®রোজা রহমান
‘
চোখে পানি টুপটুপ করে পড়ছে কুয়াশার। একহাতে বার বার তা মুছে চলেছে। এক মুছছে তো আবার এক বের হচ্ছে পানি৷ ওভাবেই একহাতে মোম ধরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল জোর গতিতে পা ফেলে। সোজা কোনোদিকে না তাকিয়ে শিশিরের ঘরে গেল। ঘরের দরজা খোলায় ছিল।
গিয়ে দেখল শিশির রাগে ফুঁসছে বিছানায় বসে। নিজেকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না সে। দু’হাতে বিছানা খামচে ধরে চোখ ফ্লোরে দিয়ে রেখেছে। কুয়াশা ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে কোনোমতো হাতের মোমবাতিটা ড্রেসিনটেবিলের উপর রেখে বিদ্যুৎ গতিতে শিশিরের উপর হামলা চালাল। এ যে সে হামলা না! রাগ, দুঃখ, কষ্ট, গালের ব্যথা, অভিমান সব একসাথে ঝারতে লাগল। শিশিরের চুলগুলো দুহাতের মুঠোয় নিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলার পণ করেছে। মাথাসমেত চুল ধরে টেনে টেনে ঝাঁকাচ্ছে আর অনবরত বলে চলেছে,
” বল কেন মারলি আমাকে? কি করেছি কি আমি? তুই কিছু না জেনে না বুঝে কেন মা’রলি আমাকে? সত্যি না জেনে আমায় কেন মা’রবি তুই? সবসময় কেন আমাকে মা-রতে হবে তোর? আমি কি স্বস্তা জিনিস? তুই সত্যিটা আগে জেনে নিতি তারপর মা-রতি। সবসময় নিজের মনমর্জি মতো কেন চলবি তুই? পেয়েছিস কি তুই? বল কেন মা’রলি? বল! আমার ব্যথা লাগে না? আমার কষ্ট হয় না? আমাকে তোর মানুষ মনে হয় না? কেন মা-রবি আমায় তুই? কে আমি তোর? বল? ”
এমন পাগলের প্রলাপ বলে চলেছে। আর একের পর এক চুল টানছে। শিশির আঁটকাতে গেলে ওর হাতে খামচি দিচ্ছে, আবার দুই বাহুতে চাপ্পড় দিচ্ছে , তো আবার কখনো বুক আর পিঠে থা-প্পড়, কি’ল, ঘু-ষি, খা’মচি সব দিচ্ছে। কোথাও বাদ রাখছে না৷ কুয়াশার শরীরের জোর মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে শিশিরের থেকেও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে৷ মানে শিশির ওকে কিছুতেই থামাতে পারছে না। আকষ্মিক হামলা সামলাতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। কুয়াশা একদম পা-গলের মতো করছে আর প্রলাপ গাইছে৷ তার একটাই কথা,
” কেন মারলি তুই? সত্যি না জেনে কেন মা-রলি? ”
এই দুইটা বাক্য শতবার বলা হয়ে গেল সাথে হেঁচকি তুলে তুলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একদম বাচ্চারা যেমন ফুঁপিয়ে আঁটকে আঁটকে কথা বলে আর কাঁদে? ঠিক তেমন করে।
শিশির এবার না পেরে কুয়াশার দুইহাত জোর দিয়ে ধরে হাত মুচড়ে কুয়াশার পিছনে দিয়ে ওকে টেনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নিল। বাচ্চাদের যে কায়দায় খাওয়ানো হয়? ওইরকম। কুয়াশার পা জোড়া বাম দিকে নিয়েছে আর মাথাসমেত শরীর ডান দিকে। হাত বাঁধা পড়ায় এবার অনবরত হাত মুচড়াতে লাগল ছাড়া পাবার জন্য। কিন্তু মুখ এখনো তার চলছে। শিশির তার নিজের দু’হাত দিয়ে কুয়াশার হাত ধরে রেখেছে৷ এখনো পাগলামো ছাড়ে নি৷ মানে ওর এতটাই ব্যথা লেগেছে যে দিকবিদিক ভুলে গেছে। তারউপর আবার মা-রটা দিয়েছে শিশির যে ওর সব থেকে অপ্রিয়৷
