®রোজা রহমান
‘
সময় এবং স্রোত বহমান। দেখতে দেখতে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেড়িয়ে একের পর এক দিন চলে যায়। মানবজীবনের দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে একের পর এক একটি দিন। তেমনিভাবে মালিথা ভিলা প্রত্যেকটি সদস্যের জীবনে চলে গেছে কয়েকটা দিন। প্রতিনিয়ত চলতে থাকা নিয়মের মাধ্যমেই দিনগুলো পাড় হয়েছে তাদের। শিশির, কুয়াশার নিয়ম মাফিক ঝগড়া আর ভালোবাসা দিয়ে চলে গেছে কয়েকটাদিন। আগামীকাল থেকে শিশিরের পরীক্ষা। সে বউয়ের বর্তমান দায়িত্ব সহ ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেবার তোড়জোড় করছে। এখন দায়িত্ব পালন করছে বউয়ের ভালো মন্দ খেয়াল রেখে, অসুস্থতার সেবা করে। আর ভবিষ্যত দায়িত্ব নেবার জন্য ক্যারিয়ারের পেছনে পড়েছে। দুই কাজ সে সুন্দরভাবে সামলাচ্ছে।
কুয়াশার এই কয়দিনে ব্যথাটা কমে গেছে। এখন আর ব্যথা আসে না। তবে খুব বেশি হাঁটা চলা করেনা। শিশিরের শাসনে সে তিড়িং বিড়িং করতে পারে না। নিচে এই কয়দিনে সে নামে নি। ঘরে থেকে থেকে তার মন মস্তিষ্ক খিটখিটে হয়ে গেছে। সেটার জন্য শিশিরকে আচ্ছা মতো ধুয়ে দেয়। তাতে শিশিরের কোনো পাত্তা পায়না। তার বকবক করার দরকার সে করে ওদিকে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বাড়ির সদস্যরা এসব দেখে হেসে কুটিকুটি হয়। মাশাআল্লাহ বলতে দ্বিধাবোধ করে না। তাদের সেই ছোট থেকে একে অপরকে খামচা-খামচি করা দুই হাম সেপাইরা আজ নিজেরা একে অপরের প্রতি যত্নশীল। মিষ্টি সম্পর্ক তাদের। তারা কোনো ভুল করেননি।
আজমিরা এসব দেখেন আর আলহামদুলিল্লাহ পড়েন। তার মেয়ের রাজ কপাল। চোখের সামনে বড় হওয়া ছেলেকে নিজের মেয়ের জন্য পেয়েছেন৷ জাকির, জাহিদ মালিথার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলেন না।
‘
শিশির গোসল করে বের হলো। দুপুর বারটা বেজে গেছে। জুম্মার নামাজে যাবে সে। ঘরে বিছানায় কুয়াশা বসে আছে। চোখ ছোট ছোট করে নখ খুঁটছে আর চেয়ে আছে। একটু আগে তার প্যানপ্যানানি বন্ধ হয়েছিল। শিশির বেরোতেই আবার শুরু হলো। শিশির চুল মুচছে আর হাঁটছে। শরীরে শধু সাদা পাজামা৷ শিশিরের অসহ্য ধরে গেল। চোখ মুখ কুঁচকে দিল একটা রাম ধমক। বলল,
” এ্যাই, গোবর ঠাঁসা! সমস্যা কিরে তোর? সুখে খেতে ভূতে কি-লাই তোরে?”
কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” এ্যাই… বুনো ওল! আমি আমার মুখে বকবক করছি তাতে তোর কী?”
