প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি। ইলেট্রিসিটি নেই এক ঘন্টা। কিন্তু নিরুদের ফ্ল্যাটে বিকট শব্দে জেনারেটর চলছে। নীরু খিচুড়ি রাঁধতে বসেছে।
তার মনে পড়ছে প্রথম যেদিন খিচুড়ি রেঁধেছিল সে দিনটার কথা। সেদিন বাসায় মা ছিলেন না। ছোট বোন পুতুলকে নিয়ে খালার বাসায় গিয়েছিলেন। বাসায় নীরু আর ভাইয়া। হঠাৎ করে ভাইয়ার বন্ধু ফরহাদ ভাই এসে পড়লেন। বৃষ্টিতে ভিজে কাদা । ভাইয়া ফরহাদ ভাইকে শুকনো কাপড় দিলেন। তিনি শুকনো কাপড় আর বারান্দায় ঝুলানো নীরুর তোয়ালে নিয়ে শিষ দিতে দিতে গোসলে ঢুকে গেলেন। নীরুর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু ফরহাদ ভাইকে সে অন্য কোন তাওয়েল নেবার কথা বলতে পারল না। ফরহাদ ভাই শিশ দিতে দিতে পাক্কা আধাঘন্টা লাগিয়ে দিলেন। তারপর ভেজা ল্যাপ্টানো তাওয়েলটা বারান্দায় শুকোতে দিলেন। কি বিরক্তিকর।
নীরুর কোচিংয়ে মডেল টেস্ট চলছিল। স্টুডেন্ট লাইফ এসেটা নিয়ে বসেছিল নীরু। ফরহাদ ভাই এসে বললেন
‘দেখি বল ইন্ট্রোডাকশন…. …’
উফ নীরু পড়া বলতে গিয়ে সব গুলিয়ে শেষ। ফরহাদ ভাই খুব ভাব নিয়ে বল্লেন
‘তোর তো ইংলিশে খুব জটিল অবস্থা!
তুই ফেল করবি ইংলিশে। শিওর। যা, যা আর পড়তে হবে না । এবার আমাদের জন্য খিচুড়ি রান্না কর। এমনিতেই যে পড়াশোনার অবস্থা ! পরীক্ষার পরেই বিয়ে দেওয়া লাগবে। ‘
নীরুর ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। এই ছেলেটা সব সময় তাকে এইভাবে অপমান করে। নীরু কান্না আটকে বল্লো
‘আমি খিচুড়ি রাঁধতে পারি না! ‘
‘সেকি রে তুই তো জামাইর বকা খেতে খেতে শেষ হবি। চল আমি শিখিয়ে দেবো কিভাবে খিচুড়ি রাঁধতে হয়। ‘
নীরুর একটুও রান্না ঘরের দিকে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তারপর ও গুটি গুটি পায়ে ফরহাদ ভাইয়ে পিছু পিছু সে গেলো রান্না ঘরে।
‘প্রথমে ডেকচিতে তেল দে তারপর গরম মশলা। মালে এলাচ, তেজপাতা দারচিনি দিবি। লবনটা ও দিয়ে দে । আর একদিকে চাল ডাল ধুয়ে পানি ঝরতে দিবি। তারপর সব ডেকচিতে দিয়ে হলুদ গুড়ো,জিরে গুড়ো কাচামরিচ ফেড়ে পানি ঢেলে দিবি। ব্যস শেষ। চাল ডুল ফুটলে নামাই নিবি। ‘
সেদিন নীরু প্রথম খিচুড়ি রাঁধলো ডিম ভাজলো।
ফরহাদ ভাই আর ভাইয়া খিচুড়ি সব চেটেপুটে খেলো। ফরহাদ ভাই সেদিন বলেছিলেন
‘বাহ তুই তো জব্বর রাঁধিস। কে বলবে এটা তোর প্রথম রান্না। এক্কেবারে ফাস্টক্লাস। প্রথম প্রেমের স্বাদ। ‘
ভাইয়া ফরহাদ ভাইকে বল্লো
‘আম্মা বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। তুই খেয়ে দেয়ে বিদায় হবি। কাপড় বদলে ভিজা কাপড় পরে চলে যাবি। ‘