মিনিট খানেক প্রলাপ বকে হাত মুচড়েও যখন হলো না তখন মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শিশিরের কাঁধের বরাবর গলার নিচে কামড় বসিয়ে দিল৷ জোরেই দিয়েছে৷ শিশির সাথে সাথে গুঙিয়ে উঠে চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেলল৷ দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। মিনিট হয়ে যাচ্ছে যখন ছাড়ল না কুয়াশা তখন শিশির অতি কৌশলে কুয়াশার দুই হাত এক হাতের মধ্যে আঁটকে নিল৷ তারপর অন্যহাত যেটা ডান হাত শিশিরের সেই হাত কুয়াশার ঘাড় গলিয়ে মাথার পিছনের চুল জোরে চেপে ধরল। চেপে ধরার জন্য কুয়াশা মাথায় ব্যথা পেল তাই মুখ তুলে নিল তখন। কুয়াশা যখন মুখ তুলে নিয়েছে তখন শিশিরও ওর চুলের বাঁধন হাত থেকে আলগা করে দিয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ ছাড়ল না। মাথা ধরেই রাখল৷
কুয়াশা এখনো হেঁচকি তুলে তুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ভাবে লাগছে দম আটকে আসছে৷ হাঁপিয়েও গেছে শিশিরকে মা-রতে মা-রতে। ওমনি ফুঁপাতে ফুঁপাতে শিশিরের দিকে তাকাল। আবারও বলল,
” বল কেন মা’রলি আমাকে? আমি কি খারাপ মেয়ে? তুই আমাকে মা’রলি? ”
এইটুকু বলে অয়নের সাথে ঘটা ঘটনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আঁটকানো কন্ঠেই বলল সব বিস্তারিত।
শিশির এবার পূর্ণদৃষ্টি দিল কুয়াশার উপর৷ ঘরের দুটো মোমবাতির আলোই মৃদু আলোকিত হয়েছে। দুটো মোমবাতি বলতে একটা শিশির ঘরে এসে জ্বালিয়েছিল। ঘরে চার্জারলাইট আছে সেটা জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করেনি। রাগের মাথায় মোমবাতি জ্বালিয়েছে। আর একটা কুয়াশা এনেছে। দুইটা মোমবাতির আলোই শিশির খেয়াল করে দেখল এই সময়টুকুর মাঝে পুরো মুখটা লাল হয়ে গেছে কান্না করার জন্য। চোখও ফুলে উঠছে৷ মোমবাতির হলুদাভায় মা-রের দাগটা চোখে পড়ল না। ঘেমে গেছে মুখ, শরীর। কারেন্ট না থাকায় শিশিরও ঘেমে গেছে। তারউপর দু’জন যে পরিমাণে ধস্তাধস্তি করল! কুয়াশার চুলগুলো হাত খোঁপা করা ছিল সেগুলো ধস্তাধস্তির সময়ই খুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।
কুয়াশাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে শিশিরের কি হলো কে জানে! সে কুয়াশার ধরে রাখা হাত দুটো ছেড়ে দিল। এরপর সেই বাম হাত কুয়াশার পেট বরাবর কোমড়ের পাশে আঁকড়ে ধরে কুয়াশাকে টেনে নিল নিজের মাঝে। মাথায় রাখা হাতটা কুয়াশার মাথা ধরে মিশিয়ে নিল বুকের সাথে। কুয়াশাও একটু আদরের সঙ্গ পেয়ে বাচ্চাদের মতো শিশিরকে আঁকড়ে ধরল৷ একদম বাচ্চাদের মতো করে নিজের দু’হাত শিশিরের কাঁধ গলিয়ে গলা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শিশিরের গলায় মুখ গুঁজে দিল৷ আবারও শব্দ করে কেঁদে দিয়েছে৷ এবারের শব্দ করে কান্নাটা অস্পষ্ট স্বরে বের হতে লাগল৷ কারণ তার মুখ শিশিরের গলার মাঝে। শিশিরকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে কেঁদে চলেছে। শিশিরও যেন সব ভুলে গেছে৷ শুধু শিশির না, দু’জনই ভুলে গেছে তারা ঠিক কে কোথায়? এবং কে কিভাবে আছে!!
