®রোজা রহমান
‘
আষাঢ় মাস। ঋতু বর্ষাকাল। এই ঋতুতে ঝুম বৃষ্টি যখন তখন নামে৷ নীরদের যখন ইচ্ছে হয় বারিধারা বইবার ঠিক তখনি তারা ঝুপঝপিয়ে নেমে আসে জমিনে। একটানা আবার কতদিন থাকে তারও দিকঠিকানা নেই। আকাশে সঞ্চরণশীল বাষ্পরাশিরা ছুটে বেড়াচ্ছে। মেঘরাজীরা তাদের গর্জন তুলছে। সমীরণও শ-শ করে বইছে। শীতল সেই সমীরণের হাওয়া। চারিদিকে পানি থৈ থৈ করে। রাস্তাঘাট ভিজে জুবুথুবু হয়। চিপচিপে অবস্থা হয়।
‘
সন্ধ্যা প্রায় নেমেই এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই আজান দেবে। রাস্তার মানুষ ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টির ছাট বিন্দু বিন্দু ফোটা দ্বারা শরীর ভিজেয়ে দিয়েছে। হঠাৎ এমন বৃষ্টিতে কেউই বাসা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে বেরোই নি। কারণ আজই প্রথম বৃষ্টি এলো। ছাতাবিহীন মানুষগুলো দোকান পাটের ছাউনিতে আশ্রয় নিচ্ছে বৃষ্টি কবল থেকে বাঁচতে তো কেউ ধৈর্য হারা হয়ে সেভাবেই চলাচল করছে। যানবাহনের যাত্রী গুলো যানবাহনেই বৃষ্টির মধ্যে যাতায়াত করছে। তাদের সমস্যা হচ্ছে না।
শিশিরের ক্যাম্পাস থেকে বেরোতে আজ দেরি হয়েছে। কারণ ডিপার্টমেন্টে অসংখ্য কাজ ছিল। সে আর রিজভী স্যারদের তাঁদের অভিজ্ঞতার সকল বিষয়ের এক্সপ্লেইন করছিল। একারণে বেরোতে চারটা পাড় হয়ে গেছে। ততক্ষণে প্রকৃতিতে অন্ধকার। বৃষ্টি আজ দুপুর থেকেই নেমেছে। তাই সে রাস্তায় আটকা পরেছে। ছাতা না থাকায় এখন ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবনা বৃষ্টি কমলেই বাড়িতে যাবে। অত তাড়াহুড়ো নেই। এই চিপচিপে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জুবুথুবু হয়ে বাড়ি ফিরতে সে নারাজ।
প্রায় এক ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছে। রিজভী চলে গেছে ভিজতে ভিজতে। কারণ তার বাড়িতে যাবার তাড়া ছিল আজ। অন্ধকারআচ্ছন্ন প্রকৃতি দেখছে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা নামতে এখনো পঁচিশ মিনিট মতো সময় আছে তবুও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত নেমেছে প্রকৃতির বুকে৷ এমনই সময়ে তার ফোন বেজে ওঠল৷ বাজতে থাকা অবস্থাতেই বের করে দেখল নীহারের ফোনকল। ধরল সে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ঝটপট প্রশ্ন এলো,
” কুশু কি তোর সাথে শিশির? ”
তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুঁচকে গেল। গোবর ঠাঁসা তার সাথে থাকবে কেন? তার সাথে কি থাকার কথা ছিল আদৌ? সে মনে করার চেষ্টা করল এমনটা কথা ছিল কিনা। মনে পরল, নাহ্ এমন তো কথা ছিল না। সে উত্তর করল,
” ওর কি আমার সাথে থাকার কথা ছিল? ঐ গোবর ঠাঁসা আমার সাথে কেন থাকবে? তাও আবার এই ভর সন্ধ্যায়!”