ফরহাদ ভাই খিচুড়ি খেয়ে ভিজা কাপড় পরে বিদায় হলেন। নীরু অবাক হয়ে খেয়াল করলো তার ভীষণ খারাপ লাগছে।তার কান্না আসছে। ভাইয়ার সাথে ফরহাদ ভাইয়ের হঠাৎ করে কি হলো সেটা নীরু বুঝতে পারে নি।
টেবিলের উপর স্টুডেন্ট লাইফ নোটের পিছনে ফরহাদ ভাইয়ের লেখা একটা চিরকুট আবিষ্কার করলো হঠাৎ
নীরুপমা
তোকে নীরুপমা ই ডাকব
আমার মা নেই,
সতমায়ের সংসারে ভালোবেসে মাথায়
হাত বুলিয়ে কেউই আমাকে কিছু বলে না।
প্রচন্ড বৃষ্টিতে খিচুড়ি খাবার আবদার রাখার ও
কেউ নেই। তাই আজকে একটু বিরক্ত করলাম
তোদের। হিরা মনে হয় আমাকে ভুল বুঝেছে। ভেবেছে তোর সংগে আমার প্রেম!
পারলে ওর ভুল ভাংগাস।
ইতি
পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা ছেলে ফরহাদ
বি দ্র -বরকে এরকম রান্না খাওয়াস। সে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাবে।
নীরু সেদিন সারাদিন কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। সত্যি সত্যিই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর নীরুর বিয়ে ঠিক হয়।
*****
জামিল টেবিলে খেতে বসে বল্লো
‘উফ! অসাধারণ এক্কেবারে ফাসস্ট ক্লাস। প্রথম প্রেমের মতো খিচুড়ি রেঁধেছ।
এনা বল্লো
‘এটা কেমন উপমা হলো বাবা! ‘
‘তুই বুঝবি না। দেখ তোর মা কাঁদছে।’
‘মার কি কোন প্রথম প্রেম ছিল বাবা? ‘
নীরু চোখ মুছে মেয়ের দিকে রাগী চোখে তাকালো। ইচ্ছে করছে কষে একটা চড় দিতে।
বাবার আদর পেয়ে মাথায় উঠেছে!
জামিল অবশ্য সুন্দর করে জবাব দিল।
‘না তোর মার কোন প্রেম ছিল না। তবে আমাকে সে বিয়ে করতে চায় নি। বয়স কম ছিল তাই গায়ে হলুদের রাতে ভয় পেয়ে তোর বড় মামার এক বন্ধুর বাসায় পালিয়ে গিয়েছিল। ফরহাদ ভাই ! ‘
নীরুর জামিলের কথায় গা জ্বালা করছে। কি সুন্দর মেয়ের সামনে বসে ইতিহাসের গীত গাইছে!জামিল নীরুর অগ্নি দৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই বল্লো
‘পরে আমাকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকেই ফরহাদ তাদের বাসায় নিয়ে গেলো। সে রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল। ঢাকা শহর পানিতে থৈ থৈ। এক হাঁটু পানি ভেঙে আমি ফরহাদ ভাইদের বাসায় গেলাম।
দেখি তোর মা আগুনের মতো মুখ করে বসে আছে। আমি গিয়েই তোর মার হাত ধরে বললাম ‘তোমার বাসায় আর যাওয়া লাগবে না, আমাদের বাড়িতে চল। ‘ আশ্চর্য তোর মা দেখি কাঁদতে কাঁদতে রাজি হয়ে গেলো! আমি গায়ে হলুদের রাতে বউ নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। হা হা হা হা! ‘
‘বাবা এতো হাসছ কেন? আস্তে হাসো খিচুড়ি গলায় আটকাবে। ‘
নীরুর ভীষণ রাগ হচ্ছে। ঠিক সেদিনের মতো, যেদিন ফরহাদ ভাই তাকে খিচুড়ি রান্না শিখিয়েছিল ।
#এমন_বরষা_ছিল_সেদিন ।
রুজহানা