কুয়াশা কাঁদছে আর শিশির ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেবার বৃথা চেষ্টা করছে। সে একটু অনুশোচনায় পড়েছে৷ আসলেই আগে সত্যিটা জানা উচিত ছিল।
‘সব সময় চোখের দেখা সঠিক হয় না৷ কিছু চোখের দেখা ভুলও হয়’
তার উচিত ছিল সেটাকে আগে তদন্ত করার। আগেই না বুঝে এতটা রাগ দেখানো কিংবা এতটা জোরে মা-রা উচিত হয় নি৷ মেয়েটা সহ্য করতে পারেনি। পারবে কি করে? সে তো কখনো এত জোরে মা-র কারো থেকে খায়নি! সে ছোট থেকেই দেখে আসছে এই মেয়েটাকে সবাই আদরে মানুষ করেছে। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে বড় করছে। আদুরে বিড়াল ছানার মতো করে সকলে যত্ন করে। বাড়ির একমাত্র ফুল কিনা!! বাবা চলে যাবার পর থেকে আরো বেশি আদর পেয়েছে। সেই মেয়েটাকে এমন মাই-র দিল আজ! তাকে এমন মা-র আজ পর্যন্তও কেউ দেয় নি৷
‘
আসলে কুয়াশার এমন মাই-র খাবার প্রয়োজনও পড়েনি। শিশির ছোট থেকে দেখে আসছে। মেয়েটা জেদি হলেও যথেষ্ট ভদ্র। কখনো কারো অবাধ্য হয়নি। ভাইদের, চাচুদের, বাবা-মাকে খুব মান্য করে চলেছে। কখনো খারাপ কাজ করেনি। যথেষ্ট শালীনতায় চলে৷ উগ্রস্বভাব কুয়াশার মধ্যে নেয়।
মেয়েটার হাজার জেদ, অবাধ্যতা, উগ্রস্বভাব, অভদ্রতা এই সমষ্টি জিনিস শুধু আর শুধুমাত্র শিশির নামক এই ছেলেটার কাছে এসে আঁটকা পড়ে।
শিশিরের সাথে এমন করার কারণও যথেষ্ট। সে ছোট থেকে শিশিরের অবহেলা, মা-ইর, ঝগড়ার সাথে পরিচিত হয়েছে। শিশিরও ছোট থাকতে হিংসার কারণে কুয়াশাকে কখনো কাছে টানে নি।
আসলে এসব ছোট মনের ব্যাপার স্যাপার। ছোটকালে ছেলে-মেয়েরা থাকে অবুঝ। তখন তাদের মনে, বিবেকে যা এসে হানা দেয় সেটায় আঁকড়ে ধরে৷ শিশিরও ছোট মনে কুয়াশার প্রতি সকলের এত ভালোবাসা সহ্য করতে পারে নি আর কুয়াশাও ছোট থেকে শিশিরের এত অবহেলা সহ্য করতে পারেনি৷ এসব কিছুর মাঝে এরা একে ওপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছে আস্তে আস্তে। যেটা বড় হয়ে স্বভাব এবং অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বলতে গেলে এসবকিছু স্বাভাব এবং অভ্যাসের দোষ।
‘
কুয়াশা এখনো আষ্টেপৃষ্টে শিশিরকে ধরা৷ শিশিরও আগলে রেখেছে। কুয়াশা কাঁদছে। কান্না থামাতে শিশির আলতো করে ডাকল,
” কুয়াশা…! এ্যাই কুশু..! ”
শুনলো না সে। কান্নায় ব্যস্ত সে। শিশির আবার ডেকে বলল,
” এ্যাই..! আচ্ছা হয়েছে। আর কাঁদতে হবে না৷ আমি না বুঝে মে-রেছি। চুপ কর এবার। ”
কুয়াশা শুনল কিনা বোঝা গেল না৷ আচ্ছা মুসিবতে পড়া গেল তো! যে আদুরীনিকে মে-রেছে এটার খেসারত এখন কোন কোন ভাবে দেওয়া লাগে কে জানে!!
শিশির আবার বলল,
” চুপপ, চুপ কর। আচ্ছা বাবা হয়েছে তো। অনেক কেঁদেছিস বাকিগুলো তুলে রাখ আগামীর জন্য ”
কুয়াশা এবার বোধহয় শুনল কথা। কান্না থামিয়ে মাথা তুলে শিশিরের মুখের সামনে মুখ নিল কিন্তু, গলা ছাড়ল না। শিশিরের দুই কাঁধের উপর হাত দিয়েই রাখল। কেঁদে কেঁটে নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেলেছে৷ সেগুলো বোধহয় হয় সব শিশির টি-শার্টেই মাখিয়েছে৷ দু’জনেই ঘেমে ন্যায়ে একাকার। চটচটে হয়ে গেছে শরীর। মাথা তুলে শিশিরের মুখের সামনে মুখ নিয়ে আদুরে ভাবে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি আবার মারবে আমায়? ”
শিশিরের খুব হাসি পেল৷ এই মেয়ে আদরে এতটায় বাদর হয়েছে! কিন্তু নিজেদের অবস্থাও শিশিরের খেয়ালে এসেছে কিছুক্ষণ আগে৷ তুবুও সেটাকে পাত্তা দেয়নি। এ মেয়ে যত বড় হচ্ছে তত বেশি কেমন উদ্ভট কার্বার ঘটছে তার সাথে। আগে ছোট ছিল ঝগড়া, মা-রা মা-রি করে শান্তি পাওয়া যেত। আর এখন শরীরের সান্নিধ্যে না চাইতেও চলে তো আসেই সাথে কেমন অপ্রস্তত অনুভূতি আসে। যতই হোক একটা মেয়ে বলে কথা!!
