#শারমিন আঁচল নিপা
আনহারি আমার এ অবস্থা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো
“কী হয়েছে? এত অস্থির কেন? কথাই বা বলছো না কেন? আন্টি কী বলেছে?”
আমি কাঁদতেও পারছিলাম না। যতই হোক সে আমার বাবা। আপার লা/শটা দাফন দেওয়ার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। আজ আমার বাবা কেন আত্ম/হ/ত্যা করবে সে হিসাবেই আমি মিলাতে পারছি না৷ আমার বুকে ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে। ফ্যানের মতো আমার মাথাটাও ঘুরছে। তাই চোখ বন্ধ করে আনহারিকে উত্তর দিলাম
“বাবা আত্মহত্যা করেছে।”
আমার কথা শুনে আনহারির কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা আমার চোখ বন্ধ থাকায় বুঝতে পারছি না। তবে তার গলার সুর শুনে বুঝতে পারছি এতে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল
“ফিয়না আমার বাবা আমাকে মারতে চেয়েছিল বলে আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। মালিহা আমার মাকে ঠকিয়েছিল বলে আমি তাকেও শাস্তি দিয়েছি। সবাই জানে আমজাদ চৌধুরি আত্মহত্যা করেছে। তবে সত্যিটা কেবল আমি জানি। সে আত্মহত্যা করেনি। আমিই তাকে খু/ন করেছি। কিন্তু তোমার বাবাকে কে খু/ন করবে? বা তিনি হঠাৎ কেন আত্মহ/ত্যা করবেন? গভীর কোনো সংযোগ রয়েছে আমার মনে হয়।”
আমি আনহারির কথা শুনে চোখ দুটো বিস্মিত হয়ে খুললাম। বেশ অবাক গলায় বললাম
“আংকেলকে আপনি খু/ন করেছেন? কিন্তু কীভাবে? নিজের বাবাকে খু/ন করতে হাত কাঁপে নি? আপনি কী সত্যিই বলছেন নাকি মজা করছেন?”
“সত্যি বলছি। যে বাবা আমার জীবনের কথা একবারও না ভেবে আমাকে হ/ত্যা করতে চেয়েছিল সে বাবার প্রতি আমার কোনো মায়া হয় না ফিয়না। আমি বাবাকে ভালোবাসতাম এটা ঠিক। এখনও বাবাকে ভীষণ মিস করি। তবে কর্মের ফল সবাইকেই পেতে হবে। তাই বাবাও পেয়েছে। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।
আমি আগে থেকেই জানতাম বাবা আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। তবে সেটা আমি প্রকাশ করিনি। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম সেটার কাহিনি অন্য একদিন বলব। আজকে শুধু আমজাদ চৌধুরির মৃ/ত্যু রহস্যের জট খুলে দিচ্ছি। আমি আসার পর থেকেই বাবার উপর নজরদারি রাখি। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল বাবা এমন কোনো স্টেপ নিবে যেটা আমার জন্য হিতকর হবে না। খুব কৌশলে বাবার ভোকালে যে যন্ত্রটা লাগানো আছে, সেখানে হিডেন ক্যামেরা সংযুক্ত করে দেই। বাবার একটা সমস্যা ছিল বাবা কথা বললে আওয়াজ হত না। একটা যন্ত্রের মাধ্যমে বাবার কথা আওয়াজের মাধ্যমে বের করা হত। আমি সেদিন রাতে যখন দেখেছিলাম গাড়িটার ব্রেকের তার কাটা হচ্ছে তখন বুঝতে পেরেছিলাম এটা আমাকে মারার জন্যই প্ল্যান করা হয়েছে। কারণ সাদা গাড়িটা আমার ছিল। আর এটা দিয়েই আমি আগে যাতায়াত করতাম। বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রতি বাবার কোনো মায়া নেই। ঠিক তেমনি পূর্বে করা কাজের জন্যও তার মধ্যে কোনো পরিতাপ নেই। তখন আমি আর বাবা হয়ে গেলাম প্রতিদ্বন্দ্বী।
আমি মালিহার সাথে আমারই এক ফ্রেন্ডকে আগে থেকেই পরিচিত হতে বলেছিলাম। এবং বলেছিলাম মালিহাকে টাকার লোভ দেখিয়ে হোটেলে নিতে। মালিহার অনেক টাকার নেশা ছিল। তাই মালিহাকে পটানো খুব বেশি কঠিন হলো না। আমার কথা মতো আমার ফ্রেন্ড তাই করল। তাকে নিয়ে একটা হোটেলে গেল প্রথম। তারপর মালিহাকে ইচ্ছা মতো নেশা করালো। একটু অন্তরঙ্গ হলো তার সাথে। একটা ভিডিও ধারণ করে বাবার নম্বরে মালিহার ফোন থেকেই ভিডিওটি পাঠাল। মালিহা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় তার ফোন কোথায় ছিল সে টের পায় নি। বাবার ফোনে সেটা আসার সাথে সাথে বাবা রেগে গেল।
