®রোজা রহমান
‘
চলে গেছে মাঝে সপ্তাহখানেক। এই সপ্তাহখানেকে কুয়াশা নিজেকে আবার আগের মতো উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার পরিবারের জন্য। মানুষ জীবনে ভালো কাজের জন্য পূর্ণতা পায়। কুয়াশা বোধহয় চাঁদ কপাল করে জন্মেছিল এই পরিবারে। আল্লাহ মানুষের জীবনে যেমন কঠিন বাস্তবতা দেখান তেমনই সেই কঠিন বাস্তবতা থেকে উঠতে, বেড়তে, মেনে নিতে কোনো না কোনো মাধ্যম ঠিকই দেন৷ কষ্টের পর আনন্দের সুযোগ ঠিকই দেন৷ দুঃখ সময় কাটিয়ে সুখের সময় পাড় করার জন্য সুযোগও দেন৷
কুয়াশার পরিবারের এক একটা সদস্যের যেমন ধারা বুঝ এই বুঝ কতজনের হয়? সকলে যদি এমন বুঝে চলত তবে কী ভাইয়ে ভাইয়ে, জা’য়ে জা’য়ে অপত্যা বলে কিছু হতো? কত পরিবার আছে যেখানে নিজের বাড়ির গীত সমাজের লোকের কাছে গেয়ে বেড়ায়৷ নিজের বাড়ির মেয়ের কুকীর্তি সমাজের কাছে ধরিয়ে দেয়। এমন কতশত পরিবার আছে৷ কিন্তু কুয়াশার পরিবার? কুয়াশার পরিবারের চাচুরা, চাচিরা, ভাইরা, ভাবিরা তার দুঃখ, কষ্ট সময়ের সঙ্গী হয়েছে। ঢাল হয়েছে তার দুঃখ সময়ের। মনবল হয়েছে মেয়ের। সমাজকে মেনে নিতে শিখিয়েছে৷ শিখিয়েছে সমাজের সাথে লড়াই করতে, জানিয়েছে সমাজের লোকের দৃষ্টিভঙ্গি। একটা মেয়ের জন্য সমাজে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন সেটা যারা মেয়ে হয়ে জন্মেছে তারা ভালো জানে৷ সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে জীবনের শেষ দিন কখন যে চলে আসে।
কুয়াশাকে ভাঙতে দেয়নি শিশির। তার কথামতো সে কুয়াশার জোর হয়েছে। হয়েছে শক্ত মেরুদণ্ড। যেই জোরে কুয়াশা নিজেকে গুটাতে পারেনি৷ শিশিরকে সে বিয়ের আগে শুধু চাচাত ভাই জানত। আর ছোট থেকে তার আদর, ভালোবাসা না পেয়ে তাকে সে সহ্য করতে পারত না৷ পারবে কি করে? যেখানে ওকে বাড়ির প্রতিটা সদস্য একমাত্র মেয়ে বলে মাথায় করে রাখত সেখানে, একটা মাত্র ছেলে কিনা তাকে হিংসা করত? এটা তো তার মনে প্রভাব ফেলবেই৷ আর মেয়ে যদি হয় একটু জেদি প্রকৃতির তাহলে তো কথা-ই নেই! হ্যাঁ কুয়াশা জেদ একটু জেদি কিন্তু ন্যাকা মেয়ে সে না৷ ন্যাকামো করা মেয়ে আর জেদি মেয়ের মধ্যে বিরক ফারাক। আজকাল মেয়েরা জেদি একটু আধটু হয়-ই। আর সেগুলো তার পরিবারের প্রতিটা সদস্য মাথা পেতে গ্রহণ করে। তাদের কথা, একমাত্র মেয়ের, বোনের জেদ সহ্য করবে না তো কার জেদ সহ্য করবে? তার অহংকার তার পরিবার সেই জোরে সে জেদি। তার আহ্লাদ তার পরিবার সেই জোরে সে আহ্লাদী। একমাত্র মেয়ে পরিবারের কাছে আহ্লাদী হবে না তো পাড়ার লোকের কাছে হবে?
শিশিরের প্রতি মনোভাব পাল্টেছে তার। সে তার হৃদয়রাজ হতে সক্ষম হয়েছে। এখন শুধু স্বীকার করা বাকি। কিন্তু কথায় আছে না? মেয়েদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফোঁটে না? ঠিক সেটাই হয়েছে কুয়াশার। সে শিশিরের দায়িত্ব দেখতে পেরেছে, যত্ন দেখতে পেরেছে কিন্তু ভালোবাসা কি আদৌ দেখতে পেরেছে? শিশির তো তাকে বলেছিল, ” আমি তোর দায়িত্ব নিয়েছি এড়িয়ে যাব না ” হয়তো সেই দায়িত্ববোধেই আছে৷ সেই ধারণা থেকে কুয়াশা মনে কথা জানাতে নারাজ। সে অপেক্ষা করবে শিশিরের ভালোবাসা পাবার, স্বামীর ভালোবাসা পাবার। দেখা যাক, তার স্বামীর মনে তার জন্য কবে ভালোবাসা ফুল ফোটে৷ বউ হিসেবে মেনে তো নিয়েছে কিন্তু ভালোবাসা তার মাঝে কি সৃষ্টি হয়েছে? বউ বলে তো সকলেই মানে ভালোবেসে বউ কতজন মানে? যাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়, তারা তো কবুল বলে খালাশ! না লাগে ভালোবাসা আর না লাগে মনের মিল। সংসার করতে পারলেই হলো। কিন্তু এই দু’টো বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের তেমন সংসার চাই না। তারা চাই ভালোবাসা, মনের মিল। দায়িত্ব নিয়ে ভালোবাসতে। ঠিক সেই দিনের অপেক্ষা দু’জন করছে।
বিয়ের আগে একসাথে বড় হয়েছে কিন্তু কেউ কাউকে মুগ্ধ নজর তুলে তাকিয়েও দেখে নি এক হিংসা, শত্রুতার নজর ছাড়া। কিন্তু বিয়ের পর দু’জন দু’জনকে নতুন রূপে দেখতে শিখেছে, নতুন রূপে জানতে শিখেছে। মুগ্ধ নজরে দেখতে শিখেছে। শত্রুতার মাঝে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক মানার জন্য একে অপরের সৌন্দর্য দেখেছে। মন দেখেছে। সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছে। এই জন্য-ই তো তারা একে অপরের মনে জায়গা করতে পেরেছে, হৃদয় ছুঁতে পেরেছে। আর এ-সবকিছু শুধু আর শুধু মাত্র বিয়ের তিন কবুলের জোরে। বিয়ের বন্ধনের জন্য। যা বেঁধে দিয়েছে বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলকে৷ তারা এখন হাজার দূরে থাকতে চাইলেও বিয়ে নাম বন্ধনটা তাদের মনে করিয়ে দেয় তারা এখন স্বামীস্ত্রী। একে অপরের অর্ধাঙ্গ, অর্ধাঙ্গনী।
‘
রাত আটটার দিকে। শিশির, নীহার বাড়িতে এলো। একসাথই এলো। হাতে করে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে৷ তা হচ্ছে হালিম, পিৎজা আর কোল্ড ড্রিংক’স৷ কুয়াশা পড়তে বসেছিল৷ একটু পর খেতে নিচে নামবে৷ কিন্তু তার আগেই শিশিরের ডাক কানে এলো। আজ কাল বাড়িতে এলে কুয়াশাকে ডাকে৷ বাড়ির প্রতিটা সদস্য ওদের দু’জনের এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করে প্রশান্তিময় হাসি ঠোঁটে ঝুলায়৷
” কুয়াশা, এ্যাই কুয়াশা..! ”
কুয়াশা ডাক শুনে পড়া ছেড়ে নেমে এলো। তার শরীর খারাপ। সেইজন্য ঘরেই থাকে। এই সময়টা বেশি বের হয়না৷ সিঁড়ি বেয়ে বার বার ওঠা নামা করলে ব্যথা বাড়ে। কুয়াশা নেমে এসে দেখল তার পছন্দের হালিম আর পিৎজা৷ খুশি হয়ে গেল। খাসির মাংসের হালিম তার বড্ড প্রিয়৷ নীহার বলল,
” তোর হালিম ”
কুয়াশা মুচকি হেসে হাতে নিয়ে ভাবিদের কাছে চলে গেল। বৃষ্টির শরীর আজকাল বেশিরভাগ সময় খারাপ থাকে। বমি করতে করতে বেচারী আধমরা হয়৷ যখন ভালো লাগে তখন নিচে থাকে৷ এখন খাবার সময় হয়ে গেছে তাই সকলে রান্নাঘর সহ ডাইনিং এই ছিল। সেখানে গিয়ে ভাবিদের সাথে মজা করে খেল পিৎজা, হালিম। বৃষ্টি বেশি খেতে পারে না৷ খেলেই সব তুলে দেয়। তাই অল্প একটু খেল৷
‘
রাত বারটা পাড়। তবুও কুয়াশা ঘুমতে এলো না আজ? কথাটা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে শিশির। সে পড়ার টেবিলে এখনো। রোজ কুয়াশা বারটা বেজে গেলেই ঘুমতে চলে আসে। শিশির ভাবল হয়তো পড়ার চাপ বেড়েছে তাই পড়ছে। তা নিয়ে বেশি ঘাটল না। সে আবার পড়ায় মন দিল৷ যতক্ষণ গোবর ঠাঁসাটা না আসে ততক্ষণ পড়া যাক!
পড়তে পড়তে রাত একটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই কিন্তু কুয়াশা এ ঘরে এলো না। তাই উঠে পড়ল। উঠে বেড়িয়ে কুয়াশার ঘরের সামনে গেল৷ দরজা দেয়া? তাহলে কুয়াশা কই? ভেবে কুয়াশার ঘরে দরজায় নক দিয়ে আস্তে করে ডাকল,
” এ্যাই কুয়াশা..! ”
উত্তর দিল না কুয়াশা৷ অদ্ভুতভাবে চোখমুখ কুঁচকে গেল শিশিরের৷ এরপর ধাক্কা দিল দেখল দরজা খুলে গেল। দরজা খোলায় ছিল! ভেতরে তাকিয়ে দেখল কুয়াশা শুয়ে কাতরাচ্ছে। মরণ যন্ত্রণার মতো করে। বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর একবার কোমড় ধরে কাতরাচ্ছে তো একবার পেট৷ শিশির ওর এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। কী হয়েছে এভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে কেন! আরেকটু লক্ষ্য করে দেখল চোখ থেকে টপাটপ পানি পড়ছে৷ কিন্তু কান্নার আওয়াজ হচ্ছে না৷ মূলত ব্যথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছে কিন্তু এতটাই তিব্রতা ব্যথার যে না চাইতেও চোখ থেকে টপাটপ পানি বেড়িয়ে আসছে। মেয়েদের সহ্যসীমা যে কতটা তা এসকল বিশেষ দিন আসলে বোঝা যায়।
শিশির হতভম্ব হয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকল। এইরকম পরিস্থিতি তার জানা নেই আর পড়েও নি। সে কুয়াশার কাছে গিয়ে খাটে এক পা তুলে হাঁটু মুড়িয়ে দিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল,
” কুয়াশা? কি হয়েছে? এরকম করছিস কেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে ? পেট ব্যথা করছে? গ্যাসট্রিক বেড়েছে, তবে ওসব খেলি কেন? “
শিশির একের পর এক প্রশ্ন করছে। কুয়শা যন্ত্রণায় শিশিরকে খেয়াল করেনি। কন্ঠ পেয়ে খুবই বিব্রত হলো। পেটের ব্যথা এতটায় তিব্র যে উঠে গিয়ে মা’কে ডাকারও শক্তি পায়নি। এমন দিনে আজমিরাই পাশে থাকেন। তিনিই যত্ন নেন মেয়ের৷ তার ব্যথা মাঝে মাঝেই ওঠে। মূলত পিরিয়ড হলে ব্যথা আসে। কখনো তিব্র তো কখনো কম। যখন খুব বেশি হয় সহনশীলতার সীমা পেরিয়ে যায় তখন মাকে গিয়ে ডেকে আনে। জাকিয়াও অনেকবার টের পেয়ে যত্ন নিয়েছেন। মেয়েটার বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম পিরিয়ডে হাড় ভাঙা ব্যথা উঠেছিল। সেটার সময় কাতরিয়ে আধম-রা হয়েছিল। আজমিরা সব বুঝিয়েছিলে। জাকিয়া সব জানিয়ে বলেছিলেন এসব বিষয়ে। জোরে কান্না করতেও মানা করেছিলেন।
কুয়াশা মূলত আজ এই ঘরে থাকতে চেয়েছিল তাই যায়নি। আর পড়তে পড়তে পেট ব্যথা এতটাই বেড়ে গেছে যে দরজাতেও ছিটকানি দেবার শক্তি পায়নি৷ সে শিশিরের কাছে খুবই অস্বস্তিতে পড়ল। আজ বিয়ের পর প্রথম এমন পরিস্থিতি হলো৷ তাই খুবই অস্বস্তি হচ্ছে। সে কোনো কথা বলছে না৷ চোখ মুখ খিঁচিয়ে পেট ধরে এবার পড়ে রইল৷ শিশির এবার অবাকই হলো। জহুরী নজর দিল কুয়াশার উপর। ওর মুখের দিকে একবার নজর দিল তো একবার পেট ধরা আর কোমড় ধরার দিকে নজর দিল। যদিও এই পরিস্থিতিতে আজ নতুন সে। তবুও পড়াশুনোর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝল বিষয়টা৷ এই সামান্য জিনিস বুঝতে সমস্যা হলো না৷
তবে বিষয়টা বুঝতে পেরে তাকেও একটু অস্বস্তি দিল। তাদের সম্পর্ক তো এখনো ততটা গভীরে যায়নি! পরক্ষণেই নিজেকে সামলাল৷ বিয়ে করা বউ তার। বউয়ের শারীরিক, মানসিক সব পরিবর্তনই তার সামনে আসবে। না চাইতেও আসবে। এক সাথে সংসার করলে স্বামীস্ত্রীর বিষয়ে তো সবই জানা হয়ে যায়? এটাই স্বামীস্ত্রীর মধ্যকার কঠিন বাস্তবতা। আর এতদিন এসবের সাথে পরিচয় হয়নি। কিন্তু এখন হতে হচ্ছে।
শিশির নিজেকে সামলে কুয়াশাকে ধরে উঠাল। বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” খুব ব্যথা করছে?”
কন্ঠটা কেমন ছিল আর প্রশ্ন করাটাও৷ যা দ্বারা কুয়াশা বুঝল যে শিশির বুঝেছে সে না বলতেই৷ ব্যথাতুর চোখ নিয়েই অবাক নয়নে তাকাল। দু’জনের চোখাচোখি হতেই দু’জনকেই আবার অনেকটা অস্বস্তি গ্রাস করল। কুয়াশাকে অস্বস্তি সহ লজ্জা গ্রাস করল। শিশির নিজেকে সামলে কুয়াশার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
” ব্যথা করছে খুব? “
কুয়াশা মাথা দুই বার উপর নিচ করে উত্তর দিল। শিশির বলল,
” লজ্জা পাবার কিছু নেই৷ এখন থেকে এমন অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হতে হবে তোর, আমার ”
কুয়াশা কথাটা ভাবল। সত্যি তো! স্বামীস্ত্রী তারা। না চাইতেও এসব সামনে আসবে শিশিরের। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” আম্মুকে একটু ডেকে দিয়ে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি এ ঘরে থাকব আজ ”
কুয়াশার কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল। কুয়াশা আমতা আমতা করে বলল,
” ব্যথা করছে অনেক আম্মু এসে থাকবে। ঠিক হয়ে যাবে। ও ঘরে তো আম্মু থাকতে পারবে না। তাই বললাম “
শিশির বলল,
” হাঁটতে পারবি? ”
” তুমি আম্মুকে ডেকে দিয়ে চলে যাও তো। হাঁটতে পারছি না তাই ডাকতে পারছি না। ঘুমোও গিয়ে। চিন্তা করতে হবে না ”
বলে আবার পেট ধরে শুয়ে পড়ল। কারণ বসে থাকতে তার জীবন বের হয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো খুবই কষ্টে বলল। শিশির আর কথা বলার সুযোগ দিল না। কোলে তুলে নিল। কুয়াশা চমকে হতভম্ব হয়ে তাকাল। বলল,
” আরেহ্ করছ কি? ধুর..ছাড়ো তো, অসহ্য! “
শিশির কুয়াশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” বউ তুই আমার। সেবা, যত্নও আমিই করব। তোর শ্বশুর আর আমার চাচা-শ্বশুর আমাকে তোর দায়িত্ব দিয়েছেন না? আদর যত্ন করার জন্য? এখন সেই দায়িত্বই পালন করব, চল।”
কুয়াশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলে কী!! শিশির ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসল তা দেখে। হাঁটা ধরল নিজের ঘরে। গিয়ে কুয়াশাকে বসিয়ে দিল বিছানায়। এরপর আগে গুগল থেকে দেখে নিল কী কী করলে ব্যথা নিরাময় হবে! সেই অনুযায়ী আগে গরম পানি লাগবে। এরপর আদা নয়তো আদা দিয়ে চা। কিন্তু সে তো রান্না ঘরে যায় না কখনো! জিজ্ঞেস করল,
” গরম পানির সেঁক দিলে আরাম লাগে। আদা খেলেও নিরাময় হয় কিন্তু আমি তো রান্নাঘরে যায় না। সেসবের অভ্যাস নেই “
” তোমাকে বললাম তুমি ঘুমোও? তবুও শুনলে না৷ যাও আম্মুকে ডাকো! ”
বসে থেকে ঝাঁঝ নিয়ে বলল কথাটা। মেজাজ গরম হচ্ছে তার। মানা করল তবুও শুনল না। এত দায়িত্বই বা পালন করতে হবে কেন? ভালোবাসতে জানে না আসে শুধু দায়িত্ব নিয়ে। যত্তসব!! আপন মনে আওরাল কথাগুলো সে।
এদিকে শিশির কুয়াশার দিকে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বাইরে চলে গেল। গিয়ে ভাবল মা’কে ডাকবে নাকি শাশুড়ীকে ডাকবে? শাশুড়ীকে ডাকতে কেমন কেমন যেন লাগছে। যতটা মা’কে ডাকা সহজ মনে করছে। এই ভেবে মা-বাবার ঘরের সামনে চলে গেল। এত রাতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও দরজায় বারকয়েক টোকা দিয়ে আস্তে করে ডাকল,
” আম্মু.. আম্মু! ”
কিছুক্ষণ ডাকার পর জাকিয়া ঘর খুললেন। ছেলেকে এতরাতে এখানে দেখে অবাক হলেন৷ আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে আব্বু? এত রাতে তুই? কোনো সমস্যা হয়েছে? “
মায়ের আতঙ্কিত কথায় শান্ত করল,
” আস্তে আম্মু। বাবার ঘুম ভেঙে যাবে। তেমন কিছু না। শান্ত হও “
জাকিয়া ভ্রু কুঁচকালেন,
” তবে কি? “
শিশির এবার অস্বস্তি মুখে আমতাআমতা করে বলল,
” একটু গরম পানি আর আদা দিয়ে চা করে দাও না!”
জাকিয়া শুনে আবারও ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। ভ্রু তার আগের ন্যায়৷ ছেলের তিব্র অস্বস্তি আর আমতাআমতা কথাতে কি তিনি ধরতে পারলেন কিছু? হয়তো পারলেন৷ আর এসব জিনিস এবাড়িতে একজনের লাগে প্রায়ই৷ তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। মাথার চুল এলোমেলো করে দিলেন হাত বাড়িয়ে। বললেন,
” আমার পা’গ’ল ছেলে, চল…!”
শিশির একটু লজ্জাবোধ করল বটে। তবুও নিজেকে সামলে নিল৷ বলল,
” ও বলল ছোট আম্মুকে ডাকতে কিন্তু আমার কেমন জানি লাগল তাই তোমাকে ডাকলাম। ঠিক করেছি না? “
” তোর ছোট আম্মু আর আমি কি দুই হলাম? দু’জনেই এখন এক। “
কথা বলতে বলতে দু’জনই নিচে নেমে এলো। কী সুন্দর দৃশ্য নাহ্? শাশুড়ী আর স্বামী মিলে বউয়ের জন্য রান্না ঘরে৷ জাকিয়া পানি চুলার উপর দিতে দিতে বললেন,
” তা আমার ছেলের ‘ও’ কি আমার ছেলের বউ হতে পেরেছে? “
শিশির এবার ভড়কে গেল মায়ের কথায়। জাকিয়া মুচকি মুচকি হাসছেন। তিনি আবার বললেন,
” তোদের পরিবর্তন চোখে পড়ছে৷ ভালো লাগছে আমাদের। এটাই চেয়েছিলাম। তোরা যে এত জলদি মানতে পারবি সেটা ভেবেই আশ্চর্য হই। যা করতি বাবাহ্ রে..!”
” মানারই তো ছিল আম্মু! ওর উপর যে কারণে আগে হিংসে করতাম সহ্য করতে পারতাম না এখন সেটা আসেনা। তাই এত জলদি মানতে পেরেছি। আগে থেকে নমনীয়তা দেখালে এমন হতো না হয়তো। তাছাড়া তোমার বৌমা বউ হিসেবে খারাপ না। শুধু জেদি। আহ্লাদী আহ্লাদ করে শুধু।”
শেষ কথাটা এমন ভাবে বলল শিশির। জাকিয়া না চাইতেও একটু শব্দ করে হেসে ফেললেন। মেকি রাগ নিয়ে বললেন,
” এ্যাই আমার মেয়ে আগে থেকেই আহ্লাদী। আহ্লাদ করবে না তো কি করবে? তুই সহ্য করবি “
” হ্যাঁ, আহ্লাদে আহ্লাদে বাদর বানাতে আমি পারব না। ওকে শাসনের উপরই রাখতে হবে “
জাকিয়া হাসলেন। বললেন,
” সে তুই তোর ‘ও’কে কি করবি না করবি তুই বুঝে নিস।”
শিশির মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। তার মা’ও মজা নেয় সুযোগ বুঝে৷
” তবে ভালোবাসতে পেরেছিস তো? মেনে নেয়া আর ভালোবাসা কিন্তু এক না আব্বু!”
শিশির মা’য়ের দিকে তাকাল৷ কথাটা ভাবল। পেরেছে কি ভালোবাসতে? এই যে ওর জন্য তড়পানো, ওর প্রতি দায়িত্ববান হওয়া যত্ন নেয়া এসব কি ভালোবাসার কাতারে পড়ে? নাকি পড়ে না? প্রশ্নটা কেন যেন নিজের কাছে চলে এলো। সে ভেবে উত্তর করল,
” হয়তো আম্মু। তবে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ও। কিন্তু কিছু প্রকাশ করিনি এখনো “
” হয়তো, যদি, কিন্তু এসব বাদ দিয়ে তোর মন যদি বলে ভালোবাসতে পেরেছিস তবে সেটাই তোর আসল উত্তর হবে। জানবি সেদিন তুই ভালোবাসতে পেরেছিস। আব্বু কুয়াশা ভালোবাসার পূজারী। ভালোবেসে দেখিস মেয়েটা চরম আহ্লাদী। জীবন রঙিন হবে তোর। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। শুধু দায়িত্ব নিয়ে সংসার সাজানো যায় না। ভালোবেসে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়, আঁকড়ে ধরতে হয়।”
মুগ্ধ হলো শিশির মায়ের কথায়৷ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ৷ এরপর মুচকি হাসল। তবে উত্তর করল না৷ জাকিয়া আদা কুঁচি কুঁচি করে প্রিচে দিয়ে গরম পানি নিয়ে বললেন,
” আমার সাথে আয় “
শিশির কথামতো গেল৷ এরপর শিশিরের ঘরে গিয়ে দেখল কুয়াশা এবার গুঙিয়ে কাঁদছে। ব্যথা আবার বেড়েছে। ঘুমও ধরা দিচ্ছে না৷ এই রাতে ব্যথা উঠলে এতটা জ্বালায়! শিশির বলল,
” সেই তখন থেকে এভাবে কাতরাচ্ছে “
” চিন্তা করিস না৷ ঠিক হয়ে যাবে। এমন হয় ওর৷ তুই একটা কাজ কর। ওর ঘরে দেখ বেডসাইড ডয়ারে হট ওয়াটার ব্যাগ আছে। নিয়ে এসে দে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি সব”
কুয়াশা ব্যথার মধ্যেও অবাক চোখে চেয়ে রইল এই দুইটা মানুষের দিকে। শিশির কথা না বাড়িয়ে এনে দিল। জাকিয়া হট ওয়াটার ব্যাগে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
” একদিন রাতে বাহিরে এসে দেখছি অনেক রাতে কুয়াশার ঘর থেকে গুঙানি আর কথার আওয়াজ আসছে। কৌতূহল বসত ঢুকে দেখি মা মেয়ের ওরকম দৃশ্য। মেয়েটা কাতরাচ্ছে কিন্তু কাউকে ডাকছে না আজমিরা। রাগ উঠেছিল। তবে মায়াও লেগেছিল। আজমিরা খুবই নরম মনের৷ মুখ ফুটে কিছু বলে না৷ সেদিন রাত জেগে দু’জন মিলে মেয়ের সেবা করলাম৷ পরেরদিন তুষারকে দিয়ে এটা কিনে আনিয়েছিলাম৷ আগে তোয়ালে দিয়ে সেঁক দিত আজমিরা৷ তবুও প্রয়োজনবোধ জানায় নি। চিন্তা করেছিস তোর শাশুড়ী কতটা পাগলী? “
শিশিরের খুবই খারাপ লাগল শুনে। সে জীবনেও এসব দেখেনি। এসব দিকে নজর দেয়নি। বাড়িতে কুয়াশার কী লাগবে না লাগবে তুষার দেখেছে৷ শিশির গিয়ে কুয়াশার পাশে বসল। তুলে নিয়ে বসিয়ে দিল। দিয়ে বুকের সাথে আগলে ধরল৷ জাকিয়া মুচকি হাসলেন৷ এরপর হাতের ব্যাগটা দিয়ে বললেন,
” এটা তল পেটে ধরে সেঁক দিতে থাক৷ আর এই আদা কুঁচি খাওয়া৷ চা দিলাম না এত ব্যথা ধৈর্য ধরে চা খেতে পারবে না। কাল সকালে খাবে “
শিশির কথা অনুযায়ী সেটা করল৷ কিন্তু অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো৷ কুয়াশা কেঁপে উঠল। শিশির টের পেল বোধহয়। তবে মায়ে সামনে কিছু বলল না৷ কুয়াশা শুধু মা ছেলেকে দেখেই গেল৷ আজমিরা কুয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” কাঁদিস না মা৷ ঠিক হয়ে যাবে৷ আমার ছেলে তোর পাশে আছে। “
কুয়াশা ছলছল চোখে চেয়ে রইল। শিশিরের মাথায় হাত রেখে বললেন,
” চিন্তা করিস না আব্বু, ঠিক হয়ে যাবে৷ এভাবেই যত্ন নিবি। আমি আসছি! “
শিশির সম্মতি দিতেই বেড়িয়ে গেলেন জাকিয়া৷ শিশির উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিল। এসে জিরো লাইট জ্বালিয়ে দিল। এরপর কুয়াশাকে শুয়ে দিয়ে সেঁক দিতে থাকল। এতক্ষণ মরণ যন্ত্রণা থেকে আস্তে আস্তে আরামবোধ হলো। আদা চিবাচ্ছে সাথে৷ ঔষধ সে খাই না৷ এমন প্রাথমিক চিকিৎসাই নেয়। শিশির দেখল কাতরানো একটু কমিয়ে দিয়েছে। বলল,
” কমছে? “
” হুঁ, আরাম লাগছে “
শিশির বলল,
” দেখলাম ম্যাসাজ করলেও আরাম লাগে। করে দেব? তুই বললে দেব! “
কুয়াশা অদ্ভুত নজরে তাকাল। এই ছেলেকে সব অধিকারই দিতে হবে সেখানে এটা আর তেমন কি?
” হুঁ “
শিশির কুয়াশা তলপেট স্পর্শ করতেই সে কারেন্ট শকট লাগার মতো করে কেঁপে উঠল। শিশিরেরও শরীরে ঝাঁকানি দিল। এ কেমন অনুভূতি? নিত্য নতুন অনভিজ্ঞতা, অনুভূতির সাথে দু’জন পরিচয় হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে অনুভূতিরা তত গভীর হচ্ছে। এক অদম্য অনুভূতি কাজ করছে শিশিরের৷ শিশির আলত হাতে কুয়াশার পেট ম্যাসাজ করতে করতে কুয়াশার দিকে তাকাল। কুয়াশা লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিল। শিহরণ হচ্ছে শরীরে। শিশির ঠোঁট কামড়ে হাসল। সম্পর্কের গভীরতা টের পাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে অতিশয় আপন লাগছে এই মেয়েটাকে। আপনই তো! তার হৃদয়ে রাজ করতে বসেছে এই হৃদয়রাণী
কুয়াশা আধা ঘণ্টা মতো চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। এরপর যখন ব্যথা কমে গেল শিশিরকে বলল,
” শুয়ে পড়ো। কমে এসেছে। এবার সেরে যাবে ”
” কষ্ট হচ্ছে না আর? “
” খুব না “
” আরেকটু করি “
” লাগবে না, এসো! “
বলে হাত বাড়িয়ে দিল। শিশির মুচকি হেসে হট ব্যাগ রেখে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কুয়াশার গলায় মুখ গুঁজে দিল। কুয়াশা বলল,
” এত ভালো লাগে এখানের স্মেল? “
অবাক হলো শিশির। মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
” তুই জানলি কি করে? “
” যে ভাবে শ্বাস টানো! “
শিশির ফিসফিস করে হেসে দিল। টেনে নিল আরেকটু।
_________
দুইদিন পর। দুপুর চারটা। শিশির এসে মাত্র গোসল করে বের হলো। সেই সময়ে কুয়াশা এলো। শিশির সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তৎক্ষনাৎ আবার তাকাল। সামথিং স্পেশাল লাগছে কি? হ্যাঁ লাগছে তো। নাকে নাকফুল পড়েছে!!
কুয়াশার নাক ফুটো করার পরে সুতো কেটে নাকফুল পড়তে পারেনি। সমস্যা হচ্ছিল অনেক। এখন নাক শুকিয়ে গেছে অনেক। তাই জাকিয়া নাকফুল পড়িয়ে দিয়েছে আজ। শিশির বিড়বিড়াল,
” অপ্সরা ”
” কি বলো? “
” এদিকে আয় “
কুয়াশা এগিয়ে গেলে হাত ধরে টেনে নিল।
” সুন্দরী, অপ্সরা লাগছে নাকফুলে আমার আহ্লাদী বউকে”
লজ্জা পেল সে। মাথা নিচু করে রাখল। শিশির হাসল।
| চলবে |
বিঃদ্রঃ আমি ইচ্ছে করলে আজকে পিরিয়ডের অংশটুকু স্কিপ করতে পারতাম। কিন্তু আমি এটা নিয়ে লিখলাম কারণ ওদের সম্পর্কের গভীরতাটা বুঝানোর জন্য এটা লিখা। কেউ ভুল ভাবে নিয়েন না।
আর হ্যাঁ আমার মনে হলো যে শিশির জাকিয়াকে ডাকলেই বিষয়টা সুন্দর হবে কারণ একটা ছেলে যার কিনা গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়া লাগে না সে বউয়ের জন্য চুলা ধরিয়ে পানি গরম করা, চা বানাতে যাওয়া এটা অতিশয় ন্যাকামো ছাড়া কিছু লাগত না।
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click