| প্রথমাংশ
®রোজা রহমান
‘
সকাল ছয়টার দিকে শিশিররা উঠে নাস্তা করে নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। শিশির কুয়াশাকে নিয়ে চলে যেতে চাইছে৷ রিজভীকে রেখে যেতে চেয়েছে। কিন্তু রিজভী জানিয়েছে এক সাথেই রওনা হবে।
এদিকে স্মৃতির বাড়ির সকলে নতুন জামাইকে এখনি যেতে দেবেন না৷ একটু জামাই আদর না করলে চলে? শিশিরকেও সেই সাথে যেতে দিলেন না। জানালেন প্রয়োজনে দুপুরের খাবার খেয়ে সকলে যাবে। শিশির এত জোড়াজুড়িতে মানতে বাধ্য হলো। দুপুরের খাবার খেয়েই যাবে।
‘
সকালে স্মৃতি উঠে সেই যে বেড়িয়েছে আর ঘরেই আসেনি বেচারি। রিজভী বেচারা ঘরে বসে একা একা ভাঁ-ভুঁ করছে। শেষে না পেরে নতুন জামাই একাই বেড়িয়ে এলো বসার ঘরে। সেখানে শিশিরকে পেল। কুয়াশা নেই। হয়তো স্মৃতির সাথে। রিজভীর পরনে এখনো লুঙ্গি। শিশির পাল্টে ফেলেছে। শিশির বন্ধুকে দেখে অমায়িক হাসল। কতটা খুশি তার বন্ধু! এই আনন্দটা যে নিজের চোখে দেখতে পারছে এতেই সে আনন্দিত। শিশিরের সাথে রনি সহ স্মৃতির ছোট ভাই বসেছিল। রিজভী গেলে রনি উঠে শিশিরের পাশে জায়গা করে দিল। দুই বন্ধ হেসে হেসে কথা বলতে লাগল৷ শিশির আস্তে করে বলল,
” কংগ্রেস দোস্ত, নতুন জীবনের সূচনার জন্য “
রিজভী অমায়িক হেসে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিল। বলল,
” তুই না থাকলে বোধহয় কিছুই সম্ভব হতো না। কৃতজ্ঞ তোর উপর। যদিও বন্ধুত্বের মাঝে এসব চলে না তবুও আমি কৃতজ্ঞ “
” ধুরর, এসব আমার হাত না। সব আল্লাহ্’র ইচ্ছে। আমি তো অছিলা মাত্র!”
রিজভী কিছু বলল না এ নিয়ে। শিশির এবার ও’কে জ্বালানো ধরল৷ বলল,
” শ্বশুরবাড়িতে লুঙ্গি পড়ে বাসর কীরকম হলো তোর? চিহ্ন কিন্তু গলার নিচে আমি স্পষ্ট দেখে ফেলেছি!”
রিজভী এবার হেসে ফেলল। সেদিন ও বলেছিল বলে এই ফাজিলটাও সুযোগ নিচ্ছে৷ শিশিরও হাসল। বন্ধুকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল। রিজভী বলল,
” সব থেকে সুখী মনে হচ্ছে “
” ইনশাআল্লাহ, আজীবন থাকবি “
রিজভী আবার হাসল বন্ধুর কথায়। কপাল করে পেয়েছে সে বন্ধু।
‘
সকাল দশটার দিকে স্মৃতির দেখা পেল রিজভী। সে ঘরে চলে এসেছে। স্মৃতি সকালের নাস্তার সময়ও আসেনি সামনে। আশ্চর্য! এত লজ্জা কোথায় পায় এই মেয়ে জাতি?
‘
দুপুরের খাবার দাবারের পর্ব শেষ করে রিজভী সহ শিশির, কুয়াশা বের হলো৷ রিজভী স্মৃতির থেকে বিদায় নিয়ে আসছে, সে এখনো ঘরে। শিশির কুয়াশা বসার ঘরে আছে। কিছুক্ষনের মাঝে রিজভী চলে এলো। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। স্মৃতি বাড়ির নিচে অবধি কুয়াশার সাথে গল্প করতে করতে এলো। কুয়াশা স্মৃতির থেকে বিদায় নিয়ে শিশিরের বাইকে উঠে পড়ল৷ রিজভী বাইক স্টার্ট দিয়ে স্মৃতির দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা মুচকি হাসি দিল৷ স্মৃতিও ফেরত দিল স্বামীকে অমায়িক হাসি৷ বিদায় নিল৷
বাইকে উঠে শিশিরকে কুয়াশা ধরল। কুয়াশা আজকাল অবাধ্য হয় খুব৷ শিশিরকে জ্বালানোর জন্য বাইকে বসলেই পেট চেপে ধরে যেটা শিশিরের একদম পছন্দ না৷ ধমক যে কতবার করে খায় তবুও ধরবে সে। আজও ব্যতিক্রম হলো না।
” গোবর ঠাঁসা, ছাড়বি? “
ধমক খেয়ে হেসে কাঁধ ধরল সে। এরপর চলে গেল সকলে। ওরা চলে যেতেই স্মৃতি বাড়ির ভেতর চলে গেল।
_________
চলে গেছে সপ্তাহখানেক৷ আজ রবিবার শিশিরের পরীক্ষা আছে। কুয়াশার নেই। কুয়াশার গতকাল শেষ হয়েছে পরীক্ষা। এদিকে গতকাল বাড়িতে শিশির জানিয়েছে দুইদিন পর কুয়াশাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। এতে কেউ দিরুক্তি করেনি৷ বরং খুশি হয়েছে সকলের কাছে দ্বিধা ছাড়া ঘুরতে যাবার কথা জানানোতে। ঘুরে আসুক দু’জন। জোরজবরদোস্তিতে বিয়ে দিয়ে সকলে চিন্তায় ছিল যেমন, এখন সব চিন্তা দূর হয়েছে। জাহিদ মালিথা গতকাল বাড়িতে ছিলেন। শুনে তিনি নিজে টাকা দিবেন জানিয়েছেন শিশিরকে। সকল ঘুরাঘুরি, থাকার জন্য উপহার হিসেবে। তুষার শুনে তুষারও দেবে বলেছে। তুহিন দিতে চাইলে জানিয়েছে এতোর প্রয়োজন নেই৷ চাচু, তুষার যা দিয়েছে তাতেই হয়ে যাবে।
‘
সকালের খাবার খেয়ে উঠে শিশির ঘরে গেল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে। কুয়াশাও একসাথে খেয়ে উঠে শিশিরের পেছন পেছন গেল। গিয়ে দেখল শিশির বেড়িয়ে যাচ্ছিল। কুয়াশাকে দেখে থামল শিশির। দরজার কাছে থেকে টেনে নিয়ে দূরে দাঁড়াল। এক হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে মিশিয়ে নিল। কুয়াশা নির্বিকার। শিশির বলল,
” সব গোছগাছ শুরু করে দে আহ্লাদী বউ। বড্ড তাড়া আমার “
কুয়াশা লজ্জা পেল। দুই পা উঁচু করে শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরল। বলল,
” বড্ড অধৈর্য হচ্ছ যে?”
