#শারমিন আঁচল নিপা
তবে একটা পার্সেল এসেছে। কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করিনি। তাহলে পার্সেল কে পাঠাল? ডেলিভারীম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম
“আমি তো কিছু অর্ডার করিনি। কে পাঠিয়েছে পার্সেল?”
ডেলিভারীম্যান হালকা গলায় উত্তর দিল
“ম্যাডাম কুড়গাঁও থেকে এসেছে এ পার্সেল।”
কুড়গাঁও নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। কুড়গাঁও আমাদের গ্রামের নাম। বারোটা বছর হয়েছে সে জায়গা থেকে চলে এসেছি। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। এতদিন পর কে পার্সেল পাঠাল? শরীর কাঁপছে আমার। কাঁপা গলায় বললাম
“কে পাঠিয়েছে পার্সেল? আর কী পাঠিয়েছে?”
“ম্যাডাম সেটা তো আমি বলতে পারব না। আমার কাজ তো কেবল ডেলিভারী করা। কে পাঠিয়েছে সেটাও জানি না।”
“সব টাকা কী পে করা? নাকি টাকা পে করেনি?”
“ম্যাম ফুল পেমেন্ট করা।”
আমার বিস্ময় যেন কাটছে না। কে পাঠাল পার্সেল! এ ভাবনায় আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হচ্ছে আমার সাথে? কেন হচ্ছে এসব প্রশ্নও আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ডেলিভারীম্যানের ডাকে ভাবনার ঘোর থেকে বের হয়ে আসলাম
“ম্যাডাম পার্সেল রিসিভ করবেন না?”
আমি হালকা গলায় কেবল বললাম
“হুম দেন।”
ডেলিভারীম্যান পার্সেল দিয়ে চলে গেল। পার্সেল হাতে নিয়ে আমার কেবল হাত কাঁপছে। শরীরটা ঝিমঝিম করছে। বুকটাও কেমন জানি ধুকধুক করছে। সব মিলে আমার বেশ অস্বস্থি হচ্ছে। আমি আস্তে পায়ে আমার রুমে গেলাম। পার্সেলটা ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখলাম। কোথাও প্রেরকের নাম নেই। শুধু গ্রামের নামটা উল্লেখ আছে আর প্রাপকের নাম আছে। আমি কাঁপা হাতে পার্সেলটা খুলে আরও বিস্মিত হয়ে গেলাম। কষ্টের দাবানলে আমি পুড়তে লাগলাম। আপার একটা তৈলচিত্র। কে পাঠাল এটা? আমার মতো সাধারণ মানুষ কীভাবে বের করবে কে পাঠিয়েছে। আর কেনই বা এত বছর পর পাঠিয়েছে। আপার এ ছবিটাতে আপাকে একদম জীবন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে আপা আবার ফিরে এসেছে। আপার এ ছবিতে কোনো মলিনতার ছাপ নেই। একদম বিয়ের আগে যেমন সজীব ছিল ঠিক তেমন এ ছবিটা। আমি ছবিটা ঘাটতে ঘাটতেই খেয়াল করলাম কিছু একটা নীচে পড়েছে। নীচের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম একটা খাম। আমি তাড়াহুড়ো করে খামটা নিলাম। খামটা ছিড়ে একটা চিঠি পেলাম। তাতে লেখা…
