®রোজা রহমান
‘
শিশিরের প্রচুর ব্যস্ততা বেড়েছে৷ জানুয়ারিতে এলএলবি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সামনে কয়েকমাস পরেই নির্বাচনী পরীক্ষা। সেই সাথে বিসিএসের জন্যও প্রস্ততি নিচ্ছে। দুই পড়া এক সাথে পড়তে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রেগুলার ক্যাম্পাসে যেতে হচ্ছে। রিজভী আর ওর এক দশা হয়েছে। দুজনে ক্যারিয়ারের পেছনে উঠেপড়ে লেগেছে। এছাড়া শিশিরের ভাবনায় ওর তাড়া বেশি। বউয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে চলে এসেছে জলদি। কতকালই বা বাবার টাকায় বউ খাওয়াবে? নিজের দায়িত্ব নিজের বুঝে নিতে হবে। এই জন্য ক্যারিয়ারের চিন্তা একটু চেঞ্জ করেছে। আর সেটা এলএলবি এর পড়েই বিসিএস দেবে। আগে ভাবনা ছিল এলএলএম এর করেই দেবে। কিন্তু সেটা এখন বিসিএসের পর কমপ্লিট করার চিন্তাভাবনা করেছে। এরপর সব ঠিকঠাক হলে আল্লাহর রহমতে সাফল্য পেলে বিজেএসও দেবে৷ এইসব চিন্তা করেই নাকে মুখে খাটতেছে ছেলেটা। উদ্দেশ্য তার কিছু করতে হবে।
পড়াশুনোর চাপে বাড়িতে সহ পরিবারের সাথেও খুব একটা সময় কাটাতে পারছে না। শুক্রবার ছাড়া তেমন সময় হচ্ছে না। এই সপ্তাহ জুড়ে এমনই চলছে। রোজ সকালে উঠে কুয়াশাকে একটু জ্বালাবে। দু’জনের কিছু না কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়াতে যাবে এরপর একটু হাতাহাতিও হবে। সব শেষে শান্ত হয়ে নিচে গিয়ে খাবার খেয়ে দু’জন দু’জনের গন্তব্যে রওনা হবে। দুপুরে কুয়াশার ক্লাস শেষে বাড়িতে রেখে আবার সে চলে যাবে। যাওয়া আসা শিশিরের বাইকেই হয়।
কুয়াশাও নিজের পড়াশুনোই ফোকাস করছে। সাথে এখন পরীক্ষা টরীক্ষার চাপ নেই বলে বিকেলে ভাবিদের সাথে ভালোই সময় কাটায়। সে এখন পড়াশুনোর ফাঁকে কাজ করার চেষ্টা করে। আগে কখনো কিছু করতে হয়নি। এক পড়াশুনো ছাড়া বাড়ির কোনো কাজই করত না। সব মা সহ চাচিরা করত। এখন সময়ে অসময়ে ভাবিদের সাথে কাজে সাহায্য করে। এছাড়া তিন জা মিলে বিকেলে প্রায়ই রঙ বেরঙের খাবার তৈরি করে। ইউটিউব দেখে সব এক্সপেরিমেন্ট করে। কোনো দিন খাবার যোগ্য হয় তো কোনোদিন হয় না।
অর্ধেক রাত পাড় করে পড়াশুনো করে। ঘুমোতে এসে আগে হয় দু’জন একটু গল্প করবে নয়তো কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যাবে। কথার টপিক থাকে আগের কিছু কথা৷
‘
চলে গেছে এভাবে কয়েকটা দিন৷ আজ বৃহস্পতিবার। দুপুর তিনটা। অতিরিক্ত গরম, রোদ প্রকৃতিতে। শিশির আজ একটু জলদি এসেছে বাড়িতে। কুয়াশা নিজের ঘরে ছিল। শিশির এসে জাকিয়া বেগমকে ডাকতে লাগল৷ কুয়াশা তা শুনে বেড়িয়ে এলো। এসে দেখল মা’কে ডেকে রেখে সে ঘরে দিকে আসছে। সামনাসামনি পড়ল দু’জন। শিশির কোনো কথা বলল না৷ নিজের ঘরে চলে গেল। কুয়াশা পেছন পেছন ঢুকল। ঢুকে দেখল শিশির ঘেমে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া শার্ট খুলছে। বুকের উপরের বোতাম গুলো খুলেছে। ঘামের বুক ভিজে লোমগুলো লেপ্টে আছে৷ মুখেও বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ দেখল তা কুয়াশা। শিশির শার্ট খুলতে খুলতে কুয়াশাকে পর্যবেক্ষণ করল। বউ যে তাকেই দেখছে। বোতাম খোলা হয়ে গেলে কুয়াশার দিকে তাকিয়েই শার্ট খুলে ফেলল। চোখের নজর অতি দৃঢ় আর ঠোঁটে কেমন দুষ্টু ভাব৷ কুয়াশা এসব দেখে ভড়কে গেল। এরপর রাগ নিয়ে বলল,
” এসেই ওমন ভ্যাঁবাচ্ছ কেন ম্যাঁ ম্যাঁ করে?”
“তো বউ বউ করে ভ্যাঁবাব? “
কথার পিঠে উচিত কথায় আবার ভড়কে গেল কুয়াশা৷ শিশির কথাটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল। হাসি রেখেই আবার বলল,
” আমার বউ তো আমার ঘরে নেই। সে তার বাপের বাড়ির ঘরে বসে চিল করছে৷ তাই মা মা করছি “
কুয়াশা শুনে খিলখিল করে হেসে দিল। শিশিরও হাসল নিঃশব্দে। কুয়াশা এবার রাগ ফেলে দিয়ে কন্ঠে ঝাঁঝ রেখে বলল,
” তা ম্যাঁ ম্যাঁ করার কারণ কি? বউ এখন বাপের ঘর ছেড়ে শ্বশুরের ঘরে এসেছে। বলতে পারো ”
” আচ্ছা? ”
” তো কি? “
শিশির এবার খুলে রাখা ঘামের শার্টটা ছুঁড়ে কুয়াশার মুখের উপর মা-রল। কুয়াশা তড়িঘড়ি করে ঘামের শার্টটা মুখ থেকে সরিয়ে ঘৃণায় মুখ কাচুমুচু করে রেগে উঠল৷ বলল,।
” এ্যাই…! এসব কি? ছিঃহ্..”
” যাহ্ এখন শ্বশুরবাড়ি এসেছি যখন স্বামীর সেবা যত্ন কর। এই শার্ট কেঁচে আন। আরো দুইটা নোংরা আছে ওগুলো নিয়ে যাবি ”
কুয়াশা রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইল৷ কততবড় বেয়াদব চিন্তা করা যায়? সে এবার কাছে এগিয়ে গেল। শার্ট দিয়ে শিশিরের বাহুতে বাড়ি মে-রে বলল,
” তো এটা ভালোভাবে বলা যেত না? অসভ্য বুনো ওল…”
বলে বকতে বকতে চলেই যাচ্ছিল শার্টটা নিয়ে। কিন্তু শিশির ওর কোমড় অবধি ভেজা ছেড়ে রাখা খোলা চুল পেছন থেকে টেনে ধরল। ‘আহ্’ করে উঠল ব্যথায়। হাত দিয়ে চুলের গোড়া চেপে ধরে বলল,
” ছাড়, বুনো ওলের বাচ্চা লাগছে আমার, মাগো..ইশশ.. ”
বলতে বলতে ইশশ, আহ্, মাগো এমন সব শব্দ করছে। পেছন থেকে সামনে ঘুরে তাকাল। শিশির বলল,
” আজকাল তোর নজর দেখছি ছুঁকছুঁকানো হয়েছে৷ যখন তখন আমাকে দেখে ছুঁকছুঁক করিস বিড়ালের মতো। ব্যপার কী বলত? আমি মাছ লাগি তোর কাছে? ”
কুয়াশা এবার পুরো ঘুরে তাকাল। কঠিনতা বজায় রেঝে দাম্ভিকতার সাথে ঝাঁঝ নিয়ে উত্তর করল,
” আমার কাছে মাছ তুই কোনোদিনই ছিলি নি৷ তুই একটা বুনো ওল আজীবন তাই-ই থাকবি৷ আর ছুঁকছুঁক কখন করলাম আমি? বিড়াল যদি আমি হয়েও থাকি তবে সেটা আমার মালিকের কাছে। মাছের নেশায় না, পোষ মানার নেশায় আসি। মালিকের যাতে সুবিধা হয়। ”
শিশির কুয়াশার কথাগুলো শুনে এবার শব্দ করে হেসে উঠল। এই গোবর ঠাঁসার সাথে ঝগড়া করে সে কোনোদিনই কথায় পারে না৷ আজও মোক্ষম জবাব দিয়ে দিল। কুয়াশা কথাটা বলতে পেরে নিঃশব্দে হাসল। শিশির এখনো চুল ধরে। এবার সে হাসতে হাসতে চুলে টান দিয়ে কুয়াশাকে খোলা বুকে এনে ফেলল। কুয়াশা চেঁচিয়ে উঠল,
” ইয়াক ছিঃহ্, এ্যাই সরো, ছাড়ো তোমার শরীরে ঘাম, দূর্গন্ধ… ছাড়ো। আমি গোসল করেছি। “
কে শোনে কার কথা? শিশির কুয়াশার ইয়াক ছিঃহ্ করা দেখে আরো শক্ত করে ধরল। কোমড় স্লাইড করে বামে থেকে ডানে নিয়ে রাখল হাত৷ স্লাইড করাটা কেমন যেন গভীর মনে হলো। এবার আপনাআপনি কুয়াশা জমে গিয়ে থেমে গেল। শিশির তা দেখে দুষ্টু হাসল৷ কাজে দিয়েছে ডোজ। বলল,
” তোকে চুপ করাতে আমার মিনিটের ব্যপার ঝগড়ুটে গোবর ঠাঁসা ”
কুয়াশা কিছু বলতে যাবে ওর ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে বলল,
” হুশশ, এই দূর্গন্ধ শরীরের ক্ষমতা কতখানি তোকে দেখিয়ে দেব। সময় আসতে দে অপেক্ষা কর শুধু। হারে হারে টের না পাওয়ালে আমিও ক্ষান্ত হব না৷ তোর মতো চুনোপুঁটি গোবর ঠাঁসাকে এই দূর্গন্ধময় শরীর নেশা যদি না চড়িয়েছি তবে আমার নামও শিশির মালিথা না। নিজেকে সামলাতে শিখে নে। আজকের এই কথার জবাব না দিয়ে ক্ষান্ত আমি হবো না “
কুয়াশা সেখানেই জমে বরফ হয়ে গেল। পুরো কায়া, অন্তর ভেতর থেকে আর্তনাদ করে উঠল,
” কুয়াশা তুই শেষ “
ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। সে যে কাকে নেড়েছে হারে হারে এই মূহুর্তে টের পাচ্ছে। কথাতেই তো অর্ধেক জ্বালিয়ে দিল!! কুয়াশার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়েছে। আগে এমনটা কখনো হয়নি। কোনোদিন এমন কাঁপা-কাঁপি টের পায়নি। আর আজকাল শিশিরের যেকোনো স্পর্শেই কেঁপে ওঠে৷ কেমন আপন আপন লাগে। এই যে এখন শক্ত, পেশিবহুল, মেদহীন শরীরের সাথে বেঁধে রেখেছে হার্টবিট মনে হচ্ছে লাফাতে লাফাতে বাইরে চলে আসবে। সামনের এই ছেলেটা আজকাল তার কাছে আ-গুন মনে হয়। কখন না জ্বালিয়ে পু-ড়িয়ে খাঁক করে দেয়। সে ডুবেছে। অর্ধেকই ডুবে গেছে এই সামনে থাকা ছেলেটাতে। আচ্ছা কতখানি ডুবেছে সে? কোমড় পর্যন্ত? নাকি গলা পর্যন্ত? ভাবনার মাঝে শিশির বলল,
” দেখ তোর ভেতরের কাঁপন শুরু হয়ে গেছে৷ “
বলে দুষ্টু চোখে আবার হাসল। বলল,
” যাহ্ এখন স্বামীর কাপড় ধুয়ে আন। আপাতত স্বামীর খেদমত কর। পরে আদর টাদরের ব্যবস্থা করব। ”
বলে ঝটকা দিয়ে দূরে ঠেলল। কুয়াশা বড় একটা দম ফেলল৷ তা দেখে আবার মুচকি হাসল। কাছে গেলে তো এ এমনিই উনিয়ে যাবে!!এখনই যা হয়েছে৷ ভেবে সশব্দে হাসল ঠোঁট কামড়ে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। কুয়াশা শিশিরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে কর্ণার আলনা থেকে শার্টগুলো নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে ধাপধুপ করে পা ফেলে। সেদিকে তাকিয়ে শিশির দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে আজকাল বড্ড আপন আপন লাগে।
এরই মাঝে জাকিয়া এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” কিরে আব্বু ডাকছিলি কেন? “
শিশির ঘুরে হাসতে হাসতে বলল,
” ছেলেকে বউ দিয়েছ এখন আর কাজের জন্য তোমার প্রয়োজন পড়বে না৷ তোমার বৌমা করবে৷ কাপড় কাঁচতে দিয়েছি তোমাদের আহ্লাদীকে “
কথাটা এমনভাবে বলল যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে সে৷ বলে হাসল। জাকিয়া কাছে এসে বাহুতে আলত হাতে চা-প্পড় দিয়ে বললেন,
” তাই নাহ্ পাঁজিছেলে..! ”
” হ্যাঁ, আহ্লাদীকে তো আহ্লাদ করে কোনো কাজ করাও না৷ তাই কাঁচতে পাঠালাম৷ ঠিক করেছি না আম্মু? “
এবার জাকিয়া ছেলের কান ধরলেন। বললেন,
” হ্যাঁ, বিশ্ব জয় করে ফেলেছ। পাঁজিছেলে। “
” আরেহ্ আম্মু কোথায় ট্রিপিকাল শাশুড়ীদের মতো ছেলেকে আরেকটু অত্যাচার করতে শিখাবা তা না করে উল্টো আমাকেই মা-রছ? দেট’স নট ফেয়ার আম্মু “
জাকিয়া এবার জোরে হেসে দিলেন ছেলের কথা শুনে। ছেলেটা সত্যি এত পাঁজি৷ ছোট থেকে সকলেকে জ্বালিয়ে মা-রে। বললেন,
” আমি সেইসব ট্রিপিকাল শাশুড়ী না যে ছেলেবউকে অত্যাচার করব৷ আর ছেলেদের শেখাব৷ পাঁজি একটা। আমার বৌমাকে অত্যাচার করবি না খবরদার। নয়তো আমিও তোর বউয়ের সাথে মিলে একসাথে পি-টুনি দেব। “
বলে কান ছেড়ে দিলেন। শিশির হাসল। বলল,
” দু’জন প্ল্যান করো নাকি? “
” প্রয়োজনে সেটাও করব “
শিশির শুনে সশব্দে হাসল। মায়ের হাত ধরে নিয়ে বিছানায় সে বসে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
” আম্মু তুমি এত ভালো কেন? আমার বেস্ট আম্মু তুমি “
ছেলের কথায় তিনি মুচকি হাসলেন। চুলে হাত বুলোতে বুলোতে। কিছু বললেন না আর৷
__________
রাত বারটা বাজতে চলল। কুয়াশা পড়া শেষ করে শিশিরের ঘরে এলো। এসে দেখল শিশির মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে৷ মাথা ধরেছে বোধহয়। কিছুদিন খুবই চাপ পড়ছে ব্রেনে। এছাড়া আজ রোদ, গরম অতিরিক্ত পড়েছে। যার জন্য মাথাটা ধরেছে।
কুয়াশার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কন্ঠে একটু অশান্তি মনে হলো,
” কি হয়েছে তোমার? “
শিশির চোখ খুলে তাকাল। কুয়াশা তাকিয়ে আছে৷ দেখল চোখ অসম্ভব লাল৷ আঁতকে উঠল সে। বলল,
” এ কি অবস্থা তোমার? শরীর খারাপ? “
বলে কপালে হাত রাখল৷ দেখল জ্বর উঠেছে। বলল,
” গায়ে তো জ্বর তোমার! “
” হ্যাঁ, মাথা ধরেছে প্রচন্ড “
কন্ঠটাও কেমন নির্জিব মনে হলো। কুয়াশার একটু মায়া হলো। আগে শিশির অসুস্থ হলে তাকিয়েও দেখত না৷ বলল,
” কফি খাবে? “
” এত রাতে আম্মুকে ডাকার দরকার নেই। আমি ঔষধ খেয়ে নিচ্ছি “
” বসো আমি করে আনছি “
কথাটা শুনে তাকাল শিশির৷ বলে কি? এ কফি করবে? জীবনে গেছে চুলার কাছে? কখনো তো দেখেনি। বলল,
” তুই পারিস? “
” শিখেছি “
শিশির অনেক অবাক হলো৷ ইদানীং বাড়িতে দিনে বেশি থাকা হয়না বলে কিছু দেখা হয়না। শিশিরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” বসো, আসছি আমি ”
বলে চলে গেল। শিশির আবার আগের ন্যায় চোখ বন্ধ করল।
‘
কুয়াশা রান্নাঘরে টুংটাং করছে। সেসময়ে আজমিরা নিচে এলেন। মূলত পানি নিতে এসেছেন। কুয়াশাকে এই সময়ে রান্নাঘরে দেখে বললেন,
” কি করছিস এত রাতে? “
কুয়াশা বিব্রত হলো। এত রাতে কেউ আসবে ভাবেনি। এখন কী বলবে ভাবছে। কী বলেই বা মায়ের সামনে শিশিরকে সম্মোধন করবে বুঝছে না৷ নাম ধরে সে কোনো কালেই ডাকে না। বুনো ওল বলে সেটা এখন অযথা বললে বকা খাবে৷ এদিকে ছেলে বলবে নাকি মেয়েজামাই বলবে ভাবনাই পড়ল। আজমিরাকে চেয়ে থাকতে দেখে আমতাআমতা করে বলল,
” তোমাদের ছেলের মাথা ধরেছে। জ্বরও এসেছে হালকা৷ তাই কফি বানাতে এসেছি”
আজমিরা একটু না অনেকটায় অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন৷ এ মেয়ে শিশিরের জন্য কফি বানাতে এসেছে? এটাকে আনন্দ ধরে নিবেন নাকি বিস্মিত হবেন বুঝছেন না৷ কুয়াশা কথাটা বলেও লজ্জায় পড়ে গেছে৷ হাজার মা হলেও কেন যেন লজ্জা লাগছে৷ বিস্মিত কাটিয়ে আজমিরা এগিয়ে গেলেন। চিনির কৌটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” আমাদের ছেলে থেকে কি আমার জামাইবাবা হয়েছে সে? “
মায়ের এমন কথায় সে আরো লজ্জা পেয়ে গেল। আজমিরা মুচকি মুচকি হাসছেন। কুয়াশা লজ্জায় মাথা নুয়ে আছে৷ এবার না পেরে মা’কে জরিয়ে ধরল। বলল,
” চেষ্টা করছি আম্মু। একবারে কিছু তো সম্ভব না! তবে ও-ও মানতে শিখেছে৷ “
অমায়িক হাসলেন তিনি। মেয়েটাকে ভাবতেন অবুঝ। কিন্তু এতটা বুঝদার আজ বুঝছেন। কতই বা বয়স মেয়েটার? এইতো সেদিনের মেয়ে। কোলেপিঠে করে মানুষ করলেন। বিয়ে দেবার পর থেকে চিন্তায় ঘুমাতে পারতেন না। মেয়েটা সুখী হবে কিনা, মেনে নিতে পারবে কিনা এসব চিন্তায় দিন,রাত পাড় করতেন। কিন্তু এরা ঠিকি সব ভাগ্য ভেবে মানতে শিখেছে। যে হারে দু’জন ঝগড়া মা-রা মা-রি করে কে বলবে এরা এখন একে অপরের জন্য দরদও দেখায়? শিশিরের জন্য কুয়াশা কফি করছে! জীবনে এই দিনও দেখবে ভাবেননি। আর আজ দেখো অধিকারবোধ, দায়িত্ববোধ থেকে দু’জন দু’জনেরই যত্ন নেয়। এটাই বিয়ের বন্ধন, বিয়ের জোর।
আজমিরা মুচকি হেসে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন। বললেন,
” আমার মানিকটা অনেক সুখী হবে৷ আমি দু’চোখ মেলে দেখব সেদিন। আমার মা টা অনেক বুঝদার৷ “
কুয়াশা লাজুক হাসল। এবার একটু আহ্লাদী হলো৷ আহ্লাদ করে মেকি অভিযোগ করে বলল,
” তোমার জামাই, স্বামী হিসেবে ততটাও খারাপ না অনেকটাই দায়িত্ববান। কিন্তু ভাই হিসেবে বে-য়াদবের হাড্ডি ছিল ”
আজমিরা শুনে হাসল শব্দ করে। কুয়াশা কথাটা বলে মাথা নুয়ে নিল৷ আজমিরা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” ছেলে আমাদের লাখে একটা ছিল৷ তাইত জামাই বানিয়ে নিয়েছি। “
কুয়াশা আবার মা’কে জড়িয়ে ধরল। তিনি বললেন,
” যা কফি হয়ে এসেছে৷ নিয়ে যা৷ আর মেডিসিন দিয়ে দিস। বেশি জ্বর উঠলে ডাকবি আমায় “
” আচ্ছা ”
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে কফির কাপে কফি ঢেলে নিয়ে চলে গেল। আজমিরা সেদিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে চেয়ে মুচকি হাসলেন। বুকটা অনেক পাতলা লাগছে৷ এরপর স্বামীর কথা মনে উঠল। মনে মনে বললেন,
” দেখেছ! আমাদের মেয়ে সুখী হচ্ছে। আমি নিজে চোখে দেখছি সেই সুখ। তোমার আদরের ভাতিজা তোমার মেয়েকে সুখেই রাখবে৷ তুমিও থাকলে দেখতে!”
আজমিরা কথাগুলো ভেবে চোখের পানি নিরবে ছেড়ে দিলেন।
‘
ঘরে এসে দেখল শিশির সেভাবেই বসে আছে। গিয়ে কাঁধের উপর হাত দিয়ে বলল,
” নাও কফি খাও। ভালো লাগবে৷ “
শিশির মুখ তুলে তাকাল কুয়াশার মুখের দিকে। এরপর কফির দিকে। কুয়াশা আবার চোখের ইশারা করল। শিশির নিল কফি। ফুঁ দিয়ে কফি মুখে নিল। নাহ্ খারাপ হয়নি। ভালোই হয়েছে। গোবর ঠাঁসাটা তাহলে রান্নাও শিখেছে!!
টিপ্পনী কেটে বলল,
” ঝগড়া ছাড়া অন্যকিছুও যে পারিস জানা ছিল না তো! “
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। অন্য সময় হলে আগে মে-রে কথা বলত। এখন অসুস্থ বলে মুখ বুজে সহ্য করল। শিশিরে মুখের সামনে ঝুঁকে আস্তে করে বলল,
” মিঃ বুনো ওল, তোমার বউ যে ঝগড়া ছাড়া স্বামী সেবা করতে জানে মানতে শিখো, বুঝেছ! “
শিশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে উঠে এলো। শিশির নিঃশব্দে হেসে দিল দাঁত বের করে। সেদিন তার বলার মতো করেই বলে গেল। ভেবে আবার হাসল। কুয়াশা ডয়ারের সামনে গিয়ে ফাস্ট এইড বক্স বেড় করে শিশিরের সামনে এলো।একটা নাপা এক্সট্রা এবং একটা এক্সেল (প্যারাসিটামল) এন্টিবায়োটিক বের করে গ্লাসে পানি সমেত শিশিরের সামনে ধরল। বলল,
” এদুটো খেয়ে নাও। মাথা ব্যথা আর জ্বরটাও পড়ে যাবে। আর ওঠো এখন৷ ঘুমোবে চলো ”
বলে শিশিরকে ঠেলতে লাগল। শিশির একেরপর এক অবাক হচ্ছে। এই রাত বোধহয় অবাকের রাত। সে অবশিষ্ট কফিটুকু খেল একটু সময় নিয়ে। এরপর কুয়াশার থেকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে উঠে পড়ল। কুয়াশা বক্স, গ্লাস জায়গামতো রেখে এলো। এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। শিশির চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। বেশি কথা বলছে না। মাথাটা একটু বেশিই ধরেছে। কুয়াশা শিশিরের কাছে এগিয়ে গেল। মাথায় হাত রেখে আলতো হাত রেখে ম্যাসাজ করতে লাগল। মেয়েলি চিকন চিকন নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ কপালে পেয়ে শিউরে উঠল শিশির। মাথা ম্যাসাজ করাতে বেশ ভালো লাগছে৷ চোখ খুলে অন্ধকারে কুয়াশার মুখটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখতে পেল না৷ তবে কুয়াশা নিঃশ্বাসের শব্দ পেল। বলল,
” অন্যসময় চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলিস এখন টেনে দে। ব্যথা করছে খুব মাথা। “
কুয়াশা নিঃশব্দে হেসে ফেলল। কথা অনুযায়ী চুল টানতে লাগল। ছোট ছোট পুরুষালী চুলের মাঝে নিজের কোমল আঙুল গুলো চালাতে লাগল। শিশির এবার আরাম পাচ্ছে। শরীরটা গরম হয়ে আছে। ভালো লাগছে না। মাথা ধরলে যে কেমন লাগে! সেটা যার ধরে সেই বোঝে। এবার সে কুয়াশার পেট ধরে টেনে নিজের কাছে আনল। কুয়াশাকে নিজের মুখো কাৎ করে নিয়ে নিজেও কুয়াশার মুখো মুখ করে কাৎ হয়ে শুয়ে গলার মাঝে মুখ গুঁজে দিল। কুয়াশা কেঁপে উঠল। আজ প্রথম এভাবে শুলো শিশির। শরীর ভালো গরম অনুভব হলো। তাই সে-ও স্বামীর অসুস্থতার সঙ্গ দিতে কিছু আর বলল না। এই লোকটা আজকাল হৃদয়ে, ভাবনায় এসে উঁকি দেয়। শিশির গলার মাঝে মুখ গুঁজে রেখেই অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” হাত বন্ধ করবি না। ম্যাসাজ কর। ভালো লাগছে। ঘুমবো আমি। ”
কুয়াশা উপায় না পেয়ে মেনে নিল। যতক্ষণ জেগে থাকল হাত চালাতে থাকল। তার একহাত শিশিরের মাথার নিচ। অন্যহাতে দিয়ে করছে। শিশির ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। নিঃশ্বাসের গরম বাতাস পড়ছে কুয়াশার গ্রীবাদেশে। এতে ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে সে। এদিকে শিশির ইচ্ছে করেই জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। কুয়াশার গ্রীবাদেশের স্মেলটা তার ভীষণ ভালো লাগে৷ ঐ যে প্রথমদিন পেয়েছিল! কিছুক্ষণের মাঝে চোখে ঘুম ধরা দিল। কুয়াশা বুঝল শিশির ঘুমিয়ে গেছে। বুঝে মুচকি হাসল।
প্রেমে পড়াতেও সুখ আছে! কেমন সুখ সুখ লাগে আজকাল। প্রেমে যে পড়েছে সে!!
________
পরেদিন শুক্রবার। জাহিদ মালিথা বাড়িতে এসেছেন। সকলে সকালের নাস্তা খেয়ে সোফায় বসেছেন। এমন সময় রান্নাঘর থেকে সোরগোল এলো।
রান্নাঘরে বৃষ্টিকে জাকিয়া বলেছেন দুপুরে রান্নার জন্য মাছ, মাংস বের করে ভিজিয়ে দিতে। সে কথা অনুযায়ী ফ্রিজ যেই না খুলেছে ওমনি ফ্রিজ থেকে আসা মাছ, মাংসের বটকা গন্ধ পেয়ে দৌড়ে রান্না ঘরের বেসিনে গিয়ে হরহর করে বমি করে দিয়েছে। এমনিতেই কাল থেকে বমি হচ্ছে। আর এখন কাচা মাংস, মাছের গন্ধ শুঁকে বমি করে দিয়েছে। গন্ধটা কেন যেন একটুও সহ্য হলো না। শাশুড়ীরা সহ ইয়াসমিন, কুয়াশা দেখে বিস্মিত হয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে সোরগোল সহ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
| চলবে |
কুয়াশা কিন্তু প্রেমে পড়ে গেছে আর শিশির??
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click