” হব না বলছিস? “
” উহু, আরো হও “
কুয়াশা দুষ্টু হাসি মুখে সাথে লজ্জা। আর মুখে শিশিরের দুষ্টু হাসি। কুয়াশার কথা শুনে দুষ্টু হাসল৷ নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
” আমার আহ্লাদী বউটা বড্ড চালাক! “
কুয়াশা খিলখিল করে হেসে দিল। শিশিরের মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে কপালে চুমু দিল। বলল,
” এত দিনে বুঝলে তা? যাও লেট হচ্ছে। আল্লাহ সব ভালো করুক। পরীক্ষা ভালো করে দিয়ো “
” ওরে পাকনা রে..! “
কুয়াশা আবার হাসল। শিশির তার আহ্লাদী বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে ছেড়ে দিল। বলল,
” আসছি “
” সাবধানে যাবে “
” হুঁ “
বলে শিশির চলে গেল৷ কুয়াশা এসে শুলো বিছানায়।
__________
দুপুর তিনটার পর ইয়াসমিনের ফোনে কল এলো তুহিনের ফোন থেকে। সে ঘরে ছিল। ফোন ধরতেই যা শুনল তার মাথা চক্কর দিল। হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু করল। চোখ ছলকে পানি এলো। তৎক্ষনাৎ শাশুড়ীকে কল করল। আম্বিয়া শুনে বলে দিলেন আজমিরাকে জানাতে জাকিয়াকে না জানাতে। আর তিনি এখনি আসছেন ছুটি নিয়ে। ইয়াসমিন সেটায় করল। গিয়ে আগে আজমিরাকে বলল,
” ছোট আম্মু বড় চাচু মেজর স্ট্রোক করেছেন। খুবই ক্রিটিকাল অবস্থা “
আজমিরা শুনে চমকে উঠলেন। তারও হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো। এদিকে কুয়াশা বসার ঘর থেকে শুনে চেঁচিয়ে উঠল। সাথে সাথে কান্না করে দিল৷ আর ওর জন্যই বৃষ্টি, জাকিয়া জেনে গেল৷ জাকিয়া শুনে অজ্ঞান হবার জোগার। দম ফাটা কান্না শুরু করলেন। বৃষ্টির শরীরের অবস্থা জেনে জানানোর পক্ষে ছিল না ইয়াসমিন। কিন্তু সকলে জেনে গিয়ে একটা বিশ্রি পরিস্থিতি হয়ে গেল। ইয়াসমিন জাকিয়াকে ধরল। এদিকে আজমিরা কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে সহ জা’কে সামলাতে হিমশিম খেয়ে উঠতে লাগলেন। বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে শাশুড়ীকে থামাতে লাগল৷ মানে সকলের কান্নাতে হাসি-খুশি মালিথা ভিলা পর্যন্ত কেঁদে উঠল।
নীহার ক্যাম্পাসে ছিল। তুহিন ফোন করাতে সে তৎক্ষনাৎ ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে বাড়িতে চলে এসেছে। বাড়িতে এসে বাড়ির অবস্থা দেখে সে নাজেহাল হয়ে উঠল। কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে সে? এদিকে তুষার ডিউটিতে সেখানে গেছে কিনা জানা নেই। আর গেলেও তারও যেতে হবে। শিশির পরীক্ষার হলে, বাবাও গতকাল চলে গেছে। তুহিন যদি একা হয় তো একা তুহিন কি করবে? নীহারের ওখানে যেতে হবে। সে একাও যাবে না ভাবল। ইয়াসমিনকে বলল,
” ইয়াসমিন তুই আয় আমার সাথে। ওদিকে প্রয়োজন হতে পারে৷ “
ইয়ামিন সম্মতি দিল। জানাল বোরকা পড়ে আসছে। এদিকে কুয়াশা শুনে সে জেদ ধরল যাবে। কাঁদতে কাঁদতে তার অবস্থা নাজেহাল তবুও সে যাবে। বড় চাচুকে দেখবে। নীহারে হাতে পায়ে ধরে জেদ ধরে সে-ও গেল এক বাইকে৷ এদিকে আজমিরা জা’কে সহ বৃষ্টিকে সামলাতে লাগল। ইয়াসমিন যেতে যেতে বাড়িতে জানিয়ে দিল। তার মাকে বলে দিল যেন এসে শাশুড়ীদের সামলায়৷
_________
হসপিটালে নীহার এসে পৌঁছাল। কুষ্টিয়া আমিন ডায়াগনিস্টে নেয়া হয়েছে জাকির মালিথাকে। সেখানে তুহিন সহ তুষারও আছে৷ তুষার ফোন পেয়ে একটুও লেট করেনি। বাবা তার মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে সেখানে সে বসে থাকে কী করে?
