®রোজা রহমান
‘
সকাল নয়টা বেজে পনের মিনিট। রোদ উঠে গেছে বেশ ভালোমতো। রোদের তেজ মনে হচ্ছে পুরো শরীর আ’গু’নের ভেতর। গরমে ব্যস্ত শহরের অবস্থা বেগতিক। এক প্রাকৃতিক গরম তারউপর এদিকে আবার রাস্তার যানজট, গাড়ির হর্ণের পেঁ পুঁ শব্দ। জাস্ট অসহ্যকর পরিবেশ। তবুও কি আর করার? ব্যস্ত শহরে, ব্যস্ত মানুষদের পেটের দায়ে ছুটতেই হবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে।
কুয়াশা আর স্মৃতি কলেজের গেইট পেরিয়ে কলেজের ভেতর ঢুকল। এটা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ। এই কলেজের ভেতরটা অনেক সুন্দর। গেইট পেরিয়ে ওরা প্রথম গেইট দিয়ে তাদের ক্লাস রুম বিজ্ঞান ভবনের উদ্দেশ্য হাটছে আর গল্প করছে। ঈশা আসে নি আজ। কলেজের ফিল্ড আগে অনেক বড় ছিল। এখনো আছে অবশ্য কিন্তু কলেজে ঢুকতে ডান সাইডে আগে গাছগাছালি ছিল। গাছের নিচে বসার জন্য সুন্দর শান বাঁধায় করা ছিল। সেগুলো কেটে, ভে’ঙে এখন সেখানে দশতালা বিশিষ্ট বিল্ডিং হচ্ছে যেগুলো ক্লাস রুম হবে। এজন্য কলেজের ফিল্ডটা একটু ছোট হয়ে গেছে। এখন বসে আড্ডা দেবার জন্য কলেজ থেকে বের হয়ে ডান সাইডে পুকুর পাড়ে সেখানে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছাত্র ছাত্রীরা আড্ডা দেয়৷ সেই জায়গাটাও অনেক সুন্দর। পুকুরটা বেশ বড় সড়ই। শান করে ঘাট বাঁধায় করা আছে। পানিগুলো অনেক সুন্দর। এছাড়া অন্যান্য সব জায়গায়ও বসে আড্ডা দেয় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টর ছাত্র ছাত্রীরা।
তারা গল্পে গল্পে ক্লাসে চলে এসেছে। স্মৃতি কুয়াশার বেস্ট ফ্রেন্ড। ঈশা কুয়াশার আত্মীয় হলেও তেমন একটা ক্লোজ না যতটা স্মৃতি তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। ক্লাস রুমে ঢুকতেই সামনে রনি এসে দাঁড়াল। এই ছেলেটা আজ এক বছর ধরে কুয়াশার পিছে পড়ে আছে। কিন্তু কুয়াশার পাত্তা পায় না৷ রনি কুয়াশার ফ্রেন্ডই ধরতে গেলে। কুয়াশা সেম ইয়ারে রিলেশন পছন্দ করে না৷ তার ভাষ্যমতে সেম ইয়ারে প্রেমের কোনো মজা নেই। তার থেকে বড় কোনো ছেলের সাথে প্রেম করলে কেয়ার করে, ভালোবাসা বেশি দেয়, কি সুন্দর যত্ন নেয়, ঘুরতে নিয়ে যায়, শাসন করে আহা কি সুন্দর প্রেম হয় সিনিয়রদের সাথে। আর সেম ইয়ারে প্রেম করে গাঁ-ধারা। যেসবের কোনো ভিত্তি নেই, কোনো ভবিষ্যত নেই জাস্ট টাইম পাস৷ এজন্য ওসবের ধারে কাছেও নেই কুয়াশা। রনি যতবার এসে প্রেম বার্তা পেশ করে সে ততবার বলে,
” তুই যত বার বলবি বল, আমি কান করেছি ঢোল ”
প্রথম দিন এই কথা শুনে তো রনি পুরোই ভেবাচেকা খেয়ে গেছিল৷ মনে মনে ভেবেছিল,
” এ কি কথার সুরত??”
অবশ্য কুয়াশার থেকে এগুলোই আশা করা যায়। এ মেয়ে এমনই, কথা বার্তার ঠিক নেই। কাকে কি বলে, কখন কি করে সে নিজেও বোঝে না।
রনিকে ভেঙচি কেটে সে আর স্মৃতি ক্লাসে ঢুকে গেল। গিয়ে তাদের রেজিষ্ট্রি করা বেঞ্চে গিয়ে বসল। রেজিষ্ট্রি করা বলার কারণ কর্ণারের সারির ফার্স্ট বেঞ্চে তারা ছাড়া আর কাউকে বসতে দেয় না। ঈশা সহ তারা দু’জন বসে। কুয়াশা মুটামুটি ফার্স্ট ইয়ারের শুরু থেকেই সবার কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিল। স্যার, ম্যামদের সাথে তার ভালোই সক্ষতা গড়ে উঠেছিল প্রথম থেকেই৷ সেটা আস্তে আস্তে এখন ভালোর দিকে। স্যার, ম্যামরাও কুয়াশাকে অনেক পছন্দ করে, ভালোবাসে। স্টুডেন্ট হিসেবেও খারাপ না তারা। কুয়াশারা বসতেই রনি আর তার একটা বন্ধু আবার তার সামনে এসে দাঁড়াল। রনি কুয়াশার সামনে বেঞ্চের উপর দুই হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল৷ কুয়াশা চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল রনির দিকে। রনি বলল,
” সমস্যা কি তোর? এত ভাব নেস ক্যান? “
উত্তরে কুয়াশা বলল,
” ভাব আবার কেমনে নেই? সেটা কেমন? দেখতে কেমন? আর তোর কোন দিক দিয়ে মনে হচ্ছে আমি ভাব নিচ্ছি? “
রনি একটু রেগে গেল এই মেয়ের হেঁয়ালিপনাতে। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
” দেখ কুয়াশা হেঁয়ালি করবি না৷ সোজাসুজি বলছি তোকে, তেমনই উত্তর দে। তোকে আমি পছন্দ করি, ভালোবাসি কেন বুঝিস না স্টুপিড! “
কুয়াশা বিরক্ত হলো। সেটা মুখে প্রকাশ পেল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে উত্তর দিল,
” আমিও সোজাসুজি উত্তর আগেও দিছি এখনো দিচ্ছি তোর আমি বন্ধু। বন্ধু হিসেবে পছন্দ হতেই পারে আর ভালোবাসতেও পারিস সেটা অতি স্বাভাবিক। এতে অস্বাভাবিক বা দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাকেও যে সেটা মেনে কৃতজ্ঞতা হয়ে তোকে ভালোবাসতে হবে তেমন তো কোনো কথা নেই! এছাড়া তোকে আগেও আমি বলেছি আমার সেম ইয়ারে প্রেম ভালোবাসা পছন্দ না। “
রনি আবারও কষ্ট পেল। সেটা দেখেই বোঝা গেল। চোখ মুখ অসহায় করে কুয়াশার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল৷ অসহায় কন্ঠে বলল,
” প্লিজ, কুয়াশা একটু আমাকে বোঝেক। আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ ইয়ার, কেন বুঝছিস না। আমি তোর জন্য মরিয়া হয়ে গেছি চোখে পড়ে না তোর? এমন অবহেলা কেন করছিস? একটু ভালোবাসলে কি হয়? একটু ভালোবাস, কথা দিচ্ছি তোকে আমার সর্বস্ব দিয়ে পৃথিবীর সকল ভালোবাসা দেব ”
ছেলেটা অসহায় ভাবে বলে চলেছে৷ ক্লাসের কাউকে পরোয়া করছে না। ক্লাসের সকলে ওদের দিকেই তাকিয়ে। স্মৃতি সহ কুয়াশা চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে রনির দিকে। এরপর কুয়াশা তার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকাল যেটা রনির হাতের মুঠোয়। একবার দেখে নিয়ে আবার তাকাল রনির পানে। অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” হাত ছাড় রনি। ক্লাসের সবাই দেখছে। নেগেটিভ ভাবে নেবে সকলে। দেখ তুই আমার বন্ধু এমন কোনো কাজ করিস না যেটাতে আমার তোর সাথে খারাপ আচরণ করতে হয়। আমি তোকে অনেক বলেছি। এসব না করে, আমার পিছে না ঘুরে পড়াশোনায় মন দে। যা জায়গায় গিয়ে বস। “
রনি কুয়াশার কথায় হাত তো ছাড়ল কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না। ছেলেটা বয়স হিসেবে অতি জলদি বেড়ে উঠেছে। দেখলে মনে হয় না ইন্টারের ছাত্র। লম্বা, ফর্সা, শারীরিক গঠন ও আকর্ষণীয়। এক কথায় সুদর্শন বলা যায়। তবে চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা টাইপ কিছু আছে এখনো। সে সরল চোখে কুয়াশার পানে অনিমেষ কিছু পল তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
” তোকে আমার ভালোবাসা স্বীকার করতেই হবে। আমি তোর মুখে আমার জন্য ভালোবাসার শব্দ বলিয়েই ছাড়ব দেখে নিস। “
এই বলে চলে গেল। কুয়াশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এটা প্রায়ই এবং এক বছর যাবত হয়ে আসছে। এমন কথা শুনে আসছে, সে অভ্যস্ত। সে-ই বা কি করবে? কারো যেটা পছন্দ না কেউ কি হাজার জোর করে করাতে চাইলে সেটা সম্ভব হয়? তবে যেখানে মেয়েটার সেম ইয়ার পছন্দ না সেখানে কি করে হাজার অনিহা থাকা সত্ত্বেও সে রনিকে গ্রহণ করবে? মনের উপর কখনো জোর খাটে না। আর এটাতো ভালোবাসার ব্যাপার স্যাপার !!
______
কুষ্টিয়া ল’ কলেজ ক্যাম্পাসে শিশির বাইক নিয়ে প্রবেশ করল। সাথে আরেক বাইকে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু রিজভী। দু’জনে পার্কিং সাইডে বাইক রেখে বাইক থেকে নামল। তারপর দু’জনে ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। দোতালায় সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় রিজভী বলল,
” দোস্ত আমাদের বোধহয় সিনিয়র লয়ারদের সাথে ইনভেস্টিগেশনে যেতে হবে। রমিজ স্যার জানিয়েছেন এতে আমরা ক্লাসের টপ দশ জন সুযোগ পাচ্ছি। দু’জন করে ভাগ করে দেবে। প্রাক্টিক্যালও বলতে পারিস৷ “
” কোন লয়ারের সাথে? নাম বলেছে? “
” না সেটা নাকি এখনো ঠিক হয়নি৷ গ্রুপে স্যার শুধু এটুকুই বলেছেন। “
” আচ্ছা স্যারের সাথে কথা বলব এ বিষয়ে “
রিজভী ছোট উত্তর দিল শুধু,
” হু “
তারপর তারা একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে উপরে তাদের নিজ গন্তব্যে পৌঁছাল। তারা এলএলবি ফোর্থ ইয়ারে। সেটা শেষেরই দিকে।
______
রাত আটটা। নীহারের ঘরে বসে জোরে জোরে পেট ফাঁটা হাসি হাসছে কুয়াশা, বৃষ্টি, হিমেল। নীহারের চেহারাটা ফাঁটা বাঁশের মতো হয়ে আছে৷ আর শিশির ভাবলেশহীন ভাবে বসে ভ্রু কুঁচকে কুয়াশা আর বৃষ্টির দাঁত কেলানি দেখছে বিরক্তও তার মুখে স্পষ্ট শোভা পাচ্ছে। সেই হাসির শব্দে সেখানে তুহিন এসে হাজির হলো। নীহার বলল,
” কুশু, ভাবি এবার তো থামো। কই তোমরা আমার কষ্টে কষ্টায়িত হবে তা না এভাবে মজা নিচ্ছ? ”
কুয়াশা হাসতে হাসতে বলল,
” কি করব ভাইয়া? হাসি থামছে না৷ তোমার মুখটা দেখতে যা লাগছে। বাই দ্যা ওয়ে দেবদাস হবার চান্স আছে হান্ড্রেড পার্সেন্ট৷ ট্রাই করতে পারো “
বলে আবার হাসতে শুরু করল। বৃষ্টিও হাসতে হাসতে বলল,
” কথাটা কিন্তু মন্দ না দেবরজী৷ কুশু ঠিক বলেছে। তোমার মুখের এক্সপ্রেশন যেমন করে রেখেছ মনে হচ্ছে তুমি বড় রকমের ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছ৷ “
তুহিন ভেতরে আসতে আসতে বলল,
” কি হয়েছে? ”
বৃষ্টি সব বলল। সব শুনে তুহিন ভাইয়ের কাঁধ চাপরে বলল,
” এর জন্য এমন টমেটো হয়ে আছিস? আরে ব্যাটা পৃথিবীতে কি আর মেয়ে নেই?”
আসলে হয়েছে কি, এদের এতো হাসির আর মজা নেবার কারণ নীহার। নীহার যে মেয়েটাকে পছন্দ করত? আজ তাকে প্রপোজ করতে গেছিল সাহস নিয়ে৷ শিশিরও ছিল। শিশিরই ডেকে নিয়েছিল নীহারকে। তারপর মেয়েটার সামনে গিয়ে প্রপোজ করতেই মেয়েটা জানিয়েছে সে অলরেডি এঙ্গেজড এবং সেটাও তারই প্রিয় মানুষের সাথে অর্থাৎ প্রেমের বিয়ে। বেচারা নীহার তখন কি আর করবে? বেচারার,
‘ প্রেম করোনের আগেই তার দিল আচ্ছেচে টুট গায়া ‘
তখন থেকে এমন চুপসে আছে। যতই হোক অনেকদিন ধরে পছন্দ করত মেয়েটাকে। মেয়েটাকে সে দেখেছিল চলতিপথে রাস্তায়। দেখতে অনেক সুন্দর ছিল মেয়েটা। তারপর সেদিন পিছু নিয়ে দেখেছিল শিশিরের কলেজে যেতে। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল সেখানেই পড়ে মেয়েটা৷
শিশির ভাইয়ের কাছে এসে কাঁধের উপর হাত দিয়ে আশ্বাস দিল। অর্থাৎ,
” চিন্তা করিস না ভাই আমি আছি তো। ওরকম হাজারটা মেয়ে খুঁজে দেব। “
কুয়াশাও এবার মনটা বেজার করে বলল,
” ভাইয়া কুল, এমন মন খারাপের কি আছে ? আমার ভাই লাখে একটা। চুটকি বাজালে মেয়েরা তোমার সাথে ডেট পর্যন্ত… “
সম্পূর্ণ করার আগেই নিয়ম মাফিক মা-ইর পড়ল৷ সেটাও রুটিন অনুযায়ী মাথাতেই। ‘আহ’ শব্দ করে রাগ নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। শিশির ওর দিকে রাগি চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ বলল,
” গোবর ঠাঁসা, এসব আজেবাজে কথা-বার্তা, কাজ-কার্বার কই থেকে শিখেছিস তুই? লেখাপড়ার নাম করে এসব শিখছিস? পড়াশোনা করে যদি এসব বাজে জিনিসই শিখিস তবে তোর আজ থেকে পড়া-লেখা বন্ধ। ঘরে বসে থাকবি তুই। দুইদিন পর বিয়ে দিয়ে দেব।”
কুয়াশা তো ফুঁসছে৷ পেয়েছে কি এই ছেলে? মা-রার শুধু ছুতো খোঁজে। আরে ব্যাটা আগে পুরো কথা তো শুনতি! তারপরে না হয় মা-রতি। সে রেগে বলল,
” তোর কথা মতো আমি পড়া-লেখা বন্ধ করব? হ পড়াশোনা করে বাজে হচ্ছি। আরো হবো৷ কি করবি তুই? কর। “
বলা শেষ করে আর কাউকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বসে থাকা শিশিরে চুল গুলো দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে জোরে আচ্ছা মতো টেনে দিয়ে ভোঁদৌড় দিয়ে পালাল। আজকে আর সুযোগটা হাতছাড়া করল না। শিশির বসে আছে বলে নাগাল ও পেয়ে গেছে চুলগুলো। তার চুল ধরে টানে শুধু এবার সেও সু্যোগ বুঝে টেনে দিল। সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। চুপ করে দেখেই গেল শুধু যেটা নিত্যদিন দেখতে হয় তাদের। এদিকে কুয়াশা দৌড় দেবার সময় ভেঙচি কেটে শিশিরকে বলে গেল,
” দেখ কেমন লাগে!!”
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part )