বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৪০
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
পূর্ণর সামনে দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ, মুখ অন্যদিক ফিরে। উনি কিছু বলছিলেন না দেখে আড়চোখে উনার দিকে একবার তাকিয়েছি ঠিক এমন সময় পূর্ণ হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠলেন,
—সমস্যা কি তোমার? বাসায় যাবেনা কেন? কি শুরু করেছো?
উনার ধমকে চুপসে গেলাম আমি। মিনমিন করে বললাম,
—অনেকদিন পর এসেছি তো তাই কয়েকদিন থেকে যেতে চাইছিলাম…
—তাই না? তোমাকে চিনিনা আমি মনে করেছো? তুমি যে আমাকে ইচ্ছে করে জ্বালানোর জন্য এরকম করছো তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি। অফিস থেকে এত ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি কোথায় রেস্ট নিবো তা নাহ। তোমার জন্য এখানে ছুটে আসতে হয় আমার। আর তুমি সব বুঝেও ইচ্ছে করে এসব করছো!
পূর্ণর গলায় স্পষ্ট রাগ। উনার ক্লান্ত চোখমুখ বলছেন উনি অফিস থেকে ফিরেই এখানে চলে এসেছেন। তার কথায় যুক্তি আছে বটে, যদিও আমি ইচ্ছে করেই এসব করছিলাম তবুও আমার কাজের পেছনেও তো কারণ আছে। আমাকে তো জানতে হবে উনার অদ্ভুত আচরণের কারণ! আর কতদিনই বা পালিয়ে বেড়াবেন আমার কাছে থেকে? তাই খানিকটা শক্ত গলায়ই বললাম,
—তো কি করবো বলুন? আপনি আমাকে এ কয়দিন ইগ্নোর করেন নি? তাই আমিও করছি।
—আমি তোমাকে কবে ইগ্নোর করলাম?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন উনি। আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
—করেছেন। দাদুবাড়ি থেকে আসার পর আপনি ঠিকভাবে আমার সাথে কথা বলছিলেন নাহ, আবার আমার দিকে তাকাতেনও না ঠিকমতো। যে-ই আন্টির বাসায় এসেছি তখন তো ঠিকি চলে এলেন। তাহলে বাসায় এতদিন কি হয়েছিলো আপনার?
—এতকিছু বুঝেছো তাহলে এটা বুঝোনি কেন ইগ্নোর করছিলাম বাসায় আসার পর?
আমি “না-বোধক” মাথা নাড়লাম। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—তোমার থেকে এর বেশি কিছু আশা করিনি আমি৷ তুমি কবে বড় হবে তুরফা? কবে আমাকে বুঝতে শিখবে তুমি?
উনার কণ্ঠে কাতরতা। তার প্রশ্নে দিশেহারা বোধ করলাম আমি। কি বুঝিনি আমি? উনি যদি আমাকে পছন্দ করেন তবে বলতে দোষ কোথায়? কেন প্রকাশ করেন না পুরোপুরি? আমায় চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ গম্ভীর মুখে বললেন,
—এখন তোমার পড়ালেখা করার সময়। অন্য সবকিছুর জন্য সারাজীবন পড়ে আছে, এসময়টা পড়ালেখায় ব্যয় করো। তোমার বয়সটা অল্প। এটা আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময়। আর আমি চাইনা আমার জন্য এখন তোমার সময় নস্ট হোক বা ভবিষ্যতে তুমি আফসোস করো। তাই এখন থেকে শুধু পড়াশুনার মনোযোগ দেও, তুরফা। আমাকে তুমি সারাজীবন নিজের পাশে পাবে, কিন্তু জীবনের এ সময়টা আর ফিরে পাবেনা। তাই বাসায় যেয়ে এডমিশনের জন্য পড়াশুনায় শুরু করবে আজ থেকে। বাকি সব চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দেও। এখন অন্য কোনকিছু নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবেনা, বুঝেছো?
উনার কথায় স্তব্ধতায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আমার কথা ভেবে উনি নিজের অনুভুতিগুলো দমিয়ে রাখছেন? এমন ধৈর্যশীল পুরুষ আদৌ হয়? লোকটাকে যত গভীরভাবে বুঝতে শুরু করি ততই অবাক হই! উনার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো আমার। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম উনার দিকে!
