®রোজা রহমান
‘
‘ উঠ ছেড়ি তোর বিয়া লাইগিছে ‘
আঞ্চলিক ভাষায় এমন একটা গ্রাম্য প্রাবাদবাক্য আছে। এই বাক্য থেকে আবার আরো একটা শব্দ সাজানো আছে সেটা হলো,
‘যার বিয়ে তার খোঁজ নাই পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই ‘
আঞ্চলিক ভাষায় লোকমুখে এই বাক্যটাও হরহামেশাই শোনা যায়। বাক্য দু’টোর যথার্থতা আছে বটে।
এই বাক্য দু’টো গ্রামে হোক আর শহরে হোক সবখানেই প্রযোজ্য। তেমনি আজ ইয়াসমিনের ক্ষেত্রে ফলে গেল।
আজ বৃহস্পতিবার। নিয়মানুসারে আজ তুহিন ও ইয়াসমিনের গায়ে হলুদ। কাক ডাকা ভোর থেকে আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আলো-আঁধারি কাটতে না কাটতেই পাড়া-পড়শীর আনাগোনা, শোরশার, আত্নীয় স্বজনদের দৌড়ঝাপ, আনন্দে বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে৷ ভোর থেকে গায়ে হলুদের আয়োজনের সাথে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে।
ইয়াসমিন এখনো ঘুমে। ঈশাও উঠে নি। অথচ ইয়াসমিনের বাড়ির কাজিনরা সহ ভাবিরা এসে ঘর ভেঙে ফেলছে। যেমনটা প্রথম বাক্যে বললাম ঠিক তেমন। বেচারা বিয়ের কনে এখনো ঘুমে আর সকলে মেতে উঠেছে। আসলে বিয়ের ব্যপারটাই এমন। বিয়ের কনের কোনো খোঁজ থাকে না। বিয়ের কনের জন্য যা করার সব বাড়ির লোক এবং পাড়ার লোকই ঠিক করে। বিয়ের দিন বিয়ের কনেকে লাগে যেন কোনো কাঠের পুতুল। সকলে যা হুকুম জারি করবে তেমন ভাবে করতে হবে। একটু এদিক ওদিক হওয়া যাবে না। বিয়ের দিন বিয়ের কনে বোবা হয়ে যায়। গোসল থেকে শুরু করে, সাজানো, খাওয়ানো পর্যন্ত অন্যের হাতে থাকে। এই বিয়ে নামক জিনসটা মেয়েদের জীবনে এলে সেদিন কেন জানি আপনাআপনি বাড়ির লোকজন, আত্নীয় স্বজন ও পাড়াঘরের লোকের কাছে কদর বেড়ে যায়। বাবাহ রে বাবাহ তাদের কি যত্ন আত্নী চলে এই দিনে! দেখলেই বিয়েতে বসতে মন চাই।
যায়হোক বোনেরা, ভাবিরা ডেকেডুকে ইয়াসমিনকে তুলে মেহেদী পড়াতে লেগে গেল। সাথে বিভিন্ন ফাজলামো সহ আড্ডা। সেগুলো এখন ইয়াসমিনের মুখ বুজে গিলতে হবে। ভাবিরা তো আগে থেকেই পাকা থাকে তারউপর অবিবাহিত কাজিনরাও কেন জানি পেকে যায়। যা নয় তা বলে। ইয়াসমিন কথাটা মনে মনে ভাবল। সে শুধু মুখ বুজে আছে। ভাবিরা মাঝে মাঝে আবার এত পরিমাণে লজ্জাজনক কথা বার্তা বলছে সেগুলো শুনে না চাইতেও ইয়াসমিনের দুই গাল লজ্জায় টানটান হয়ে যাচ্ছে। কি এক জ্বালায় পড়ল বেচারি!! এখন থেকে সকাল দশটা-এগারটা অবধি এমন ফাজলামো আর মেহেদী পড়া-পড়ি চলবে। এর মাঝে অবশ্য সকালের খাওয়াটা হবে। তারপর কনেকে গোসলে নেওয়া হবে। সেগুলো সব ভাবিদের দায়িত্ব। বিয়ের দিন ভাবিরা বিয়ের কনের দায়িত্ব নেয়।
‘
আমিনুল হকের কোনো ভাই নেই। আম্বিয়া বেগমের বাবারা ছিলেন তিন ভাই। আম্বিয়া বেগমের বাবাই বড় ছিলেন। তো আম্বিয়ার ভাই-বোনের সংখ্যা, এক ভাই ও দুই বোন। এদিকে আম্বিয়ার ভাই তো আমিনুল হক। তার দুটোই মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। আর এ সকল ভাবিরা, চাচতো বোনেরা হলো চাচাতো ভাবি, চাচাতো বোন অর্থাৎ ইয়াসমিনের চাচাতো দাদুর পক্ষের। বাড়ি সব পাশা-পাশি। এই জন্য মেলবন্ধনটাও অনেক আপন। যা হয় না হয় তাদের নিয়ে হয়। আমিনুল হকও চাচতো ভাই-বোনদেরও দাওয়াত করে মেয়ের বিয়েতে সামিল করেছেন। এখন তারাই আমিনুল হকের সাথে একজোট হয়ে আয়োজন কাজে লেগেছেন।
_____
সকাল নয়টা বেজে পাড় হয়ে গেছে। মালিথা ভিলাতেও আয়োজন কাজ ধুমধামে চলছে। সকালের নাস্তা করা সকলের হয়ে গেছে। এই বাড়িতেও সকালের খাবার খাওয়ার পর মেহেদী পড়া-পড়ি চলছে। ঈদে দেওয়া মেহেদী সাবান পানি দিয়ে ডলে ডলে তুলেছে সব। এখন আবার নতুন করে দিচ্ছে। বিয়ে বলে কথা!! সব কিছু নতুন এবং স্পেশাল না হলে হয়? মেয়েরা এসব সাজগোছের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। সব কিছু পারফেক্ট হওয়া চাই। সে যেকোনো অকেশন বলো।
মেহেদী পড়ার মাঝেই স্মৃতি এলো। কুয়াশা শুধু স্মৃতিকেই বলেছে। কারণ একমাত্র স্মৃতিই তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। স্মৃতি থাকার জন্য আর কাউকে কখনো ফ্রেন্ড করেনি কুয়াশা আসলে প্রয়োজন পরেনি। এরা দু’জনে সেই ক্লাস সিক্স থেকে এক সাথে আছে।
স্মৃতি এসে সকলের সাথে ভালোমন্দ কথা বলে সকলের সাথে বেশ অল্প সময়ের মাঝে ভাব জমিয়ে ফেলল। শশীর বেশ পছন্দ হলো স্মৃতিকে।
‘
এদিকে ছেলেরা সকালে খেয়ে দেয়ে কি সব কাজ করে বেড়াচ্ছে। কি কাজ করছে কে জানে? একে ওপরে তো ভালোই দৌড়া দৌড়ি করছে।
তুহিন বেশ ভালোই ব্যস্ত নিজের বিয়ে তবুও। তুষার মাঝে মাঝে তুহিনকে ডেকে কি সব উপদেশ দিচ্ছে।
কুয়াশা মেহেদী নিতে নিতে সব অবলোকন করছে ভ্রু কুঁচকে। এতক্ষণেও যখন বুঝলো না তখন বৃষ্টিকে প্রশ্ন করল,
” এ্যাই ভাবি ওরা এমন করে বেড়াচ্ছে কেন গো? কি করছে ওরা? যেটা আমরা জানি না! ”
কুয়াশার কথায় বৃষ্টি একবার তুষারদের দিকে নজর দিল। তারপর ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
” এমা তুমি জানো না? ”
” নাহ ”
” ওরা বাসরঘর সাজাচ্ছে। বাসরঘর সাজানোর কথা ছিল আগামীকাল সকালে কিন্তু শিশির বলেছে আজই সাজানো হোক। প্রয়োজনে তুহিন ভাই শিশিরের ঘরে থাকবে। সাজানোর জন্য একটা ছেলেকে এনেছে আর শিশিররা সব দেখিয়ে দেওয়া, এগিয়ে দেওয়া করছে। ”
” ওওও ”
” হু ”