শিশির মনে মনে হেসে নিয়ে ঠোঁটে আলতো হাসি বজায় রেখে বলল,
” হ্যাঁ, সে তো বটেই। আবার মা-রব কোনো অকাম করা দেখলে। ”
” আমি অকাম করি নি। বললাম তো সব ”
” আচ্ছা বুঝলাম৷ আর শোন.. ”
” হু ”
” ঐ অয়নের থেকে দূরে থাকবি। ওর মতিগতি কখন কি বলে কখন কি করে! দূরে থাকবি ওর থেকে। আত্নীয় বলে কিছু বলতেও পারছি না ”
” আমি দূরেই থাকি, অয়ন ভাইয়াকে আমার পছন্দ হয় না৷ কেমন ফেবিকল টাইপ। শুধু গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসে। ”
” পছন্দ করে তোকে ”
” করুক, তাতে আমার কি? আমার পছন্দ না তাকে। ”
শিশির আর কথা বলল না। এবার কুয়াশার কোমড়ের বাঁধন আলগা করে দিল। তারপর মাথা থেকে হাত নামিয়ে এনে বলল,
” নাম এবার। যে মা-রা মা-রলি! আমি একটা মে-রেছি তোকে। আর তুই আমাকে গণধো’লাই করলি, গোবর ঠাঁসা একটা ”
” ঠিক করেছি৷ না বুঝে না জেনে আমাকে মা-রার শাস্তি। ”
শিশির চোখ গরম করে তাকাল। ঝটকা দিয়ে কুয়াশাকে এবার বিছানায় ফেলল। কুয়াশা বিছানায় বসে বলল,
” স্যাভলন কোথায়? ”
” সর, আগলা পিরিত দেখাতে হবে না। কামড়ে দিয়ে আসছে আবার সেবা করতে। হাতও জ্বলে যাচ্ছে আমার। ”
কুয়াশার তো সেই আনন্দ হচ্ছে শিশিরকে মা-রতে পেরে। সে আর কিছুই বলল না৷ উঠে দাঁড়াল। যা ইচ্ছে করুকগা, হয় স্যাভলন লাগাক আর না লাগাক তার দেখার নেই৷ সে মা-রতে পেরেছে এতেই বাহাদুরি সে৷
শিশিরও উঠে হালকা মোমবাতির আলোয় মিররের সামনে গিয়ে কাঁধ দেখার চেষ্টা করল। কামড়টা বেশি ক্ষতি করেনি। কারণ কলার ওয়ালা টি-শার্ট বলে। তবে দাঁতের ছাপ বসে লাল হয়ে উঠেছে। ভাগ্যিস কলার ওয়ালা!! নয়তো এই গোবর ঠাঁসা বোধহয় আজ কাঁধ কামড়েই খেয়ে নিত। কুয়াশা এবার ভেঙচি কেটে একটা মোম নিয়ে হাঁটা ধরল। দরজার সামনে যেতেই শিশির বলল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা দাঁড়া ”
কুয়াশা ফুঁসে উঠে বলল,
” এ্যাই বুনো ওল, আবার কি ? ”
” ঠাটিয়ে আবার একটা থা-প্পড় দেব! কথা ঠিক করে বল ”
কুয়াশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিশির একটু আমতা আমতা করে বলল,
” তোর গালে আইস কিউব দে গিয়ে ”
” পারব না। এই গাল আজ ভাইয়াদের দেখাব তারপর তোমাকে বকা শুনাব তারপর আমি ক্ষ্যান্ত হব ”
বলে হাঁটা ধরল। শিশির মেজাজ নিয়ে কিছুটা দৌড় এসে ধরল কুয়াশার হাত। বলল,
” এখনো নিশ্চয়ই ব্যথা আছে? নাকি ভুলে গেলি? আবার ঐ একই জায়গায় খেতে না চাইলে কথা শোন ”
কুয়াশা উত্তর করতে যাবে তা শোনার প্রয়োজন মনে করল না শিশির। বলল,
” চুপপ ”
বলে কুয়াশার হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে ওর হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে গেল৷ কুয়াশা আর কথা না বলে মনে মনে ভেঙচিয়ে বলল,
” হুহ, মে’রে আসছে আবার দরদ দেখাতে বুনো ওল কোথাকার। ”
আলতো আলো-আঁধারিতে আস্তে আস্তে গিয়ে ফ্রিজ থেকে আইস-কিউব নিয়ে সেটা কুয়াশার ওড়নার এককোণায় দিয়ে ওর গালের উপর ধরল। বলল,
” ধরে আস্তে আস্তে স্লাইড কর। ব্যথা হবে না আর দাঁগ থাকবে না ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর না করে ধরল। এই বোধহয় প্রথম শিশিরের কোনো কথা প্রত্যুত্তর না করে এক কথায় শুনল। আবার এই বোধহয় সর্বপ্রথম দু’জন মা-রা মা-রি করে একে ওপরের প্রতি দরদ দেখাচ্ছে। বাহহ কি উন্নতি!!
‘
এরই মাঝে কারেন্ট চলে এলো। আবার সব আলোয় ঝলমল করতে লাগল। কুয়াশা শিশিরের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচি কেটে ছাদের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল বরফ ডলতে ডলতেই।
শিশির সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই মেয়ের এতটা সান্নিধ্যে আর যাওয়া যাবে না। এখন থেকে এসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তখন মাথায় কিছুই ছিল না বলে ওরকম একটা কাজ করে ফেলেছে। এখন শরীরের মধ্যে কেমন শিরশির অনুভব হচ্ছে। বিড়বিড়াল সে,
” নারী শরীরের ছোঁয়া, সান্নিধ্য ভয়ংকর যা অতি ভয়ংকর!! “
_______
সবকিছু ঠিকঠাক করে রান্নাবান্না শেষ করে রাত বারটা পাড় হয়ে গেল। বারটার পর সকলে একসাথে বসে খেল। ছাদেই খেল সকলে। শুধু জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথার জন্য নিচে নিয়ে যাওয়া হলো।
খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে তিন জা নিচে চলে গেছে। ছোটরা সবাই একজোট হয়ে গল্প করছে আর মেহেদী পড়ছে৷ নিচে মাদুর বিছিয়ে বসেছে এবার৷ সেই মাদুরের উপর শিশির, নীহার, হিমেল, অয়ন, তুষার, তুহিন শুয়ে ফোন টিপছে আর গল্প করছে৷ মেয়েরা কেউ একা একা মেহেদী পড়ছে তো কেউ পড়িয়ে দিচ্ছে। এমনই সময় অনি বলল,
” শিশির ভাইয়া মেহেদী পড়বা না? আমি পড়িয়ে দেব?”
উত্তরে শিশির বলল,
” না অনি, আমি মেহেদী পড়ি না। ভাইদের দিয়ে দাও ”
অনি মন বেজার করে ফেলল৷ ঈশা সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। সে বুঝেছে অনি শিশিরকে পছন্দ করে। বিষয়টা তারকাছে খারাপ লাগল৷ হিমেল বলল,
” অনি আপু আমাকে দিয়ে দাও। ভাই ওসব কোনো কালেই নেয় না ”
অতঃপর কি আর করা? অনি হিমেলকে মেহেদী দিতে লাগল। কুয়াশাকে বৃষ্টি দিয়ে দিচ্ছে। অনেক সুন্দর পারে বৃষ্টি মেহেদী দিতে। দিতে দিতে বৃষ্টি ইয়াসমিনকে বলল,
” ইয়াসমিন! তুহিন ভাইকে দিয়ে দাও তুমি। তুমি তো এখনো নেওয়া ধরো নি। ”
এইটুকু বলে আবার ফিসফিস করে বলল,
” এই সু্যোগ কাজে লাগাও। নিজের বিয়ের মেহেদী নিজেই বরকে দিয়ে হাত রাঙিয়ে দাও ”
ইয়াসমিন লজ্জা পেল। কথাটা সবাই শুনে নিয়েছে তবুও। শুনে সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। তুহিন একটু অপ্রস্তত হলো। তবে কিছু বলল না। বোধহয় সম্মতি আছে। ইয়াসমিনও উঠে গেল তুহিনের কাছে৷ তুহিন মানা করল না। হাত বাড়িয়ে দিল হবু বউয়ের দিকে। হবু বউও যত্ন করে হাতটা নিয়ে মেয়েদী দিতে লাগল।
এদিকে অয়নের ইচ্ছে হলো ওদের মতো কুয়াশার থেকে মেহেদী পড়তে কিন্তু কুয়াশা নিজেই তো অন্যের থেকে নিচ্ছে! তাই আর প্রকাশ করল না।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part )