ওপাশ থেকে নীহারের বড্ড অধৈর্যবাণী এলো তৎক্ষনাৎ,
” হেয়ালি করিস না শিশির। কুয়াশা বাসায় ফিরে নি৷ তোর সাথে থাকলে বলে দে। রাত হয়ে যাচ্ছে তবুও বোনটা আমার বাড়ি ফিরে নি৷ হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমাদের৷ বল ভাই আছে তোর সাথে ও?”
নীহারের কথাটা তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারল না শিশির। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কী বলল নীহার? কুয়াশা বাড়ি ফিরে নি অথচ তার কাছে আছে কিনা জিজ্ঞেস করছে? বাড়ি ফিরেনি তো কোথায় কুয়াশা? মস্তিষ্ক যখনি এই কথাটা ধারন করতে পারল ঠিক তখনি প্রকৃতির বজ্রপাতের সাথে তার মাথায়ও বজ্রপাত হলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে কুয়াশা বাড়ি ফিরে নি! ভাবতেই প্রকৃতির অন্ধকারের সাথে তার চোখজোড়াতেও অন্ধকার নেমে এলো৷ প্রকৃতির বারিধারার সাথে তার অন্তরেও বিষাদময় বারিধারা নামতে চাচ্ছে। এ কী শুনছে সে! তার তো যাবার জায়গা নেই তো যাবে কোথায়?
পরক্ষণেই মনে হলো বান্ধবীদের বাড়িতেও যেতে পারে। কিন্তু বেয়াদব গোবর ঠাঁসাটা ফোন করে বলে নি সেটা? বলল,
” ভাইয়া কুয়াশা আমার সাথে নেই। হয়তো বান্ধবীর বাড়ি গেছে। খোঁজ নাও ফোন দিয়ে। চলে আসবে চিন্তা করো না “
ওপাশ থেকে বড্ড বিরক্তঝরা বাণী এলো,
” তোর কি মনে হচ্ছে আমরা খোঁজ না নিয়ে বসে আছি? আমাদের একমাত্র বোন এখনো বাড়ি ফিরেনি আমরা খোঁজ না চালিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকব? কুয়াশা কোথাও যায়নি। ওর বান্ধবীই ঈশা আর স্মৃতি। ও ওদের বাড়িতেও যায় নি৷ মাথা টেনশনে ছিঁড়ে যাচ্ছে আর তুই বলছিস চিন্তা না করতে? থাক তুই চিন্তামুক্ত। তোকে চিন্তা করতে হবে না আমাদের বোন নিয়ে।”
নীহার অতিরিক্ত রেগে ফোন কেটে দিল৷ সে যে বেজায় রেগে গেছে সেটা শিশির বুঝল। তা না হলে নীহার এমন ভাবে বলত না। কিন্তু নীহার বলল টা কী? তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তাদের বোন এখনো বাড়ি যায় নি? এটা কী করে হতে পারে? গেল কোথায় কুয়াশা!!
ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই তো? জানা মতে তো নেই থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারত৷ তেমন ভাবভঙ্গি তো কখনো দেখে নি যে, বয়ফ্রেন্ডের সাথে ভেগে যাবে। এমন মেয়ে কুয়াশা না। সে বোন মানুক আর না মানুক কুয়াশাকে চেনে। এমন হাজার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। অস্থির হয়ে উঠল সম্পুর্ণ কায়া, অন্তর। মাথায় হাতুড়িপিটার মতো ব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। কোনো দূর্ঘটনা ঘটল না তো? ভাবতেই আর বৃষ্টির তোয়াক্কা করল না। এক লাফে ছাউনি থেকে বেড়িয়ে এলো। ভিজে গেল সমস্ত শরীর৷ তোয়াক্কা করল না তাতে। তার উদ্দেশ্য এখন বাড়ি। যতক্ষণ পুরো ঘটনা জানতে না পারছে ততক্ষণ শান্তি নেই।
_______
শিশির বাড়ি ফিরল তখন চারিদিকে আজান দেওয়া শেষ হয়ে গেছে৷ সন্ধ্যার শেষে রাত নামছে। বাইক চালিয়ে বৃষ্টির মধ্যে কোন অবস্থায় এসছে ঠিক জানা নেই। হতভম্ব হয়ে বাড়ির মেইন গেইট পেড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল। ভিজে সে জুবুথুবু। বসার ঘরে প্রতিটা সদস্যর অবস্থা দেখল। তৎক্ষনাৎ অন্তর জ্বলে উঠল। তারমানে নীহার যা বলেছে সেটায় ঠিক?