শিশির তুই বলতে শুনে রেগে গেল। এগিয়ে গিয়ে কুয়াশার মাথার উপর চাটি বসাল চুল ধরে টেনে দিল। বলল,
” তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। তুই তুকারি করলে এখানে মে-রে আধমরা করে হসপিটালে পাঠাব বে-য়াদব! “
কুয়াশা মাথায় লাগাতে ‘আহ্’ শব্দ করে চেঁতে উঠল। বলল,
” হ্যাঁ নিজের মতো শুধু পারো তো মা-রতে আর সিদ্ধান্ত চাপাতে। আমি বাইরে যাব বলছি সেটা কানে যাচ্ছে নাহ্ তোমার? “
” তোকে ধরে রেখেছি আমি? তোর ইচ্ছে তুই যা আমাকে জিজ্ঞেস করতে আসছিস কেন? “
এইযে এই একটা উত্তরই তিনি তখন থেকে দিয়ে যাচ্ছেন। তার যে এই উত্তরটা ত্যাড়াব্যাকা মাম্মি সেটা কী আর কুয়াশা বুঝছে না? অবশ্যই বুঝছে৷ যেতে দেবে না বলেই এমনভাবে বলছে। কুয়াশা বলল,
” এ্যাই তোমার ত্যাড়াব্যাকা মাম্মির কথার ধরণ রাখো তোহ্! ভালোভাবে যাবার কথা বলো। আমি কতদিন নিচে যাই না। তোমার একটু মায়া হওয়া উচিত “
” আচ্ছা তাই? “
শিশির কুয়াশার দিকে ঝুঁকে বলল কথাটা। সে আবার বলল,
” সকলে তোর ভালো চাচ্ছে বলে তোর আহ্লাদ বেড়ে যাচ্ছে নাহ্?”
এই কথার প্রেক্ষিতে কুয়াশা এবার আহ্লাদীর ভোল ধরল। সে শিশিরের নগ্ন শরীরটার কোমড় জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। শিশির ভ্রু কু্ঁচকে মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে নিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল। কুয়াশা মাথা উঁচু করল। তাকাল শিশিরের দিকে। শিশির ভ্রু কুঁচকে রেখে কিছুটা বিরক্ত ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বলল,
” আহ্লাদ করে কি হবে? “
” নিচে যেতে পারব “
শিশির এবার না হেসে পারল না। কুয়াশার কথাতে শব্দ করে হেসে ফেলল। কুয়াশা তার চিবুক শিশিরে পেটের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। সেও মিটমিট করে হাসছে। আজ কাল তার স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য আহ্লাদী ভোল বেশ ভালোই ধরে সে। শিশির হেসে নিয়ে বলল,
” কত বড় ফাজিল এটা ভাবা যায়!”
কুয়াশা মুখটা আম সত্ত্বর মতো করে ফেলল৷ মাথাটা তুলে শিশিরের হালকা ভেজা নগ্ন লোমশ বুকের উপর চুমু দিল একটা৷ শিশির তাকিয়ে রইল। মনে মনে সে হাসছে। কিন্তু মুখে কাঠিন্যতা৷ কুয়াশা তাকিয়ে দেখল স্বামী তার এখনো গলে নি। সে আবারও চুমু দিল একই জায়গায়, একই ভাবে। তবুও গলল না শিশির। শিশিরই কী কম ভোল জানে? সেও বউয়ের এই ছোট ছোট আহ্লাদীপনা আদর নেবার জন্য একই রকম রইল। কুয়াশা আবার আরো একটা চুমু দিল। পর পর তিনটা চুমু দিয়ে এবার আগের ন্যায় শিশিরের পেটের উপর চিবুক রাখল। বলল,
” এ্যাই দাও না অনুমতি! আজই যাব আর যাব না৷ শুক্রবারের দিন সকলের সাথে বসে খাব। প্লিজজ “
শিশির বউয়ের দিকে তাকাল। চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এবার সে তোয়ালে বিছনার উপর রেখে একহাত কুয়াশার কাঁধে রাখল আর একহাতে কুয়াশার কানের পিঠে চুল গুঁজতে গুঁজতে বলল,
” যাহ্ গোসল করে নে৷ নামাজ থেকে এসে নিচে একসাথে বসে খাব “
কুয়াশা শুনে আনন্দে হেসে উঠল৷ এই ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব আনন্দ দেয়। কী সুন্দর মূহুর্তটা তাই না? বউ তার স্বামীর কাছে আহ্লাদ করে আবদার করল আর স্বামী তার আহ্লাদী বউয়ের আহ্লাদটা মানল, পূরণ করে দিল। এমনই তো করা উচিত। স্বামী স্ত্রীর মাঝের এই জিনিস গুলো কত্তো মধুর মিষ্টি হয় ধারণা করা যায়!
কুয়াশা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠে দুই হাঁটুটে ভর দিয়ে বিছানার উপর থেকেই শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে টুপ করে গালে আরেকটা চুমু দিল। শিশির শব্দহীন হাসল বলল,
” ব্যাপার কী বলত? আজকাল তুই কামড়ের বদলে চুমু দিস কেন? মতিগতি কি তোর? ”
কুয়াশা গলা ছেড়ে দিয়ে মেকি রেগে উঠে ঝাঁঝ নিয়ে শিশিরকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,
” এ্যাই, সরো তোহ্! আর আদরই দিব না তোমাকে। মানুষের ভালো করতে নেই। হাহ্, আদর দিচ্ছি বলে তেল হয়ে যাচ্ছে! বুনো ওল একটা “
বলে সে নামতে লাগল।
” এ্যাই, এসব কী ভাষা তোর? আর আদর দিয়ে আমার কী ভালো করছিস তুই? “
” হ্যাঁ ভালো করছি না তো। সেই জন্যই তো নিজেও বউয়ের আদর নেবার জন্য ভোল ধরে থাকো, যত্তসব বুনো ওল মার্কা লোক”
উচিত কথা পেয়ে শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কথাটা মিথ্যা না। তবুও দমল না সে। বলল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা! তোর আদর নেবার জন্য আমি শিশির ম-রে যাচ্ছি? “
” হ্যাঁ ম-রবা কেন তুমি শিশির? মরছ না তোহ্! সে তো নিজে বিয়ের আগেও বলেছিল, ‘এ্যাই গোবর ঠাঁসা! তোকে বিয়ে করার জন্য আমি শিশির ম-রে যাচ্ছি?’ অথচ এখন এই গোবর ঠাঁসার নেক স্মেল না নিলে তার ঘুম হয় না। যত্তসব ঢং! “
কুয়াশা ঝগড়া করছিল আর জামা বের করছিল। জামা বের করে নিয়ে ধেই ধেই করে বাথরুমে ঢুকে গেল। ধারাম দিয়ে দরজা বন্ধ করল। শিশিরের ঘরে গোসল করে এখন আগে করত না। ও ঘর থেকে সব জিনিস না আনলেও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আর কয়েকটা ড্রেস এনে রেখেছে।
এদিকে শিশির আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। মনে মনে একটা কথায় ভাবল,
” তার বউটা এত ঝগড়ুটে কেন? “
বেচারা। কী সুন্দর বউটার আদর পেল অথচ আবার ধুয়ে দিয়েও গেল! কী একটা জ্বালা তার! বউ তার এই রোমান্টিক মুডে থাকে আবার তৎক্ষনাৎ ঝগড়ুটে মুডে চলে যায়। তার হয়েছে যত দুনিয়ার জ্বালা। বিরক্ত নিয়ে পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে চেঁচিয়ে কিছুটা বাথরুমের কাছে গিয়ে বলল,
” গোবর ঠাঁসা, ধেই ধেই করে চলছিস ভালো কথা। সিঁড়ি দিয়ে এমন ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে নামতে গিয়ে আবার যদি কিছু ঘটিয়েছিস তো তোর খবর আমি শিশির নিজে করব এবার। মনে রাখিস!”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। শিশির নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচে নেমে গেল।
__________
দুপুর দুটো। নামাজ শেষ করে সকলে মাত্র এলো। আজ জাহিদ মালিথা নেই। তিনি এই সপ্তাহে আসেননি। মসজিদের জিলাপি হাতে সকলের। নীহার কুয়াশাকে ডাকল,
” কুশু..! “
কুয়াশা নিচে ডাইনিং রুমে সেটা তারা দেখেই ডাকছে। জাকির মালিথা ডাকলেন,
” কুহেলি মা!”
কুয়াশা ডাক শুনে। দ্রুত পায়ে এলো। এসে দেখল জিলাপি। আগের সেই স্বভাব তার এখনো রয়ে গেছে। যেই সপ্তাহে জিলাপি আনবে চাচুরা, ভাইরা সেই চিলের ন্যায় দৌড় দেবে৷ সেটা আজও করল। যেই না দৌড়ে আসতে গেল ওমনি খেল ধমক। সেটা অবশ্যই শিশির দিয়েছে। ধমকে বলল,
” এ্যাই ফা-জিল! দৌড়াচ্ছিস কেন ওমন? কোমড় আবার ভাঙতে সাহায্য করব আমি?”
কুয়াশা ধমক খেয়ে দমল একটু। জাকির মালিথা বললেন,
” ওরকম দৌড়াচ্ছিস কেন মা? আবার সমস্যা হবে। মেনে চল। “
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে শ্বশুরের হাত থেকে জিলাপি নিয়ে নিল। একে একে তুহিন, তুষার, নীহারের হাত থেকে নিল। কিন্তু শিশির তাকে আজোও জিলাপি দেয় না। এই জিনিসটার কোনো পরিবর্তন আনেনি সে৷ হিমও দেয় না৷ শিশির আর হিম আয়েশ করে সোফায় বসে খেতে লাগল৷ শিশির এক কামড় দিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল। সে তীক্ষ্ণ চোখে শকুনের ন্যায় শিশিরের জিলাপি ও জিলাপি খাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। যেন এখন চিলের ন্যায় ছো মা-রবে। আর করলও তাই। শিশির মাত্র একটা জিলাপিতে এক কামড় দিয়েছে। দিয়ে সেটা চিবিয়ে মাত্রই আরেক কামড় দেবার জন্য ঠোঁটে ঠেকিয়েছে ওমনি কুয়াশা ঝড়ের বেগে এসে তুফানের ন্যায় কেঁড়ে নিল শিশিরের হাত থেকে জিলাপি। সকলে দেখে মিটমিট করে হাসছে। শিশির আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। কুয়াশা মুখ ভেঙচিয়ে শিশিরের খাওয়া জিলাপিটায় কামড় দিতে দিতে চলে গেল ডাইনিং রুমের দিকে। সে এখন জা’য়েদের সাথে বসে খাবে। বৃষ্টি ইয়াসমিন ডাইনিংয়েই আছে।
কুয়াশা এমন করেই এখন থেকে জিলাপি কেঁড়ে নেয়। শিশির দেবে না তো কী হয়েছে? সে তার অধিকার বুঝে নিতে যানে এবং নেয়ও। আগের মতো হলে কী এটা করতে পারত? নাকি শিশিরই মানত? চুল ছিঁড়া ছিঁড়ি বেঁধে যেত নির্ঘাত! বিয়ের পর থেকে কুয়াশা শিশিরের থেকে কেঁড়ে চুড়েই খায়। শিশির এটা নিয়ে কিছু বলে না। সে হয়তো চায় তার বউ তার উপর অধিকার খাটাক। অধিকার দেখিয়ে তার অধিকার বুঝে নিক।
একদিন এমন করাতে কুয়াশা জিলাপি কেঁড়ে নিতে নিতে বলেছিল,
” আমি যেমন তোমার অধিকার তেমন-ই তুমি এবং তোমার জিনিস আমার অধিকার। আর এই জিলাপি আমার অধিকারের অধিকার “
কথাটা মনে করে শিশির অমায়িক হাসল। বউটা তার কথার উপর মাত ভালোই দিতে পারে। দিবেই তো তার আহ্লাদী বউটা যে ভবিষ্যত লয়ার!