আমি ঠিক তখন বাবার কাছে গেলাম। বাবার বুকে ছুরি ধরে বাবাকে চিঠিতে যা লেখা ছিল সব লিখতে বললাম। বাবার ভোকালে সমস্যা ছিল বলে গলার আওয়াজ বাইরে যায়নি। কারণ রাতে ঘুমানোর সময় বাবা যন্ত্রটা খুলে ঘুমান। নিজের প্রাণের মায়ার জন্যই বাবা চিঠিতে এসব লিখতে বাধ্য হলো। তারপর বাবার হাত থেকে গ্লাভস পড়ে চিঠিটা নিলাম। বাবাকে মদ্যপান করালাম। বাবা যখন একদম মাতাল হয়ে নিস্তেজ হলো। তখন আমি বাবার ফোন থেকে ট্রাক ড্রাইভারকে কল দিলাম। আমার বিশেষ একটা গুণ ছিল তা হলো কণ্ঠ নকল করতে পারি৷ এটা হিডেন গুণ থাকায় কেউ জানত না। আমি বাবার ফোন থেকে একজন ট্রাক ড্রাইভারকে কল দিলাম। তাকে বললাম গাড়িটা যেন গ্যারেজ থেকে নিয়ে যায়। সেরকম করেই আমাদের দারোয়ানকে কল দিয়ে বললাম ট্রাক ড্রাইভার আসলে যেন গাড়িটা দিয়ে দেয়। ব্যাস আমার কাজ শেষ।
তারপর মালিহাকে মেসেজ করলাম তার জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট আছে। সেটা যেন সে রিসিভ করে। যেহেতু মালিহা ছিল টাকার কাঙ্গাল। সেহেতু আমি নিশ্চিত ছিলাম এত দামী গাড়ি সে উপেক্ষা করতে পারবে না। ঠিক তাই হলো।
এদিকে বাবাকে আমি তার মাতাল হওয়ার সুযোগ নিয়ে মালিহার ভিডিও দেখিয়ে হিট করলাম। বাবা বাধ্য হয়ে উত্তেজিত হয়ে নিজের গলায় নিজেই দড়ি দিল। আত্মহত্যা বাবায় করেছিল তবে আমি শুধু পুশ করেছিলাম।
এদিকে ট্রাক ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে মালিহার বাসায় সামনে দিয়ে আসে। মালিহা নিজে সেটা রিসিভ করে। তখনও সে মাতাল ছিল। আমার ফ্রেন্ড তাকে মাতাল অবস্থায় তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যায়। কারণ সেদিন তার ফ্লাইট ছিল। সে দেশের বাইরেই থাকে। এখানে তেমন আসে না। কেবল আমার কথায় এসেছে আমার আর্জি পূরণ করার জন্য। ভীষণ ভালোবাসে তো আমাকে। ভালোবাসার মানুষের কথা উপেক্ষা করা যায় না। তাই সে ও পারে নি৷
পরদিন সকালে সে গাড়ি নিয়েই মালিহা বের হয়। আমি তো জানতাম গাড়ির ব্রেক কাটা। তবে মালিহা তো তা জানত না। ফলস্বরূপ তার মৃত্যু হলো রোড এক্সিডেন্টে।
যেহেতু একজন আত্মহত্যা করেছে আরেকজন রোড এক্সিডেন্ট সুতরাং এখানে কোনো প্রমাণ নেই আমি খুন করেছি। আর আমার ফ্রেন্ড তো দেশের বাইরে সুতরাং তারও কোনো অস্তিত্ব এ দেশে নেই।
জানো ফিয়না অপরাধীকে কখনও ছেড়ে দিতে নেই। বিশ্বাস ঘাতকতার বদলা কেবল খু/ন দিয়েই নিতে হয়।”
আনহারির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজের বাবার মৃত্যু কষ্টটা ডাইভার্ট হয়ে গেল এ কাহিনি শুনে। আমার মাথায় কেবল আমজাদ চৌধুরি আর মালিহা নাম দুটোই ঘুরছে। এত সহজ বিষয়টি কেউ বুঝতে পারল না। দুজন মানুষ খু/ন হলো অথচ দুজনের খু/নের জন্য খুনী দুজনেই দায়ী হলো। আর আনহারির পাকা অভিনয় দেখে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না সে খুন করেছে। এত দক্ষ পরিকল্পনা কীভাবে সাজিয়েছে সে ভালো জানে। তবে বাবার খুনের সাথে আনহারির হাত নেই। এটা আনহারির কথা এবং ভাবভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে। তবে বাবা কেন আত্মহত্যা করল। একদিন বাবায় বলেছিল আনহারির সাথে তার দেখা হয়েছিল আর আনহারি বলেছিল তার খুনের সাথে জড়িতে সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। তাহলে আনহারিই কী বাবাকে খু/ন করেছে?
আমি আনহারিরকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার তো বাবার সাথে একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। তুমি কেন বাবাকে এমন বললে?”
