বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৫৭
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
সকালের মিস্টি রোদ গায়ে মেখে নতুন দিনের সূচনা হলো। বৃষ্টির রেশ কাটিয়ে প্রভাতকিরণের আলোয় জেগে উঠেছে প্রকৃতি, জানালার পর্দা ভেদ করে যে আলোয় জেগে উঠলাম আমিও। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেও বাধ সাধলো, নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়ার বন্ধনীতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছেন পূর্ণ। উনার হাত সরানোর চেস্টা করতেও সহজে ছাড়াতে ব্যর্থ হলাম, যেন এ গভীর ঘুমের মাঝেও আমায় নিজের থেকে দূরে যেতে দিতে উনি নারাজ! শ্বাস নিয়ে আলতো হাতে তার কপালের উপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমের ঘোরেই উনার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির ভাজ পড়লো। একি সাথে হালকা হলো হাতের বন্ধন। এ সুযোগেই বেড থেকে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম!
গোসল সেড়ে রেডি হয়ে নিচে চলে এলাম। সকাল প্রায় পৌনে ৮টা বাজে। বড়াম্মু রেস্ট নেওয়ায় এখনো উঠেন নি, নয়তো প্রতিদিন এতক্ষণে উঠে যান। রান্নাঘরে কাউকে না পেয়ে নিজেই সবার জন্য রান্না করবো ঠিক করলাম। বাসার হেল্পিংহ্যান্ড এর সাহায্যে নিজ হাতে সকালের নাস্তা বানানোর মাঝপথে রাইসা এলো রান্নাঘরে। আমায় দেখে স্মিত হেসে বললো,
—কখন উঠেছিস তুই? রান্নাও তো করে ফেলেছিস দেখছি!
—হ্যাঁ, সকালে ঘুম ভাঙলো তো তাই ভাবলাম করে ফেলি। বড়াম্মু কি উঠেছে রে?
—হ্যাঁ, উঠেছে। আসছেই হয়তো এদিকে। মা-র গলা শুনলাম একটু আগেই। জায়গা দে, তোকে হেল্প করি।
কথা বলতে বলতে রাইসাও আমার সাথে যোগ দিলো। দুজনে মিলে সব কাজ সেড়ে টেবিলে খাবার রাখার ভেতরেই বড়াম্মু এলেন৷ আমাদের দুজনকে মিলেমিশে কাজ করতে দেখে খুশি হলেন। সব কাজ শেষ করে পূর্ণকে ডাকার উদ্দেশ্যে রুমে প্রবেশ করলাম। জনাব এখনো কাথা মুড়ি দিয়ে উদোম হয়ে ঘুমোচ্ছেন। বেলা যে হয়ে গেছে সেদিকে হুশ নেই। অথচ অফিসের জন্য দেরি হলে আমাকে বকবেন! উনাকে বারকয়েক ডাকার পরেও কোন সাড়া না পাওয়ায় বাহু ধরে আলতো ঝাকাতেই মেলে ফেললেন চোখ।
একনজর আমায় দেখে মুচকি হেসে ঘুমের মাঝেই টেনে নিলেন নিজের দিকে, বেসামাল আমি হুট করে টাল সামলাতে না পেরে ঝুকে পড়ে গেলাম তার উপর! মাথা খানিকটা তুলতেই এলোমেলো লম্বা কেশগুচ্ছ নিজ হতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো তার মুখের দু’পাশে! সেই চুলে মুখ গুজে শ্বাস নিয়ে পূর্ণ বললেন,
—আজকের সকাল যে এত সুন্দর হবে তা তো আগে জানা ছিলো না!
—আপনার দেরি হয়ে যাবে কিন্তু। উঠুন।
—একদিন দেরি হলে কিছু হবেনা! তোমাকে রেখে অফিস যেতে মন চাচ্ছেনা।
—তো কি আমাকে নিয়ে অফিস যেতে চাইছেন?
—তুমি যাবে? চলো না। একবার কাজ করবো তারপর রোমান্স করবো তারপর…
—ছিইই! আপনি চুপ করবেন? দিন দিন কেমন লাগামছাড়া কথাবার্তা বলা শুরু করছেন! এখনি উঠে ওয়াশরুমে যান!
কথাটা বলে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই উনি মৃদু হেসে থেমে গেলেন। তবুও আরো কিছুক্ষণ নিজের সাথে শক্ত করে ধরে রেখে কয়েকটা চুমো খেয়ে ছেড়ে দিলেন। অতঃপর এতক্ষণের দুষ্টু মুখটা সর্বদার ন্যায় গম্ভীর করে আমায় ছেড়ে বললেন,
—উফফ তুরফা, ছাড়ো তো! লেট হয়ে যাচ্ছে আমার অফিসে! তুমি খুব দুস্টু হয়ে গেছো, ছাড়তেই চাওনা আমায় দেখি!
বলেই কাপড় আর তোয়ালা নিয়ে গটগট করে ঢুকে গেলেন বাথরুমে। ভাবখানা এমন যেন এতক্ষণ আমিই তাকে ধরে ছিলাম! যতকিছুই হয়ে যাক এ লোকটার স্বভাবের পরিবর্তন হবেনা! হতাশ দৃষ্টিতে উনার যাওয়ার দিক চেয়ে ভাবলাম!
খাওয়ার টেবিলে বসে আছে সবাই। বড়াম্মু অনেক গর্বের সাথে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
—আমার আর চিন্তা নেই গো। আমার মতোই সংসার গুছিয়ে রাখতে পারবে এমন দুটো বউ পেয়েছি মাশাল্লাহ। দুজন মিলেমিশে কি সুন্দর আজকের সব রান্না করেছে, টেবিল সাজিয়েছে দেখো! ওদের দেখেই খুশিতে মনটা ভরে উঠছে!
উনার কথায় সবাই সায় দিলো, আমাদের প্রশংসা করলো। বিনিময়ে আমি ও রাইসা একে-অপরের সাথে হাসি বিনিময় করলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে যাওয়ার পর অফিসের উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে পূর্ণ রুম ছাড়ছিলেন। আমিও চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসে নোটস উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ পূর্ণ এসে আমার পাশে দাড়ালেন। উনাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালাম।
—কিছু বলবেন?
উনি কিছু না বলেই শুধু এক কদম এগিয়ে এসে নিজ হাতে তুলে নিলেন আমার হাতদুটো। ভ্রু কুচকে উনার দিক চেয়ে রইলাম। উনি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—আজকের রান্নাগুলো তুমি করেছিলে না?
আমি চোখ তুলে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। খানিকক্ষণ বাদে মাথা নাড়তেই উনি মুচকি হেসে আলতো করে চুমু খেলেন হাতের উল্টোপিঠে! বেশ নরম সুরে বললেন,
—খুব ভালো হয়েছে। তোমাকে দেখলে যেমন আমার অন্তর প্রশান্ত হয়, তেমনি তোমার হাতের রান্না খেলে আমার উদর পরিতৃপ্ত হয়! বিয়ের পরেরদিন বলেছিলাম না এ প্রশংসাটা অন্য কোনোদিনের জন্য তোলা থাক? আজ তোমার সেই অভিযোগ ভেঙে দিলাম। তুরফা রাণীর আর কোন অভিযোগ নেই তো? থাকলে বলে ফেলো৷ সেগুলোও ঘুচিয়ে দেবো!
বিস্ময়ে, আবেগে বুদ হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। এতটা যত্নের সাথে কারও এতদিন আগের অভিযোগ মনে রেখে তার মান ভাঙার দায়িত্ব নেওয়া যায়? উনাকে না দেখলে হয়তো জানতামও নাহ। আমার বিস্ময়ের মাঝেই কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলেন সেই দায়িত্ববান পুরুষ। তার যে অনেক কাজ বাকি! জীবনের সবদিকেই যেন সমানভাবে ব্যালেন্স করে চলেন তিনি!
_________________
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। আজ রাইসা ওর বাসায় চলে যাচ্ছে। কাল হলুদ, পরশুদিন বিয়ের অনুষ্ঠান। আন্টি ফোন দিয়ে বারবার বলছিলেন তার বাসায় যাওয়ার কথা কিন্তু পূর্ণর অত্যাচারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কেউই আর এ বিষয়ে আমায় জোর করেনি। যথারীতি হলুদের দিন এসে গেলো। কিন্তু আমার মন ছটফট করছে আন্টির বাসায় যাওয়ার জন্য! রাইসার হলুদে মজা করার প্ল্যান করেছিলাম কত, সেগুলো এভাবে নস্ট হতে পারেনা! তাই ঠিক করলাম যেভাবেই হোক পূর্ণকে মানাতে হবে। মনে মনে ফন্দি আটলাম যথারীতি!
রাত হতেই সর্বদার ন্যায় বাসায় এলেন উনি। হাত মুখ ধুয়ে আসতেই আমায় বিছানায় বসে মুখ কালো করে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন যেন! কাছে এসে বসে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—কি হয়েছে তোমার? মুখটা এমন ভার করে রেখেছো কেন?
উনার কথায় ইতোমধ্যে কালো করে রাখা মুখটায় আরেকটু আধার নামিয়ে থমথমে গলায় উত্তর দিলাম,
—কিছু নাহ।
—কিছু তো অবশ্যই হয়েছে! সকাল অব্দি তো ঠিক ছিলে, আমিও তো কিছু করিনি। তাহলে এমন উদাস মুখে বসে থাকার কারণ কি? কেউ কিছু বলেছে? আমাকে বলো না, তুর পাখি। কি হয়েছে?
—আপনি কিছু করেন নি তাই না? সব তো আপনিই করেছেন! আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেন আন্টির বাসায়? আমার কি ইচ্ছে হয়না রাইসার সাথে থেকে ওর হলুদ সেলিব্রেট করতে?
রাগী গলায় মুখ ফুলিয়ে বললাম। উনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। একটু পর চোয়াল শক্ত করে তার কাঠকাঠ জবাব,
—ওহ। এ জন্য মুখের এ অবস্থা বানিয়ে রেখেছো? আর আমি কতকিছু ভাবছিলাম। তুমি রাইসার হলুদে অংশ নিতে চাও, তাই তো? ঠিক আছে আমি তো মানা করছিনা। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো, তুমি রাইসাকে হলুদ লাগিয়ে খেয়েদেয়ে আবার আমার সাথে চলে আসবে। সিম্পল! এই সামান্য ব্যাপারে এত আপসেট হওয়ার কি আছে?
উনার কথায় বিরক্তিতে নাকমুখ বন্ধ হয়ে এলো! লোকটা কি সোজা কথা বুঝেনা নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছেনা? দাতে দাত চিবিয়ে বললাম,
—শুনুন, এভাবে হলুদে যাওয়ার চেয়ে না যাওয়াই ভালো। আপনার এত কস্ট করে আমায় নিয়ে যেতে হবেনা। আমি যাবোই না।
—রাগ করছো কেন? এমন করেনা, সোনা।
উনি কাছে আসার চেস্টা করতেই সরে গিয়ে বললাম,
—আপনার এসব আদিখ্যেতা আপনার কাছেই রাখুন তো! একদম কাছে আসবেন নাহ। মেজাজ নস্ট করে দিয়ে এখন ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে!
আমার সাথে কথায় না পেরে অবশেষে হার মানলেন পূর্ণ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন,
—ঠিক আছে। তুমি যেয়ে থাকতে চাইছো তাই তো? তবে তাই হবে। ওখানেই থাকো। আমি তোমার কে? আমার সাথে থাকতে চাইবেই বা কেন তুমি!
উনার তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে হাসি পেলো আমার। কেমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন! মুচকি হেসে উনার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
—বেশিদিন তো থাকছিনা! কাল প্রান্ত ভাইয়ার হলুদ শেষে ওখানে যাবো, রাত থেকে পরেরদিন বিয়ে খেয়ে সবার সাথে আবার চলে আসবো।
—তোমাকে ছাড়া যে একদিন থাকতেও আমার ভালো লাগেনা। তুমি তাও না বুঝলে আমি কিছু বলবোনা। যতদিন ইচ্ছা থাকো। যা করার করো!
তার কণ্ঠে অভিমান। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় উদাসীনতা বিরাজমান! কি করবো ভাবতে না ভাবতেই বলে ফেললাম,
—আই লাভ ইউ।
—হু…। কিহ?
উনার চোখে বিস্ময়, কিছুক্ষণ আগের রাগ যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো! এদিকে আমি কথাটি বলে সাথে সাথেই লজ্জায় তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। খানিকক্ষণ বাদে খোলা চুলে মুখ গুজে তার রাশভারি গলার আওয়াজে সরগরম হলো কক্ষ,
—এভাবে আমার দূর্বল জায়গায় আঘাত না করলেও পারতে, তুর পাখি। আর যে চেয়েও রাগ দেখাতে পারছিনা তোমার উপর! আই লাভ ইউ টু!
#চলবে
.
.