“স্নেহের ফিয়না। ইচ্ছা করেই নামবিহীন পার্সেলটা পাঠিয়েছি। তোমার বড়ো আপা অনন্যাকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। ভেবেছিলাম এক সময় এসে ভালোবাসার কথা বলব। পড়ালেখা করতে অনেক কষ্টে বাপের জমি বিক্রি করে দেশের বাইরে আসি। এসে পড়ালেখাও চলছিল ভালো। হঠাৎ করে শুনতে পারি অনন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। না পাওয়ার কষ্ট থাকলেও খুশি হয়েছিলাম। কারণ শুনেছিলাম বড়ো ঘরে বিয়ে হয়েছে। সবমিলে ভালোবাসাটা এক কোণে রেখে নিজের জীবনের সাথে লড়াই করছিলাম। সে সময়টায় বিয়োগব্যথা ভুলতে এ ছবিটা অঙ্কন করেছিলাম। অনন্যার সজীবতা যেন এ ছবিতে মিশে আছে। এ ছবিটা দেখলে আমার ভীষণ শান্তি লাগত।
এভাবেই চলছিল আমার জীবন। হুট করে শুনলাম অনন্যার ডিভোর্স হয়েছে। সেদিন অনন্যাকে পাবার একটা আশা আমার মনে চলে এসেছিল। তবে একটু খারাপ ও লোগেছিল। ডিভোর্স কোনো নারীই সহজে চায় না। আমি অনন্যার কষ্টটা অনুভব করতে পারতাম। ভেবেছিলাম তার শোকটা কাটুক এরপর তার সাথে যোগাযোগ করব। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নগুলো খুলে বলব। তাকে আবার পড়াব। অনেক বড়ো করে তার স্বপ্ন পূরণের সাথী হব।
কিন্তু সব আশায় হঠাৎ করে থমকে গেল অনন্যার মৃ/ত্যুর কথা শুনে। সেদিনের পর থেকে আমি আর এ ছবিটা দেখিনি। কারণ কষ্ট বাড়বে। যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। দীর্ঘ বারোটা বছর আমি দেশে আসিনি। অন্যন্যার জন্য আসেনি বিষয়টা এমন না। সিটিজেনশিপ পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। সবমিলিয়ে বারো বছর পর দেশে আসলাম। দেশে এসে জানতে পারলাম তোমরা ঢাকায় থাকো। কেউ তোমাদের খোঁজ জানে না। অবশেষে অনেক কষ্টে খোঁজ নিয়ে তোমাকে স্থিরচিত্রটা পাঠালাম। যত্ন করে রেখো।”
চিঠিটা পড়া শেষ করে আমি ভাবনার অতল গহ্বরে ডুবে গেলাম। কাকতালীয়ভাবে সবকিছু একই দিনে কীভাবে হচ্ছে। এটা কী সত্যিই কাকতালাীয়! নাকি এতে রয়েছে গভীর রহস্য। কে এই নামবিহীম মানুষটা যে আপাকে এত ভালোবাসত। সবকিছুই গোলমেলে লাগছে। ভীষণ ক্লান্ত আমি এসব হিসাব মেলাতে মেলাতে।
আপার ছবিটা খাটের উপর রেখে চুপ করে বসে রইলাম। আর কিছুই ভালো লাগছে না। একটু পর টিউশনের সময় হয়ে যাবে। যেতে যেন ইচ্ছায় করছে না। এক রহস্য যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে। ঐ মেয়েটাই কে? আপার মুখ স্পষ্ট ছিল। আপাকে নিজের চোখে ঝুলতে দেখেছি। তাহলে আনহারি ভবনের সে ময়েটা কে? এসব ভাবনা আমাকে পাগল করে তুলছে।
এর মধ্যেই মা এসে আপার ছবি দেখে রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল
“অন্যন্যার ছবি কোথায় পেলি? জানিস না মৃত মানুষের ছবি ঘরে রাখতে নাই। ভুলে গেছিস অনন্যা কীভাবে মারা গেছে? আত্মঘাতীকে মরা মানুষের ছবি রাখলে ঘরে শয়তান প্রবেশ করে। এখনই ছবিটা ফেল। নাহয় পুড়িয়ে ফেল। এ ছবির জায়গা এ ঘরে হবে না।”
মায়ের কথা শুনে আমি বেশ রেগে গেলাম। রাগটা দমানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম
“কেমন মা তুমি? ঠিক আছে মেনে নিলাম ছবি রাখলে ঘরে ফেরেশতা আসে না। তাই বলে নিজের মেয়ের ছবি ফেলে দিতে বলবা? কোনো বক্সে রেখে দিলেই তো হয়। অনন্যার প্রতি কিসের এত রাগ তোমার? আপা কী ক্ষতি করেছে তোমার? উঠতে বসতে আপাকে দিয়ে খুটা দাও। আপার মৃ/ত্যুর জন্য তুমি দায়ী মা। আপাকে তোমরা একটু ভরসাও দাও নি। দিনের পর দিন তোমাদের কথার আঘাতে আপা মারা গেছে। আজকে যদি একটু ভরসা দিতে আপা আমাদের সাথেই থাকত। আপা কত জ্ঞানী ছিল। বেঁচে থাকলে অবশ্যই ছেলেদের মতো কাজ করে খাওয়াইতো মা। অতি লোভে তোমাদের আজকে এ হাল। আপার আত্মা তোমাদের শান্তি দিবে না।”
আমার কথা শুনে মা রেগে গেল। তবে কিছু বলার সাহস আর পেল না। আমার সামনে থকে তড়িৎ গতিতে বের হয়ে গেল।
আমি আপার ছবিটাকে আবার বক্সবন্দি করলাম। তারপর স্বযত্নে বুকসেল্ফে রেখে দিলাম।
আজকে আর টিউশনে গেলাম না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। বাবা কাজ শেষ করে খেতে এসেছে। সবাই একসাথে বসলাম। বাবার মুখে চিন্তার ভাঁজ। খাবার প্লেটে কেবল হাত নাড়ছে। মা বাবাকে এমন করাতে জিজ্ঞেস করলেন
“কী গো খাচ্ছ না কেন?”
চিন্তিত মুখে বাবা জবাব দিলেন
“অন্যন্যা মারা গেছে বারোটা বছর হলো। এখন পর্যন্ত অনন্যার কথা মনে হয়ে আমার খারাপ লাগেনি। কেন লাগেনি জানি না। সেদিন জাম গাছে অনন্যাকে ঝুলতে দেখে আমার সত্যিই কষ্ট হয়নি। মনে হয়েছিল হাফ ছেড়ে বেঁচেছি। এ মেয়েকে চায়লেও কোথাও গছাতে পারতাম না। তবে খারাপ লেগেছিল তখন যখন তাকে কেউ দাফন করতে দিচ্ছিল না। অনন্যার মা… আমি অনন্যাকে নিজের হাতে মাটিতে পুতে রেখে এসেছিলাম। কাফনের কাপড় সরিয়ে মুখটা খুলে রেখে এসেছিল। সেটা তো অনন্যায় ছিল অন্য কেউ ছিল না। তাহলে আজকে আমি কাকে দেখলাম? একদম অনন্যার মতো দেখতে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা আবার মতিভ্রম। পরে বুঝতে পারলাম এটা আমার মতিভ্রম না। মেয়েটা ঠিক আমার পাশেই এসে আমাকে বলল
” ক্ষত জায়গা আপনার একদম শুকিয়ে গেছে তাই না? ক্ষত জায়গা কী করে খুঁচিয়ে বিক্ষত করতে হয় সেটা আমি জানি। সময়ের সাথে সাথে আমাকে মেরে ফেলার শাস্তি তো পাবেন আপনারা।”
বিশ্বাস করো অনন্যার মা আমি পুরোপুরি স্তব্ধ। এ কথা বলার পর মেয়েটা চলে গেল। বারবার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি। তবে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম এটা স্বপ্ন নয়। কিন্তু মেয়েটা কে?”
বাবার কথা শুনে মা চুপসে গেল। কিন্তু বাবার কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগল মেয়েটা কেন বাবাকে বলল খুনের শাস্তি পাবে? তাহলে কী অন্যন্যার খুন হয়েছিল? আর সেটার সাথে বাবা দায়ী?
চলবে?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার