#শারমিন আঁচল নিপা
“বানিয়ে বানিয়ে আমি আরও গল্প বলতে পারব। যেটা কি’না সত্য হয়ে যাবে। আমার আগে আপনার দুটো স্ত্রীর মধ্যে একজনকে কীভাবে খুন করেছেন। এরপর তৃনাকে কীভাবে খুন করেছেন। আর ফাতেমার লাশ গুম করতে কীভাবে সাহায্য করেছিলেন সেটাও কী বর্ণণা করব? সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আচ্ছা আপনি হেলেনাকে চেনেন তো?”
হেলেনা নামটা শুনতেই দীপকের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। ভয় ভয় গলায় জিজ্ঞেস করল
“তুমি হেলেনাকে চেনো কী করে?”
আনহারি এবার হেসে জবাব দিল
“ঠিক সেভাবেই চিনি যেভাবে আপনি চেনেন। বেশি কথা বাড়াবেন তো আরও গর্তে পড়বেন। এখানেই থেমে যান। এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো আনজুমানকে কোনো মিথ্যা বলিনি। এত সহজে মিথ্যা বলা আমার কাজ না। আমি যা বলি একদম সত্য। আর সত্য দিয়েই আমি সবটা জয় করব।
দীপক এতগুলো খু/ন করেছে এটা শুনতেই আমার কেমন যেন লাগছে। এ মানুষটাকে দেখে অমানুষ লাগলেও খুনী লাগে না। মানুষকে বাইরে দেখে কিছুই বিবেচনা করা যায় না, কে কেমন। আনজুমান ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। আনজুমানের মেয়ে পাশেই বসে আছে। সে যেন কিছুই বুঝছে না। ঠান্ডা পাথরের মতো মায়ের কান্না দেখছে। এ মুহুর্তে তার কী করা উচিত সেটা সে বুঝছে না। আনহারি এবার আনজুমানের কাছে গিয়ে বলল
“দীপক যখন আমাকে ঠকিয়েছিল ঠিক এমন কষ্ট আমারও হয়েছিল। আমি পরে পরে কেঁদেছিলাম। হা হুতাশ করেছিলাম। চিৎকার করেও কেঁদেছিলাম। আপনাদের কাছে এসে কত হাত জোড় করে বলেছিলাম একটু যেন আপনার ভাইকে বুঝান। সেদিন আপনি বলেছিলেন ছেলেরা একটু এমনেই হয়। এতে দোষের কী। ঘরের বউ যদি চাহিদা মেটাতে না পারে তাহলে তো পরের বউয়ের কাছে যাবেই। ছেলেরা এমন না হলে নাকি সে ছেলে, ছেলেই না।
আমার আর্তনাদ সেদিন শুনেননি আপনি। আজকে তো আমিও বলব আপনি হয়তো আপনার জামাইয়ের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারেননি তাই ফাতেমার কাছে গিয়েছিল। পুরুষ লোকের কোনো দোষ হয় না। তাহলে জটলাও খারাপ মানুষ না। আর সকল পুরুষ খারাপও না। তবে আপনার বাড়িতে থাকা সকল পুরুষ জাত খারাপ। আর এটা আপনাদের মানতে কষ্ট হওয়ার কথা না। ছোটো থেকেই তো এসব দেখে আসছেন। আপনার বাবাকে দেখেছেন। আপনার বাবা কীভাবে আপনার মাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছিল। সে ঘরেও তো আপনাদের একটা বোন আছে। সেই মহিলাকে কীভাবে আপনারা অত্যাচার করেছিলেন ভুলে গেছেন? সেদিন তো আপনার বাবাকে শাস্তি দেননি, দিয়েছিলেন সে মহিলাকে। আর সে মহিলা আপনাদের পায়ে হাত দিয়ে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল, দেননি। তার কী দোষ ছিল বলুন তো? সে তো জানত না আপনার বাবার আরেকটা পরিবার আছে। অথচ তবুও তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে। আপনারা সবসময় নিজের পুরুষের দোষ না দেখে অন্য মেয়ের দোষ দেখেছেন। এখন নিজের বেলায় সেটা কেন মানতে পারছেন না? পরের খারাপ করলে আল্লাহ সেটা কোনো না কোনোভাবে ফিরিয়ে দেন। আর আপনার সৎ বোনের কী হাল সেটা নাহয় আরও পরে বলব। আপাতত এতটুকু শোক সইতে থাকুন। আপনার জীবনের যন্ত্রণা তো কেবল শুরু। আমি অনন্যা যতদিন বেঁচে থাকব আপনাদের আমি তিলে তিলে মারব।”
কথাগুলো বলেই আনহারি রুমে চলে গেল। এদিকে আমার কাছে সব কিছু এলোমেলো লাগছে। কপাল জুড়ে আমার কয়েস্ত ভাঁজ জমেছে। হার্টবিট ক্রমাগত বাড়ছে৷ হাত, পা ও কখন থেকে কাঁপছে। আনহারি এ পরিবারের এত গোপন তথ্য কীভাবে জানে সেটাই জানার জন্য আমার মনটা উদগ্রীব হয়ে আছে। এত অল্প সময়ে এত বিশেষ বিশেষ তথ্য কারও জানার কথা না। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না এটা আনহারি। আমার মন কেবল এটাই বলছে এ অনন্যা। হ্যাঁ এটাই আমার বোন অনন্যা। আমার বোনের সাথে এত মিল আনহারির হওয়ার কথা না। হয়তো বারো বছর আগে আনহারিই মারা গেছে। আর এ বারোটা বছর যাবত অনন্যা আনহারি হয়েই সকল তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমি তার জীবনে না আসলেও সে হয়তো এ বাড়িতে এসে প্রতিশোধ নিত। কিন্তু কাহিনিটা রেলগাড়ির বগির মতো চলছে তাই একটা বগি আরেকটা বগির সাথে না চায়তেও জুড়ে যাচ্ছে।
আনজুমানের কান্না যেন থামছেই না। সে মেঝে থেকে উঠে ঘরে গিয়ে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। কেন জানি না আনজুমানের এ কান্না আমাকে ভীষণ শান্তি দিচ্ছে। আপার কান্না মুখটা যতটা কষ্ট আমাকে দিয়েছিল ঠিক ততটা সুখ আনজুমানের কান্না আমাকে দিচ্ছে। দীপক তার রুমে চলে গেল। পিয়ালি আর এসবের মধ্যে আসেনি। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে আনহারির কাছে গেলাম। আনহারি মেবাইল চাপছে। আমি তার পাশে বসতেই বলল
“কিছু খাবে?”