‘
আজমীরা সন্ধ্যার থেকে কান্না শুরু করেছে তার সাথে জাকিয়াও শুরু করেছে৷ আম্বিয়া বরাবরই স্ট্রোং তাই দুই জা’কে সে সামলাচ্ছে। ইয়াসমিন, বৃষ্টি ভাইয়েদের সাথে চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে একমাত্র আদরের মেয়ে ফিরছে না রাত হয়ে গেছে। বয়ফ্রেন্ড ঘটিত কোনো ঘটনা নেয় তারা জানে। যদি থাকতো তবে এতদিনে ঠিকই বুঝত।
মায়ের মন বলে কথা? কাঁদতে কাঁদতে ফিট হবার জোগাড় হয়েছে৷ হিম কেঁদে কেঁদে মা’কে থামানোর চেষ্টা করছে৷ ছেলেগুলো এত আশ্বাস দিয়েছে তাদের বোনকে তারা খুঁজে বের করবে তবুও থামছেন না।
শিশির সকলকে দেখে নিয়ে এগিয়ে গেল। শিশিরকে দেখে জাকিয়া আবার ঝরঝর করে কান্না করে দিলেন। দেবরের মেয়ে হলেও নিজের মেয়ের মতো করে বড় করেছেন ছোট থেকে৷ সেই মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না তিনি মানতে পারছেন না৷
শিশির আজমীরার কাছে এগিয়ে গিয়ে বসল। আজমীরা এবার শিশিরের হাত ধরে কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন৷ বললেন
” আব্বুরে আমার মেয়েটাকে তোরা খুঁজে এনে দে আব্বু৷ ওর যাবার জায়গা তো নেই রে আমরা ছাড়া। ওর কি হলো রে। এনে দে না আমার জানটাকে। এখনো ফিরল না আমার কলিজাটা। কোনো দূর্ঘটনা হলো কিনা তাও তো জানি না ”
শিশিরের শেষ কথাগুলো শুনে গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। আজমীরাকে তড়িঘড়ি করল বলল,
” ছোট আম্মু, এসব বলো না। কুশুকে ঠিক পাব আমরা। সুস্থ সবলই পাব। শান্ত হও তুমি প্লিজ “
শিশিরের শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে। যতই নিজে আশ্বাসবাণী দিক না কেন। মাথার মধ্যে শুধু আজেবাজে ঘটনা কিলবিল করে বেড়াচ্ছে৷ এখানে মা, চাচিদের কান্না দেখে আরোই সহ্য করতে পারছে না। বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র বাড়ির সম্মান কোথায় গেল?
সে ইয়াসমনিকে পুরো বিকেলের ঘটনা জিজ্ঞেস করল। সব শুনে হাত পা অসাড় হয়ে এলো তার। গেছে কোথায় মেয়েটা?
তৎক্ষনাত ফোন বের করে রিজভীর কাছে ফোন দিল৷ কেন দিল জানে না৷ সন্দেহের বসে ফোন দিল৷ যেমনই হোক তাকে আগে জানতে হবে কুয়াশা কোথায়!
