বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৭২
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
দু’হাতে মেহেদি লাগিয়ে সোফায় বসে আছি। আজ সন্ধ্যায় আমার হলুদ। কাল সকালে বিয়ের অনুষ্ঠান। সেদিন পূর্ণ আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা বলার পর আন্টিরা বাসায় আসেন। তখন বড়রা সবাই মিলে অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ঠিক করেছেন। অতঃপর এসব আয়োজন। বড়াব্বু চেয়েছিলেন যেন তার বাসাতেই আমাদের বিয়ের সব আয়োজন হয় কিন্তু আন্টির বিশেষ অনুরোধেই তার বাসায় আসা। কেননা আমার উপর তার-ও হক আছে, মায়ের মতোই বড় করেছেন এতগুলো বছর! তাই আমি গতকাল আন্টির বাসায় চলে এসেছি, বিদায়ের আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবো। সকাল সকাল রাইসাও চলে এসেছে। আমায় দেখে এগিয়ে এসেই আমার মেহেদিভরা হাতের দিক তাকিয়ে বললো,
—বাহ। মেহেদি আর্টিস্ট দেখি বেশ ভালো। খুব সুন্দর মেহেদি পড়িয়ে দিয়েছে তো তোকে! ভাইয়ার নাম লিখে নিয়েছিস না?
আমি “হ্যাঁ-সূচক” মাথা নাড়তেই উৎসাহী দৃষ্টিতে চোখের সামনে দু’হাত তুলে ধরলো। অনুসন্ধানী নজরে কয়েকবার দুইহাতে চোখ বুলিয়ে কিছুক্ষণ পর থেমে গেলো। হতাশ মুখে বলে উঠলো,
—কি রে? আসলেই দেখছি খুজে পাচ্ছিনা। বেশ কৌশলেই লুকিয়ে রেখেছে পূর্ণ ভাইয়ার নাম। ভালোই হলো, তার খুজতে সময় লাগবে!
ওর কথার প্রত্যুত্তরে আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
—খুঁজে না পেলেই ভালো। তবে উনার যে প্রখর দৃষ্টি। আমার সন্দেহ হচ্ছে বুঝলি!
—আরে ধুর, এমন কিছু হবেনা। দেখবি হয়তো খুজেই পাবেনা। তোর মেহেদি তো প্রায় শুকিয়ে এসেছে, তুলে ফেল যা। সন্ধ্যায় আবার হলুদ আছে। রেডি হতে হবে!
আমি মাথা নাড়িয়ে কিছু বলার আগেই রাইসাকে খাবার খেয়ে নিতে বলার জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন আন্টি। আফটার অল, মেয়েটার এ সময়ে ভালোমতো যত্ন নেওয়া বড্ড বেশি জরুরি! আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মেহেদি তুলে রুমে চলে এলাম। হাতজোড়া লাল টুকটুকে রং ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই! কোথায় যেন শুনেছিলাম মেহেদির রঙ যত গাঢ় হয় জামাই তত ভালোবাসে, যদিও এসব কুসংস্কার। এসবে আমি বিশ্বাস করিনা। তবুও আনমনে কথাটা আসায় হালকা হাসলাম। পূর্ণর ভালোবাসার গভীরতা মাপার জন্য আমার অন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই, উনি নিজেই যথেষ্ট। পূর্ণকে হঠাৎ দেখতে মন চাইলো, এ সময় বাসায় তার হলুদ হওয়ার কথা। না জানি কিভাবে হচ্ছে। প্রান্ত ভাইয়া অবশ্য বলেছেন তিনি আমায় ভিডিও করে পাঠাবেন। এখনো পাঠাননি কেন ভাবতে ভাবতেই মেসেজের টুংটাং শব্দ এলো ফোনে। হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও দিয়েছেন প্রান্ত ভাইয়া। ব্যাপক আগ্রহের সাথে ভিডিও অন করতেই চোখে পড়লো দাদুবাড়ির কাজিনমহলকে! তাসিন ভাইয়া, মিলা আপু সহ আরও অনেকেই এসেছেন। ক্যামেরা অন্যদিকে ঘুরতেই চোখে এলো পূর্ণ-র মুখশ্রী। সোফায় বসে আছেন চুপচাপ। পড়নে শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি। কি স্নিগ্ধ লাগছে তাকে! তাসিন ভাইয়া দুস্টুমি করে গালের দিকে হাত বাড়াতেই বলে গমগমে সুরে বলে উঠলেন,
—একদম মুখে লাগাবিনা।
কিন্তু উনার কথায় তাসিন ভাইয়া দমে গেলোনা। বরং পেছন ঘুরে বাকি কাজিনদের চোখ টিপে ইশারা করতেই সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পড়ে উনাকে হলুদ লাগাতে থাকলো। পূর্ণর মুখের অবস্থা দেখা দেখার মতো, চোখমুখ থমথমে করে রেখেছেন। বুঝা যাচ্ছে পুরো মুখে হলুদ লাগিয়ে দেওয়ায় নিজের কাজিনদের উপর বেশ বিরক্ত তিনি! কিন্তু আক উনার কথায় কেউ পাত্তা দিলোনা। সবশেষে প্রান্ত ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
—এমন দিন তো আর বারবার পাবোনা, বড় ভাইয়া। তাই আজ সুযোগ পেয়েও আমরা কিভাবে ছেড়ে দেই, বলো?
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলো কাজিনমহল। এসব দেখে মুচকি হেসে ভিডিও কেটে দিলাম আমি! এবার সন্ধ্যায় আমার হলুদের পালা!
_______________________
হলুদ রাঙা শাড়ি পড়ে বাসায় সাজানো স্টেজে বসে আছি। হাতে-গায়ে সতেজ ফুলের গহনার রঙিন সমাহার। এতক্ষণে আমার শশুড়বাড়ি থেকে লোকজন আসা শুরু হয়ে গেছে। আমার চাচি, বড়াম্মুরা আমায় হলুদ লাগানোর জন্য চলে এসেছেন আন্টির বাসায়। আমায় দেখে বড়াম্মু এগিয়ে এসে থুতনিতে হাত রেখে কপালে চুমু খেলেন। মিস্টি হেসে বললেন,
—আমার বউমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে। এখন হলুদের ছোয়ায় তোর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে। কাল নির্ঘাত আমার ছেলের মাথা নস্ট হয়ে যাবে।
বড়াম্মুর কথায় আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো। আমিও মাথা নিচু করে লাজুক হাসলাম। রাইসা হলুদের ডালা নিয়ে এগিয়ে এলো। আন্টি, চাচি, ফুপি একে একে সবাই আমায় হলুদ লাগিয়ে দিলো৷ তাদের হলুদ লাগানো শেষ হতেই খাওয়াদাওয়া করতে চলে গেলেন বড়দের গ্রুপ। রয়ে গেলো শুধু আমার কাজিনমহল। ওরা সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে এসে হাম/লা করলো আমার উপর। ইচ্ছামতো হলুদ লাগিয়ে তবেই ক্ষ্যান্ত হলো। সর্বোপরি হলুদ লাগানো শেষ হতেই তাসিন ভাইয়া আমায় দেখে তাড়স্বরে হেসে উঠে বললেন,
—তুরফা বোন, তোকে দেখতে বেশ কিউট লাগছে এখন। মন চাইছে জোরে করে গাল টেনে দেই।
বলেই গাল টানার জন্য এগিয়ে এসে কিছু মনে করে থেমে গেলেন। হঠাৎ উদাস সুরে বলে উঠলেন,
—না ভাই। দরকার নেই তোর গাল টানার। ছোটবেলার ওই কাহিনি মনে পড়লে এখনো ভয় লাগে।
—কিসের কথা বলছো, ভাইয়া? কি হয়েছিলো?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করতেই তাসিন ভাইয়া চোখেমুখে আধার নামালেন যেন।
—বোন রে, তখন আমরা সবাই ছোট ছিলাম। দাদুবাসায় গিয়েছিলাম ছুটিতে। তুই লাল টুকটুকে জামা পড়ে বসে ছিলি, ছোট্ট পুতুলের মতোন লাগছিলো দেখতে। আমিও ছোট মানুষ, আবেগের বশে বেশ জোরেই গাল টেনে দিয়েছিলাম তোর। ফলশ্রুতিতে তোর দুই গাল হালকা লালচে হয়ে গিয়েছিলো। তুই বাচ্চা মানুষ ব্যাথা পেয়েছিলি বিধায় কেদেছিলি বেশ জোরে। পূর্ণ ভাইয়ারা তখন মাত্র বাহিরে থেকে খেলে বাসায় ফিরেছিলেন। বাসায় ঢুকেই তোর এমন কান্না শুনে বেশ অবাক হয়। এরপর তোর গাল আর পাশে আমায় দেখে বুঝতে বাকি থাকেনা কি হয়েছিলো। এরপর হাতের ফুটবল মাটিতে রেখেই আমার পিছে দৌড়। অনেক ছুটেও সেদিন ভাইয়ের হাত থেকে বাচতে পারিনি, যে ধোলাইটা দিয়েছিলো রে বাবা।
মাথা চুলকে চোখমুখ কুচকে কথাটা শেষ করলেন তাসিন ভাই। তার অভিব্যক্তি দেখে সবাই হেসে উঠলো একসাথে। আমিও হাসির মাঝেই বিস্ময় চেপে রাখলাম, লোকটা আর কত কিছু লুকিয়ে রেখেছে আমার থেকে কে জানে? ভাবনার মাঝেই দেখি তাসিন ভাইয়াও হেসে উঠলেন সবার সাথে। হয়তো অনেকদিন পর ছোটবেলার পুরাতন স্মৃতি চারণ করে বেশ মজা পেলেন! সকলের সাথে হাসি-ঠাট্টায় সুন্দর এক হলুদসন্ধ্যা কাটলো আমার!
_____________________
রাত হয়ে চলেছে বেশ। হলুদ অনুষ্ঠান করে সবাই চলেও গেছে। শুধু থেকে গেছে রাইসা ও আমার কাজিন বোনেরা। ওরা আজ এখানেই থাকবে আমার সাথে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই যে যার মতো গল্প করতে ব্যস্ত। আমিও ড্রেসচেঞ্জ করার জন্য পা বাড়াতেই ফোন বেজে উঠলো। এ সময় কে ফোন করছে আমি বেশ বুঝতে পাচ্ছি, তাই দ্রুতকদমে হেটে ফোন রিসিভ করেই বলে উঠলাম,
—এতক্ষণে তবে সময় হলো আপনার আমার সাথে কথা বলার? সারাদিন কোথায় ছিলেন বলুন? একটাবারও কল দিলেন না যে?
—তুমি কি সাজগোজ তুলে ফেলেছো?
পূর্ণর এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম। কি প্রশ্ন করলাম আর বিনিময়ে কি উত্তর দিলেন! উল্টো আমাকেই প্রশ্ন করলেন! অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলাম,
—এখনো না। আপনি দেখবেন? ভিডিও কল দিই?
—না।
উনার কথায় আরেকদফা অবাক হলাম। কি হয়েছে তার? এভাবে কথা বলছেন কেন? আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো এমন সময় মিলা আপু নক করলেন দরজায়। এরপর রুমে ঢুকে আমার হাত টেনে বেরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
—ছাদে যা, তুরফা।
—এখন? এই সময় কেন, আপু?
—যার সাথে কথা বলছিস সে-ই তোর প্রশ্নের ভালো উত্তর দিতে পারবে।
কথাটা বলে হেসে উঠে আমায় ঠেলে ছাদে নিয়ে গেলেন আপু। আমায় ছাদে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজটা পেছন থেকে লাগিয়ে চলে গেলেন ছাদের বাইরে। আপুর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে পেছন ঘুরতেই চোখে পড়লো ছাদের অপর প্রান্তে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণকে। এখনো আমার মতো কানে ফোন ধরেই দাড়িয়ে আছেন তিনি। একধাপ এগিয়ে এসে রসিকতার সুরে বললেন,
—ফোন রাখো।
উনার কথায় হেসে ফেললাম আমিও। কান থেকে ফোন সরিয়ে তার দিক এগিয়ে গেলাম। উনিও এগিয়ে এসে দু’হাতে আগলে ধরলেন আমায়। কতক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে নিজ হাতে আমার গাল আকড়ে ধরে মুগ্ধ চোখে বললেন,
—খুব সুন্দর লাগছে, বউ। সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমায় সামনাসামনি এরুপে দেখবো বলে! ধৈর্যের ফল সুন্দর, এটা তার প্রমাণ!
তার কথায় লাজুকতা ছড়িয়ে গেলো দু’গালে। আরক্তিম মুখে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে চেয়ে থাকলাম তার পানে। হঠাৎ উনি এগিয়ে এসে নিজের গাল বাড়িয়ে আমার হলুদমাখা গালে ছুয়ে দিলেন। তার দাড়ির স্পর্শে হালকা কেপে উঠায় চোখ বন্ধ হয়ে এলো নিজ হতেই। খানিকপর সে হলুদমাখা গাল আমার গলার কাছে ছুয়ে দিতেই বন্ধ চোখজোড়া আরেকটু তীব্রভাবে বুজে হয়ে এলো।
—এখন আমাদের হলুদ কমপ্লিট!
সরে এসে দুর্বোধ্য কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো চাঁদের আলোর নিচে প্রজ্জ্বলিত তার সুন্দর মুখ। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি লেগে আছে। চোখে গভীর ভালোবাসা। সে চোখের দিকে চেয়েই লাজুক হেসে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
—এজন্যই এসেছেন, তাই না?
—হু। তোমাকে দেখা মেইন উদ্দেশ্য ছিলো। তবে আরও একটা কাজে এসেছি কিন্তু।
—তাই? কি কাজ?
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মাথা নিচু করে একগাল হাসলেন পূর্ণ। অতঃপর পাঞ্জাবি টেনে ঠিক করে পকেট থেকে একটা চারকোণা বক্স বের করে আমার সামনে হাটুগেড়ে বসলেন। অবাক চোখে সেদিকে তাকাতেই আমার বিস্ময়মিশ্রিত চোখজোড়ায় চেয়ে বক্স থেকে একটা ডায়মন্ড রিং বের করে এগিয়ে ধরে বললেন,
—এই ছাদে একি জায়গায় বিয়ের জন্য আমাদের কথা বলতে পাঠানো হয়েছিলো, মনে আছে? সেদিন তুমি বলেছিলে আমি যেন বিয়েতে নির্দ্বিধায় মানা করে দিই। কিন্তু সেদিন চেয়েও যা বলতে পারিনি, আজ স্বেচ্ছায় তা বলছি। আমি তোমাকে কখনো মানা করতে পারবোনা, তুর পাখি। আমি সারাজীবনের জন্য তোমাকে নিজের করে পেতে চাই, বৈধভাবে আমার রাজ্যের রানী করে রাখতে চাই। তুমি কি আরেকবার আমার হবে? নিজ ইচ্ছায় আমায় বিয়ে করবে?
আবেগঘন এমন মুহুর্তে হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেলো, সুখপাখিরা মনসম্রাজ্যে কিচিরমিচির করতে লাগলো। পূর্ণ সত্যিই পারেন বটে! এমন আবদারে কখনো মানা করা যায়? তাইতো মাথা নাড়িয়ে উনার কথায় সায় দিয়ে তার বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখতেই অনামিকায় আংটি পড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন তিনি! উঠে দাড়িয়ে খানিকটা ঝুকে আংটি পড়ানো হাতে চুমু খেতেই হেসে উঠলাম আমিও!
নির্জন রাত্রির নিরিবিলি ছাদে দুজনের এ ভালোবাসার সাক্ষী হলো একঝাক চাঁদের আলো!
চলবে………