কুয়াশা আবার ওদের দিকে একবার নজর দিল। তারপর মুখ ঝামটাল। মনে মনে বলল,
” বাসরঘর সাজানোর কি তাড়া দেখো! খাটাশ একটা। লাগে যেন সেই শুবে। অসভ্য বুনো ওল একটা ”
ভেবে আবার নিজের কাজে মন দিল। এর মাঝে উপর থেকে একে একে সকল ছেলেরা চলে এলো। এসে একে একে সোফায় বসল। মেয়েরা ফ্লোরে বসেছে। নীহার এসে একপলক শশীকে দেখল। হাসছে মেয়েটা। যাক ভুলে গেছে বোধহয় সব৷ ভুলতে পারলেই ভালো। শশী একবারও নীহারের দিকে তাকাল না। প্রচুর অভিমান হয়েছে।
শিশির টি-টেবিল থেকে শরবতের গ্লাস নিতে নিতে বলল,
” ভাবি ওবাড়ি কখন যাওয়া হবে? ”
বৃষ্টি বলল,
” ও বাড়ি বলতে? ইয়াসমিনদের? ”
” হ্যাঁ ”
” ওটা বোধহয় তিনটার পর। কিন্তু তোমরা খোঁজ নিয়ে কি করবা? এমনিতে তো ছেলেরা এলাও না ”
বলে বৃষ্টি হাসল। শিশির ভ্রু কুঁচকাল৷ মানে কি? তারা এলাও না কেন? শুধু শিশির না সাথে অয়ন, নীহার, হিমেলও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। শিশির বলল,
” মানে? আমরা ছেলেরা এলাও না কেন?”
” কারণ লগনে মেয়েরায় যায় আর মেয়েদের সংখ্যা অনেক তাই আমরা মেয়েরায় শুধু যাব। এমনটায় কথা হয়েছে। তোমরা আগামীকাল বরযাত্রীতে যাবে ”
কুয়াশা জোরে জোরে হেসে দিল। শিশিরের মুখের অবস্থা দেখে। সে আনন্দ পেয়েছে। এবার শিশির গেল রেগে। শিশির কুয়াশার দিকে শকুনের নজরে একবার তাকিয়ে রেগে আবার বলল,
” হ্যাঁ তো, বরযাত্রী তো তোমরাও যাবে! এছাড়া আমরা তো তোমার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গেছিলাম। তখন তো এমন কিছু শুনি নি? ”
” হ্যাঁ আমার বেলায় মেয়ে ছিল না তাই তোমরা ছেলেরা যেতে পেরেছিলে”
” যা তা! ”
এরপর রেগেমেগে নীহারকে বলল,
” এ্যাই নীহার ভাই, তোর মামার টাকার কি অভাব পড়েছে? নাকি কিপ্টা? যে গুণে গুণে লোক নিবে? জলদি আমাদের যাওয়া কনফার্ম কর “
নীহার নিজেও বিষয়টা জানত না। সে তুহিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল। তুহিন জানাল সে নিজেও জানে না৷ কেউ জানে না তো জানে কে? কুয়াশা আবার হেসে গর্বে বুক ফুলিয়ে বলল,
” এসব বড় চাচুর কথা। এখানে কারোরি দোষ নেই। আমিনুল মামা জিজ্ঞেস করেছিলেন কারা আসবে। বড় চাচু বলেছেন শুধু মেয়েরা যাবে। ”
শিশির বলল,
” এ্যাই তুহিন ভাই কিছু করবা তুমি? ”
” থাম দেখছি। চেঁচাস না।”
বলে তুহিন আম্বিয়াকে ডাকল। আম্বিয়া বললেন,
” তোর আব্বুকে বল বড় ভাইকে বলতে। বড় ভাই কোনো ডিসিশন নিলে আমি আর কথা বলতে পারি না। তোর আব্বুকে ডেকে বল। আমি ভাইয়াকে বলছি ছেলেগুলোও যাবে “
তুহিন সম্মতি দিয়ে চলে গেল। শিশির বিশ্বজয়ের হাসি দিল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কুয়াশা মুখ ঝামটাল। শিশির ওর মুখ ঝামটানো দেখে কিছু আর বলল না। কারণ বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে ঝগড়া, মা-রা মা-রি করলে বাজে হবে বিষয়টা। নয়তো এতক্ষণ কুয়াশার মাথায় একটা চা-টি পড়ে যেত।
______
দুপুর দু’টো। মেয়েরা তৈরি হচ্ছে লগনে যাবে বলে। ছেলেরা সকলে তৈরি হয়ে বসে আছে বসার ঘরে। সকল ছেলের ড্রেসআপ কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবি সাথে সাদা পাজামা।
তুষার যাবে না জানিয়েছে। সে তুহিনের সঙ্গ দেবে৷ তুহিন একা থাকবে বাড়িতে। এছাড়া তার ওখানে যাওয়াটা কেমন জানি নিজের কাছেই লাগছে৷ লগনে আবার সে কি করতে যাবে? এজন্য জানিয়েছে যাবে না। বৃষ্টিকে সকলের সাথে যেতে বলেছে। বৃষ্টিও তেমন ধার ধারে নি। এমনিতেই এই বিয়ের অনুষ্ঠান এসে তুষারকে সে পাত্তা দিচ্ছে না৷ এখন তুষার গেল কি আর না গেল তার দেখার নাই৷ সে আপন মনে ননদদের সাথে আনন্দ করে বেড়াচ্ছে। সকলে একজোট হয়ে কুয়াশার ঘরে সাজছে।
বৃষ্টি সব হয়ে এসেছে প্রায়। সে সবুজ রঙের পাড় এবং বাসন্তী হলুদ রঙা জমিনের জামদানী শাড়ি পড়েছে বাঙালি স্টাইলে। ফুলের গহনা পড়েছে। দীঘল কাল লম্বা চুলগুলো হালকা ভেজা থাকায় আপাতত ছেড়ে দেওয়া। সব শেষে খোঁপা করে গোলাপ দেবে। আপাতত কুয়াশার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এলো। এসে দেখল তুষার তৈরি হয়ে গেছে। পরনে কলাপাতা রঙের পাঞ্জাবি এবং সাদা রঙের পাজামা। লম্বা, বলিষ্ঠ দৈহিক শরীরের পুরুষটা অতি সুদর্শন। এ বাড়ির ছেলেগুলো সবাই সুন্দরের দিক দিয়ে এর উপর ও সুন্দর। সকলে লম্বা, সুন্দর। তুষারও তেমন।
বৃষ্টি তুষারকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। গিয়ে স্বামীর কাছে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে বলল,
” আমার সুদর্শণ স্বামীকে আরো সুদর্শন লাগছে। নজর না লাগুক ”
বলে চোখের কাজল ঘাড়ের পিছনে দিয়ে দিল। তুষার এতক্ষণ বৃষ্টিকে দেখছিল। মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী। বৃষ্টির গায়ের রঙ অনেক ফর্সা যাকে বলে ধবধবে ফর্সা। লম্বা কুয়াশার সমান। ছিমছাম শরীরের গঠন। তুষার মুচকি হেসে বৃষ্টিকে ঘুরিয়ে মিরর মুখো করল। এরপর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমার সুন্দরী বউকে যে আজ বসন্ত ঋতুর মতো লাগছে। এই বসন্তে যে আমার নিজেকে হারাতে ইচ্ছে করছে! ”
” ধুরর কি সব বলো! ছাড়ো এখন। আমার সাজ নষ্ট করো না তো ”
বলে তুষারকে সরাতে লাগল কিন্তু তুষার সরল না৷ হাসল সে৷ বৃষ্টিকে ঘুরিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে কপালে গভীর একটা চুমু দিল। বলল,
” তুমি এত ভালো কেন বৃষ্টি?”
বৃষ্টি মুচকি হাসল তা শুনে। বলল,
” আমার স্বামীটা যে এতটা ভালো। তাইতো তার চোখে আমিও ভালো। ভালো মানুষদের চোখে সবকিছুই ভালো লাগে৷ ”
আহ !! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। কি সুন্দর উত্তর দিল বউটা! তুষার মনে মনে ভেবে প্রশান্তিময় একটা হাসি দিল। এরপর আরো একটা চুমু দিল কপালে বৃষ্টির। দিয়ে আবেশে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল বৃষ্টিকে।
______
আড়াইটার মধ্যে সকলের সাজগোছ হয়ে গেল৷ সব ঠিকঠাক করে তিনটার মধ্যে রওনা দেবে৷ মেয়েরা সকলে হলুদ সাজে সেজেছে। কেউ সবুজ পেড়ে হলুদ জমিনের জামদানী পড়েছে তো কেউ লাল পেড়ে হলুদ জমিনের সিল্কের শাড়ি পড়েছে। আবার কেউ সম্পূর্ণ বাসন্তী রঙের সুতি শাড়ি পড়েছে। মেয়েদের শাড়ির পড়ার ভঙ্গিমা বাঙালি বধূ স্টাইলে সাথে কৃত্রিম ফুলের গহনা। দেখে মনে হচ্ছে এটা সরিষার বাগান। সব হলুদে হলুদে ছেয়ে গেছে। বসার ঘর জুড়ে সব মেয়েদের আনাগোনা।
শিশিররা বাইরে গেছিল মাত্র আসল। এসে এই অবস্থা দেখে সকলে টাস্কি খেয়ে গেল৷ হা করে দেখছে৷ নীহারের চোখ শশীর উপর গিয়ে আঁটকে গেল৷ এই মেয়েকে এতটা সুন্দরী লাগছে হলুদ শাড়িতে! মনে হচ্ছে না কোনো ষোল-সতের বছরের মেয়ে। শাড়িতে কি মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি পেয়ে যায়? যায় বোধহয়, নয়তো এই মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন বয়স ধরায় যাচ্ছে না!
নীহারের হা করা লুকটা শিশিরের নজর এরালো না৷ শশী একবার নীহারের দিকে তাকাল তারপর চোখ সরিয়ে কুয়াশার কাছে চলে গেল। শিশির তা লক্ষ্য করে নীহারকে বলল,
” কি হয়েছে ভাই? ”
” কি হবে? ”
” শশীর সাথে ”
নীহার এবার অপ্রস্তত হলো। আমতা আমতা করে বলল,
” ওর সাথে কি হবে আমার? বাচ্চা মেয়ে একটা ”
” ভাই অত্যন্ত আমার কাছে লুকাস না। আমি সেদিন দেখেছি তোকে, শশীকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যেতে। বাচ্চা বলে নিশ্চয়ই নিস নি? ”
নীহার এবার দীর্ঘ একটা শ্বাস নিল। এই ছেলের থেকে এবার চেয়েও কিছু লুকোনো যাবে না৷ যতই হোক হবু উকিল সাহেব বলে কথা!! তদন্ত করা তার শিক্ষা ও ধর্মে মেশানো।
নীহার সবটা বলল শিশিরকে। শিশির সব শুনে একটু অবাক হলো। বলল,
” ভাই দেখ মেয়েটা নিতান্তই ছোট। এখনো তেমন বুদ্ধি হয়নি। ওর যা বুদ্ধি সব ছেলেমানুষী বুদ্ধি। এখন আশে-পাশে যা দেখবে ভালো লাগবে আর সেগুলোই শিখবে, অভ্যস্থ হবে। কোনটাতে ভালো হবে কোনটা খারাপ হবে সেসব ভাবার সময় ওদের থাকবে না। আমরা কিন্তু ওর সময়টা পাড় করে এসেছি। সেই সময়ে ফিরে গিয়ে দেখ আমরাও ওরকম বয়সে অনেক পাগলামি করেছি। তেমনি ও তোকে পছন্দ করেছে, ব্যস করেছে এর আগে পরে ও ভেবে দেখে নি, যে তোর পছন্দ বলে কিছু আছে বা ওকে তুই এক্সেপ্ট করবি কি করবি না। এসব ও কখনো ভাবে নি। ওর ভাবনায় শুধু ছিল, তুই এবং ও তোকে পছন্দ করে। যেমনি হোক তুই ওর ভালোলাগাকে প্রাধাণ্য দিবি এমনি একটা ভাবনা ছিল৷ কিন্তু ওর এতটুকু মনে তোর ঐ কঠিন কথাটা সহ্য হয়নি যেখানে ও কখনো ভাবেই নি তুই ওকে মানবি না সেখানে তোর সত্যিকার অর্থে না মানাটা ও নিতে পারে নি৷ ছোট্ট মনে অনেকটা প্রভাব ফেলেছে৷ ”
এটুকু বলে শিশির থামল। নীহার তাকিয়ে আছে শিশির আবার বলল,
” আমি তোর উপরও কিচ্ছু চাপিয়ে দেব না। তোর লাইফ তোর ডিসিশন। তোর পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে৷ কিন্তু আমার মনে হয় না শশী অপছন্দের একটা মেয়ে। আর তোদের বয়সের ডিফারেন্সটা-ও আহামরি না। একদম স্বাভাবিক এবং পারফেক্ট বয়সের ডিফারেন্স। কিন্তু মেয়েটা ছোট এটায় বড় সমস্যা। আগে যা বললাম ওগুলো তুই আমার বন্ধুতুল্য ভাই বলে বললাম। একটা মেয়ের মন ভেঙেছিস সেটা নিয়ে তোকে বুঝালাম তোর ভুলটা ঠিক কোথায় এবং তুই ঠিক করেছিস নাকি ভুল করেছিস। নিশ্চয়ই আমার কথা দ্বারা এটা বুঝলি যে তুই ভুল করেছিস?
এবার বলব একটা বোনের প্রতি ভাইয়য়ের দায়িত্ব নিয়ে,
ভাই শশীকে আমি বোনের মতো করে ভালোবাসি। খালাতো, মামাতো বোনের মধ্যে ঐ একমাত্র আমার সব থেকে ক্লোজ ইভেন শশী নিজেও আমার প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। বড় ভাই হিসেবে অনেক মানে। মেয়েটা অনেক চঞ্চল কিন্তু এই দুইদিন ওর মলিন মুখ আমার ভালো লাগছে না ভাই ”
নীহার অসহায় চোখে তাকাল শিশিরের দিকে। শিশিরও মলিন ভাবে তাকাল। শিশির যে তার কথার মাঝে বুঝিয়ে দিল তার এই সম্পর্কে কোনো আপত্তি নেই এবং সে যে মেয়েটার মন ভেঙে বড় ভুল করেছে। শিশির আবার মলিন মুখে হাসি টেনে নীহারের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
” ভাই লালন ফকির তার গানের মাঝে একটা কথা বলে গেছিলেন তা হলো, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কথাটার কিন্তু যথেষ্ট যথার্থতা আছে! ভাই সময় থাকতে থাকতে সব কিছু আঁকড়ে ধরতে হয়। যা নিজের তা নিজের করে নিতে হয়। বলা তো যায় না পরে পরে বলে সেটার সময়, সুযোগ কখনো এলোই না! ভাই হয়ে বোনের দায়িত্ব দিচ্ছি তোকে, আমি চাই ঐ চঞ্চল মেয়েটার মুখে আবার আগের মতো হাসি ফুটুক। সেই হাসি ফুটানো এবং কারণ তুই-ই হ। মেয়েটা খারাপ না৷ বাচ্চা তো কী হয়েছে? যত্ন করে গড়ে নিস৷ ও যখন তোর মাঝে আনন্দ পেতে চাই একটু সেক্রিফাইজ করে না হয় তুই-ই হলি ওর আনন্দ! খুব বেশি কী ক্ষতি হয়ে যাবে?? ”
শিশির শেষ কথাটা চোখে মুখে দুষ্টুমি রেখে দুষ্ট হেসে বলল। নীহার ভাইয়ের দুষ্টুমি মাখা হাসি ও কথা ধরতে পেরে নিজেও দাঁত বের করে হেসে শিশির বাহুতে একটা চা’প্প’ড় দিল। তারপর জড়িয়ে ধরল। কেন জানি নিজেকে হালকা লাগছে৷ তার থেকে বয়সে ছোট এই ভাইটার মুখে এত সুন্দর বুঝদারের মতো কথাগুলো শুনে। শিশিরও জড়িয়ে ধরেছে নীহারকে। নীহার শিশিরকে জড়িয়ে ধরে রেখেই কানের কাছে আস্তে করে বলল,
” খুব বেশিই ক্ষতি হবে৷ এতদিন কি অপেক্ষা করা যায়? কোথায় ভাবলাম নিজের লাইনটা ক্লিয়ার হয়ে গেল। কিন্তু তোর ঐ ইঁচড়েপাকা বোনটা এসে আমার সিরিয়ালটা ঝুলিয়ে দিল। এখন ওয়েটিং রুমে পড়ে থাকতে হবে। এটা কিন্তু ভাড়ি অন্যায় করল তোর বোন! এর খেসারত দিতে হবে কিন্তু দেখিস! ”
শিশির শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
” নিজের মতো করে পুষিয়ে নিস। ”
নীহার তা শুনে হাসল৷ বন্ধুর মতো ভাইটাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ল৷ বলল,
” তোর বোনটা বহুত ইঁচড়েপাকা জানিস! এটুকু কালে রোমান্সের উপর পিএইচডি করে ফেলেছে। ভাবতে পারিস? ”
শিশির আবার হাসল শব্দ করে। বলল,
” তাহলে আর কি? খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা… ”
বলে দুষ্টু হেসে চোখ টিপল। আবার বলল,
” তবে বাচ্চা কিন্তু মানুষ করে নিতে হবে! ”
নীহার শিশিরের বাহুতে আবার একটা মে-রে বলল,
” ফাজিল হচ্ছিস দিন দিন। আমার আগে তোকেই বউ এনে দেব। অপেক্ষা কর ”
” হ দে তো। বউ নিয়ে একটু এনজয় করি। সব কিছু একটু রঙিন রঙিন করি। কেমন জানি সব এক ঘেয়েমী হয়ে গেছে। বউ আসলে তখন রাতের সাথে দিনও রঙিন হবে আমার, আহা…!!! ”
” ফাজিল, সরর। আমার পর তোর সিরিয়াল ততদিন অপেক্ষা কর ”
বলে শিশিরকে চোখ মে-রে হাঁটা ধরল হাসতে হাসতে। শিশির মেকি অসহায় লুক নিয়ে বলল,
” ভাইইই ”
নীহার এবার জোরে হাসতে হাসতে একটু জোর গলায় মৃদু চেঁচিয়ে বলে গেল,
” এসব কিছুর কারণ, একমাত্র তোর ইঁচড়েপাকা বোন, আমার দোষ নেই ”
শিশিরও এবার হেসে ফেলল। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। এই ভাইটা তাকে খুব বোঝে৷ পাশে রিজভী এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” ভাই ক্রাশ খেয়েছি ”
” কত মন খেলি? “
” মাপি নি ”
” যাহ মেপে আয় ”
” আরে আগে শোন তো ক্রাশওয়ালী কে”
” কে?”
” স্মৃতি ”
” কিহহ! “
” হ “
” এত রেখে তোর ঐ গোবর ঠাঁসার বান্ধবীর উপর নজর গেল ? ”
” আমি কি করব গেলে? মেয়েটা রসমালাই তুই দেখ একবার ”
” দেখব না। তুই দেখ বেশি করে সাথে রসমালাই খেয়ে খেয়ে সুগার বানিয়ে ফেল শা-লা “
” আরে চেঁতস ক্যা? ”
” তো কি করব? ঐ আ-বা-ল-টার বোনের উপর পিছলাতে পারলি না? আমার পিছনে লেজ হয়ে পড়ে আছে আজ কয়টাদিন। কেমন জানি ভারি ভারি লাগে। লাগে যেন সত্যি আমার পিছনে আস্ত একটা লেজ গজিয়েছে।
রিজভী শব্দ করে জোরে হেসে দিল। শিশির চেঁতে উঠল বলল,
” হাসবি না। আমি জ্বালায় আছি আর তুই বন্ধু হয়ে আমারে না বাঁচিয়ে পিছলা খেয়ে উল্টায় এলি!! “
” হ, ঠেঙ আমার ভাইঙ্গা গেছে এক্কেবারে ”
” তো আর কি? লুলা ঠেঙ নিয়ে বেড়া এখন “
|| চলবে ||
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part )