রিজভীর কাছে ফোন দিয়ে সরাসরি জানাতে চাইল কুয়াশা তাদের ওখানে আছে কিনা! এমন কথায় বা কেন বলল জানা নেই। মনে চাইল বলে দিল। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রাত হয়ে গেছে মেয়েটার ফেরার নাম নেই। রিজভী যদিও অবাক হয়েছিল কিন্তু সম্পূর্ণ বিষয় শুনে সে-ও চিন্তায় পড়েছে৷
তুষার, নীহার, তুহিন কেউ নেই৷ নীহার, তুহিন তুষারের সাথে গেছে।
‘
তুষার একের পর চিন্তা করে চলেছে। আজ দুইদিন যাবত তার একটা কেস হাতে এসেছে উপরমহল থেকে। তা হলো মেয়েদের অ’পহ’রণ করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। সেই অ’প’হ’রণ’কারীদের ধরার। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে ভেবে তুষারের হাত পা ভেঙে আসছে৷ তাদের বোনও সেই বিপদে পড়ল না তো? একের পর এক কুয়াশার ফোনে কল করছে কিন্তু বার বার একই রকম বাক্য কানে আসছে।
“আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুণ “
এই বাক্যগুলো শুনতে শুনতে সকলের কান পঁচে গেল। কেউ বাদ রাখেনি কল করা৷ সব ভাইগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। তুষার কুয়াশার ফোন ট্রেকিং করছে। লাস্ট লোকেশন স্টেশন পর্যন্ত দেখাচ্ছে। এখন ফোন বন্ধ থাকায় মেইন লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে না৷ হয়তো সিম খুলে ফেলা হয়েছে। তুষারের ফোর্সরা হাল ছাড়ে নি। খোঁজ নিয়েই ছাড়বে। বাড়ির সকলের ফোন ট্রেকিং দিয়েছে যদি অ’প’হ’র’ণ করা হয়ে থাকে আর কোনো কারণে সেই অ’প’হ’র’ণ’কারীরা ফোন দিলে সাথে সাথে ধরতে পারবে।
জাহিদ মালিথা আজ সকালে চলে গেছেন। উনাকে খোঁজ দেওয়া হয়েছে। তিনিও সম্পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
‘
শিশির বাড়ি থেকে কোনো রকম চেঞ্জ করে বেড়িয়ে পড়েছে। থানায় সকলে কী করছে না করছে আগে দেখবে। তারপর সে নিজের মতো করে কাজ চালাবে৷ তার বুকের ভেতর কেমন জ্বলুনি ধরেছে। মেয়েটাকে বাড়ি ফিরেই দেখতে পায়, সকালে উঠে দেখতে পায়। ঝগড়া, মা-রা মা-রি করে। কখনো কোথাও যায় না দুইদিনের জন্যেও৷ আর আজ এত ঘন্টা হয়ে গেল মেয়েটার খোঁজ নেই। চোখ জোড়া কেমন তৃষ্ণার্থ কাকের ন্যায় হয়ে গেছে। মাথা টেনশনে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সকলের মতো তারও কষ্ট হচ্ছে!! মুখে তো বলে, “তুই আমার কেউ না।” কিন্তু এখন ঠিকই তার পুড়ছে। রক্ত কথা বলে। সব রক্তের টান। রাস্তা ঘাটে চোখ বুলোতে বুলোতে গেল আর আল্লাহকে ডাকছে। যে করেই মেয়েটাকে সহি-সালামত যেন পেয়ে যায়। ভয় করছে কোনো ক্ষতি যেন না হয়। অস্তির লাগছে চোখমুখ ঝিমিয়ে আসছে কোথায় গেলে পাবে মেয়েটাকে? অজান্তেই বিড়বিড়াল সে ,
” কুয়াশা সোনারে কোথায় তুই!! “
‘
রাত দশটা বেজে গেছে। মালিথা ভিলায় কারো খাবার মুখে ঢুকে নি। জাকির মালিথা মেয়ের জন্য ভেবে ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উনাকে কোনো রকম খাইয়ে ঘুমের ঔষধ ও প্রেশারের ঔষধ দেয়া হয়েছে। কারণ প্রেশার বেড়ে গেছিল উনার।
আজমীরার অবস্থা করুন। আম্বিয়া আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারেন নি। তিনিও জা-য়েদের সাথে কান্না করে দিয়েছিল। বৃষ্টি, ইয়াসমিন খুব কষ্টে নিজেদের শক্ত রেখে সকলকে সামলাচ্ছে। হিম বোনের জন্য কেঁদে কেঁটে একাকার হচ্ছে।
______
রাত এগারটা। ঘরের চাল ফুটো, বেড়া ফুটো। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে শব্দ হচ্ছে।চাল দিয়ে পানি পড়ছে। টিনের ঘর। চারিদিকে অন্ধকার শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে। সেই মোমবাতির আলোয় যতটুকু আলো হচ্ছে ততটুকু চোখে দেখা যাচ্ছে। কুয়াশার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে৷ চোখ মিলে তাকিয়ে সেগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। সব দেখে নিয়ে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সে ঠিক কোথায়? তাকে কোথায় আনা হয়েছে? কেন আনা হয়েছে?
এখানে কীভাবে এলো সেটা ভাবতেই দুপুরের কথা মনে হলো৷ কালো ঘণ মেঘের মধ্যে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছিল সে আর স্মৃতি। তাই কলেজ থেকে ওভাবেই বের হয়েছিল তারা।। কারণ বাড়িতে চিন্তা করবে দেরি হলে৷ বেশি দূরের পথ না হওয়াতে সমস্যা হবে না বলে বেড়িয়েছিল দু’জন। বৃষ্টির আগে পৌঁছাতে পারলেই হবে। বৃষ্টি যখন তখন শুরু হবে অযথা রাস্তায় থাকার চেয়ে বাড়ি গিয়ে কাথা মুড়িয়ে ঘুম দিলেই বেশি শান্তি পাওয়া যাবে৷ এসবই ভেবে রাস্তায় নেমেছিল৷ কিন্তু মেইন রোডে আসতেই ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির মধ্যে চলাচল গাড়ি চলছিল কিন্তু সবটায় ভর্তি ছিল যাত্রীতে। কপাল যেদিন পুড়ে সেদিন সবদিক দিয়েই পুড়ে৷ তাই তারা অপেক্ষা না করে স্টেশনে যাবার গলির দিকে হাঁটতে লেগেছিল। গলিতে নেমে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিএনজি পিছনে থেমে তাদের দেখে ডাকে। তারা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করে। তৎক্ষনাৎ উত্তর আসে, ‘যাবে’। দু’জন খুশি হয়ে উঠে পড়ে।
বাঁধে বিপত্তি সেই সময় যখন এক সিএনজিতে স্মৃতি, কুয়াশা একসাথে যেতে পারবে না এটা ভেবে৷ স্টেশনের মোড়ে এসে সিএনজি ওয়ালা বলে স্মৃতিকে নিয়ে যেতে পারবে না সে ঐ রাস্তায় যাবে না। তাই স্মৃতি নেমে অন্য গাড়িতে উঠে চলে যায় আর কুয়াশা রয়ে যায়। এরই মাঝে সিএনজি ওয়ালা কাকে যেন ফোন করে বলে,
” ফাঁকা ”
জাস্ট এটুকু। এরপরই একটা মধ্যে বয়সের লোক সিএনজিতে ওঠে। কুয়াশা বেশি পাত্তা দেয় নি। রাস্তায় তো কত মানুষই পাবলিক গাড়িতে ওঠে! অন্ধকার তারউপর বৃষ্টির জন্য সিএনজির পর্দা নামানো ছিল৷ তাই কোনদিকের পথ ধরেছিল ড্রাইভার সেটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে। তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে পাশের লোকটা মুখ আটকে ধরে। যেখানে কিছুএকটা ছিল যেটাতে সে পরক্ষনেই জ্ঞান হারিয়েছিল৷ তারপর আর মনে নেই৷
সে কোথায়! শহর থেকে বা কোথায় এনেছে তাকে! কিছুই জানে না। চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে৷ দুই হাত পা শুধু বাঁধা। ভাবনার মাঝেই পাশের রুম থেকে বিশ্রি কিছু আওয়াজ আসল। যেগুলো শুনে তার শরীরে শীতল শ্রোত বেয়ে যাচ্ছে ভয়ে৷ শরীর ঘিনঘিন করে উঠল৷ তাকে কোথায় আনা হয়েছে? সবকিছুর বোধে না এলেও এটা ঠিক বুঝতে পারছে এটা ভালো মানুষদের আনাগোনার জায়গা না। আর পাশে যেমন সব কথাবার্তা, শব্দ আসছে এগুলো ভালোকিছু না। খুবই অশ্লীল। এই অশ্লীল জায়গায় তাকে কে আনলো? আর কেন আনলো? এই জায়গার নাম তার জানামতে পতিতালয়।