ইয়াসমিন সারা রাস্তা কুয়াশাকে বলেছে ওখানে গিয়ে কান্না না করতে। আর করলেও যেন শব্দ না করে। ইয়াসমিন নিজও বসে চোখের পানি ফেলছে। কুয়াশা আর শব্দ করে কাঁদছে না। তারা এখনো চাচুকে দেখেনি।
নীহার, তুষার, তুহিন ছুটে বেড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মালিথা ভিলার সদস্য আজ অনেক বছর পর আবার। ছোট চাচুর মৃ’ত্যুর পর দাদা দাদি চলে গেলেন এরপর আর কোনো ঝড় আসেনি। আজ অবধি কারো কোনো বড় রকম অসুস্থ বা অসুখ হয়নি।
‘
পরীক্ষা দিয়ে শিশির রিজভী ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যে যার বাড়িতে চলে এলো। শিশির বাড়িতে এসে কান্না কাটি দেখে হতবাক হয়ে গেল। শাশুড়ীর মুখ থেকে সব শুনে তার অন্তর, আত্না কেঁপে উঠল। দু’নিয়া আঁধার হতে লাগল৷ বাবা নামক জিনিসটা যে কী সেটা যারা হারায় তারা বুঝে। বাবাকে হারালে সে যে দু’নিয়া হারিয়ে ফেলবে! শিশির নিজেকে শক্ত করে মা’কে আশ্বাস দিয়ে তৎক্ষনাৎ ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে গেল। নীহারকে কল করতে করতে বাইকে উঠল।
জাকিয়া ছেলেকে দেখে কান্না বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ যার জন্য শিশির যেতে না যেতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন৷ স্বামীকে তিনি অনেক ভালোবাসেন৷ এই বাড়িতে স্বামীর হাত ধরে এসেছিলেন৷ স্বামী সব সময় সাপোর্ট হয়ে পাশে থেকেছেন৷ ভালো মন্দ সব কাজে উৎসাহ দিয়েছেন। সংসার গড়তে, শক্ত হাতে সামলিয়ে রাখতে স্বামীই একমাত্র ভরসা হয়েছিলেন। সংসারের প্রতি এত এত জ্ঞান স্বামীর থেকে পেয়েছেন, সকলের মন জুগিয়ে চলা, একে অপরকে ভালোবেসে আগলে রাখা সব স্বামী শিখিয়েছেন৷ এত বড় পরিবারটা সামলাতে তিনি ঢাল হয়েছেন। পরিবারের মেলবন্ধন, হাসি-খুশি দিয়ে ভরিয়ে রাখার একমাত্র মূলমন্ত্র হচ্ছেন স্বামী। এখন সেই স্বামী যদি মৃত্যুর মুখে যায় আর সেটা সেই স্ত্রী শুনে কী করে ভালো থাকে? কী করে সহ্য করবেন তিনি?
এই বাড়ির প্রতিটা মানুষের শক্ত ঢাল ও মনোবল জাকির মালিথা। জাকির মালিথার কৃতিত্ব এই বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে। জাকির মালিথা এই মালিথা ভিলার শক্ত ভিত আর তার ভাইরা ভাইয়ের বউয়েরা এই বাড়ির চারপাশের শক্ত দেয়াল। এই বাড়ির প্রতিটি সন্তান হচ্ছে ঘরের সৌখিন আসবাবপত্র। যা এই বাড়ি সৌন্দর্য। এখন যদি সেই শক্ত ভিতটাই ভেঙে যায় তাহলে দেয়ালগুলোই টিকবে নাকি ঘরের সুন্দর আসবাবপত্রগুলো টিকবে? ভেঙে গুড়িয়ে যাবে না? নষ্ট হয়ে যাবে না? জাকির মালিথার কিছু হলে এই বাড়ির কেউ সহ্য করতে পারবে? থাকতে পারবে? মেনে নিতে পারবে? নাকি জাকির মালিথাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে?
হ্যাঁ মানুষ চিরকাল বাঁচতে আসে না পৃথিবীতে। তবুও শেষ বয়সে চলে যাওয়া এক জিনিস আর বয়স নায় ফুরোতে দূর্ঘটনায় দুনিয়া ছাড়া এক জিনিস। সেটা সহ্য করা খুবই কষ্ট সাধ্য। মেনে নিতেও কষ্ট হয়। তেমনি জাকির মালিথাকে হারালে কেউ সহ্য করতে পারবে না। যদিও সময় কারো জন্য থেমে থাকে না তবুও খত কী যায়? নাকি ঘা সহজে শুকোয়?
‘
শিশির বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বাইক নিয়ে সেই ঝড়ের বেগে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বাইক চালাচ্ছে। যেতে যেতে বাবাকে নিয়ে নানান কথা ভাবতে লাগল। বাবার কিছু হলে সে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। বাবা তার শক্ত হাত। বাবার জোরো এতদূর। এসব ভাবতে ভাবতে বুকটা ভারী হয়ে এলো। বুকে ব্যথা অনুভব হলো। চোখটা ভিজে এলো আর তখনি দূর্ঘটনা ঘটল। ধেয়ে আসা একটা মিনি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ হলো। রাস্তায় থাকা লোকজন দৌড়ে এলো। সোরগোল লেগে গেল৷ ভিড় জমাল জনগণ। চেঁচামেচিতে পূর্ণ হলো।
‘
নীহার ডক্টরের সাথে কথা বলছিল৷ সেই সময়ে ফোনটা বেজে উঠল। শিশিরের ফোন৷ ফোন পেয়ে ধরল।
“হ্যালো” বলতেই ওই পাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠ পেল৷ ভ্রু কুঁচকে গেল তৎক্ষনাৎ। জিজ্ঞেস করল,
” কে বলছেন? এটা তো আমার ভাই শিশিরের ফোন আর নাম্বার! ”
ওপাশ থেকে ইতিবাচক উত্তর এলো। তিনি বললেন,
” আপনার ভাই এক্সি-ডেন্ট হয়েছে। একটা ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ লেগে। আমরা সদর হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি। আপনার নাম্বারটা প্রথমে ডায়ালে পেলাম তাই ইনফর্ম করলাম…. “
আর কিছু শুনল না নীহার। কীরকম আছে শিশির, কোন পরিস্থিতিতে আছে কিচ্ছু শুনল না। সে মূলত আর শুনতে পারল না। শুনতে পারল না নাকি শুনতে চাইল না? বসে পড়ল ফ্লোরে। হাত পা ভেঙে এলো। এ কী ঝড়, তুফান এলো তাদের জীবনে? এ কী মসিবত এলো? তাদের হাসি, খুশি পরিবার কই গেল? হাসি খুশি পরিবারের এ কী অবস্থা? সব যেন ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে। মালিথা ভিলা যেন ভেঙে চুড়িয়ে, গুড়িয়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যেতে চাইছে। তাদের পরিবারে এ কী বদ নজর পড়ল!