আমি মাথা নেড়ে না বলে বললাম,
“কে রান্না করবে আপু। রান্না করার মতো কেউ তো নেই। শুকনো খাবার দিয়েই চলে যাচ্ছে। আপাতত কিছু লাগবে না।”
আনহারি হেসে জবাব দিল
“কে রান্না করবে মানে? আনজুমান রান্না করবে। আর তুমি দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। আমি আনজুমানকে বলছি।”
কথাটা বলেই আনহারি তার রুম থেকে বের হয়ে আনজুমানের কাছে গিয়ে বলল
“যা আছে ঘরে রান্না করুন। আমাদের অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
আনজুমান কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল
“এ অবস্থায় রান্না করব আমি?”
“আপা ভালোই ভালোই বলছি গিয়ে রান্না করুন। এরকম হাজারটা যন্ত্রণা চাপা দিয়ে আপনাদের রান্না করে আমি খাইয়েছি আপনিও পারবেন। এ বাড়িতে বা/ন্দি হয়ে থাকতে পারলে থাকুন নাহয় বের হয়ে চলে যান।”
অসহায় কণ্ঠে আনজুমান বলে উঠল
“আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই। কই যাব?”
“তাহলে বা/ন্দি হয়ে থাকুন। যান গিয়ে রান্না করুন। ফিয়না সবটা পর্যবেক্ষণ করবে। তা না হলে কী থেকে কী মিশিয়ে দিবেন বলা তো যায় না।”
আনজুমান আর কথা বাড়াল না। সুরসুর করে উঠে রান্না ঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভেজালো আর ভাত বসালো। সাথে টুকটাক যা কাটা লাগে সেগুলো কেটে নিল। রান্না করায় পুরোদমে মনেযোগ দিল। বারো বছর পর এমন বিপরীত পরিবর্তন দেখতে পারব কল্পনাও করিনি। আজকে ভীষণ শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আপার সাথে করা সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নিতে পারছি। আপার আত্মা একটু হলেও শান্তি পাবে।
আনহারি তরীকে কিছু চকলেট দিলো খাওয়ার জন্য। সবার সাথে কঠোর হলেও তরীর প্রতি আনহারি বেশ কোমল। সত্যি বলতে বাচ্চাটার কেনো দোষ নেই। বাবা মায়ের শাস্তি তো বাচ্চাকে দেওয়া যায় না।
রান্না শেষে আনজুমান তার রুমে চলে গেল। আমি, আনহারি আর তরী খেতে বসেছি। তরী আনহারির বেশ ভক্ত হয়ে গেছে। আমরা খেতে বসতেই দীপক আর পিয়ালি এসেছে খেতে। দীপক যখনেই খেতে বসতে নিবে তখনই আনহারি বলে উঠে
“নিজের খাবার নিজে রান্না করে খান। এখানে কেবল আমাদের খাবার। আপনাদের জন্য রান্না হয়নি।”
দীপক এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল
“অনন্যা তুমি কিন্তু বেশি বাড়বাড়ি করছো। আমি কিন্তু এসব আর মেনে নিব না। ভীষণ বাজে হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। সবাই তোমাকে ভয় পেলেও আমি পাই না।”
আনহারি হেসে জবাব দিল
“কাল সকালে আরও বাজে হবে ব্যাপারটা। সকালটা হতে দিন শুধু। “
আনহারির কথা শুনে আমি ভাবতে লাগলাম সকালে কী এমন চমক তৈরী করে রেখেছে সে, উপর ওয়ালা ভালো জানেন।
আনহারির কথা শুনে দীপক আর কথা বাড়ালো না। নিজের ঘরে পিয়ালিকে নিয়ে চলে গেল। আমরা খাওয়া শেষ করে নিজেদের রুমে আসলাম।
এদিকে জটলাকে অফিসারের মাহিদের সামনে আনা হয়েছে জিজ্ঞসাবাদ করার জন্য। জটলাকে নানান ভাবে অফিসার মাহিদ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আর সে জিজ্ঞসাবাদের জের ধরে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে যা শুনে আমি বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না। সত্যিই কী এমনটা হয়েছে। আনজুমানও স্তব্ধ হয়ে গেল তা শুনে। নিজের স্বামীর এ স্বীকারোক্তি সে মানতে পারছে না। ফেরেশতার মতো স্বামীর এ রূপ দেখবে সে ভাবতেই পারছে না।
এমন সময় মা কল দিল। মায়ের কল ধরতেই মা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
“তোর বাবা আত্মহত্যা করেছে।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আমার বুক কাঁপতে লাগল।
সবার আগে গল্প পেতে নীল লেখায় চাপ দিয়ে লাইক ফলো দিন শারমিন আঁচল নিপা । Sharmin Achol Nipa
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার