®রোজা রহমান
‘
দেখতে দেখতে সেই ক্ষণ চলেই এলো। হাজার ইতিউতি করেও শিশির কুয়াশার লাভ হয়নি৷ তাদের হাত, পা, মুখ বড়রা কথারজাল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। সব মুখ বুজে এখন মানতে হচ্ছে। বড়দের ভালোবাসা, স্নেহ, আদর, কৃতজ্ঞতা সব স্বীকার করে দু’জনেই বিয়ের পীড়িতে বসতেই চলেছে। বিয়ের সিদ্ধান্তটাও বড়দের উপর ছেড়ে দিয়েছে। এখন শুধু ভবিষ্যত দেখার পালা তাদের। দেখা যাক তাদের ভবিষ্যতের জল কতদূর গড়ায়।
‘
দুপুর তিনটা। একদম নিরিবিলি সব আয়োজন। কোন সোরগোল নেই৷ আত্নীয় বলতে জাকিয়া বেগম তার দুই ভাই এবং শুধু বোনের স্বামীকে ডেকেছে সাথে শশীকে আনতে বলেছেন৷ আর আম্বিয়ার ভাই আমিনুল হক এবং বৃষ্টির বাবাকে শুধু ডাকা হয়েছে৷ এসব সকালেই জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথা জানিয়েছিলেন তাদের। আমিনুল হক আসতে চাইলেও জাকিয়া বেগমের দুই ভাইয়ের বড় ভাই শুধু আসতে চেয়েছেন ছোট ভাইয়ের কাজের জন্য ঢাকায় আছেন৷ আর শশীর বাবা অর্থাৎ হানিফ সাহেব জানিয়েছেন আজ আর যাওয়া সম্ভব হবে না উনার তবে আগামীকাল চেষ্টা করবেন তবুও না হলে পরিবার সহ সময় করে দেখা করে আসবেন।
এদিকে শশী সবটা শুনে নাচা শুরু করেছে সে যাবেই। তার শিশির ভাইয়ের বিয়ে তাও আবার কুয়াশা বুবুর সাথে? ভাবা যায়!! আর সে যাবে না এটা হতে পারে? দুনিয়া উল্টে গেলেও তার সেখানে উপস্থিত থাকা চায়-ই চায়। কিন্তু হানিফ সাহেবের সময় হবে না। তাই বলেছে কাল যাবেন। শশী মানতে নারাজ। তৎক্ষনাৎ নীহারকে কল করে কেঁদে কেঁদে সবটা বলে দিয়েছে। তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছে। নীহারও কী করবে বুঝে উঠছে না। সেখানে গিয়ে তো আনতে পারবে না। কারণ তাদের কী সম্পর্ক সেটার এখনো নাম পায়নি। অধিকারের জন্য এঙ্গেজটাও হওয়াটা জরুরি। কিন্তু এখনো সেসব দেরি আছে। তাই সে বড় আম্মুকে বলেছে। জাকিয়া সব শুনে মিহিরের সাথে শশীকে পাঠাতে বলেছেন। দুই ভাইবোনই আসুক না হয়!! তবে হানিফ সাহেব আসতে দিতে চাইলেও রাত থাকতে মানা করেছেন। শশী মেনে নিয়েছে। সেসব পরের বিষয় আগে যেতে হবে তার। সে খুবই উত্তেজিত।
কুয়াশার বান্ধবী হিসেবে ঈশা, স্মৃতিকে ডাকা হয়েছে। বান্ধবীর জীবনের বড় সময়টাতে না হয় পাশে থাকল তারা! নীহার রিজভীকে বলেছে আসতে। এসবকিছু শিশির বা কুয়াশা কেউই বলনি৷ সবটা বাড়ির মানুষই করেছেন৷ তারা রাগে, দুঃখে কাউকে কিছু জানাতেও নারাজ৷
‘
কেনাকাটা কিছুই করা হয়নি। মূলত করতে চায়ও নি কেউ। সেসব কিনে পড়াতে গিয়ে যদি আবার হিতে বিপরীত হয় তখন আবার বিপদ! এছাড়া শুক্রবার মার্কেটের অনেক দোকান বন্ধ। তাই আর সেসব দিকে আগায় নি কেউ৷ আগে ভালোই ভালোই বিয়েটা হয়ে যাক। এরপর সবকিছুতে জোর খাটানো যাবে৷ এসব ভেবেই নিরব আয়োজন করেছে৷ শুধু কাজীকে ডাকা হয়েছে।
‘
বসার ঘরে বসে আছে বড়রা সাথে কাজী। সকলে জুম্মার নামাজ পড়ে এসে আয়োজন কাজে লেগেছে। শিশিরকে সাথে করে নামাজ পড়ে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর তুষার, তুহিন, নীহার, হিমেল, রিজভী, মিহির পাত্র অর্থাৎ শিশিরকে নিয়ে একসাথে সকলে নেমে এলো। শিশিরের পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা৷ সিম্পল একদম বাড়িতে থাকা পাঞ্জাবিই পড়েছে সে৷ যেটা পড়ে জুম্মার নামাজে গেছিল সে। শিশিরকে সাথে করে বসল সব ভাই। শিশির নির্বিকার। তার সবকিছুতে এখন বিরক্তবোধ হচ্ছে। নিরবে যে যা বলছে করছে৷ ভেতরে রাগকেও সংবরণ করে রেখেছে৷
উপস্থিত বাবা, চাচুরা দেখে মুচকি হাসল। ছেলে তাদের মাশাআল্লাহ। এই সামান্য সাদা পাঞ্জাবিতেই কী সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে৷ শুভ্রতায় ছেয়ে গেছে মুখখানি। যদিও বিরক্তির ভাজ কপালে দৃশ্যমান৷ তবুও অন্তর জুড়ানো সুদর্শন সে।
‘
এদিকে কুয়াশাকে কেউ শাড়ি পড়ার কথা বলতে পারেনি। এমনিতেই জেদি তখন যদি আবার বেঁকে বসে বিপদ হবে৷ সে একটা লাল-সাদা মিশেলের কর্টনসুতির থ্রিপিচ পড়েছে৷ নিজের মন মতো করে তৈরি হয়েছে৷ একদম সাদামাটা। মুখে স্নো ছাড়া কোনো প্রসাধনী নেই। কানে সিম্পল সোনার দুল, গলায় চেইন আর বাম হাতে সোনার একটা ব্রেসলেট ও আঙটি পড়েছে। ব্রেসলেটটা তুষার তাকে গিফট করেছিল আঙটিটা তুহিন জবের প্রথম স্যালারি পেয়ে গিফট করেছিল। দুল, চেইন ওর দাদা-দাদী থাকতে উনারা দিয়েছিলেন। ভারী গহনা এখনো তাকে দেয়া হয়নি। হালকা ভেজা চুল ছেড়ে দেয়া। বৃষ্টি, ইয়াসমিনকে শাশুড়িরা বলেছে কোনো রা না করতে। ওর যেমন ভালো লাগে তৈরি হোক৷ বিয়েটা আগে হয়ে নিক তারপর সবকিছু বলবে এবং করবে। তাই বৃষ্টিরাও আর জোর করে নি। ঘরে তারা কুয়াশার সাথে বসে। জোহরের নামাজ সহ নফল নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছিল নামাজ পড়েই রেডি হয়েছে সে। শশী সহ স্মৃতি, ঈশাও এসেছে দুপুর দু’টোর দিকে৷ শশী বলল,
” বুবু শাড়ি পড়বে না? বিয়ে তোমার শাড়ি না পড়লে কী করে হবে? ”
বৃষ্টি শুনে চোখের ইশারায় থামতে বলল শশীকে৷ শশী তা বুঝল না। কুয়াশার কাটকাট জবাব,
” এই বিয়েই না করতে পারলে বাঁচি সেখানে আবার ঢং করে শাড়ি পড়ব? “
শশী কিছু বলতে যাবে সে সময়ে আজমিরা, জাকিয়া, আম্বিয়া এলেন। মেয়েকে দেখে তিন জা মুচকি হাসলেন৷ জাকিয়া এসে কুয়াশার ডান হাত তুলে কনিষ্ঠ আঙুলে হালহা কামড় দিয়ে বললেন,
” নজর না লাগুক আমার পাখির। কী সুন্দর লাগছে এই সামান্যতেই!! মাশাআল্লাহ ”
তারপর কিছু একটা দেখলেন খুঁটিয়ে এরপর বললেন,
” তোর তো এখনো নাক ফুটো করা হয়নি রে মা৷ ইশশ এটা কখনো বলাও হয়নি৷ ”
কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে তাকালে আম্বিয়া চুপ থাকতে বললেন জা’কে। কুয়াশা প্রশ্ন করল,
” নাক ফুটো করতে হবে কেন? আমার ওসব ভালো লাগে না। তাই করিনি ”
আজমিরাও আর কিছু বলতে দিলেন না৷ এটা নিয়েও পরে বলা যাবে৷ আগে কবুল বলা অবধি যাক। সব আপনাআপনি হবে৷ এর মাঝে হিম এসে জানালো নিচে ডাকা হচ্ছে। কথাটা শুনে কুয়াশা বুকে বাড়ি দিল৷ তার জীবনের রঙ পাল্টানোর দিন আজ! আর কিছুক্ষণের মাঝে সব থেকে অপছন্দের ছেলেটা তার জীবনসঙ্গী হবে!!
সরল চোখে মায়ের দিকে চাইল। আজমিরা মেয়ের দিকে হাসি হাসি মুখে চায়ল চোখে পানি টলমল করছে৷ কখন শ্রোতের ধারার মতো বেয়ে পড়বে। কিন্তু মেয়ের সামনে তিনি নরম হবেন না। শক্ত থাকতে হবে। মেয়েটার জীবনের অমূল্য সময় এটা। বাবা বীহিন বড় করেছেন। আজ তিনি থাকলে দিনটা আরো রঙিন হতো। সব ভেবে মেয়ের কাছে গিয়ে কপালে চুমু আঁকলেন। ডান হাতটা শক্ত হাতে ধরে হাসি মুখে বললেন,
” চলো ”
মায়ের কথায় অভিমানে সিক্ত হলো মন৷ অভিমান নিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ হাত পা কাঁপছে কেন তার!! অদ্ভুত ভাবে শরীরও কাঁপছে, অন্তুর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই পথটুকু শেষ করে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আর পৌঁছাতে পারবে না সে৷ সেটা বোধহয় বুঝল সকলে৷ জাকিয়া, আম্বিয়া সাপোর্ট হয়ে শক্ত হাতে হাত ধরলেন মেয়ের। তাকাল মা, চাচিদের দিকে। তারা চোখে ইশারায় আশ্বাস দিলেন। অর্থাৎ,
” ইনশাআল্লাহ সব ভালো হবে মা। জীবন সুন্দর। ”
বৃষ্টি, ইয়াসমিন পাশে এসে দাঁড়িয়ে দু’জনেই বলল,
” কুয়াশা..! সোনা বিশ্বাস কর জীবনের রঙ সুন্দর ”
ইশা, স্মৃতি, শশী এসে হেসে বলল,
” নতুন জীবনের জন্য পা বাড়াও উডবি মিসেস শিশির কুয়াশা মালিথা ”
পুরো অন্তর, কায়া কেঁপে উঠল এক লহমায়। বিদ্যুৎ সঞ্চার ঘটল সম্মোধনটা কানে পৌঁছাতেই। শরীরের লোমগুলো তৎক্ষনাৎ খাড়া হয়ে কাঁটার ন্যায় বিঁধল ৷ শিরশির করছে পা থেকে মাথা অবধি। গালে রঙিন আভার ও সঞ্চার ঘটল বোধহয়। চোখ বুজে এলো, কান গরম হয়ে উঠল। শক্ত হাতে মা এবং হবু শাশুড়ীর হাত ধরল। এবার চোখ খুলল। দরজার সামনে থেকে হিম এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,
” অ’ভিনন্দন, বুবু। আমাদের সম্পর্ক দু’রকম হতে যাচ্ছে”
কুয়াশা এত এত কথা আর গিলতে পারছে না। এদের সাথে থাকলে নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলবে এত এত কথার ভিড়ে। তাই হিম ছাড়তেই সে কাঁপা কাঁপা পায়ে এক পা বাড়াল। সকলে সঙ্গ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল।
________
সিঁড়ি দিয়ে নামছে সকলে কুয়াশাকে নিয়ে। ঘুরে তাকাল সেদিকে বসে থাকা সকলে। শুধু শিশির বাদে৷ তার নজর ফ্লোরে। বসে থাকা চাচুরা, ভাইরা মুচকি হাসলেন৷ তাদের ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে। ভাবনার মাঝে সেখানে পৌঁছাল কনে পক্ষগণ৷ মেয়েকে বসিয়ে দিল মায়েরা। শিশিরের সামনে সোফায় একদম মুখোমুখি। বসানোর পর উপস্থিত প্রতিটি সদস্য একবার শিশিরের দিকে তাকাল তো এবকার কুয়াশার। দেখে নিয়ে সকলে মনেমনে আওড়াল,
” মাশাআল্লাহ “
কুয়াশা মাথার ওড়নাটা টেনে নিল একবার। সামনে সে এখনো তাকায় নি। কেন তাকায় নি বোঝা গেল না। অভিমানে? রাগে? নাকি লজ্জায়? বোঝা গেল না৷
শিশিরও নির্বিকার৷ তারও তাকাতে ইচ্ছে করছে না। গোবর ঠাঁসাকে আবার নতুন করে দেখার কী আছে? কিন্তু সত্যি কি দেখার কিছু নেই? উহু এটা ভুল, তারই একমাত্র দেখার জিনিস হবে সে একটু পর থেকে। এখন না দেখলে কি? সারাজীবন তাকেই দেখার দায়িত্ব নিতে হবে৷
ভাবনার মাঝে কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন বিয়ের কাজকর্ম শুরু করবে কিনা। কথাটা কানে যেতে আবার ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এবার দু’জনেরই বাড়ল। শিশির এবার কী ভেবে যেনে তড়াক দৃষ্টি তুলে কুয়াশার পানে তাকাল৷ তাকিয়ে একটা সদ্য ফোঁটা ফুল দেখতে পেল। তবে অনুভূতি প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তার শব্দভাণ্ডারে পেল না। পেল না নাকি পেতে চাইল না বোঝা গেল না। চোখ নামিয়ে নিল আবার। যে মেয়েকে বোন বলে স্বীকার করতেই কষ্ট হতো আজ সে ভাগ্যর লীলাময় খেলায় এক লহমায় বউ হতে চলল! উপর ওয়ালার কী ভবিতব্য ভাবা যায়!!
জাকির মালিথা সম্মতি দিলে কাজী বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও কথা সেরে শিশিরের উদ্দেশ্যে কবুল বলতে বললেন। মাথাটা আবার তৎক্ষনাৎ ঝিমঝিম করে উঠল৷ ছেলে হয়েও যেরকম অবস্থা হচ্ছে এই মুহূর্তে তাহলে কুয়াশার কি হচ্ছে? বুক কাঁপছে তার৷ শরীরে ঘাম উঠছে। সাদা পাঞ্জাবির উপর তা দৃশ্যমান হচ্ছে।
ভাইরা, চাচুরা বুঝল৷ তুহিন, তুষার, নীহার, রিজভী চারজন কাঁধে এবং বাহুতে হাত রাখল। আশ্বাসের হাত। শিশির চোখ বন্ধ করল তৎক্ষনাৎ। চোখ খুলে কুয়াশার মুখ পানে গভীর, প্রগাঢ় দৃষ্টি দিল একবার৷ কুয়াশার নজর নিচে। এরপর দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে তিন কবুল বলে দিল৷ কুয়াশার কানে যেতেই কান ঝা-ঝা করে উঠল। শরীর পুরো ঝাঁকিয়ে তুলল তিন কবুলের বুলিগুলো। চোখে পানি এসে গেল৷
এবার কুয়াশার দিকে নজর দিল সকলে৷ সে নিচে তাকিয়ে ওড়নার মাথা চেপে ধরে আছে শক্ত হাতে। কাজী সাহেব আবারও একই ভাবে প্রয়োজনীয় কথা সারলেন। শেষ করে কুয়াশাকেও একই ভাবে কবুল বলার নির্দেশ দিলেন৷ কুয়াশার হাতপা থরথর করে কাঁপছে। কান্না পাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে কি সকল মেয়েরই এমন হয়? হয় বোধহয়। নয়তো তার কেন এমন লাগছে! নাকি তারই শুধু এমন হচ্ছে! হাত পা ঘেমে উঠেছে৷ ঠান্ডা হয়ে গেছে হাত, পা। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। এ কি কঠিন যু-দ্ধ? সারাজীবনের জন্য এই বিয়ে নামক কঠিন যু-দ্ধ তার সঙ্গী হতে চলেছে। সে কি পারবে প্রতি ক্ষনে প্রতি পলে জিতে যেতে? সাপোর্ট হিসেবে কি পাবে এই সামনে থাকা মানুষটাকে?
কুয়াশার কাঁপা-কাঁপি টের পেয়ে জাকিয়া, আজমিরা দুই পাশে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রাখলেন৷ আম্বিয়া, বৃষ্টি, ইয়াসমিন পেছন থেকে হাত দিয়ে আশ্বাস দিল৷ কুয়াশা একবার জাকির মালিথার দিকে তাকল। এরপর জাহিদ মালিথাকে দেখে নিয়ে মায়ের পানে টলমল চোখে চেয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে তিন কবুল বলল। বুক ভারী হয়ে এলো। বহুত কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অসহায় লাগছে৷ শুধু আল্লাহকে ডেকে বলল মনেমনে,
” আল্লাহ সহায় হোন আমার ”
কুয়াশার কবুল বলা শুনে সকলে উচ্চ শব্দে হাসি মুখে বলে উঠল,
” আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লা”
উচ্চশব্দে সম্বিত ফিরে পেল শিশির৷ বুঝল বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বুকে বাড়ি দিল কিছু একটা৷ আজ থেকে জুড়ে গেল তার জীবনের গতিপথের সাথে এই সামনে বসে থাকা সব থেকে অপছন্দের মেয়েটা। ছোট থেকে শুধু ঝগড়া, চুলোচুলি করা মেয়েটা তার বউ! ‘বউ’ শব্দটা আওড়াতেই পা থেকে মাথা অবধি শিরশির করে উঠল৷ গতকালও কী ভেবেছি সে যে, রাত পোহালে এই মেয়েটা তার বউ হবে? ভাবা কেন! জীবনেও এটা ভাবনাতেও আসত না৷ আর দেখ সেই ভাবনাটা না চায়তেও হয়ে গেল। বিয়ের বন্ধনে আটকা পড়ল দু’জনে। দুই হাম সেপাই একে অপরের জনম শত্রু, কেউ কাউকে একচুল পরিমাণ ছাড় না দেওয়া
“বুনো ওল বাঘা তেঁতুল”
এদের এবার জীবন, সংসার কেমন হয় সেটায় দেখার পালা। কী কী করে জীবন পাড় করে আর কীভাবে সংসার করে৷ আদৌ ভালোবাসা নামক মধুর শব্দটা তাদের মাঝে এসে ধরা দেয় কিনা দেখা যাক৷ মনের মিল ঘটে কিনা, কিংবা তারাই সেসব চাই কিনা দেখা যাক।
‘
কুয়াশার কবুল বলা হলে কাজী সাহেব তাকে স্বাক্ষর করতে বললেন। কুয়াশা কাগজটা নিয়ে টলমল চোখে স্বাক্ষর করে দিল৷ এরপর শিশিরকে বলা হলা স্বাক্ষর করতে। শিশিরও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে স্বাক্ষর করে দিয়ে উঠে পড়ল। তার আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। একা থাকতে চাই সে। বাড়ির লোকের কার্জসিদ্ধী হয়ে গেছে৷ এখানে তার আর কাজ নেই। বুক ভারী হয়ে এসেছে। সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
” আমি রুমে যাচ্ছি ”
কেউ আর আটকাল না৷ সকলে বুঝল তার মনের অবস্থা। দিল সময় কাটাতে একা। কিছুক্ষণ একা সময় কাটাক। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ এটা সত্যি যে কঠিন। মনের বিরুদ্ধে বিয়ে করা৷ অনেক সময় পরিবার নামক মানুষ গুলোই সেই বিরুদ্ধে গিয়ে কাজটা করাতে বাধ্য করে। সেটাই হয়ে গেল শিশির, কুয়াশার সাথে। এখন তাদের মানিয়ে নেওয়া ও মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই৷ সব ভবিষ্যতের উপর৷
শিশির কথাটা বলে হনহন করে উপরে চলে গেল৷ শিশির সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই কান্নার আওয়াজ পেল৷ তৎক্ষনাৎ পা থেমে গেল তার। কুয়াশার কান্নার আওয়াজ। সে-ও কেঁদে দিয়েছে। হাউমাউ করে মায়ের পেট জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে৷ কান্নাটা আর আটকাতে পারল না। আরোই পারল না শিশিরকেও একই ব্যবহার করতে দেখে৷ তার কি ভালোবাসা আদৌ জুটবে কপালে? নাকি সবই দায়িত্ববোধ পালন করবে শিশির!!
শিশির আর একপল ও দাঁড়াল না৷ বড় বড় পা ফেলে চলে গেল ঘরের দিকে। সময় লাগবে তার।
| চলবে |
এর পড়ের অংশটু্কু গুছিয়ে লিখতে গেলে অনেক বড় পর্ব হয়ে যাবে তাই দুইভাগ করলাম৷ পরের টুকু রাত ৯-১০ টার মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। না পারলে কাল দিব।
আর সকলে দুপুরে বিয়ে খেতে চেয়েছিলে তাই দুপুরেই খাবার সুযোগ করে দিলাম
বিয়ে কিন্তু হয়ে গেছে সকলে ওদের অভিনন্দন জানাও
আমি কাজী তাই মিষ্টি খাওয়াও আমাকে
‘বুনো ওল বাঘা তেঁতুল’
| পর্বঃ ৩১ শেষাংশ
®রোজা রহমান
‘
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ বিয়ের পর কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেসব পার্ট চুকিয়ে জাকিয়া বেগমের ভাই, আমিনুল হক, বৃষ্টির বাবা সহ ঈশাও চলে গেছে একটু আগে। ঈশাকে আর রাখেন নি আমিনুল হক। এখন রয়েছে রিজভী, স্মৃতি, শশী, মিহির। শশীরাও চলে যাবে বলেছেিল। কিন্তু নীহার যেতে দেয় নি। এছাড়া জাকিয়াও আটকে দিয়েছেন।
কুয়াশা কান্নাকাটি করে নিজের ঘরে চলে গেছিল তখনি। সেখানে ঘরের দরজা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। কেউ আর ডাকেনি তাকে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
শিশিরের কাছেও এখন অবধি কেউ যায়নি। সে এখন ঘরের দরজা খুলেছে৷ চোখ মুখ ফোলা ঘুম থেকে উঠল বোঝায় যাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল। পাঞ্জাবি খুলে ফেলেছে। এখন পাতলা টি-শার্ট আর টাউজার পড়া। নেমে দেখল ভাইরা সব নিচেই বসে আছে। সেও বসল গিয়ে৷ সকলের নজর তার উপর। বিরক্ত হলো সে। আজব!! এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে? সে কি সেজেগুজে বেড়িয়েছে মেয়েদের মতো আটা-ময়দা মেখে? নাকি নতুন করে রূপ ঝরছে! অসহ্য! ভাবল শিশির।
সকলে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শিশিরকে। ঘুম থেকে উঠে এলো! এদের আর কী বলবে সব? এমন বিয়ে যে কারো হয় জানা ছিল না। সবথেকে ইউনিক বিয়ে বোধহয় এই বুনো ওল বাঘা তেঁতুলেরই হলো। একে তো দু’টো চুলোচুলি করা হাম সেপাইকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিল তারউপর আবার কোনো নতুন কিছু পড়লও না আবার বিয়ের পর গিয়ে দু’টোই নাকে তেল দিয়ে ঘুম পেড়ে এলো? আজব এই দু’টো!
নীহার উঠে গিয়ে শিশিরের পাশে বসল। এখন সে একটু জ্বালাবে এটাকে। টিপ্পনী কেটে বলল,
” দেখলি তো? বলেছিলাম না, আমার আগে তোকে বউ এনে দেব? যাহ্ কথাটা সত্যি করেই দিলাম। বউ এনে দিলাম। আমি তোর বড় হয়ে ওয়েটিংএ রয়ে গেলাম। আহারে, কত বড় সেক্রিফাইজটা-ই না করলাম আমি! তাও মূল্য দিচ্ছিস না। অকৃতজ্ঞ.. ”
সকলে নীহারে কথা শুনে হেসে ফেলল। শিশির রেগে তাকাল৷ এখন সবকয়টা মজা উড়াবে বেশ ভালোভাবে বুঝছে। বলল,
” হ্যাঁ অনেক বড় সেক্রিফাইজ করে ফেলেছিস না? আমার তোকে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। আয় খাই.. “
বলে নীহারের দিকে সত্যি মুখ এগিয়ে নিয়ে যেতে নিল। নীহার এ্যাই, এ্যাই দেখ, দেখ করতে করতে মুখ সরাল৷ সকলে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। নীহার দুইহাত বুকে বেঁধে নিয়ে বলল,
” এমা, ছিঃহ ছিঃহ ভাই করছিস কী! ”
ভাবটা এমন যেন, তার সতিত্ব হ’রণ করতে যাচ্ছিল। শিশির আবার রাগ দেখাল। সরে এসে বলল,
” তোকে আমার বোনই আর দেব না যাহ্ সর। তুই আজীবন ওয়েটিং রয়ে যা। তোদের মতো রাজা’কা’রদের হাতে বোন দেয়া-ই উচিত না ”
” তুই বললেই হবে নাকি? তোর বোন আমার কাছে আসার জন্য এক পায়ে খাঁড়া। পাড়লে দুই পায়েই খাঁড়া হতো ”
আবার হাসল সকলে। রিজভী হাসতে হাসতে এসে শিশিরের অপর পাশে বসল। বলল,
” এ ভাই..এ্যাই! এই বয়সেই তোর বিয়ে নামক কপাল খুলে গেল ভাবতে পারছিস তুই! একটু তো হাসবি নাকি? মনে হচ্ছে তুই একটা অবলা নারী তোরে বনবাসে পাঠানো হবে।”
এবার রিজভীর দিকে রাগত হয়ে তাকাল। রিজভীর মাথায় চাটি মে-রে বলল,
” আমার রঙ লাগে নি। তোদের লেগেছে তোরা ব্যান্ড বাজিয়ে নাচ বে’দ্দপ।”
” বলছিস তো? “
নীহারের উত্তর। শিশির আবার ভ্রু কুঁচকে রেগে তাকাল। তুহিন বলল,
” আহ্, নীহার রাগাস না তো ওকে। ”
শিশির নড়েচড়ে বসল। নীহার হেসে শিশিরে বাহু ধরে নিজের বাহুর সাথে লাগিয়ে দুলতে লাগল দু’জন। শিশিরও আর কিছু বলল না।
_______
সন্ধ্যা শেষ হয়ে গেছে৷ এদিকে ঘর ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে কুয়াশাকে তোলা হয়েছে। চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে বেচারী। বৃষ্টিরা ধরে বেঁধে ওয়াশরুমে পাঠিয়েছে। এখন তাকে শাড়ি পড়াবে আর একটু সাজাবে। যেমনি হোক বিয়ের রাত বলে কথা! তখন কিছু করতে পারেনি কারণ বিয়ে হওয়াটার অপেক্ষায় ছিল। এখন জোর করে সব করবে। তার আগে খাওয়াবে। কুয়াশা বেড়িয়ে এলো। ইয়াসমিন খাবার নিয়ে এলে বৃষ্টি খাইয়ে দিতে লাগল। আর বিভিন্ন গল্প করতে লাগল। যেন কুয়াশার মন ভালো হয়।
খাওয়ানো হয়ে গেলে। শাড়ি টাড়ি পড়িয়ে সিম্পল করে সাজাতে বসল৷ কুয়াশা উচ্চবাচ্য করল না। এদের যা ইচ্ছে করুক। কিছু বললেও শুনবে না। এরই মাঝে জাকিয়া এলেন। হাতে কিসব যেন নিয়ে।
কুয়াশার পরনে কালো পেড়ে লাল জমিনের সিল্ক-জামদানী শাড়ি৷ শাড়িটা অসম্ভব সুন্দর। আর কুয়াশাকে অসম্ভব সুন্দরীও লাগছে শাড়িটাতে৷ উজ্জ্বল হলুদ ফর্সা শরীরে দারুণ মানিয়েছে সাথে কালো ব্লাউজ।
জাকিয়া দেখে হাসলেন। বললেন,
” ইশশ কী সুন্দর লাগছে আমার বউমাকে”
ব্যস আবার নড়ে উঠল ভেতরের সব৷ আজ বোধহয় মেয়েটার হার্ট অ্যা’টাকই করিয়ে দেবে এরা! এসব নতুন নতুন সম্পর্কে ডেকে ডেকে। কুয়শা বলল,
” বড় আম্মু তোমাদের মেয়ে আমি কোনো বউমা টউমা না। অসহ্য ডাক বন্ধ করো তো”
জাকিয়া শব্দ করে হেসে ফেললেন। বাকিরা মুচকি হাসল৷ বললেন,
” তুই ডাকতে না করলেই বোধহয় সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে? তুই শুনতে চাস আর না চাস আমার ছেলেরই বউ তুই আজ থেকে৷ পারলে বড় আম্মু রেখে আম্মু ডাক মেয়ে ”
” পারব না “
” আচ্ছা পারতে হবে না। তোর যা ইচ্ছে ডাক। আল্লাহ সময় দিলে নিজেই একদিন ডাকবি নিজের ইচ্ছেতে। কিছু চাপিয়ে দেব না তোকে। ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। জাকিয়াও আর এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। তিনি হাতে একটা গহনার বাক্স নিয়ে কুয়াশাকে কাছে ডেকে বসালেন। একে একে বিভিন্ন গহনা বের করলেন, সোনার। যা দেখে কুয়াশার চোখ কপালে। জাকিয়া কুয়াশার হাতে একজোড়া মোটা বালা পড়াতে পড়াতে বললেন,
” এসব সব আমি আমার ছেলেদের বউয়ের জন্য গড়িয়ে রেখেছিলাম। বৃষ্টিকে ওর বিয়ের সময় দিয়েছিলাম। আর শিশিরের বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। এগুলো আমার দেনমোহরের টাকা সহ তোর বড় চাচুও দিয়েছিলেন। সেগুলো দিয়ে বানিয়েছিলাম। আর কিছু আমার বিয়েরগুলো ছিলো সেগুলো আবার নতুন করেছিলাম৷ আমার শাশুরী বড় বউ হিসেবে অনেক গহনায় দিয়েছিলেন। সেগুলো আমার দুই ছেলেবউকে ভাগ করে দিয়েছি। এগুলো আমি এখন কি বা করব? কবে মরে টরে যাব। তাই তোদের বুঝিয়ে দিলাম সব। যত্ন করিস। এখানে আমার শাশুড়ীর দেয়া গহনাও আছে৷ এছাড়া বাবার বাড়ি থেকেও পেয়েছিলাম টুকিটাকি গহনা। আর এখন শুধু সিম্পল কিছু রেখেছি আমি। সেগুলো যতদিন বাঁচি পড়তে পারব। “
বলে একে একে গলায় বেশ মোটা হার, বড় দুল, একটা চেইন, দুটো বড় আঙটি, একটা টায়রা, আর একজোড়া রূপার নূপুর পড়িয়ে দিলেন। টায়রা টা অবশ্য পড়ালেন না। বললেন পড়ে কখনো পড়তে। এমন সাজে টায়রা মানাবে না৷ অপেল আছে সেটা আর তো পড়াতে পারবে তাই রেখে দিলেন। কুয়াশা হতভম্ব হয়ে দেখে গেল আর শুনে গেল। এখানে ওর কি বলা উচিত? বুঝল না। বৃষ্টিও এবার বলল,
” আমি কাল তোমার ভাইয়ের সাথে গিয়ে হার দেখে আসব। আসলে সব কিছু এমন জলদি হয়ে গেল কিছুই গোছানো হয়নি। ”
কুয়াশার কেমন কেমন যেন লাগছে। এসবকিছুর সাথে, এমন সব ব্যবহারের সাথে, এমন সব কথার সাথে সে নতুন পরিচয় হচ্ছে। তাই মাথা সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর এমনই হয় নাকি!! ইয়াসমিন একটা চেইন পড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
” এটা বিয়েতে উপহার পেয়েছিলাম আমার মামা দিয়েছিলেন। তোকে দিলাম আমার তরফ থেকে। আমিও সময় করে তোর ভাইয়ের সাথে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আসব। আপাতত এটুকু গিফট রাখ”
বলে মুচকি হাসল। কুয়াশা হতবাক হচ্ছে বার বার। এত গহনা ও কি করবে!! আর সব থেকে বড় কথা গলাই ওর তিনটা চেনই তো হয়ে গেল! বলল,
” তোমরা এ কি পাগলামো করছ? আমাকে গহনার মাঝে ডুবিয়ে দিচ্ছ তো। গলাই তিনটা তো চেইন ই দিলে! আর বড় আম্মু এসব আমি রাখতে পারব না। তোমার কাছে রেখে দিও। আমি হারিয়ে ফেলব। “
জাকিয়া হেসে বললেন,
” আচ্ছা। তোর যখন লাগে চেয়ে নিয়ে পড়বি। “
কথার মাঝে আম্বিয়া, আজমিরা এলেন। আম্বিয়া কুয়াশাকে একজোড়া চিকন বালা পড়িয়ে দিলেন। বললেন,
” সময় করে আরো উপহার দেব। আপাতত এটা আজকের জন্য। ”
কুয়াশা আর কথায় বলল না। এদের সাথে আর কথায় বলবে না সে। শশী হেসে পাসে বসে বলল,
” আমি কবে আসব এই বাড়ি? আমার এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। তোমরা কত ভালো। কী সুন্দর মিলেমিশে থাকো! আমার এখনি সব আদরের লোভ হচ্ছে। “
শশীর কথা শুনে কুয়াশা সহ সকলে জোরে হেসে দিল৷ আম্বিয়া বললেন,
” বাচ্চা মেয়ে, সময় হলে তুমিও সব পাবে। আগে আমার ছেলের বউ তো হয়ে এসো। সেটার জন্যও অপেক্ষা করতে হবে। “
বলে মাথায় হাত রেখে আদর করলেন। শশী জড়িয়ে ধরল আম্বিয়ার কোমড়। সকলে মুচকি হাসল ওর বাচ্চামিতে।
এতক্ষণ আজমিরা দু’চোখ ভরে মেয়েকে দেখছিলেন শুধু। মেয়ের সুখ দেখছিলেন। মেয়ে তার ভীষণ সুখী হবে মানিয়ে নিতে পারলে। আর সেই সুখ আল্লাহ উনাকে নিজের চোখে দেখার সুযোগ করে দিলেন। আজমিরা মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কুয়াশা তাকাল। মাকে দেখে চোখটা ভরে এলো। আজমিরা চোখের পানি ঝরঝর করে এবার ছেড়ে দিলেন৷ আর আটকে রাখলেন না। শব্দহীন ভাবে চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে৷ দুই জা কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলেন৷ আজমিরা মেয়ের সারা মুখে চুমু আঁকলেন। তারপর কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন,
” সুখী হ আমার মা ”
কুয়াশা নিরবে চোখের পানি ফেলছে। সকলের চোখে টলমল পানি৷ এটা মায়েদের কঠিন সময়। যদিও মেয়েকে পড়ের ঘরে দিতে হয়নি। তবুও কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে স্বামী থাকলে আজ সেও মেয়ে, মেয়েজামাই অনেককিছু দিতে পারত৷ কিন্তু এখন পারছেন না। এবাড়ি থেকে স্বামী তাদের জন্য কিছুই করে যান নি। কি করেই বা করবেন যখন একটু সুখপাখি ধরা দিয়েছিল তখন সেখানে কালো ছায়া চলে এসেছিল। আর স্বামীর নামে যেসব আছে তা ছেলে মেয়েদের করেছে। তিনি নিজে হাতে কিছুই করতে পারেন নি এ সংসারের বাহিরে গিয়ে।
মেয়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে আজমিরা কিছু গহনা কুয়াশার হাতে তুলে দিলেন৷ সেগুলো খুব বেশি আহামরি কিছু না। তার মায়ের বাড়ির এখানে কিছুই নেই। যা সব শ্বশুর শাশুড়ীই দিয়েছিলেন। আর তার স্বামী বিয়ের পর চাকরি পেলে চার বছরের মাথায় একটা চিকন চুড়ি, আর ছোট একটা দুল গড়িয়ে দিয়েছিলেন টাকা জমিয়ে। কারণ জাহিন মালিথা খুবই অল্পপরিমাণ রোজগার করতেন। শাশুড়ী তাকে একটা সিম্পল সিতাহার দিয়েছিলেন। একজোড়া চিকন বালা, আর দুল, এর বেশি কিছু পাননি। সেগুলে সব মেয়েকে দিয়ে দিল। কুয়াশার বাবার দেয়া দুইটা গহনা দিয়ে বললেন,
” এ দু’টো তোর বাবা বানিয়ে দিয়েছিলেন”
এরপর থেমে বললেন,
” আমি এ সংসারের বাহিরে গিয়ে কিছুই করতে পারি নি। তাই মেয়ে জামাইকে কিছু দেবার স্বাধ্যিও আমার নেই। এগুলো শাশুড়ী দিয়েছিলেন তোকে দিলাম৷ শিশিরকে শুধু দোয়া ছাড়া কিছুই দিতে পারব না। ”
এই কথা শুনে কুয়াশার বুক ফেঁটে কান্না এলো। মা কখনো বাবার কথা তাদের কাছে বলে না। নিজেই নিরবে চোখের পানি ফেলে। আর আজ এই গহনা বাবা দিয়েছিল শুনে হাউমাউ করে কেঁদে দিল মেয়েটা। বাবা থাকলে আজকে কি করত? জানা নেই তার। সকলে সান্ত্বনা দিয়ে থামালেন।
জাকিয়া জা’কে বোঝালেন। এসব বলতে মানাও করলেন।
________
রাত নয়টা পাড় হয়ে গেছে। শিশিররা সব ভাইরা বাহিরে চলে গেছিল। মাত্র ফিরে খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকাল। এরপর সোফায় গিয়ে বসল। তখন শিশিরকে ডেকে পাঠালেন জাকির মালিথা। সাথে জাকিয়াও গেলেন।
শিশির আসতেই জাকির মালিথা একটা চেক হাতে ধরিয়ে দিলেন। দেখল দু’ লক্ষ্য টাকার একটা চেক৷ শিশির অবাক হয়ে তাকালে তিনি বললেন,
” চিন্তা করো না এটা তোমারই টাকা৷ তোমার টাকা তোমার বউকে দেবে৷ এটা দেনমোহরের টাকা। দু’লক্ষ্য টাকাই দিতে বলেছিলাম। কারণ তোমার একাউন্টে তোমার পড়াশুনোর মাঝে অল্প পরিমাণই জমিয়েছি। তার মধ্যে থেকে এই টাকাটুকু দেনমোহর ধার্য করিয়েছি। তুষার দিতে চেয়েছিল আমি নিই নি৷ এটা একান্তুই তোমার দায়িত্ব। যদিও আমি দিলে কিছু হতো না কিন্তু আমি চাই নিজের টাকা থেকে দেনমোহর দিয়ে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করা শুরু করো ”
এখানে কি বলবে? বুঝছে না শিশির। তার বাবা যে এতটা দায়িত্ববান, বুঝবান সে একের পর এক অবাক হচ্ছে শুধু। তার বাবা যেমন দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন সে পারবে তো দায়িত্ব নিতে বাবার মতো করে!! শিশির বাবার বুকে মাথা রাখল। তিনি ছেলের মাথা হাত রাখলেন। এবার জাকিয়া এসে ছেলের কাছে দাঁড়িয়ে একটা সোনার আঙটি তুলে দিলেন। বললেন,
” এটা সহ দেনমোহরের চেকটা কুয়াশাকে দিবি। বিয়ের রাতে স্বামীর কিছু দেয়া কর্তব্য। এগুলো দিতে হয়। নিয়ম বলতে পারিস। আর দু’জনে একসাথে নফল নামাজ আদায় করবি। এটা আমার আদেশ। ”
প্রথম কথাগুলো শুনে শিশিরের মনে হলো এর থেকে কঠিন কাজ আর দ্বিতীয়টা নেই। আওরাল,
” ইয়া আল্লাহ! এ দিন আসতে হলো তার জীবনে! নিজে হাতে ঐ গোবর ঠাঁসাকে কিছু দিতে হবে? এ কী দিন এলো তার জীবনে!”
শিশির মুখে কিছুই বলল না। আদেশ, উপদেশই তার এখন মানতে হবে। নিয়ম যখন পালন করতেই হবে। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল সে।
_________
সব ঠিকঠাক করতে করতে রাত দশটা পাড় হলো। বৃষ্টি, স্মৃতিরা জোড় করে কুয়শাকে শিশিরের ঘরে দিয়ে গেছে। যদিও বৃষ্টি শাশুড়ীকে বলেছিল,
“ওরা না আবার খু-না খু-নি করে আম্মু” শুনে সকলে একদফা হেসেছিল। সে এখানে আসতে নারাজ। তার এক কথা সে তার নিজের ঘরেই থাকবে৷ কিন্তু আজমিরা ধমকে পাঠিয়েছেন৷ মেজাজটা সেই জন্য চড়ে গেছে। বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? ঐ বুনো ওলের সাথে ওর ঘরে গিয়ে থাকতে হবে! ঝগড়া ছাড়া তো কিছুই হবে না! এটা ভেবেই তার মেজাজ গরম। সে ঘরে এসে শিশিরের বিছানায় ধারাম দিয়ে বসে ঢাঁস করে শুয়ে পড়েছে৷ কেমন যেন একটা গন্ধ এই বিছানায়। কিন্তু বেশি পাত্তা দিল না। সে রাগকেই বেশি পাত্তা দিল৷
‘
রাত এগারটা’র কাঁটা ছুঁই ছুঁই। শিশিরকে নীহার, রিজভী ঠেলেঠুলে ঘরে দিয়ে পাঠিয়েছে। সে আজ ছাদে রাত কাটাবার প্লান করেছিল। গল্পের মাঝে থেকে ঠেলেঠুলে তুলে দিয়েছে।
বিরক্ত এবং রাগ দু’টো নিয়েই সে ঘরে প্রবেশ করল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে মেয়েলি একটা গন্ধ পেল। বিছানায় চোখ দিয়ে দেখল কুয়াশা এলোমেলো ভাবে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। তা দেখে পুরো শরীর ঝনঝন করে উঠল। শাড়ির আচল কিঞ্চিৎ বুক থেকে সরে গেছে৷ পা’য়ের থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে। সে এমন এলোমেলো শোয় বলে কাঁথা নিয়ে ঘুমোই নিজের ঘরে। শিশির চোখ ফিরিয়ে নিল। নিয়ে শব্দ করে দরজা দিল যাতে কুয়াশা উঠে যায়। তাই-ই হলো। কুয়াশা শব্দ পেয়ে উঠে গেল৷ বিরক্ত নিয়ে তাকাল। অসহ্য আজ থেকে ঠিক মতো ঘুমোতেও পারবে না। বলল,
” এ্যাই বুনো ওল, দিলি তো কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে? ”
মেজাজটা আরো চড়ে গেল,
” ঠাটিয়ে থা-প্পড় দেব একটা। কথা ঠিক কর ”
” করব না কি করবি? মেজাজ গরম করাস না বলে দিলাম। ”
” আচ্ছা?? আমি তোর মেজাজ গরম করাচ্ছি? ”
বলে এগিয়ে গেল কুয়াশার দিকে। কুয়াশার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল৷ এ এখন পুরো লাইসেন্স পেয়ে গেছে৷ এখন কথায় কথায় অধিকার খাটাতে আসবে। শিশির কুয়াশার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ এক হাঁটু তুলে দিল বিছানার উপর। অন্য পা ফ্লোরে। এরপর কুয়াশার বাহু ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিল। এবার একটু ঝুঁকল। কুয়াশা কেন জানি আজ শিশিরকে ভয় পাচ্ছে৷ বুক হাফরের মতো ওঠা নামা করা শুরু করল। হতবাক হয়ে শুধু চেয়ে রইল। বুলি বন্ধ হয়ে গেছে। শিশির কুয়াশার চোখের অতল গভীরে নজর দিল৷ এরপর বাম হাত তুলে কুয়াশার ঘাড় গলিয়ে পেছনের চুলের মধ্যে দিয়ে টেনে ধরল। টেনে উপর করে নিল কুয়াশার মুখ। এবার কুয়াশা চোখ মুখ কুঁচকে ‘আহ’ করে উঠল। কুয়াশার পুরো মুখ শিশিরের মুখোমুখি শূন্যে তোলা৷ দু’জনের নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে। কুয়াশা আজ পাল্টা আ’ক্র’মন করতে পারছে না৷ পারছে না নাকি চাইছে না? বোঝা গেল না। শিশির কুয়াশার কুঁচকানো মুখের উপর দৃষ্টি দিয়ে বলল,
” এই ঘর আমার, এখানে যা কিছু আছে সব আমার। আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি এবং পারব। কি করবি? আমাকে মেজাজ দেখাস তুই? অবুঝ না নিশ্চয়ই তুই? ”
কুয়াশার বুঝতে একটুও দেরি হলো না কথাগুলো। শিশির যে কী বোঝাল বুঝে গেছে। এই কারণেই আরো সে এই বুনো ওলকে বিয়ে করতে চাইনি। এখন সব রকম স্পর্ধা দেখাবে। কথার উত্তর করল না কুয়াশা। ব্যথা পাচ্ছে চুল ধরে রাখার জন্য। সে শিশিরের গভীর, দৃঢ় দৃষ্টিতে নজর দিল৷ টলমল চোখ তার। শিশিরে চোখে পড়ল। চুল টেনে ধরে রেখেছে তাই ছেড়ে দিল। সরে এলো। বসল গিয়ে ডিভানে। রাগটাকে সংবরণ করার জন্য দীর্ঘ শ্বাস নিল কয়েকবার মাথা নিচু করে।
কুয়াশাও নিজেকে সামলে নিল। মা বার বার বলেছে কোনো প্রকার ঝগড়া মা-রা মা-রি না করতে অন্তত আজকের রাতটা। কিন্তু তবুও রাগ আটকাতে পারছে না৷ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল।
এরপর দু’জনই মনে পড়ার মতো করে একসাথে বলে উঠল,
” আম্মু নফল নামাজ আদায় করতে বলেছে দু’জনকে “
অদ্ভুত ভাবে একসাথে বলে ফেলল কথা৷ যেটাকে বলে জোড়া কথা৷ বিরক্ত হলো দু’জনই। শিশির বলল,
” আম্মু..! কোন আম্মু ”
” তুমি কোন আম্মুর কথা বলছ?”
” আমি আমার আম্মুর কথা বলছি ”
” আমিও আমার আম্মুর কথা বলছি ”
দু’জনই জ্বালায় পড়েছে। কী এক্টা জ্বালা! সম্পর্কের সব বদলে যাচ্ছে। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এদের এই অবস্থা দেখলে যে কারো একটা গান মনে পড়বে,
” সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে… ”
যায়হোক এদের এমন সিরিয়াস মোমেন্টে গান টান না মনে পড়াই ভালো। তখন আবার বিপদ হবে৷
বিরক্ত নিয়ে শিশির বলল,
” যা ফ্রেশ হয়ে অজু করে আয়৷ ”
কুয়াশার কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না৷ তাই চলে গেল। শিশির নূপুরের শব্দ পেয়ে ওর যাবার পানে চেয়ে রইল। মেয়েটাকে লাল শাড়িতে অসাধারণ মানিয়েছে৷ শরীরে বিভিন্ন গহনা সোনার। ঝিকমিক করছে গায়ের সাথে। সেজেছেও বেশ। আজ তাদের বিয়ে হয়েছে সেই জন্য কি সেজেছে? বউ সে তার। এই ঝগড়ুটে, জেদি মেয়েটা তার বউ!! ভেবে কেমন একটা অনুভূতি হলো। শিউরে উঠল শরীর। এসব কিছুই স্বাভাবিক না। বহুত সময় চাই।
কুয়াশা আসলে, সে-ও অজু করে এসে নামাজ পড়ে নিল। শিশিরের পিছে দাঁড়িয়ে কুয়াশা পড়ল। মা বলে দিয়েছেন এমনটা। স্বামীর সাথে এবং পেছনে নামাজ আদায় করা সুন্নত।
নামাজ শেষ হলে কুয়াশা, হার, দুল আর জাকিয়ার দেয়া মোটা বালা জোড়া খুলে ফেলল। গলাই একটা চেইন হাতে চিকন বালা রাখল। খুলে আপাতত সেগুলো আলমারীতে রেখে এলো। তা দেখে শিশির মনে পড়ার মতো করে আলমারীর কাছে গিয়ে কিছু একটা বের করল। সেটা কুয়াশা দেখল। এনে কাছে এগিয়ে এসে বলল,
” ধর এগুলো ”
দেয়ার ভাবটা এমন যেটা দেখলে যে কারোরি মেজাজ গরম হবে। কুয়াশারও হলো। সে রাগ নিয়ে বলল,
” কি এসব? ”
” চোখে দেখিস না? ”
” দেখছি কি আছে এগুলোতে? ”
শিশির বিরক্ত নিয়ে বলল,
” এটা চেক, আর এটাতে আঙটি আছে। ”
ভ্রু কুঁচকাল কুয়াশা৷ সে এবার আমতাআমতা করে বলল,
” চেকটা দেনমোহর, আর আঙটিটা গিফট। আম্মু বলল আজ বউদের কিছু দিতে হয়। এটা নিয়ম। ”
কুয়াশা ভ্রু সোজা হয়ে গেল। শিরশির করে উঠল শরীর। বলল,
” লাগবে না আমার এসব। তুমি রেখে দাও”
মাথা নিচু করে বলল সে। লজ্জা পেল কি? শিশির আদেশের সুরে বলল,
” বেশি না বুঝে ধর এগুলো ”
কুয়াশা তাকাল সরল চোখে। তা দেখে শিশির কুয়াশার ডান হাত তুলে চেকটা হাতে দিল। আর আঙটিটা বের করে পড়িয়ে দিল নিজে হাতে। কেঁপে উঠল কুয়াশা। শিশির পড়িয়ে সরে এলো। হাতে থাকা চেকে নজর দিয়ে দেখল দুই লক্ষ্য টাকার চেক। চোখ কপালে উঠে গেল। এতটাকা সে কী করবে!!
” এতটাকা আমি কি করব? ”
” তুই জানিস, তুই কী করবি!”
” হুর.. এত টাকা আমি নিতে পারব না। রাখো তোমার কাছে। ”
” এক থা-প্পড় দাঁত ফে’লে দেব। স্বাধে কী বলি গোবর ঠাঁসা! “
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল ধমক খেয়ে। শিশির এবার শোবার জন্য প্রস্তত হলো। তাকাল কুয়াশার দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝাঝাল কন্ঠে হঠাৎ বলল,
” দেখ গোবর ঠাঁসা, তুই যদি ভাবিস আমি ট্রিপিকাল ড্রামা সিরিয়ালের স্বামীদের মতো করে বলব যে, তুমি খাটে ঘুমিয়ে পড়ো আমি ডিভানে শুয়ে পড়ব, আই উইল ম্যানেজ। তো সেটা ভুল ভাববি। আমি এমন কিছুই বলব না। তোর ইচ্ছে হলে এখানে থাক নয়তো বিদেয় হ। আমি আমার বিছানা ছাড়া ঘুমতে পারব না। ”
চেঁতে উঠল কুয়াশা,
” এ্যাই বুনো ওল..! তোর কী মনে হয়? আমি নিজেও বাংলা সিনেমার ঐ সস্তা ডায়লগ ঝারব? লাইক যাত্রাপালা,
‘চৌধুরী সাহেব…! আপনি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ুন আমি নিচে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ব, টাইপ? টিভি সিরিয়ালের অবলা নারীর মতো বউ হবার কোনো শখ জাগেনি আমার। তুই নিজে শুলে শো না শুলে নাই ”
বলে ধারাম দিয়ে ঢাঁস করে শুয়ে পড়ল। শিশিরকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগই দিল না। শিশির হতবাক হয়ে গেল। কই ভাবল,
” একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না”
টাইপ কিছু বলবে এই গোবর ঠাঁসাটা। কিন্তু এ তো তার ভাবনার উল্টো!! অবশ্য সে ভুলে কেন গেল এটা কুয়াশা গোবর ঠাঁসা! ভেবে আপন মনে হাসল। সে-ও শুয়ে পড়ল পাশে লাইট অফ করে। এক কাত হয়ে কুয়াশার পিঠের দিকে মুখ করে টিপ্পনী কেটে বলল,
” আমি তো আবার ভাবলাম তুই বলবি, দেখেন চৌধুরী সাহেব আমাকে টাচ করার চেষ্টা করবেন না। ”
” তোমার ভাবনার দোষ আছে৷ আমি সেসব অবলা নারী নয় যে যাত্রাপালা করব। আর তুমি মালিথা নট চৌধুরী ”
শিশিরের দিকে ঘুরে কথাটা বলে আবার ঘুরে শুয়ে পড়ল। লাইট অফ করে দিয়েছে? চোখ বন্ধ থাকায় বুঝতে পারেনি এতক্ষণ। শরীর শিউরে উঠল এখন বুঝতে পেরে।
এদিকে শিশিরের কেমন কেমন জানি ফিল হচ্ছে। একটা মেয়ে পাশে থাকলে ফিল অন্যরমক আসেই আর এ তো এখন বউ। এই ‘বউ’ শব্দটায় যত নষ্টের গোড়া৷ এই শব্দটার জন্য ফিলিংসও পাল্টে যাচ্ছে। তা না হলে এতদিন তো এমন হয়নি!! এই মেয়ে আজ তার পাশে শুয়েছে সম্পূর্ণ অধিকারের সাথে, ভাবা যায়!
কিছুক্ষণ শুয়ে থেকেও ঘুম ধরা দিল না। এপাশ ওপাশ করেও ধরা দিচ্ছে না কারো চোখে৷ মন অস্থির হয়ে উঠছে৷ যদি মনের মিল থাকত আজকের রাতটা অন্যরকম হতো দু’জনেরই। সেখানে দু’জনের কেউ মনের উপর জোর খাটাতে পারছে না৷ কী নিদারুণ, নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় ভুগছে দু’টি মানব মানবী! কেন এমন হলো তাদের সাথে! খুব কী ক্ষতি হতো বাড়ির লোক তাদের একটু সময় দিলে!!
শিশির আর না পেরে এক লাফে উঠে বসে পড়ল। ঘরের জিরো লাইট জ্বালিয়ে দিল। হালকা হলুদাভায় পূর্ণ হলো ঘর। শিশির উঠতেই কুয়াশা টের পেয়ে ঘুরে তাকাল। দেখল মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে শিশিরের মুখো ঘুরে শুলো। তাকিয়ে রইল। শিশির এবার চোখ খুলে কুয়াশার দিকে তাকাল। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধক করে উঠল বুকে। চোখ ফিরিয়ে নেমে হনহন করে বেলকনিতে চলে গেল।
শিশির যেতেই কুয়াশা উঠে বসে পড়ল। তারপর কী হলো কে জানে? গুমরে, ডুকরে কেঁদে উঠল। কিন্তু খুব বেশি শব্দ করে না। গুমরে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে দিল। সেই শব্দ শিশির কানে পৌঁছে গেল। অন্ধকারচ্ছন্ন, তারা ভরা আকাশে দৃষ্টি দিয়ে রেলিঙে দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। খুবই অসহ্য লাগছে এসব। কুয়াশার কান্নায় বুক ভারী হয়ে এলো। বাবার বলা কথা গুলো মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল মেয়েটা এখন তার বউ। আবার এই বউ শব্দ! এই শব্দটা আবার মাথায় কিলবিল করতে লাগল। রাগ উঠল এই শব্দটার উপর। রাগে, ক্ষোভে দিল একটা কি’ল বসিয়ে বেলকনির রেলিঙে৷ এই একটা শব্দই সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। দায়িত্ববোধ মাথায় জেঁকে বসছে। জোরে জোরে কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিল আর ফেলল। মেয়েটা এখনো কাঁদছে। না পেরে আবার ঘরে চলে এলো হনহন করে। এসে কুয়াশাকে তুলল। ওর মাথা তুলে মুখের দিকে তাকাল। কেঁদে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। কুয়াশা চোখের পানি নিয়ে অসহায় চোখে তাকাল। চোখের পানি দু’হাতে মুছিয়ে দিল শিশির। বলল,
” কাঁদিস না। আমার সময় লাগবে ”
কুয়াশা দু’হাতে শিশিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মাথা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমারও ”
শিশির ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল৷ বলল,
” চল ঘুমবো, কাল থেকে মনদিয়ে পড়াশুনো করবি। ”
” হু ”
আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শিশির ঘুরে ওর সাইডে এসে লাইট অফ করে দিল। শুয়ে পড়ল। শুয়ে কুয়াশাকে বলল,
“এদিকে আয়৷ ”
বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ে এগিয়ে গেল। শিশির কুয়াশাকে টেনে বুকে নিল৷ মাথাটা নিজের বুকের উপর নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ঘুমো। সব ঠিক করার চেষ্টা করব। আমি দায়িত্ব নিয়েছি তোর। এড়িয়ে যাব না ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। শিশিরের কথাটা ভাবল। সারাজীবন দায়িত্বই দেখিয়ে যাবে! ভালোবাসবে না? আর সে-ও কি বাসতে পারবে!! সব চেষ্টা করতে হবে।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click
রাতে আরেক পর্ব দেয়ার কথা থাকলেও দিই নি কারণ লিখে উঠে অনেক রাত হয়ে গেছিল। তাই এখন পোস্ট করলাম৷ অনেক বড় পর্ব দিলাম সেজন্য।
কেউ অধৈর্য হইও না৷ আমার ভাবনা অনুযায়ী লিখতে দাও। ইনশাআল্লাহ সব পাবে।