শিশিরের কথা শুনে নীহার এবার ভেঙে গেল। এতক্ষণও নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল। বড় চাচু তাদের কাছে একটা হৃৎপিণ্ড। তার অসুস্থতাতে সকলে ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু এখন তাদের আদরের ভাইয়ের এ কী পরিণতি? তারা এবার সহ্য করবে কী করে? নীহারের চোখে পানি টলমল করতে লাগল। তুহিন ভাইকে ওভাবে বসে পড়তে দেখে দৌড়ে এলো। এসে সে-ও পাশে বসে তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল,
” ভাই, ঠিক আছিস তুই? “
নীহার তা শুনে পাশ ফিরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
” ভাই, শিশির…!”
” কি হয়েছে? শিশির কি? “
” ভাই, শিশির এক্সি-ডেন্ট হয়েছে। ট্রাকের সাথে বাইক নিয়ে। ভাই আমাদের শিশির, আমাদের ছোট ভাই! ভাই ওর কিছু হলে আমরা থাকব কি করে? “
নীহারের প্রথম কথা শুনতেই তুহিন হিম হয়ে গেল। আর কিছু যেন শুনতেই পেল না৷ এদিকে চাচু ওদিকে ভাই! সকলে যেন অথৈ সাগরে তলিয়ে যেতে লাগল৷ এই অতল সাগরের থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী? তুহিন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” শক্ত হ। কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কেমন কন্ডিশন শিশিরের জেনেছিস? কেমন আছে ও? কোথায় আছে ও? ”
” কেমন অবস্থা শুনিনি। তবে সদর হসপিটালে নিয়েছে পাবলিক৷ “
তুহিন শুনে তুষারকে ডাকল। তুষারকে সব বলতেই তুষারের মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যেতে নিল যেন। সে-ও আর নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। বাবা, ভাইয়ের এক সাথে করুন অবস্থার কথা শুনে ও দেখে তারাও ভেঙে পড়ছে৷ তুষার নিজেকে সামলিয়ে বলল,
” তোরা এখানে থাক, আমি শিশিরের কাছে যাচ্ছি “
নীহার তা শুনে বলল,
” ভাই, আমিও যাব “
তুষার মানা করল না। বলল,
” তুহিন তুই থাক। কুশুকে কিছু বলিস না৷ জানতে দিস না। এমনিতেই বাবার জন্য ভেঙে পড়েছে৷ আর বাড়িতেও আগেই বলিস না “
তুহিন সম্মতি দিতেই তুষার, নীহার চলে গেল৷ যেতে যেতে শিশিরের ফোনে আবার কল করতে করতে গেল। কিন্তু কল ঢুকল না। এবার আরো চিন্তায় পড়ল। বুকের মাঝে ধুকপুক করছে। ছলাৎছলাৎ করছে সব৷ যতক্ষণ না নিজেদের চোখে ভাইকে সহি-সালামত পাচ্ছে আর দেখছে ততক্ষণ শান্তি নেই মনে। আমিন ডায়াগনস্টিক থেকে সদর হসপিটাল খুব বেশি দূর না। রাস্তা ক্লিয়ার থাকলে জোরে গেলে দশ মিনিটও লাগবে না৷ বাইকে দু’জনেই উঠে রাস্তাটুকু আল্লাহকে সরণ করতে করতে গেল। সব যেন ঠিক থাকে আর সব যেন ঠিক হয়ে যায়। তাদের প্রতিটা সদস্য যেন আবার হাসার সুযোগ পায় এবং হাসে। মালিথা ভিলা মানে একরাশ আনন্দ, একরাশ হাসি-খুশি। পরিবারের প্রতিটা সদস্য এক একটা মূল্যবান কোহিনূর। সেই কোহিনূরদের যেন কিচ্ছুটি না হয়। আল্লাহ যেন সহায় হোন।
| চলবে |
এতটুকুই লিখতে পারলাম। কাউকে কাল পর্যন্ত আর অপেক্ষা করাতে চাইলাম না। তাই অর্ধেকটা দিলাম বাকিটুকু কাল জলদি দেবার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
আর হ্যাঁ কেউ আবার বইকো না আমাকে
‘বুনো ওল বাঘা তেঁতুল’
| পর্বঃ ৫৪ | ‘শেষাংশ’
®রোজা রহমান
‘
কুয়াশা এক মিনিটের জন্যও স্থির হতে পারছে না। তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে কেন যেন৷ মনে হচ্ছে সবকিছু হারিয়ে ফেলবে। বড় চাচু যে তার কাছে কী সেটা সেই জানে৷ বড় চাচুকে হারালে সে ঠিক থাকবে না৷ ছোট থেকে বড়চাচুর আদর পায়। বাবা চলে যাওয়াতে বড় চাচু বাবার অভাব পূরণ করেছেন৷ মেজো চাচু অধিকাংশ দিন বাহিরে থাকতেন৷ তাই বড় চাচুর উপর টানটা অধিক তার৷ হয় না এমন? যার সাথে, কাছে বেশি থাকা যায় যার ভালোবাসা বেশি পাওয়া যায় সেই বেশি আপন এবং ভালোবাসার মানুষ হয়। ফুুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একভাবে কান্না করে চলেছে৷ ইয়াসমিন জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিয়ে চলেছে৷ নিজেও চোখের পানি ফেলছে।
তুহিন এসে ইয়াসমিনকে ডাকল দূরে। ইয়াসমিন গেলে শিশিরের কথা বলল৷ শুনে ইয়াসমিন আৎকে উঠল৷ চোখ ফেটে এবার গলগলিয়ে পানি পড়তে লাগল৷ তাদের সুখের সংসারের এ কী হাল! তুহিনের চোখে পানি কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ইয়াসমিন কাঁদতে কাঁদতে পিছন ঘুরে কুয়াশার দিকে দেখল৷ আবার তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
” পাগলীটা এবার পাগল হয়ে যাবে৷ সেই যখন থেকে বড় চাচুর কথা শুনেছে তখন থেকে কান্না করছে৷ এখন শিশিরের কথা শুনলে সামলাব কি করে? “
” বলো না ও’কে। তুষার ভাই জানাতে মানা করে গেছে৷ আগে ওরা খোঁজ দিক কেমন আছে ভাইটা আমার৷ তারপর জানিয়ো”
থেমে বলল,
” বড় চাচুরও কন্ডিশন বলতে পারছি না। ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। আল্লাহ যেন সব ঠিক করে দেন। কোনো ক্ষতি যেন না হয়। আমরা আবার বড়চাচুকে অক্ষত অবস্থায় চাই। আল্লাহর কাছে শুধু এই দোয়াটু্কু “
‘
জাকিয়াকে খুব কষ্টে জ্ঞান ফেরানো হয়েছে৷ হিমেল এসে পর্যন্ত কেঁদে চলেছে চাচুর জন্য। ছোট্ট মনটা তার বিষিয়ে উঠছে বার বার। এত ঝড় তার মন মস্তিষ্ক নিতে পারছে না৷ ইয়াসমিনের মা এসেছেন সাথে ঈশাও। আম্বিয়াও চলে এসেছেন৷ সকলে মিলে জাকিয়াকে সামলাচ্ছেন৷ বৃষ্টিকে বার বার বুঝাচ্ছেন যেন টেনশন না করে আর কান্নাকাটি না করে৷ অস্থিরতা কমাতে নয়তো বাচ্চার সমস্যা হবে৷ বৃষ্টি অনাগত বাচ্চার মা হয়ে তার কথা ভেবে শাশুড়ীদের কথা মানার চেষ্টা করছে৷ কান্না কম করার চেষ্টা করছে৷ তবুও স্থির হতে পারছে না। তার এই সংসার তার বড্ড আপন। হিমকে আজমিরা কোলের মাঝে নিয়ে বুঝাচ্ছে। স্কুল থেকে এসে অবধি তার অবস্থা খারাপ।
এই বাড়িতে এখনো শিশিরের কথা জানানো হয়নি। শিশিরের কথা জানলে বোধহয় সকলে ভেঙে পড়বে৷
‘
তুষার, নীহার হসপিটালে পৌঁছেছে৷ যেদিকে এক্সি-ডেন্ট বা কাটা ছেঁড়া রুগী থাকে সেদিকে আন্দাজে খোঁজ নিচ্ছে। কারণ শিশিরের ফোন বন্ধ। খোঁজ করে জানতে পারল একটু আগে একটা এক্সিডেন্টের রুগী এসেছে। জরুরী বিভাগে নেয়াও হয়েছে৷ তৎক্ষনাৎ তুষার, নীহার দৌড় দিল৷ নীহার বাইকের উপর থেকে রিজভীকে সবটা জানিয়েছে। রিজভী তখনি রওনা দিয়েছে। জাহিদ মালিথা আসছেন পাবনা থেকে৷
তুষাররা গিয়ে দেখল শিশিরকে ডক্টর দেখছে৷ সে জ্ঞানেই আছে৷ খুব বেশি ক্ষতি হয়নি আবার কম কিছুও হয় নি। আল্লাহ রক্ষা করেছেন এই শুকরিয়া।
দূর থেকে ট্রাকটা শিশির খেয়াল করেছিল না৷ আসলে ও এতটায় বাবার জন্য শোকাহত যে মন মস্তিষ্ক শুধু বাবার কথা ভাবছিল। অবশ্য রাস্তার একপাশ দিয়ে বাইক চালাচ্ছিল কিন্তু তবুও কিভাবে যেন ট্রাকটার সাথে সংঘর্ষ হয়৷ আসল কথা দূর্ঘটনাটা হবে যার জন্য এমন৷ তো রাস্তার পাশেই ছিল আর ট্রাকের সাথে বেঁধে পাশেই বাইক সমেত উল্টে গিয়ে কিছুটা দূর স্লিপ খায়। তাও আবার পেছনের দিকে। বাইকটা পুরোটা কোমড় থেকে পায়ের উপর পড়ে৷
এদিকে ট্রাকটার সাথে বাড়ি লাগতেই ড্রাইভারটা ভয়ে গাড়ির ব্রেক ঘুরিরে পাশ দিয়ে চলে যায়৷ ভাগ্যিস পাশ দিয়ে গেছিল যদি সোজাসুজি ওভাবেই যেত তো শিশিরের শরীরের উপর দিয়ে যেত৷ একদম বাইক সহ তাকেও পিষে দিয়ে যেত৷