একে একে সোফায় বসল পুরুষগুলো৷ নীহার গিয়ে শিশিরের গা ঘেঁষে বসল। মিটমিট করে হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বলল,
” তোর চালাকি আমি ধরে ফেলেছি বুঝলি! তুইও চাস কুশু তোর থেকে কেঁড়ে নিয়েই খাক। এই জন্য ওকে আগে থেকে দিস না। যদি তোর দেবার ইচ্ছে না থাকতো তো এতক্ষণ চুলোচুলি করতি দু’টো। “
শিশির নীহারের কথাগুলো ওর দিকে তাকিয়ে শুনছিল। এবার কথাগুলো শুনে মুচকি হেসে সোফায় গা এলিয়ে দিল। কোনো উত্তর করল না। নীহার তার ভাইয়ের ভাব ভঙ্গিতে বুঝে গেল ওর কথায় সত্য। হাসল মুচকি নীহারও। কতটা পরিবর্তন সম্পর্ক ভাবা যায়! বিয়ের বন্ধন বলে কথা!
‘
খাবার টেবিলে। বাড়ির তিন গিন্নি বাদে সকলে খাচ্ছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিন, কুয়াশা সকলের সাথে বসেছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিন এখন সময় অসময়ে সকলের সাথে বসে খায়। কুয়াশা এখন আগের মতো মেয়ে হিসেবে বেশি চলে না। সে নিজে থেকেই চলে না। ভালোবাসা, আদর এক থাকলেও সে নিজেকে এই বাড়ির বউ মনে করে। তাই দুই জা’য়ের সঙ্গে বেশি তাল মিলায়। তার জ্ঞানবোধ সত্যি আলাদা৷ সে চায় আর দুটো জা যেন এসব নিয়ে মন খারাপ করতে না পারে। তার প্রতি ধারণা যেন না পাল্টায় যে, সে-ও তো এখন এই বাড়ির ছেলের বউ। তার কদর এত কেন এ বাড়িতে তাদের থেকে? এমন ধারণা পাল্টানোর জন্যই কুয়াশা নিজেকে বাড়ির বউয়ের মতোই রাখার চেষ্টা করে। তবে মেয়ের মতো সকলে এখনো দেখলে বৃষ্টি, ইয়াসমিন এ নিয়ে কখনো কিচ্ছু মনে করে না। তারা বুঝে কুয়াশা সর্ব প্রথম এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে ছিল এখন বউ হয়েছে। কুয়াশার বিষয়টা একদম আলাদা৷ কুয়াশার জন্য তাদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। শ্বশুর,শাশুড়ীরা যথেষ্ট আদর করেন তাদের। আসলে বৃষ্টি, ইয়াসমিনের মতো জা, বউ, ছেলেবউ, ভাবি পাওয়াটাও ভাগ্যার বিষয়।
খাবার সময় আজ কাল কুয়াশা শিশির এক জায়গাতেই পাশাপাশি বসে। আজ শুক্রবার নিয়ম মাফিক ভালো ভালো সুস্বাদু খাবার রান্না হয়েছে। খাসির মাংস, মাছের মাথা তো আছেই সেই সাথে। যেগুলো শিশির কুয়াশার পছন্দের। এখনো এই বাড়িতে দুইটা করে মাথা রান্না হয়৷ কারণ এরা ভালোবাসার ভাগ দিতে রাজি সবতারই ভাগ দিতে রাজি কিন্তু মাছের মাথার ভাগ দিতে একদম নারাজ। মূলত প্রিয় খাবারের থেকে দু’জন দু’জনের ভালোবাসা দূরে রাখে। খাবারের কাছে কোনো আত্মীয়তা চলবে না। নিজেদের পছন্দের খাবারে এক চুল পরিমাণ ভাগ দিতে নারাজ তারা। এটা নিয়ে একদিন বেঁধেছিল। জাকিয়া কী মনে করে যেন একটা মাথা রেখেছিল। ওমনি শুরু হয়ে গেছিল। সেটা বেশি দিনের ঘটনা না অবশ্য। যায়হোক আজ আবার টেবিলে খাসির মাংস নিয়ে কাঁড়া-কাঁড়ি চলছে।
জাকির মালিথা সহ সকলে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। এদের এই অভ্যাস কী জীবনেও যাবে না? আজমিরা ধমক দিলেন কুয়াশাকে। কুয়াশা ধমক খেয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কু্ঁচকে খাবারে মন দিল। মনে মনে ভেবে রাখল ঘরে গিয়ে হবে এটার শেষটুকু অর্থাৎ যুদ্ধ।
__________
কেটে গেছে আরো সপ্তাহ খানেক। শিশিরের নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে৷ সে পড়াশুনো নিয়ে একটু ব্যস্ত। এদিকে কুয়াশারও পরের মাস থেকে সাময়িক পরীক্ষা।
আগামীকাল শিশিরের পরীক্ষা আছে। রাত এগারটা। কুয়াশা নিজের পড়া পড়ে এসে শুতে এলো। সে শুয়ে শুয়ে টুকটাক পড়াশুনো করছে বাড়িতেই৷ কলেজে যায় না। স্মৃতি, ঈশার থেকে নোট’স নিয়ে নেয়। স্মৃতিরা দুইদিন করে এসে কুয়াশাকে দেখে গেছে।
ঘরে এসে দেখল শিশির ঘাড় ম্যাসাজ করছে। হয়ত বসে থাকতে থাকতে ঘাড় ধরেছে। কুয়াশা এগিয়ে এসে তার নরম, কোমল হাতে আঙুল দিয়ে বিনা বাক্যে ঘাড় সহ পিঠ ম্যাসাজ করতে লাগল। একজোড়া কোমল, চিকন ছোট ছোট হাতের স্পর্শ নিজের ঘাড়ে পেয়ে শিশিরের হাত থেমে গেল। সে পিছন ঘুরে দেখল কুয়াশাকে। কুয়াশা অমায়িক হাসল৷ শিশির বলল,
” শুয়ে পর তুই। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। “
সে কথার উত্তর করল না৷ ম্যাসাজ করতে করতে বলল,
” কফি খাবে? “
” তোকে অত পাকনামি করতে হবে না। এখনো সম্পূর্ণ দুই সপ্তাহ হয়নি। অত সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে না ঘুমো গিয়ে। “
” এত বেশি কথা বলো কেন? বসো আমি আম্মুকে দিয়ে বানিয়ে আনছি “
বলে চলে যেতে নিলে শিশির আঁটকে দিল। বলল,
” লাগবে না”
বলে হাত ধরে কোলের উপর বসাল৷ সে চেয়ারে বসে। কুয়াশা বলল,
” কফি খেলে ভালো লাগত। অনেক রাত জাগো।”
” মাঝে মাঝে অবাক হই ভিষণ রকম। যে এটাই কী সেই কুয়াশা নাকি আমি ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়ি রোজ রোজ? “
কুয়াশা খিলখিল করে হাসল৷ শিশিরের নাকে নাক ঘষে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে বলল,
” আমার নিজেরও তাই মনে হয়। যে এই বাড়িতে মনে হয় আমি ভুলে বসবাস করছি। “
শিশির নিঃশব্দে হাসল। মানতে তারও দুই একসময় কষ্ট হয় যে এই মেয়েটার সাথে সে এখন সংসার করছে? যাকে চুল পরিমাণ সহ্য হতো না! ভেবে আপনমনে আবার হাসল৷ সময় কথা বলে কিনা!
সে কুয়াশার কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” এ্যাই..! কবে সুস্থ হবি রে তুই? “
কুয়াশা শিশিরের কথার মর্মার্থ বুঝে বুকে কপাল ঠেকিয়ে দিল৷ লজ্জা মাখা হাসি দিল লুকিয়ে৷ বলল,
” সুস্থ আমি। অথচ তোমার কাছে অসুস্থ। এত ভালোবাসলে কেন আমায়! “
শিশির মুচকি হাসল। আগের ন্যায় স্বরে বলল,
” আরো সুস্থ হ। সে দিনের অপেক্ষা করছি। “
কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাথা তুলে। শিশির হাসল। বলল,
” যাহ্ শুয়ে পর। “
” তুমিও শুবে চলো “
” আসছি একটু পর “
কুয়াশা নেমে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শিশির আরো কিছুক্ষণ পড়ে উঠে পড়ল৷ লাইট অফ করে কুয়াশকে কাছে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল। কুয়াশা ঘুমই এসে গেছিল। শিশিরের স্পর্শ পেয়ে ঘুম হালকা করে শিশিরের হাতের উপর হাত রাখল। সে কুয়াশার গলার মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে। কুয়শার এটা কেন যেন শিশিরের সাথে সাথে নিজেরও অভ্যাস হয়ে গেছে। একদম বদ অভ্যাস যাকে বলে।
_________
কেটে গেল আরো কয়েকটা সপ্তাহ। মাসের নামও পরিবর্তন হয়েছে। অক্টোবর মাসের অর্ধেক হয়ে এসেছে। কুয়াশার পরীক্ষা চলছে। তিনটা হয়ে গেছে।
সকালের খাবার খেয়ে শিশির, কুয়াশা চলে গেল পরীক্ষা দিতে। শিশিরের পরীক্ষা আজ হয়ে গেলে থাকবে আর একটা।
‘
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শিশির আর রিজভী পরীক্ষার হল থেকে বের হলো। দু’জনে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছে। কিছু ইম্পরট্যান্ট কথাও বিনিময় করছে৷ কথার মাঝে রিজভী পকেট থেকে ফোনটা বের করল। পরীক্ষার হলে ফোন সাইলেন্ট রাখে। এখন জেনারেল মোড করার জন্য ফোনটা বের করল। আর বের করে ফোনটা অন করতেই ফোনের স্কিনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল। শরীরও ঝাকানি দিল। ফটাফট ফোনের লক খুলতেই আকাশ ভেঙে পড়ল যেন তার মাথায়৷ শরীরে কিছু একটা চাপা পড়ল। বুকে কিছু একটা বাড়ি দিল।
শিশিরও রিজভীর ফোন বের করতে দেখে ওর ফোনও জেনারেল মোডে দেবার জন্য বের করতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। লক খুলতেই সে-ও হতবাক হয়ে গেল। কুয়শা, নীহারের কল, মেসেজে ভর্তি! তড়াক বন্ধুর দিকে তাকাল। যা ভেবেছে তাই। ডেকে উঠল বন্ধুকে,
” রিজভী..! “
রিজভী চোখ তুলে তাকাল। নির্জিব চোখ তার। ছলছল করছে যেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। শরীর ভেঙে আসছে তার। শিশির তড়াক করে রিজভীকে আগলে ধরল। রিজভী বিরস বদনে ডেকে উঠল,
” দোস্ত “
” কিছু হবে না। আমি আছি তো তোর সাথে! সব হ্যান্ডেল করব আমরা। চল আমার সাথে।”
রিজভী কিছুই বলতে পারল না। তার মাথায় শুধু একটা জিনিসই বাড়ি দিচ্ছে। শিশির তৎক্ষনাৎ নীহারকে ফোন করে বলে দিল কুয়াশাকে নিয়ে আসতে। আর বাইকে ওঠার আগে তুষারকে বলে সব বুঝিয়ে রাখল। প্রয়োজনে আইনের ব্যবস্থা নেবে তবুও বন্ধুকে কষ্টের ভাগিদার হতে দেবে না৷ তার একমাত্র কলিজার টুকরো বন্ধু। ছোট থেকে একসাথে। বন্ধুর থেকে ভাই বললেও কম হবে। সেই বন্ধুর জন্য সে সব করতে পারবে। তার বিপদে আপদে সব সময় এই বন্ধুকে পেয়েছে সে।
শিশির বলল,
” দোস্ত নিজেকে সামলা আর মন দিয়ে বাইক চালাবি, ওকে? “
রিজভী সম্মতি দিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। শিশিরও স্টার্ট দিল দু’জন বাইক নিয়ে তড়াক বেড়িয়ে গেল ক্যাম্পাস থেকে।
| চলবে |
সাসপেন্স
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click