সে আবার ঝরঝর করে কেঁদে দিল তার ভবিষ্যতে ভেবে৷ তার ভাইয়েরা কই? তার তুষার ভাই, মেজো চাচু কী জানে না তাদের মেয়েকে অ’পহ’রণ করা হয়েছে! বাড়ির কথা মনে পড়ছে মায়ের কথা মনে পড়ছে। সে এখানে থাকতে পারছে না। কি দোষ তার? তাকে পতিতালয়ে আনা হয়েছে? আর একটা কথা মাথায় আসছে না আনল তো আনল তাকে একা কেন আনল? স্মৃতিও তো তার সাথে ছিল!!
ভাবতে ভাবতে তার ব্যাগ খুঁজল। ব্যাগ কই? ব্যাগে ফোন আছে। ভাইয়াদের জানাতে হবে।
‘
একটু পর একটা মধ্যে বয়স্ক মহিলা এলো খাবার নিয়ে। এসে বাজে ভাষায় গালি দিয়ে বলল খেয়ে নিতে। কুয়াশা দেখল মহিলাটা খুবই বিশ্রি ভাবে সেজে আছে। পরিধান বস্ত্র অশ্লীলতার পরিচয় দিচ্ছে। দৃষ্টিও তার অশ্লীল। মহিলাটা আবার বলল,
” গতর তো তোর হেব্বি টসটসারে রে মা* কি দিয়া বানাইস এমনে? যৌবনে ভরা রসাল ফল লো তুই। তোরে তো যে দেখবিনে সেই নিতে চাবিনে রে। মাইয়া হয়ে তারিফ করছি। ভাব তাইলে তোর গতরের জোর কী! মজায় মজা। ”
এইসব কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে কুয়াশার শরীর ঘিনঘিন করে উঠল৷ জীবনে যেসব শুনেনি সে আজ শুনল সেসব। এসব কথায় মানে সে খুব ভালো করেই বুঝল। বমি এসে গেল তাকে নিয়ে এমন মন্তব্য শুনে। প্রশ্ন করল,
” কী খারাপ ভাষা আপনার। আপনি নিজে একটা মেয়ে হয়ে এসব বলতে লজ্জা করছে না? আমাকে ছেড়ে দিন আমাকে এখানে আনা হয়েছে কেন? ”
মহিলাটা শুনে বিদঘুটে হাসি দিল। পান খেয়ে দাঁত, ঠোঁট লাল করে ফেলেছে। সেটাও ঘৃণা লাগল দেখে৷ মহিলা বলল,
” এখানে কেন আসে জানিস না? আর কেন আনা হয় জানিস না? এটা পতিতালয় শুনলি লো মা*। তবে তোদের একটু অন্য কাজেই আনা হইছে। তোদের কাজ এখানে না লো মা*। তোর যে গতর, এতে অন্নেক টেকা পাওয়া যাবিন৷ তাই তোরে টেনেসফার (ট্রান্সফার) কইরি ঢাকায় দিয়া হবি৷ সেজাগায় থিক কোন যাবি আমি জানি নি৷ বস জানে সব। ”
কুয়াশা হতভম্ব, হতবিহ্বল, হতবাক হয়ে বসে রইল। তার মানে তাকে দিয়েও ব্যবসা করানো হবে!! আর সে এখানে একা না? আরো মেয়েরা আছে? ভাবতেই শব্দ করে কেঁদে দিল৷ আল্লাহ এত রেখে তাকে কেন এমন বিপদে ফেললেন৷ সে কান্না করতে করতে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। মহিলা আবার বলল,
” বৃষ্টির জন্য গাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তোদের আজ নিয়ে যায় নি। কাল নিয়ে যাইবিনে৷ ”
বলে হাসল৷ কুয়াশা কেঁদে বলল,
” আমাকে ছেড়ে দেন। আমার চাচা, ভাই পুলিশ অফিসার। জানতে পারলে কি অবস্থা হবে জানেন তো? আপনাদের কইটাকে হাজতে পুরবে। ”
পুলিশের কথা শুনে মহিলাটা দমে গেল বোধহয়৷ চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কী ভেবে যেন শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,
” পতিতালয়ে পুলিশ আইসা কি করবিনে রে? কত জনরে ধরবিনে? এখেনে যেই মাইয়ারা আছে সবাই নিজের ইচ্ছেই দেহ বিক্রি করে। ওদের টেকার সুখও লাগব গতরের সুখও লাগব বুঝলি লো মা** তোরা এইখানে কাইল পর্যন্ত থাকবি তারপর রাতেই তোদের নিয়ে চলে যাবিনে। এই সময়ে তোর খোঁজ পাবিনে কেউ? ”
ছিঃহ কী নোংরা লোকজন এরা!!কিন্তু তার পরিণতি কী হবে? কুয়াশা হাউমাউ করে আবার কেঁদে দিয়ে বলল,
” আমাকে ছেড়ে দেন না। এখানের মানুষ সব খারাপ কাজ করে। আমি বাড়ি যাব৷ আপনিও তো একটা মেয়ে দয়া করুণ প্লিজ ”
মহিলা বলল,
” এখানে দয়া দেখানি হয় না৷ সব টেকা। দুইদিন থাকলি তুইও মজা পাইয়ে গেলি সব ভালো লাগবিনে ”
বমি এসে গলায় বিঁধল কুয়াশার এসব নোংরা কথা শুনে৷ কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমাকে এখানে আনা কেন হয়েছে। কে এনেছে? আর কি জন্য এনেছে? ”
” আবার একই কথা কইস! তোরে কেন আনা হইছে কইলামই তো। কিন্তু আর কিছু কইতে পারব না। এখন গিলে নে। ”
রেগে কুয়াশা বলল,
” খাব না আমি৷ আমার ভাইরা চাচুরা জানতে পারলে তোদের এই ব্যবসা নিপাত করে ছাড়বে মনে রাখিস ”
মহিলা আর কথা বলল না। হাত খুলে দিয়ে খেয়ে নিতে বলে ফোন করে কাকে যেন কি বলতে বলতে চলে গেল। কুয়াশা নিজের অবস্থা ভেবে হাউমাউ করে কান্না করে দিল৷ আঠারো বছরের জীবনে এমন কিছুর সাথে সে প্রথম পরিচয় হলো। তার সম্মান কী আর থাকবে এসব জানাজানি হলে? তার পরিণতিও কী এখানকার মেয়েদের মতো হবে? ফোন কোথায় তার? হাত খোলা পেয়ে নিজের ফোন খুজতে ব্যস্ত হলো। ফোনও পাচ্ছে না ব্যাগও পাচ্ছে না। অধৈর্য হয়ে কেঁদে দিল আবার। আওড়াল,
” আল্লহ রক্ষা করুন আমায় দয়া করে”
| চলবে |
আরেকটা পর্ব দিতে পারি সুযোগ হলে।
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click