কথায় আছে না? ‘রাখে আল্লাহ মা-রে কে!’ সেটাই ঘটেছে৷ আল্লাহ চেয়েছেন তাই আজ শিশির অক্ষত৷ তা না হলে আজ কী হতো একমাত্র আল্লাহ জানেন। শিশির পড়ে গিয়ে মাথার সমেত কপালটা রোডে লাগে তবে আল্লাহর কৃপায় সে ব্যলেন্স করে খুব বেশি জোরে লাগতে দেয় নি৷ স্লিপ খাওয়ার জন্য বাম হাতের কনুই সহ তালুর কাছে অনকটা ছিঁলে কেটে গেছে৷ কোমড় সহ পায়ের উপর অত ভারী বাইকটা পড়াতে কোমড়ের পাশে হাড়ে বাড়ি লেগেছে। হাঁটুতে নিচে থাকা রাস্তার ইটের টুকরো পড়াতে হাঁটুতেও লেগেছে এবং কেটেও গেছে৷ আর সবথেকে বেশি লেগেছে পায়ের গিড়াতে। বাম পা’য়ের গিড়াটা মুচকে তো পড়েছিলই সাথে বাইকের ভরও নিতে পারেনি। গিড়ার হাড় বোধহয় সরে টরে গেছে। ডক্টর তেমনটাই ধারণা করেছেন৷ এখন এক্সেরে করতে হবে জানালেন।
তুষাররা সবটা শুনল। আল্লাহর কাছে তবুও শুকরিয়া আদায় করতে ভুলল না। অল্পের উপর দিয়ে গেছে বিপদটা৷
এরপর শিশিরকে যারা এনেছে তাদের সাথে কথা বলল। যিনি ফোন দিয়েছিলেন তিনি নীহারের হাতে শিশির ফোনটা দিলেন৷ জানালেন ফোনে চার্জ নেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ উনারা শিশিরকে তুলে ওর পকেটে থেকে ফোন বের করে শিশিরের মুখ থেকে পাসওয়ার্ড জেনে কল করেছিল৷ শিশির বহু কষ্টেই বলেছিল। সব শুনে তুষার নীহার ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করল লোকগুলোকে। লোকগুলো হাসি মুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ঠিক তখনি রিজভী দৌড়ে এলো। এসে বিমূঢ় হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে হতভম্ব হয়ে সব জিজ্ঞেস করল। প্রিয় বন্ধুর এবং তার পরিবারের এ কী হাল!
নীহার তুষারকে জানাল এখানে রাখবে না। শিশিরকে ক্লিনিকে নেবে। আমিন ডায়াগনস্টিকয়েই নিয়ে যাবে। ওখানে জাকির মালিথা আছে এক সাথে দু’জনের চিকিৎসা করবে। সেখানেই পা এক্সরে করাবে। তুষারও সম্মতি দিল।
শিশির ভাইয়ের কাছে বাবার কথা জিজ্ঞেস করাতে তুষার একটু মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে জানাল অনেকটা সুস্থ আছেন। শিশিরকে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করে ওরা শিশিরকে ধরাধরি করে সিএনজিতে তুলে নীহার সাথে বসল আর রিজভী, তুষার বাইকে বসল। আমিন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
‘
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল ধরিত্রীতে। তুষাররা শিশিরকে নিয়ে আমিন ক্লিনিকে এলো৷ তুষার, নীহার, রিজভী তিনজন মিলে শিশিরকে নিয়ে ঢুকল। আলাদা বিভাগে ভর্তি করানো হলো। ডক্টর দেখানো হলো। ডক্টরও জানালেন এক্সরে করাতে হবে। কুয়াশারা অন্য সাইটে তাই এখনো ঠিক পায়নি। জানানো হয়নি এখনো। তুষাররা নিজেরাই ঠিকঠাক করল৷
শিশির ব্যথায় দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আছে৷ আর জায়গাগুলোর ব্যথা সহ করতে পারলেও গিড়ার ব্যথাটা সহ্য করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
‘
জাহিদ মালিথা এলেন সন্ধ্যার পর। বড় ভাইয়ের জন্য এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তুহিন বাবাকে শান্ত করতে পারছে না৷ ছেলেটা যেমন শান্ত প্রকৃতির তেমন স্ট্রোং অনেক। এত বড় বড় ঝড় যাচ্ছে তবুও নিজেকে শক্ত রেখেছে। তুহিন তুষারকে কল করে জানাল বাবাকে সামলানো যাচ্ছে না৷ তুষার তৎক্ষনাৎ চলে এলো এসে চাচুকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। কুয়াশা চাচুর কান্না দেখে আবার জোরে কান্না করে দিয়েছে৷ ইয়াসমিনও কান্না করছে আর থামাচ্ছে। ইয়াসমিনের বাবা আমিনুল হকও এসেছেন
‘
ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে থাকে সাধারণত দুই ধরণের। একটি মস্তিষ্কে রক্তসংরোধজনিত অন্যটি রক্তক্ষরণজনিত। রক্তসংরোধজনিত স্ট্রোক হয়ে থাকে রক্তসরবরাহকারী রক্তনালি বিঘ্নিত ঘটে অর্থাৎ বন্ধ হয়ে গিয়ে হয় অন্যটি রক্তবাহের অর্থাৎ রক্তনালির ছিঁড়ে গেলে হয়।
জাকির মালিথার সিটি-স্ক্যান করা হয়েছে। উনার স্ট্রোকটি মস্তিষ্ক রক্তসংরোধজনিত স্ট্রোক। ডক্টর চিকিৎসা চালাচ্ছেন। জানিয়েছে বিশ-চব্বিশ ঘণ্টার আগে শারীরিক অবস্থার কথা কিছুই জানাতে পারবেন না। ডক্টর সর্বচ্চ চেষ্টা করছেন। সকলে শুধু আল্লাহকে ডাকছেন৷ বাড়িতে ফোন করে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
শিশির অস্থিরতায় কাটাচ্ছে। রিজভীকে বার বার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছে আর বলছে বাড়িতে তার বিষয়ে যেন কিচ্ছুটি জানানো না হয়। তাহলে হাল আরো খারাপ হবে৷ রিজভীও মেনেছে। তুষারদেরও বার বার মানা করেছে যেন কাউকে কিচ্ছু না বলা হয়।
‘
রাত নয়টার দিকে। কুয়াশা ইয়াসমিনের সাথে বসে আছে। তুষাররা কত করে বলেছে ইয়াসমিনের সাথে চলে যেতে। মূলত কুয়াশাকে আর বাড়ির কাউকে এই অবস্থায় শিশিরের কথা জানাতে চাচ্ছে না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয়নি৷ মূলত তাকে সেখান থেকে এক পা-ও নড়াতে সক্ষম হয়নি কেউ। সে চাচুকে দেখবে তবেই বাড়ি যাবে। না হলে শান্তি পাবে না। কিছু বললেই কাঁদছে। মেয়েটা জেদি হলেও বুক ভরা ভালোবাসা।
তুষাররা একবার বাবার কাছে আসছে একবার ভাইয়ের কাছে। জাহিদ মালিথাকে একটু আগে শিশিরের কথা জানানো হয়েছে। তিনি শিশিরকে দেখে এসেছেন। বুক তার ভার হয়ে যাচ্ছে এত কিছু সহ্য করতে গিয়ে৷ একদিকে ভাই তো একদিকে ভাতিজা। স্ট্রোং ডিআইজি সাহেবও ভেঙে পড়ছেন। কুয়াশাকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।
এতক্ষণ পর হঠাৎ কুয়াশার মস্তিষ্কে শিশিরের কথা এলো। সেই সকালের পর আর দেখেনি। এদিকে চাচুর কথা চিন্তা করতে করতে শিশিরের কথা মনেই আসে নি। সে কই? তাকে কি বাবার কথা জানানো হয়নি? এখন রাত হয়ে গেছে তো! পরীক্ষা তো সাড়ে চারটার দিকেই শেষ হয়ে যায়! তো এখনো বাবাকে দেখতে এলো না? কুয়াশার খুবই অদ্ভুত ফিল হলো। এরপর আবার ভাইদের লুকিয়ে, চুপিয়ে এখান থেকে বার বার কোথায় যেন যাচ্ছে সেসবও মস্তিষ্কে এলো। সে তো চাচুর জন্য কিছুই খেয়াল করেনি! শিশির কই তবে? তড়াক পাশ ঘুরে ইয়াসমিনকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠল,
” বুবু, তোমাদের দেবর কই? সে তো এলো না এখানে! চাচুর কথা জানানো হয়নি? বাড়িতে গেলে তো সবই জানবে তো এখানে এলো না কেন এখনো? আশ্চর্য! গেছে কোথায় ওই বুনো ওলটা? “
ইয়াসমিন এবার কুয়াশার দিকে বিরস বদনে তাকাল। কুয়াশাকে বলবে কী বলবে না ভাবছে৷ এমনিতেও জানতেই পারবে। তারউপর এখন সে বুঝে গেছে শিশির একবারও আসেনি এখানে। হাজারটা প্রশ্নতো করবেই সাথে ফোন করতেই থাকবে৷ যেটা করলে সে পাবেই না শিশিরকে। তার থেকে সত্যিটা বলে দেয়া ভালো। ইয়াসমিন ভেবে নিয়ে বলতে গেল কিন্তু ভাঙা ভাঙা কন্ঠ হয়ে গেছে তার। একটু কান্না করলেই গলা বসে যায় তার। কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরল। বড় বোনের মতো করে আগলে নিল৷ এরপর মাথায় হাত রাখল৷ কুয়াশার খুব অদ্ভুত লাগছে এসব৷ ইয়াসমিন বলল,
” পুরোটা শুনে রিয়াক্ট করবি৷ আগেই ভেঙে পড়বি না “
কুয়াশার বুক জ্বলে উঠল৷ ভেতর কেঁপে উঠল ইয়াসমিনের এমন কথা শুনে। কি এমন হয়েছে? শিশির ঠিক আছেতো? কুয়াশা কিছু বলতে নিবে ইয়াসমিন বলল,
” পরীক্ষা শেষে বাড়িতে গিয়ে চাচুর কথা শোনে৷ সেখান থেকে বাইক নিয়ে তড়িঘড়ি করে আসতে গিয়ে ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে শিশিরের….”
ব্যস আর কিছু বলতে দিল না ইয়াসমিনকে আর না শুনল নিজেই। এক্সিডেন্ট হয়েছে এটুকুই যথেষ্ট। বজ্রাহত নয়নে বজ্রাহত কন্ঠে বলে উঠল,
” কিহ্..!”