আনহারি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাদের পরিবারের কেবল তোমার সাথেই আমার দেখা হয়েছে। অন্য কারও সাথে না। আর এমন ঘটনা তো ঘটেনি। তোমার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”
আনহারির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। তাহলে বাবা কাকে দেখেছিল?
এদিকে জটলার স্বীকারোক্তিতে জানা যায় বড়ো আপাকে জটলা ডিভোর্সের আগে ধ/র্ষণ করেছিল। আর বড়ো আপা যখন সেটা তার শ্বাশুড়িকে জানিয়েছিল। সে বরং জটলার শাসন করেনি, করেছিল আপার শাসন। আপাকেই নষ্টা মেয়ে বলে উপাধি দিয়েছিল। এরপর আপার শ্বাশুড়ি দীপককে সবটা জানালে সে তার বোনের সুখের কথা চিন্তা করে তাকে জানায়নি। জটলাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে বিষয়টা সেখানেই স্থগিত করেছিল। তবে বড়ো আপা বার বার চায়তো এর একটা বিহিত হোক। এক বাড়িতে নিজের ধর্ষকের সাথে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একদিকে এমন ঘটনা অন্যদিকে দীপকের পরকিয়া। সবমিলে দীপক তার রাস্তার কাটা সরাতে বড়ো আপার নামে দুর্নাম রটিয়ে দিল। আর সে জের ধরেই আপাকে ডিভোর্স দিল। আপা ডিভোর্সের পর সন্তান হওয়ার কথা দীপককেই দিয়েছিল। আর দীপক তখন বুঝিয়ে আপার সন্তানকে এবরশন করায়। কারণ আপা ভেবেছিল এ সন্তান দীপকের। তবে জটলা নিশ্চিত হয় এ সন্তান তার ছিল। কারণ দীপক বেশ কিছুদিন আগে জানতে পারে সে কখনও বাবা হতে পারবে না। দীপক আপাকে আশ্বস্ত করে আবার সব ঠিক করে নেবে। তবে সেটা ঠিক না করে দীপক হুট করে বিয়ে করে বসে। এরপর আপা কীভাবে আত্মহত্যা করে, কেন করে সেটা সে জানে না। আর পায়েসে কীভাবে পটাশিয়াম সায়ানইড মিশলো সেটা সত্যিই সে জানে না।
একদিনের স্বীকারোক্তিতে এতটুকুই উৎঘাটন করা গেছে। কাল আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
এখন এটা নিশ্চিত হওয়া গেল সেদিন আমার বড়ো আপায় মা’রা গিয়েছিল। যে ধোঁয়াশা আমার ভেতর ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম সে আনহারি হবে। তবে বাস্তবতা আমার ভাবনার বিপরীত পিঠ ছিল। আপার ভেতরে এত কষ্ট জমা ছিল অথচ কেউ বুঝে নি। আনহারির দিকে তাকিয়ে আছি আমি৷ যন্ত্রণা মানুষকে কতটা হিংস্র করে তুলে সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
কিন্তু বাবা কেন আত্মহত্যা করল? আর ঐদিন বাবা আনহারিকে না দেখলে কাকে দেখেছিল? আর পায়েসে কে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়েছিল? আমি আনহারিকে আবার প্রশ্ন করি
“পায়েসে কী পটাশিয়াম সায়ানাইড তুমি মিশিয়েছিলে? আর মেশালেও কীভাবে? তুমি তো রান্না ঘরে যাও নি।”
আনহারি মুচকি হেসে জবাব দিল
“সব রহস্য বলে দিলে কী আর টুইস্ট থাকবে? একটু টুইস্ট থাকুক। যাইহোক আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি তোমার বাবাকে দাফন করে আবার এসো। যা খরচ লাগে আমি দিব। আমাকে সেখানে গিয়ে সব আপডেট দিবে।”
আমি মাথা নাড়ালাম। এত মৃত্যু দেখতে দেখতে বাবার মৃত্যুটা আমাকে আর কাঁদাচ্ছে না। আমি সে সময়েই রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌছালাম রাতে। বাবাকে পুলিশ নামিয়ে নিয়ে গেছে তাদের হেফাজতে। ময়না তদন্ত করে লা/শ দিবে। মা হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।।আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল
“তোর বাবা যে এমন কাজ করেছে আমি বিশ্বাসেই করতে পারছি না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফিয়না।”
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
“আচ্ছা মা বাবা কেন হঠাৎ আত্মহত্যা করবে? তার পেছনে কী কোনো কারণ আছে?”
মা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। মায়ের কান্নাও হুট করে থেমে গেল। মনে হচ্ছে কিছু একটা মা লুকাচ্ছে। আমি মাকে এবার চেপে ধরলাম। এরপর মা যা বলল তা শুনে আমার ভীষণ দম বন্ধ লাগছে।
সবার আগে গল্প পেতে নীল লেখায় চাপ দিয়ে লাইক ফলো দিন শারমিন আঁচল নিপা । Sharmin Achol Nipa
কপি করা নিষেধ
শারমিন নিপা