্যে কোনো আকর্ষণ বিকর্ষণ কোনো কিছুই কাজ করছে না। অপরদিকে ইলেকট্রনের প্রবল আকর্ষণ ভেদ করে প্রোটন যেন এ বলয় ত্যাগ করতে নারাজ। তবে বাইরে থেকে এক বিশেষ বল বাঁধা দেওয়ার দরুণ আমাকে বাধ্য হয়েই দীপকের রুমের দিকে এগুতে হলো।
আমি দীপক ভাইয়ার রুমের সামনে যেতেই বুঝলাম পিয়ালি আর দীপক কথা বলছে। দীপক বেশ রেগে রেগেই পিয়ালিকে বলছে
“এতগুলো বউ খু/ ন করতে পরেছি তোকেও খু/ন করতে আমার সময় লাগবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর অবস্থাও তৃণার মতো হবে। তোকে যদি দেখেছি এ চৌকাঠ পার হতে তোর খবর আছে। এ রুমের ভেতর তুই বসে থাকবি। ঐ মেয়ের ধারে কাছে যাবি না একদম। জানে মেরে ফেলব। আর ঐ মেয়েকে আবার জানে মারতে কী করা লাগে সেটা আমি দেখতেছি। একবার মা/রার পরও যখন বেঁচে গেছে। দ্বিতীয়বার মা/রার পর যেন বেঁচে না থাকে সে ব্যবস্থায় করব। “
দীপকের কথা শুনে আমি আরেকটা রহস্যে ডুবে গেলাম। তার ভাষ্য অনুযায়ী বুঝা যাচ্ছে বারো বছর আগে সে অনন্যাকে খু/ন করেছে। তাহলে আমার বোন আত্ম/হ/ত্যা করেনি। তবুও বিনা কারণে সে জানাজা পেল না। এ কথা আমি প্রমাণ ছাড়া সবার সামনে বলতে পারব না। তবে আনহারিকে এ বিশেষ তথ্যটা দিতে হবে। এখন হাতে পাওয়া সকল ক্লু মাথায় রেখে এগুতে হবে। দীপকের কথা শুনে পিয়ালি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। পিয়ালির বসার ধরণ দেখে আপার কথা মনে পড়ে গেল।
সেদিন আমি এসেছিলাম আপার বাড়িতে মেহেদী পাতা নিয়ে। মাকে অনেকবার বলেছিলাম একটু পাতা বেটে হাতে দিয়ে দিতে। মা নানান অজুহাতে আর দেয়নি। এদিকে ছোট্ট আমার মধ্যে মেহেদী পরার অস্থিরতা ঝেঁকে বসেছে। আমি ঠিক তখন কাউকে কিছু না বলে আপার বাড়ি চলে আসি। আপার বাসায় আসার পর আপার ঘরে ঢুকার সময় খেয়াল করলাম দুলাভাই আপাকে মারছে। মারার কারণ হলো আপা কেন সময় মতো চা দেয় নি। একে তো চা দিতে দেরি করেছে তার উপর চায়ে চিনি দিয়ে পরিবেশন করেছে। আর এটা নাকি আপার শ্বাশুড়িকে মারার জন্য এমনটা করেছে। আপার শ্বাশুড়ির অভিযোগ এটাই ছিল। কারণ উনার ডায়বেটিস ছিল। আপা সেদিন মাইর খেয়ে ঠিক এভাবে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। কারণ চোখের পানিও আপার কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গিয়েছিল। শরীরও মার খেতে খেতে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে বিনা কারণে আপাকে মার খেতে দেখে আমি আর সেখানে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। সেদিন মাকে বাড়ি ফিরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম
“মা দুলাভাই আপাকে অনেক মেরেছে। তুমি একটু গিয়ে দুলাভাইকে কিছু বলো। আপা তো ইচ্ছা করে এমন করেনি। চায়ে চিনি দেওয়ার জন্য আপাকে মেরেছে। আপার অনেক কষ্ট হচ্ছে মা।”
মায়ের উত্তর ছিল
“শ্বশুড়বাড়িতে গেলে এমন একটু আাধটু সয়ে নিতে হয়। তুই আবার ঐ বাড়িতে কেন গিয়েছিলি? তোকে না নিষেধ করেছি আমি.. ঐ বাড়িতে যখন তখন যাবি না।”
এই বলে মা আমার গালে থাপ্পর কষিয়ে দিল। অথচ মা হয়ে মেয়ের কষ্টটা মাকে স্পর্শ করেনি। সয়ে নেওয়ার নাম করে যে একটা মেয়েকে দিনের পর দিন জীবন্ত লা/শ বানিয়ে ফেলে সেটা পরিবার বুঝে না। কেনই বা মেয়েদেরকেই সব সয়ে নিতে হবে। সমাজের নিতীটা বেশ অদ্ভুত। নীতির বিপরীতে গিয়ে যদি কোনো মেয়ে কিছু করতে চায় তাহলে সে মেয়ে হয়ে যায় নষ্টা বে/শ্যা। এটাই আমাদের সমাজ। আর এটাই সমাজের মানুষের আচরণ।
এসব চোখে ভাসতেই চোখের কোণে এক বিন্দু জল নেমে আসলো। আমি নিজেকে দ্রূত সামলাম। দীপক ভাইয়া সিগারেট টানছে আর ঘরে পায়চারি করছে। আমি তাকে কী বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না। এ মুহুর্তে নাম ধরে ডাকাটায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি উত্তম মনে হচ্ছে। তাই নাম ধরে ডেকে বললাম
“মিস্টার দীপক আপনাকে অনন্যা আপু ড্রইং রুমে ডাকছে।”
আমার সম্বোধনটা হয়তো দীপক ভাইয়ার পছন্দ হয়নি। তাই ঘর থেকে তেড়ে এসে বলে উঠল
“কত বড়ো সাহাস আমার বাড়িতে এসে আমাকেই নাম ধরে ডাকা হচ্ছে? তোর আর আমার বয়সের ফারাক জানিস?”
তিনি এমনিতেও খুব হাইপার অবস্থায় ছিলেন আর আমার মুখে নাম শুনে আরও হাইপার হয়ে গেলেন। হাইপার হয়ে আমার গায়ে হাত তুলতে নিলে আনহারি দৌড়ে এসে আটকায়। সে দীপকের হাতটা ধরে দীপকের গালেই কষিয়ে থাপ্পর মেরে বলে উঠল
“এর পর এ হাতটাও ভেঙ্গে দিব। একটা হাত তো নড়াতে পারছেন না। এটাও আর নড়াতে পারবেন না।”
রাগের মাথায় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান টাও থাকে না। তাই সে আনহারীর গায়ে হাত তুলতে নেয়। সেক্ষেত্রে মাহিদ এসে বাঁধা দেয় এবং দীপক ভাইয়াকে জোর গলায় বলে
“এ মুহুর্তে যদি অনন্যা আপনার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করে আপনার ঠাঁই কোথায় হবে আপনি বুঝতে পারছেন?”
এর মধ্যেই আপার শ্বাশুড়ি এসে বলে উঠল
“দীপু রে মাথা গরম করিস না। মাথা গরম করলে এ মেয়ের থাবায় আমরা সবাই মারা পড়ব। শয়তান মেয়ে তো আমাদের জ্বালাতে এসেছে। এখন সয়ে নে পুত। সময় হলে সবকিছুর জবাব দিস। মাথা ঠান্ডা কর পুত “
দীপক ভাইয়া থেমে গেল। রাগটা নিবারণ করে অফিসার মাহিদকে বলল
“কেন এসেছেন?”
“আঙ্গুলের ছাপ নিতে। এ মেশিনে আঙ্গুলের ছাপ দিন তাহলে বুঝতে পারব এটা আসল কাবিননামা কি’না। আর অনন্যাও এখানে আঙ্গুলের ছাপ দিলে বুঝা যাবে সে আসল অনন্যা কি’না। এটার জন্যই এসেছি আমি “
পুরো সময়টায় আনজুমান নিশ্চুপ ছিল। এখন একটু গলা খুলে বলল
“ভাই ছাপ দে। এখনই প্রমাণ হবে সে মিথ্যা। মিথ্যা প্রমাণ হলে তাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াব আমি। আর আমার গায়ে হাত তুলার প্রতিশোধ নিব আমি।”
দীপক এবার তার হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপটা দিল৷ আর আনহারিও দিল।
অফিসার মাহিদ ছাপ দুটো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে আমার ভেতরটায় ভয় গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে। কারণ দুজন মানুষ এক হলেও তাদের হাতের ছাপ কখনও এক হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হেরে যাওয়ার বার্তা যেন আমার কানে আসছে। এ বিষয়টি কীভাবে আনহারি পার করবে সেটা বুঝতে পারছি না। মাহিদ আনহারির দিকে তাকাল। তার তাকানোর ধরণ বলে দিচ্ছে আনহারির সত্যতা সামনে আসতে চলল।।।।
কপি করা নিষেধ
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার