#শারমিন আঁচল নিপা
আমার চিবুকে ধরে আমাকে প্রথমে উত্তম মধ্যম দেওয়া হলো। তারপর তিনি চলে গেলেন। ফিরে আসলেন হাতে এক বোতল মদ নিয়ে। সেটা জোর করে আমার গলায় ঢালা হলো। মনে হচ্ছিল আমার বুক জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। হাত, পা কাঁপছে। নিজেকে বন্দী কয়েদী লাগছে। সে সময়টায় আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এ সংসার আমি করব না। এখানে থাকলে আমি মরে যাব।
আমি মাতালের মতো হয়ে গেলাম। সে সময়টায় নেশার ঘোরে আমার সাথে কী হয়েছে আমি খেয়াল করতে পারছি না। সকাল ১১ টায় আমার ঘুম ভাঙ্গে বাইরের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে। শ্বাশুড়ি মা পাশের বাড়ির লোকজন নিয়ে শালিস বসিয়েছেন। ঘরের দরজাটা আধখোলা। আমি অর্ধনগ্ন হয়ে আছি। শরীরের উপর পাশবিক অত্যাচার সারা রাতেই বয়ে গেছে বুঝতে পারলাম।
হতচকিয়ে উঠলাম। কাপড় ঠিক করলাম। সরাসরি চলে গেলায় ওয়াশরুমে। হাত মুখ ভালো করে ধুলাম। সারা গাল নীল হয়ে গেল চরের আঘাতে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোপ ছোপ কালো দাগ কামড়ের। অসহনীয় ব্যথা করছে৷ আমি নিজেকে তবুও সামলাম। ক্ষুধা লাগলেও সেটা দমিয়ে রাখলাম। গরীব ঘরের মেয়ে হওয়ায় খেয়ে না খেয়ে বেঁচে ছিলাম। তাই ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার হয়ে গিয়েছিল৷ সবকিছু সামলে ঘর থেকে বের হলাম।
সবাই আমার দিকে তেড়ে আসছে। গ্রামের মুরব্বি চাচীরা আামকে দেখে ছিঃ ছিঃ করছে আর বলছে
“অনন্য তোকে এত ভালো জানতাম আর তুই কি’না এত বেয়াদব। শ্বশুড় বাড়িতে এসে জমিদার হয়ে গেছিস তাই না? সকাল ১১ টায় তোর ঘুম ভাঙলো? এদিকে যে তোর শ্বাশুড়ি পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেল সে খেয়াল তোর নেই তাই না? তোকে আমরা কত ভালোবাসতাম। তোর ব্যবহারে আমরা কত মুগ্ধ ছিলাম। আর এখন দেখি সব উল্টো। টাকার মুখ দেখতে না দেখতেই এত বদলে গেছিস? এজন্যই লোকে বলে কম পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে লাফায় বেশি। আর খালি কলস নড়ে বেশি।”
আমি দমটা আটকে খিঁচ খেয়ে রইলাম। অনেক জবাবেই দিতে মন চাচ্ছে তবে পারছি না। কারণ সবার সামনে মাইর খেলে অপমান আমারেই হবে অন্য কারও না। এসব ভেবে সামনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম মা আসতেছে এদিকে। সাথে বাবাও এসেছে আর ফিয়না। ফিয়না আমার ছোটো বোন। দুনিয়াতে যদি কাউকে অনেক বেশি ভালোবাসি আমি সেটা ফিয়না। তাকে আমি কোলে নিয়ে মানুষ করেছি বলা যায়। তার প্রতিটা নিঃশ্বাস আমার জানা। ফিয়নাকে দেখে আমার বুকে বল পেল। মনটা ফুরফুরা হলো। অজানা একটা শক্তি আমার দিকে ধেয়ে আসলো। আমার একটু স্বস্তি মিলল।
বড়ো আপার খাতার এ পৃষ্ঠার এ লাইনগুলো পড়ে আমি থেমে গেলাম। আমার প্রতি আপার এ মহব্বত আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। আমার বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। বিষাদের সুর যেন আমাকে গ্রাস করছে। চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। স্মৃতির পাতায় চলে গেলাম সে সময়টায়।
সেদিন বেশ খুশি মনেই বড়ো আপার শ্বশুড়বাড়ি গিয়েছিলাম। কারণ দুপুরে বৌ ভাত ছিল। আমরা একটু আগে আগেই চলে যাই। বাকি মেহমান বলতে আমাদের তরফ থেকে কেউ ছিল না। কারণ মা বড়ো ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বেশ দাম্ভিক হয়ে গিয়েছিল। তাই আসার মধ্যে আমি, বাবা আর মা এসেছিলাম। আমি সেখানে গিয়েই আপার কাছে ছুটে যাই। আপাকে জড়িয়ে ধরি। আপা ওহ করে শব্দ করে উঠে। কারণ আপার শরীরের ক্ষত জায়গায় আমার হাতের চাপ পড়ে। আপার ওহ শব্দ শুনে আমি আপাকে ছেড়ে দেই। আর অভিমান গলায় বলে উঠি
“আমি ধরেছি বলে এমন করছিস তাই না?”
আপা হেসে জবাব দিল
“ধুর পাগলি এমন কিছুই না। শরীরটা ভালো না রে।”
এদিকে আমাদের আগমনে গ্রামের অন্য লোকরা চলে যায়। আপার শ্বাশুড়ি আমাদের বসতে দেয়। নাস্তা দেয়। আমরা যথারীতি নাস্তা করতে বসি। নাস্তার মাঝেই আপুর ননাস এসে বলে উঠে
“মায়ই এত বেয়াদব মেয়ে জন্ম দিয়েছেন কী করে? কথায় কথায় তর্ক করে। আপনি একটু শাসন করে যাবেন। এরকম করলে তো সংসারে অশান্তি ছাড়া কিছু হবে না। মেয়েরা হবে নমনীয়। সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। মেয়েরা কেন এত রুষ্ঠ গলায় কথা বলবে। আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে যাবেন একটু। এরকম করলে তো এমন বউ রাখা মুশকিল। সংসার করতে বিয়ে করিয়েছি ভাইকে, তর্ক করতে না।”
মা মুখে পিঠা নিতে নিচ্ছিল। পিঠাটা তার হাত থেকে পরে গেল। বাবাও একটা ঢোক গিলল। বাবা অবশ্য চুপ করে রইলেন কিছু বলল না। মা আপুর নানাসের কথা শুনে একটু হেসে বলল
“ছোটো মানুষ তো বুঝেনি মা। আমি এখনেই ওকে রুমে নিয়ে বুঝাচ্ছি। ও আর এমন করবে না।”
কথাটা বলে মা বড়ো আপার হাত ধরে রুমের দিকে নিতে লাগলেন। আমিও মায়ের পিছু পিছু ছুটে গেলাম। রুমে গিয়ে মা বড়ো আপাকে খাটে বসালেন নিজেও বসলেন। মা বসার সাথে সাথে বড়ো আপা খাট ছেড়ে উঠে মায়ের পা ধরে বলল
“আম্মা আমি এ বাড়িতে টিকতে পারব না। আমাকে তুমি নিয়ে যাও। ওরা আমাকে এত খাবার থাকতেও রাতে শুধু ডিম ভাত খাইয়েছে। আমার গায়ে হাত তুলেছে আমার জামাই। পশুর মতো গতকাল আমাকে ভোগ করেছে। সে তো আম্মা নেশা করে। আমার দম বন্ধ লাগছে আম্মা। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমি পড়াশোনা করে বড়ো হয়ে তোমাদের টাকা ইনকাম করে দিব। আম্মা গো আমার গালটা দেখো মাইরের দাগে নীল হয়ে গেছে। আমার সোনা গয়না সব কেড়ে নিছে। আমাকে বিধবার মতো সাদা শাড়ি পড়িয়ে রাখছে। আম্মা আমার জামাইয়ের নেশার সমস্যা। নেশা মানুষকে অমানুষ করে তুলে। আম্মা গো এ পাশবিক মানসিক অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারছি না।”
বড়ো আপার কথা শুনে মা রেগে গেলেন আরও। সে আপাকে পা ছাড়িয়ে বলল
“বিয়ে দিয়েছি কি নিয়ে যেতে? একদম চুপচাপ এ বাড়িতে থাকবি। তোরে নিয়ে গিয়ে কী ঘরে পাল্লা দিব? পড়াশোনা শিখে ইনকাম করে খাওয়াবি এত সোজা সব? পড়াশোনা করে মেয়েরা বে/শ্যা হয় বুঝছিস। আর জামাই তো গায়ে হাত তুলতেই পারে। তোর বাপে তুলে না হাত? আমি কী এজন্য সংসার ছেড়ে দিছি?। সংসার সইয়েই খায়তে হয়। আর ভোগ কী অন্য পুরুষ করবে? জামাই কী তোরে বিয়ে করছে শো পিস করে সাজাইয়া রাখার জন্য নাকি। আর বড়োলোকের ছেলেরা একটু নেশা পানি করেই। ঘরে তো পান্তা ভাত ও জুটত না। এখানে যে ডিমভাত খায়তে পারতেছিস এটাই অনেক। আরেকবার যদি মুখ দিয়ে এরকম অলক্ষুণে কথা বলছিস তোর খবর আছে। এখন আমার সাথে যাবি সবার কাছে পা ধরে মাফ চাবি। “
আপার কান্না এ কথা শুনার পর আরও বেড়ে গেল। কান্না গলাতেই বলে উঠল
“আমার কষ্টে কী তোমার অন্তর কাঁপছে না আম্মা। আমি অন্যায় করি নাই তবুও মাফ চায়তে বলতেছো। আম্মারে আমারে নিয়া যাও। এ জীবন থেকে আমি মুক্তি চাই আম্মা।”
“আবার একই কথা বলিস? একদম জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব। এখনই আমার সাথে যাবি সবার কাছে পা ধরে মাফ চাবি।”
কথাটা শেষ করে মা বড়ো আপার হাত ধরে টেনে আনলো সবার সামনে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
“অনন্যাকে আমি বুঝিয়েছি। সে আর এরকম করবে না। সবার কাছে এখন সে মাফ চায়বে।”
বলেই মা বড়ো আপাকে ইশারা দিল মাফ চাওয়ার জন্য। বড়ো আপা কান্নায় বিগলিত হয়ে একে একে শ্বাশুড়ি, ননাস, ননাসের জামাই আর নিজের স্বামীর কাছে পা ধরে মাফ চায়। বড়ো আপার হাহাকার সেদিন আমি সত্যিই বুঝিনি। বুঝিনি তার যন্ত্রণা। আপার হাহাকার করা অন্তরটা সেদিন দেখি নি। দেখেছি কেবল বদলে যাওয়া সম্পর্ক গুলো।
এরপর আপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় আপার নানী শ্বাশুড়ি এসে নতুন নাটকের সূচণা ঘটাল। যেটা আপাকে আরও বেশি ঘায়েল করল।
চলবে?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার