®রোজা রহমান
‘
শিশির কুয়াশাকে নিয়ে বাড়ির উঠানের এক পাশ দিয়ে সকলের নজর এরিয়ে উঠানে থাকা চাপকলের সাথে লাগোয়া গোসলখানার মধ্যে ঢুকে গেল। উঠানে শুধু শশীর দেখা পেয়েছে। শশী শিশিরের কথা অনুযায়ী রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
কুয়াশাকে কোলে করে আনতে দেখে তড়িঘড়ি করে গোসলখানার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এ্যাই ভাইয়া! কি হয়েছে বুবুর? “
” পণ্ডিতি করতে গিয়ে কামাই করেছেন তিনি “
শশী কথার মর্মার্থ বুঝতে পারল না৷ কুয়াশাকে নিচে দাঁড় করিয়ে দিল। অমনি ব্যথায় ককিয়ে উঠল। কোমড়ের হাড়ে লেগেছে অনেকটা৷ শিশির তাকাল কুয়াশার দিকে। বুঝল ব্যথা ভালোই পেয়েছে৷ বুঝে মেজাজটাও চড়ে গেল৷ বে-য়াদব সব সময় উড়নচণ্ডী হয়ে হাঁটা চলা করবে৷ বিপদ সবসময় নিজেই ডেকে আনবে। এতকরে বলা হলো পিছলা তবুও দৌড়ে যেতে গিয়ে অকাম করল। এত দৌড় ঝাঁপ কিসের তার? মনডা চাচ্ছে আগে কয়েক ঘা বসিয়ে নিতে। চোখ মুখ কুঁচকে কিড়মিড় করল শিশির। বলল,
” বেয়াদব গোবর ঠাঁসা, এখন ককাচ্ছিস কেন? যাহ্ দৌড়া! মনটা যা বলছে না তোর উপর! ঠাটিয়ে কয়েকটা দিতে পারলে শান্তি লাগত। ফাজিল কোথাকার”
কুয়াশা চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ সে কি বুঝেছিল এমনটা হবে? যদিও পিছলার উপর দৌড়ানো ঠিক হয়নি। কিন্তু ভয়েই তো দৌড়ে যেতে গিয়ে এমনটা হলো। শশী বলল,
” পড়ে গেছ বুবু? “
” হ্যাঁ “
শিশিরের উত্তর। কুয়াশা নিরবে চোখের পানি ফেলছে। যদিও এখনো খুব একটা ব্যথা আসে নি। কিন্তু রাত হতে হতে অনেকটা ব্যথা ধরা দেবে। ভেবে শিশির শশীকে বলল,
” শশী! ঘরে পেইন রিলিভার আছে? “
” হ্যাঁ, আছে “
” নিয়ে এসে দে৷ আর এর ড্রেস আনিস”
শশী সম্মতি দিয়ে চলে গেল৷ কিছুক্ষণের মাঝে চলেও এলো৷ এসে শিশিরের হাতে দিয়ে চলে গেল। কুয়াশা নিরবে পানি ফেলছে চোখের৷ শিশির গোসলঘরের দরজা আটকে দিল। ঝাঁঝ নিয়ে ভারিক্কি, রূঢ় কন্ঠে বলল,
” দেখা কোথায় লেগেছে “
কুয়াশা চমকে উঠল। তাকাল শিশিরের দিকে। তা দেখে শিশির বলল,
” হাতে এবার থা-প্পড় না খেতে না চাইলে পিছন ঘোর আর দেখা কোথায় আঘাত লেগেছে! “
” লাগবে না দাও, আমি আম্মুর থেকে দিয়ে নেব”
এবার বেজায় রেগে গেল শিশির৷ সে কি তার পড়ের ঘরের লোক? নাকি পরপুরুষ? এই সামান্য জিনিস নিতে তার এত সমস্যা? স্বামী সে তার। কিড়মিড় করে ধমকে বলল,
” এ্যাই ফাজলামো করছি তোর সাথে আমি? “
বলে কুয়াশার গাল চেপে ধরল রাগে৷ মেজাজ সত্যি তার গরম হয়ে গেছে৷ একে তো এমন বেপরোয়া হয়ে চলে তারউপর সবসময় ব্যস্ততা বাড়ায় আবার এখন অবুঝের মতো কথা বলছে। সে আবার বলল,
” এ্যাই বল, আমি তোর কী হয়? তোর এত ফর্মালিটি করতে হবে কেন? সব হচ্ছে, হবে আর সামান্য জিনিস নিয়ে এখন তোর ন্যাকামি দেখব আমি? “
বলে ছেড়ে দিল চোয়াল৷ কুয়াশা কিছু বলল না। স্বামী তার। কিন্তু তবুও লজ্জা লাগছে৷ শিশির বেজায় রেগে গেছে। শিশিরের দিকে পিছন ঘুরে হাত দিয়ে বোঝাল কোথায় লেগেছে৷ শিশির দেখল৷ কোমড়ের মাঝামাঝির হাড় সোজাসুজি আঘাত পেয়েছে৷ এরপর কুয়াশার শরীরের দিকে তাকাল। ভেজা জামা৷ বলল,
” জামা আগে চেঞ্জ করবি নাকি ক্রিম আগে লাগাব?”
” তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো “
শিশির কিছু বলল না। এগিয়ে কুয়াশার পেছনে গিয়ে বসল। এরপর কোমড়ের কাছ থেকে জামার কিছুটা অংশ সরিয়ে আলগা করল৷ কুয়শা শিশিরের হাত পেয়ে কেঁপে উঠল। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পিছন ঘুরে। শিশিরের যদিও অস্বস্তি, অস্থিরতা ফিল হচ্ছে তবে পাত্তা দিল না এখন৷ এই গোবর ঠাঁসা জন্য জীবনটা প্যারাময় হয়ে গেল৷ একটা না একটা অঘটন ঘটাতেই আছে আর সে দায়িত্ব পালন করতেই আছে৷ ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। হলুদ ফর্সা কোমড়ের উপর নজর দিয়ে দেখল আঘাত পেয়ে মাংসপেশির উপরে কালো আস্তরণ পড়ে আছে। সাথে সাথে এতটা কালো হয়ে উঠেছে? কালসিটে পড়ে গেছে। ক্রিম নিয়ে কালসিটের উপর হাত দিতে না দিতেই ককিয়ে উঠল ‘আহ্’ শব্দ করে। শিশির নরম স্বরে বলল,
” ব্যথা তো ভালোই পেয়েছিস মনে হচ্ছে। ভেতরে যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে?”
” একটু একটু “
” আপাতত এটা দিয়ে দেখি কী হয়। নয়তো ডক্টরের ট্রিটম্যান্ট লাগবে “
বলে থেমে আবার বলল,
” আর ঘরে গিয়ে শশীর থেকে একটা ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ নিয়ে খেয়ে নিবি। “
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না নিরব সম্মতি দিল। শিশির ক্রিম নিয়ে আলত হাতে জায়গাটায় ম্যাসাজ করতে লাগল। কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে ভালোভাবে ক্রিমটা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
” চেঞ্জ করে বেড়িয়ে আয়৷ আমি বাইরে গেলাম “
কুয়াশা সম্মতি দিলে সে চলে গেল৷ আগে নিজেরও চেঞ্জ করতে হবে৷ অনেকক্ষণ ভেজা শরীরে আছে৷
‘
কুয়াশা শশীর ঘরে চলে এসেছে৷ শশীরা সব গল্প করছিল। স্মৃতি বলল,
” অনেকটা লেগেছে নাকি রে?”
” হ্যাঁ, ব্যথা হয়ে গেছে অনেক “
ঈশা বলল,
” এসে বস, হাঁটা চলা করিস না বেশি “
কুয়াশা বসতে গিয়েও অনেকটা ব্যথা অনুভব করল হাড়ে মাঝে৷ কষ্ট করে বসল। শশী বলল,
” আম্মুকে বলছি ডক্টর দেখানোর কথা “
” না থাক এখন, তোর ভাইয়া বলল এটাতে না হলে নেবে। একটু দেখি আগে। আর ব্যথার কোনো ঔষধ থাকলে দে। “
শশী আর কিছু বলল না ঔষধ এনে দিল। এগুলো ঘরে থাকে তাদের কারণ হানিফ সাহেবের বার্ধক্যজনিত হাড়ের ব্যথা আছে। সেসময় বৃষ্টি, ইয়াসমিন এলো৷ শশীর থেকে শুনেছে। ওরাও জিজ্ঞেস করল কতটা ব্যথা পেয়েছে। একই ভাবে জবাব দিল কুয়াশা। এরপর একে একে সকলে জেনে গেল কুয়াশা পড়ে গেছে। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে৷ ব্যস হয়ে গেল৷ সকলে ব্যস্ত হলো তাকে নিয়ে৷ শিশির সকলকে জানাল সমস্যা খুব বেশি না। ভাঙেচুড়ে নি। শুধু আঘাত পেয়েছে। ব্যথার মলম দেয়া হয়েছে। কিছু না হলে ডক্টরের ট্রিটম্যান্ট নেয়া যাবে৷ কারোর এত অস্থিরতা দেখাতে হবে না। ওর একটু শাস্তি হবারও দরকার৷ এতে যদি শিক্ষা হয়। তা শুনে কুয়াশা কাঁদো কাঁদো করে বসে থাকল৷ জাকিয়া ছেলেকে ধমকালেন। হয়ে গেছে, এখন কি করার? এসবের সাথে তো আর নিজের হাত থাকে না। তবুও সাবধানতা বজায় রেখে চলা ভালো৷
_________
দুপুর দুটোর দিকে সকলে দুপুরের খাবার খেল। শিশিররা যে মাছ ধরেছে সেগুলো কিছুটা রান্না করেছেন জিনিয়া আর বাকি গুলো কেটেকুটে ফ্রিজে রেখেছেন। আগামীকাল বোনদের দিয়ে দেবেন। জিনিয়া পিঠা এখন বানাতে শুরু করবেন৷ দুপুরের রান্নার জন্য এখনো শুরু করেনি। খাবার খেয়ে সকলে রেস্ট করছে৷ কুয়াশা ঘুমিয়ে গেছে। টুকটাক গল্প করতে করতে সকলেই একটু ঘুমাল৷ এরই মাঝে শিশির শশীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল সব ঘুমচ্ছে৷ একটু অপ্রস্তত হলো। চলে গেল৷ ভেবেছিল কুয়াশার শরীরের হালচাল জিজ্ঞেস করবে৷ সে-ও গিয়ে শুলো। নীহাররাও ঘুমচ্ছে।
_________
বিকেলের দিকে সকলের ঘুম ভাঙল। সময় চারটা পয়তাল্লিশ। সবার ঘুরতে যাবার প্ল্যান ছিল। কুয়াশা যেতে পারবে না ভেবে কেউ কিছু বলছে না আর৷ কিন্তু কুয়াশা নিজেই জানাল তার বেশি আর সমস্যা হচ্ছে না। ঔষধ খেয়ে পেইন রিলিভার দিয়ে অনেকটা কম। এখন সত্যি কম কিনা ঘুরতে যাবার লোভে মিথ্যা বলল কিনা সেটা শিশির বোঝার চেষ্টা করল এবং জিজ্ঞেসও করল। কিন্তু সে জানাল কম। শিশির আর কিছু বলল না। সকলে রেডি হলো আশেপাশের গ্রাম ঘুরে দেখবে। শশী ওর কাজিনদের ডেকে আনল। দুইটা মেয়ে কাজিন তার মাঝে শোভাও আছে আর একটা হিমের বয়সের ছেলে এলো। চাচত ভাই বোন শশীর।
‘
পরন্ত বিকেল। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। তেজ নেই কিন্তু তার লালাভ আলোক রশ্মি এখন পরিলক্ষিত বসুধায়। গাছের পাতায় পাতায় টিনের চালে চালে তার আলো জ্বলে জ্বল-জ্বল করছে৷ সারাদিন তেজ ছিল তার। এইজন্য গরমও বেশ ভালোই পড়ছে৷ কিন্তু গ্রামের মাঠের খোলা হাওয়ায় গরম কারো গায়ে লাগছে না।
সকলে শশীদের বাড়ি থেকে বের হয়েছে। পাকা রাস্তায় উঠে ডান সাইটের সোজা রাস্তায় হাঁটা ধরেছে৷ যত এগুচ্ছে গ্রামের পরিবেশে তত মুগ্ধ হচ্ছে সকলে। চোখ জুড়ানো পরিবেশ। শিশিররা হাঁটছে গ্রামের অনেক মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মূলত কৌতূহল গ্রামবাসির মনে। সকলে দেখছে এরা গ্রামের না শহরের মানুষ কারণ সাজসজ্জায়, চেহারায় সেটা ধরা দিচ্ছে। একটা মহিলা কৌতূহল দমাতে না পেরে শোভাকে জিজ্ঞেস করল,
” এ শুবা..! ইরা কারা রে? কুনতি আইয়িছে? ”
মহিলাটা শশীর গ্রামের ভাষায় বলল। শশীরা নিজেদের গ্রামের ভাষা বলে না। ওরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু শশীর চাচারা, কাজিন রা বলে৷ শিশিররা থেমে গেল। তাদের এসবের প্রতি ধারণা আছে তাই কিছু মনে করল না৷ গ্রাম জিনিসটায় এমন কোনো নতুন মুখ কারো বাড়ি আসতে দেখলে জিজ্ঞেস করে করে মাথা খেয়ে ফেলবে৷ শোভা উত্তর দিল,
” শশীর খালার বাড়ির লোক। কুষ্টিয়া থিক আইসিছে।”
মহিলাটা বিজ্ঞের ন্যায় ‘ও’ বলল। শিশিররা আর কথা বাড়ালো না। কারণ গ্রামের লোকজন একটু বেশি বোঝে। বেশি বোঝে নাকি যা শুনে তা বেশি বলে কে জানে!
শিশিররা হাঁটতে লাগল। ঐ মহিলাটার মতো আরো কয়েকজন একই কথা জিজ্ঞেস করল৷ মিহির সহ শোভারা উত্তর করল৷
শশীদের বাড়ি ছেড়ে কিছু দূর হাঁটলে একটা ক্যানাল আছে। যেটার শাখা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে জানা নেই। শশীদের বাড়ির সামনের রাস্তার সোজা যাবার জন্য সেই ক্যানালে পাড়াপাড়ের জন্য ব্রিজ করা আছে৷ দেখতে ভীষণ সুন্দর পরিবেশ। একদম নিরিবিলি। সেখানে ব্রিজের পাশে ইয়া বড় মোটা বট গাছ আছে। অনেক বছরের পুরোনো। সোজাসুজি যে রাস্তাটা আগে মাটির ছিল এখন পাকা হয়েছে৷ কিন্তু সেই ক্যানালের ব্রিজের উত্তর, দক্ষিণ দিকের দুই পাশের রাস্তাগুলো চিকন আর মাটির। মাটির রাস্তা ঘেঁষে ছোট বড় বিভিন্ন রকমের গাছ। ক্যানালের ব্রিজের উপর থেকে গড়ান রাস্তা। ব্রিজ ছেড়ে অপূর্ব, অসাধারণ মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। গ্রামের টিনের চালের বাড়ি একটা দুটো, কোনোটা মাটির বাড়ি। ছোট বড় টিন ও মাটি দিয়ে তৈরি সব বাড়ি-ঘর৷ ব্রিজের উপর দাঁড়ালে মাঠের বাতাসে শরীরের হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠে এতটা শীতল হয় মন। ভোরের পর সকালে আর পরন্ত বিকেলে এমনটা বেশি মনে হয়। রাস্তার দুই পাশের মাঠগুলো এত বড় বড় যে যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠই দেখা যায় তার শেষ সীমানা আর পাওয়া যায় না। যদিও পাওয়া সীমানা সেটাও চোখে না লাগার মতোই।
ক্যানালের ব্রিজের উত্তর দক্ষিণে যে চিকন চিকন রাস্তা আছের সেদিকের বাম সাইটে, ডান সাইটে বড় বড় পুকুর আছে। মাছ চাষ হয়। পুকুরে সামনে উঁচু করে চড়াট পেতে সেগুলো উপরে ছন অথবা পাটকাঠি দিয়ে ছাউনি করা এবং চারকোণা ঘিরে রাখা। তার ভেতর রাতে মানুষ থাকে কারণ মাছের পুকুর পাহারা দেয় মালিকরা বা যারা পুকুল বর্গা নিয়ে মাছ চাষ করে থাকে। মাছ চাষ করাটা এই গ্রামে বেশিই হয়ে থাকে৷ এই জন্য আশেপাশে, যেখানে সেখানে পুকুর অতিরিক্ত। এরপর পাকা রাস্তা বরাবর নেমে গেলে আশেপাশে মাঠের মাঝেই অনেক পুকুর খনন করা৷ পাকা রাস্তা ঘেঁষে সেগুলো দেখতে এতটা মনোমুগ্ধকর লাগে তা বলে প্রকাশ করার মতো না৷ শুধু চোখ জুড়িয়ে যায়। বাতাসে পুকুরের পানির স্রোত গুলো দেখতে এত সুন্দর লাগে, শুধু দেখতেই মন চাই সাথে একদম টলটলা পরিষ্কার পানি৷ পানি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে মন চাই।
‘
হাঁটতে হাঁটতে শিশিররা সে ক্যানালে এলো। এসে ব্রিজের উপর থামতেই সকলে মুগ্ধ হয়ে গেল৷ দৃষ্টি জুড়িয়ে গেল। কেউ কেউ তো বলেই ফেলল,
” কী সুন্দর পরিবেশ! এখান থেকে যেতে মন চাইছে “
বলে সব ছবি উঠাতে ব্যস্ত হলো। শশীরা হাসছে ওদের কার্বার দেখে৷ শিশির ব্রিজের উপর থেকেই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক সব দেখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। শশী বলল,
” সামনে আরো সুন্দর জায়গা পাবে, চলো”
মিহির বলল,
” তোমরা কোন সাইটে যাবে? সোজা রাস্তায় নাকি মাটির রাস্তায়? ”
কুয়াশা বলল,
” আমি তো সব দিকে ঘুরে দেখব। একদিকও বাদ রাখব না। এত সুন্দর পরিবেশ আগে জানলে কালই আসতাম। দুইদিন ধরে দেখে শেষ করতাম “
সকলে হাসল। শিশির বলল,
” কোমড় ভাঙা নিয়ে আবার শখ করতে আসিস না! তখন আমারই টানা লাগবে আলুর বস্তা”
সকলে এবার জোরে হেসে দিল। কুয়াশা ফুঁসে উঠল বলল,
” এ্যাই, আলুর বস্তা কে? তুমি বুনো ওল চুপ থাকো “
শিশির কথা বলল না। সকলে একে একে বলল আগে সোজা রাস্তায় গিয়ে ঘুরবে এরপর ডান সাইটের রাস্তা দেখিয়ে বলল এসে ঐ রাস্তায় যাবে। সকলে একমত হয়ে হাঁটতে লাগল আবার। যত যাচ্ছে তত চোখ জুড়ানো গ্রামের দৃশ্য। মিষ্টি, ফুরফুরে বাতাস৷ বাতাসে শ-শ শব্দ। ফ্রেশ নিঃশ্বাস টানছে সকলে। চলাচল রাস্তার অনেক লোকই ওদের তাকিয়ে দেখতে দেখতে চলাচল করছে৷ কুয়াশা আনন্দে ব্রিজের গড়ান রাস্তা থেকে দৌড়ে নামল। ওর ওমন দৌড়ে নামা দেখে শিশির দিল রাম ধমক,
” এ্যাই…! আবার পড়বি নাকি? তখন পড়ে কোমড় খসে নি বলে এখন খসানোর পারমানেন্ট ব্যবস্থা করতে চায়ছিস? আয় আমি খসিয়ে দিয়ে সাহায্য করছি, বে’য়াদব ”
যদিও কুয়াশা হাঁটতে গেলেও ব্যথা লাগছিল কিন্তু সে আনন্দে ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে এমনটা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। শিশিরের ধমক খেয়ে উড়নচণ্ডী ভাব বন্ধ করল। মিহির বলল,
” শিশির ভাই কুয়াশার একদম শশীর মতো স্বভাব। এটাও এমন লাফিয়ে বেড়ায় সব সময়। তোমরা আসার দুই সপ্তাহ আগে থেকে ওর ক্লাস নেয়া হয়েছে। যেন তোমরা যত দিন থাকবে উড়নচণ্ডী হয়ে না চলে। আম্মু ওর মাস্টার ছিল “
বলে শব্দ করে হাসল। উপস্থিত সকলে হেসে ফেলল। শশী কটমট করে ভাইয়ের দিকে তাকাল। নীহার বলল,
” শিক্ষিকা হিসেবে তাহলে আমার শাশুড়ী ভালোই। ভালোই ক্লাস নিয়েছেন। মেয়ে তার পরীক্ষায় পাস করেছে৷ এই জন্য বলি এই উড়নচণ্ডী ইঁচড়েপাকা দুইদিন এত শান্তশিষ্ঠ কিকরে আছে! “
সকলে হাসল তা শুনে৷ হাঁটতে হাঁটতে এমন অনেক ইয়ার্কি, ফাজলামো করল সব আর গ্রামের প্রকৃতি উপভোগ করল৷ অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে রাস্তার কোল ঘেঁষে একটা ছাউনি দিয়ে বসার জন্য চড়াট পাতা আছে। সকলে ওটা দেখে বসল সেখানে। সবার অবশ্য জায়গা হলো না৷ ছেলেরা দাঁড়িয়ে রইল। শান্ত শোভার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আসলে গল্প বললে ভুল হবে সে শোভার সাথে ফ্লার্ট করছে৷
কুয়াশারা চড়াটের উপর বসে, সামনে বড় একটা পুকুর, মাঠের বাতাস, পরন্ত বিকেল, বাতাসে পানির স্রোত, নিরিবিলি কোনো সোরগোল নেই আহ্ কী যে সুন্দর মনোরম, মনোমুগ্ধকর, রোমাঞ্চকর লাগছে! এখান থেকে আর উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছে না৷
শিশির কুয়াশার কয়েকটা ছবি তুলল৷ সকলে এক সাথে সেলফি উঠাল। এই মনোরম পরিবেশের সাথে নিজেদের ক্যাপচার করল। স্মৃতি হিসেবে রাখল৷ এমন এক জায়গায় আবার কখনো হবার সুযোগ হতেও পারে নাও পারে৷
ঐ রাস্তায় আর বেশিদূর গেল না কেউ৷ সকলে ফিরে এলো। অনেক হাঁটাহাঁটি হয়ে যাচ্ছে কুয়াশা কোমড়ের ব্যথা ফিরে আসছে৷ কিন্তু বলল না সেটা৷ সে হেঁটেই চলল৷ এসে মাটির রাস্তায় হাঁটল। মাটির রাস্তার পাশে ক্যানালের পানি বইয়ে চলে গেছে দূর বহুদূর। এর শেষ সীমানা কেউ জানে না বোধহয়। চিকন মাটির রাস্তা ডান সাইটে সারিবদ্ধ গাছগাছালি ছোট বড়৷ বাম সাইটে ক্যানালের পানি। আহ্ এই পরিবেশটাও রোমাঞ্চকর! হাঁটতে হাঁটতে সকলে বিভিন্ন গল্প করল৷ মিহির, শশী, শোভারা বিভিন্ন কথা বলল তাদের গ্রাম নিয়ে৷ অনেক দূরে গিয়ে আবার ফেরত পথে এলো। রিজভী স্মৃতি এক সাথে হাঁটছে আর নিজেদের মতো গল্প করছে৷
তুষার, তুহিন সৌরজের সাথে বাজারে গেছে। শশীদের এখানে হাট বলে।
ফিরে আবার সেই ব্রিজের কাছে এলো। বেলা গোধূলির লগ্নে এখন৷ সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। এই গোধূলির লগ্নেও কিছু সুন্দর জিনিস, মূহুর্তের সাথে পরিচয় হলো ওরা। এতক্ষণ মাঠে থাকা কৃষকরা তাদের নীড়ে ফিরছে। সাথে লাঙল সহ গরু নিয়ে৷ ইশশ কী সুন্দর যে লাগছে৷ সারাদিন খাটাখাটুনি করে এখন ফিরছে৷ অনেক রাখাল গরু নিয়ে গেছিল মাঠে তারাও ফিরছে তাদের নীড়ে।
এরপর আরো একটা সুন্দর জিনিস দেখল ওরা৷ সেটা হচ্ছে দুইটা লোক অনেকগুলো পাতিহাঁস নিয়ে ফিরছে৷ কিছু না হলেও সেখানে দু’শত থেকে আড়াইশতর বা তারও অধিক পাতিহাঁস নিয়ে আসছে৷ হাঁসগুলো একদম সারিবদ্ধ হয়ে এঁকেবেঁকে পা ফেলে দৌড়ে আসছে৷ পেছনে একটা লোক আর হাঁসগুলো সামনে একটা লোক। কিছুটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে সকলে থেমে গেল৷ কুয়াশা চোখ বড় বড় করে বলল,
” এ্যাই শশী! এতগুলো হাঁস এরকম ছেড়ে দিয়ে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল এনারা? এমন ছেড়ে দিয়েছে হারিয়ে যাবে না?”
” নাহ্, হারায় না। এগুলো খামারের হাঁস। এনারা মালিকের খামার দেখাশোনা করেন৷ আর রোজ এমন সকালে মাঠে নিয়ে যায় আর সন্ধ্যার আগে আবার নিয়ে খামারে রাখে৷ সারাদিন মাঠের, পুকুরের পানিতে থাকে আর মাঠের শামুক, ঝিনুক আরো অন্যান্য জিনিস খেয়ে বেড়ায়৷ এই সব হাঁসকে এখন আনার সময় একবার হাঁক ছেড়ে ডাকলেই চলে আসে। তারাও জানে তাদের নীড়ে ফেরার সময় হয়ে গেছে। “
মিহিরের কথা শুনে সকলের আবার মন জুড়ালো। গ্রামের এসব জিনিসগুলো সত্যি মুগ্ধকর। হাঁসগুলো কুয়াশাদের ছেড়ে যাবে তখনই কুয়াশা হাঁসের মাঝে চলে গেল দৌড়ে। হাঁসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল৷ প্যাক-প্যাক করে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। কুয়াশা হেসে কুটিকুটি হলো৷ সকলে হাসল৷ শিশির বলল,
” কুয়াশা এদিকে তাকা ”
বলতে বলতে কুয়াশার কয়েকটা ছবি উঠাল৷ হাঁসগুলোর মাঝে থেকে৷ কী দারুণ লাগল মূহুর্তটা!! শিশির হাসল। নীহার বলল,
” আমি কনফার্ম ঘরজামাই থাকছি “
সকলে এবার আরো জোরে হেঁসে উঠল। ইয়াসমিন বলল,
” তোকে কালই এখানে রেখে যাচ্ছি। নিয়ে আর যাব না “
” সত্যি, রেখে যা তোহ্। তার আগে কাজি ডেকে বিয়েটা পড়িয়ে দিয়ে যাইস “
সকলে হাসল শশীও হেসে ফেলল তা শুনে। আবারও মজা করতে করতে সব বাড়ি ফিরল।
কিছু মূহুর্ত মন জুড়ানো, কিছু মূহুর্ত চোখ জুড়ানো, কিছু মূহুর্তে হৃদয়ে, স্মৃতিতে গেঁথে রাখার মতো। আজ এই পরন্ত বিকেল থেকে গোধূলির লগ্ন পর্যন্ত মূহুর্ত গুলো তাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে গেঁথে গেল। এসব আবার হয়তো এখানে আসলে দেখা হবে কিন্তু আজ যে প্রথম বাড়ের মতো এতটা মুগ্ধতা এলো এটা দ্বিতীয়বার আর আসবে না। কথায় আছে না? প্রথম সব কিছুই সুন্দর। তো শিশিরদের সাথেও তেমনই হচ্ছে। তারা এই প্রথম যেই সুন্দর, মনোরম, মনোমুগ্ধকর, রোমাঞ্চকর পরিবেশ, প্রকৃতি, মূহুর্তের সাথে পরিচয় হলো এটা অতি, ভয়ংকর রকমের ভালোলাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়ে। দ্বিতীয়বার তা আর জায়গা করতে পারবে না।
‘
বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মাগরিবের আজান কানে ভেসে এলো৷ যারা নামাজ পড়ে তারা নামাজ পড়ে নিল। এরপর ঘরে বসল আড্ডা দিতে। কিন্তু এদিকে কুয়াশার অবস্থা বেগতিক হচ্ছে, ক্রমেই ব্যথা বাড়ছে। তার কোমড় ব্যথায় টনটন করছে ভেতরে। ঔষধ খেয়ে কমলেও বেশি হাঁটাচলা হয়ে গেছে। এখন ব্যথা ফিরে এসেছে অতিরিক্ত রূপে ধারণ করছে। বাড়াবাড়ি রকমের রূপ নিচ্ছে৷ বসতে পর্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। শক্ত মাটির উপর ঠাস করে কোমড়টা বাড়ি খেয়ে পড়েছে এটা কি কম কথা? কোমড়ের হাড়ে কতটা আঘাত লাগতে পারে! আল্লাহ রক্ষা করেছেন কোমড় ভেঙে যায়নি৷
রাতের খাবার খেয়ে সকলে বসল। কারেন্ট এখনো আজ রাতে যায় নি৷ তাই ঘরেই থাকল৷ এমন সময় কুয়াশা বার বার গুঙিয়ে উঠছে৷ ব্যথায় চোখ মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করছে। শশীরা টের পেয়ে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করতে লাগল একের পর এক৷ কুয়াশা জানাল তার প্রচুর ব্যথা করছে কোমড়ে। এটা শিশির সহ জাকিয়াদের জানানো হলো। শুনে সকলে ছুঁটে এলো। শিশির গিয়ে পাশে বসে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল। কিন্তু সে ব্যথায় কপোকাত। হানিফ সাহেব বললেন এখানে আশেপাশে চেকাপ করার জন্য কোনো ডক্টর নেই এমন ফার্মেসী ডক্টর ছাড়া। বড় ডক্টর, হসপিটাল অনেক দূরের পথ। শিশির বেশ চিন্তায় পড়ল৷ জাকিয়া একটু গরম পানি করে দিতে বলল জিনিয়াকে৷ গরম কিছুর সেঁক নিক। আর সৌরজ গিয়ে ফার্মেসী থেকে আপাতত ব্যথা নিরাময়ের জন্য ঔষধ এনে দিল। কালই চলে যাবে রাতটা কষ্ট করে কাটিয়ে দিতে পারল শহরে গিয়ে ডক্টরের কাছে নেবে জানালেন জাকির মালিথারা৷
মেয়েটার এমন জেদ, উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য শুধু অঘটন ঘটে৷ নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবে৷ শিশির অনেক বকা তো দিল কিন্তু বউয়ের জন্য অস্থিরতা কমাল না তার৷ সে নিজে পাশে বসে ব্যথা উপশমের কারণ হলো৷ এমনটা দেখে বৃষ্টি আর ইয়াসমিন গিয়ে জাকিয়াকে কিছু একটা বলল। যেটা শুনে জাকিয়ার ভালো লাগল৷ আর জিনিয়াকে বললেন শিশির আর কুয়াশাকে একটা ঘর ছেড়ে দিতে আজকের রাতটার জন্য। জিনিয়া বিষয়টা শুনে তাই-ই করলেন৷ আলাদা একটা ঘর কুয়াশা আর শিশিরকে দেয়া হলো৷
| চলবে |
ভাবনা ছিল আজকের পর্বতেই শশীদের বাড়ির কাহিনী শেষ করব। কিন্তু হয়ে উঠল না৷ গ্রামের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে পর্বটা বড় হয়ে গেল৷
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click