এদিকে আমার মুখে বিস্ময় দেখে পূর্ণ ইষৎ হাসলেন। আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন,
—এখনই এত অবাক হয়োনা, তুর পাখি। তোমার যে আমার সম্পর্কে এখনো আরও অনেক কিছু জানা বাকি আছে। কিছুটা বিস্ময় সেদিনের জন্যও বাচিয়ে রাখো।
পূর্ণর আচরণে আজ যারপরনাই অবাক হচ্ছি আমি। কি বললেন উনি আমায়? তুর পাখি? নামটা শুনতে কত্ত আপন লাগছে! যেন কোন প্রেমিকপুরুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষকে ডাকছে! এই প্রথম তার থেকে এমন সম্বোধন পেয়ে, তার কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো আমার!
—আপনি এত ভালো কেন?
মুগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমার মুগ্ধতায় নিঃসংকোচ হাসলেন পূর্ণ। সোডিয়ামের আলোর নিচে যে হাসি ভয়ংকর সুন্দর লাগলো আমার কাছে! যে হাসি বুকে ঝংকার তুলে নির্দ্বিধায়! উনি খানিকটা ঝুকে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
—একবার তোমার পরীক্ষা শেষ হতে দেও, আমি কতটা ভালো তার সবটাই হাতেকলমে দেখিয়ে দেবো তোমায়।
উনার কণ্ঠে অদ্ভুত মাদকতা ছিলো! যা অস্থির করে তুললো আমায়। ঢিপঢিপ করতে থাকা বুকে কোনমতে শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
—বাসায় যাবেন নাহ?
—নাহ। আজ ঠিক করেছি তোমাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় রাত কাটাবো।
দুষ্টু হেসে বললেন পূর্ণ। আমি উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই পূর্ণ ভ্রু কুচকে বললেন,
—এভাবে তাকাও কেন হ্যাঁ? আমি তোমার বড় ভুলে গিয়েছো? আমাকে চোখ রাঙ্গাও!
—আমার বরের দিকে আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাকাবো, আপনার কি?
পূর্ণর সেদিনের বলা কথাকে কপি করে বললাম আমি। উনি প্রথমে অবাক হলেও পুরোপুরি প্রকাশ করলেন নাহ। বাকা হেসে বললেন,
—সেইম কথাটা তোমায় আমি বললে কেমন লাগতো, তুরফা? একটু ভেবে দেখো তো।
উনার কথায় গাল গরম হয়ে গেলো আমার। অন্যদিক ফিরে বললাম,
—ছিহ! এখন চলুন তো। বাসায় যাবো।
বলেই হাটা শুরু করলাম আমি। উনার সাথে বেশি কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলোনা আমার, দেখা যাচ্ছে আমার কথায় আমাকেই ফাসিয়ে দিচ্ছেন বরাবরের মতো আর লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে! যা আমি এ মুহুর্তে চাইনা। পূর্ণ খানিকটা হেসে চুপচাপ আমার পাশে এসে হাত ধরে হাটতে লাগলেন। আমি প্রসঙ্গ ঘুরাতে জিজ্ঞেস করলাম,
—আজ গাড়ি নিয়ে আসেননি যে? কিভাবে যাবো আমরা?
—রাইসা বললো তুমি নাকি গাড়িতে বাসায় যেতে চাওনা। রিকশায় যাবে। তাই ভাবলাম রিকশায় করেই নিয়ে আসি তোমাকে। তবে আসল কারণ হচ্ছে ইচ্ছা করেই গাড়ি নিয়ে আসিনি। ভেবে দেখলাম একসাথে রিকশাভ্রমণও তো হয়নি আমাদের কখনো!
চোখ টিপে কথাটা বললেন পূর্ণ। বড় বড় চোখে উনার দিকে তাকালাম আমি। একিসাথে রাইসাকে বকলাম মনে মনে। কি দরকার ছিলো উনাকে বলার? পরমুহুর্তে ভাবলাম ভালোই হয়েছে, আমারও ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে এক ভরাসন্ধ্যায় রিকশাভ্রমণ করার। আজ অবশেষে সেই ইচ্ছেটাও পূর্ণর সান্নিধ্যে পূরণ হয়ে যাবে!
#চলবে
.
.