ইয়াসমিন তড়িঘড়ি করে বলল,
” আরে পুরো কথা শুনেক “
নাহ্ আর কিচ্ছু শুনল না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল দুইহাতে মুখ ঢেকে৷ ইয়াসমিন এত বলতে লাগল বেশি কিছু হয় নি তবুও কানে নিল না৷ সে তার মতো কেঁদেই চলল৷ গগনবিদারী কান্না তার। তার কান্নার রেশ শুনলে যে কেউ কেঁপে উঠবে। যে কারো বুকে লাগবে। হাউমাউ করে কেঁদেই চলল৷ তুষাররা, তুহিন, জাহিদ মালিথা ডক্টরের কাছে গেছে। নীহার, রিজভী শিশিরের কাছে৷ এখানে শুধু ইয়াসমিন, কুয়াশা আর হসপিটালের লোকজন সহ নার্স। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল৷ কুয়াশার কান্না শুনে সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল৷ দুইটা নার্স এসে সমানে জিজ্ঞেস করতে লাগল ‘কি হয়েছে? ‘
ইয়াসমিন কত কথা বলল একটাও কানে তুলল না। তুলবে কী করে? তার তো বুক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে শিশির এক্সিডেন্ট হয়েছে এটুকু শুনে। হাত পা অচল হয়ে উঠেছে। মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাচ্ছে। একদিকে স্বামী একদিকে শ্বশুর সে কীভাবে সহ্য করবে? হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” বুবু, এ্যাই বুবু নিয়ে চলো ওর কাছে। নিয়ে চলো। প্লিজ নিয়ে চলো৷ বুবু তোমার দোহায় লাগে নিয়ে চলো। আমি দেখব তাকে৷ ও বুবু কেমন আছে ওঁ? বলো! ঠিক আছে তো? কোথায় আছে এখন ওঁ? “
ইয়াসমিনও এবার কেঁদে দিল। বলল,
” শান্ত হ সোনা। ঠিক আছে শিশির। বেশি কিছু হয়নি৷ এখানেই এই হসপিটালেই আছে। শান্ত হ৷ তোর ভাইরা এলে নিয়ে যাচ্ছে ”
কিছুতেই শান্ত হলো না। অস্থির হয়ে উঠল সে। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক থেকে ওদিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রলাপ বকতে লাগল বিভিন্ন। ইয়াসমিন তৎক্ষনাৎ তুহিনকে কল করে সব বলল। তুষার, তুহিন তড়িঘড়ি করে এলো। ঠিক এই জন্যই জানায়নি বোনকে আর চলে যেতে বলেছিল। এসে বোনকে আগলে নিয়ে জানাল, শিশির ঠিক আছে। এখানেই আছে৷ নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কুয়াশাকে একটু শান্ত করে তুষার নিয়ে গেল শিশিরের কেবিনে।
শিশিরের কেবিনের সামনে গিয়ে কুয়াশার হাত পা আচানকই কাঁপতে লাগল। তুষারের সাথে ঢুকে দেখল শিশির শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। পাশে নীহার আর রিজভী বসে আছে চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। হয়তো শিশিরকে ঘুমোতে বলা হয়েছে। শিশিরকে ঐ অবস্থায় দেখে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল দরজার মুখে থেকে৷ তুষার একহাতে জড়িয়ে ধরা কুয়াশাকে। কান্নার শব্দ পেয়ে শিশির চোখ খুলে তড়াক তাকাল। দেখল তার আহ্লাদী বউকে সারাদিন পর। কেঁদে চোখ মুখ আর ঠিক নেই৷ চোখ, মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে৷ তুষার বলল,
” কুশু, সোনারে কাঁদিস না৷ দেখ ঠিক আছে শিশির। অল্প লেগেছে৷ “
শিশির শুনে হাসার চেষ্টা করল৷ বউ তার কথা শুনেই কী পরিমাণ কেঁদেছে বুঝল তা৷ বলল,
” আমি ঠিক আছি তো! “
কুয়াশা আরো কান্না শুরু করল৷ কারণ শিশিরের কন্ঠ ভাঙা ভাঙা। তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতটা সুস্থ সে৷ হাতে, পায়ে, মাথায় ব্যান্ডেজ করা৷ নীহার উঠে এসে বলল,
” কুশু, চুপপ। যাহ্ কথা বল”
বলেই শিশিরকে বলল,
” থামা। আমরা বাহিরে গেলাম৷”
বলেই চলে গেল ওরা। ওরা গেলে শিশির বলল,
” এ্যাই..! এদিকে আয় “
বলে ভালো হাতটা বাড়িয়ে দিল৷ যেন কোনো বাচ্চাকে ডাকছে। কুয়াশা একটুও দেরি করল না। স্বামীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। এতক্ষণ এই স্পেসের আশা করছিল সে। বুকের জ্বালা মিটবে শুধু এই বুকে মাথা রাখতে পারলে৷ এই বুকটা তার খুব আপন যেখানে সবরকম শান্তি আছে। শারীরিক বলো আর মানসিক বলো। চাচুর জন্য দুপুর থেকে বুক ব্যথা হয়ে আছে। আর এখন স্বামীর কথা শুনে আর ঠিক থাকতে পারছে না। কী অবস্থা হয়েছে এ?
কুয়াশা শিশিরের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদল অনেকক্ষণ। শিশির থামাল না৷ কাঁদতে দিল। জানে সে হাজার বলেও হবে না৷ কাঁদবেই। পাশে বেডে বসেই শিশিরকে জড়িয়ে ধরে আছে। এই কেবিনে শুধু শিশিরই আছে৷ কুয়াশা কিছুক্ষণ কেঁদে বলল,
” ওরা কেউ কিচ্ছু জানায়নি আমায় “
শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বলল,
” এই যে এই কারণেই জানায়নি। আমিও মানা করেছিলাম। বাবার জন্য তোর অবস্থা কী হতে পারে ধারণা ছিল আমার তারউপর আমার আহ্লাদী বউটাকে আর কষ্ট দিতে চাইনি “
কুয়াশা কাঁদতে লাগল শক্ত করে ধরে। শিশির বলল,
” আমি ঠিক আছি। আর কাঁদতে হবে না “
শুনল না সে। কেঁদেই চলল,
” এ্যাই আহ্লাদী বউ!”
কুয়াশা এবার কান্না থামিয়ে মাথা তুলল।বলল,
” আমার দুনিয়া ঘুরে গেছিল শুনে “
শিশির অপলক তাকিয়ে রইল তা শুনে৷ বলল,
” বেশি কিছু হয়নি। শুধু গিড়াতে সমস্যা হয়েছে বেশি। এই জন্য হাঁটতে পারছি না৷ নয়তো পড়ে থাকতাম না আমি৷ বাবা আমার ওদিকে আছে দেখতে পারছি না৷ পা এক্সেরে করা হয়েছে। রিপোর্ট আসলে যানা যাবে। “
কুয়াশার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে৷ নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” চাচুর কী হবে? আমার এসব আর ভালো লাগছে না। চাচু কখন ঠিক হবে? আবার আগের মতো কথা বলবে। আমাকে ডাকবে, কুহেলি মা! “
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল৷ শিশিরের বুকটা ফেটে এলো। চোখটা জ্বলে উঠল আবার৷ বাবার কী হবে তারও জানা নেই৷ আল্লাহকে ডাকছে শুধু। কুয়াশা বলল,
” এ্যাই..! চাচু আবার আগের মতো ঠিক হবে তো? ওরা বলেছে ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। আমার ভয় হচ্ছে খুব “
শিশির কী বলবে বুঝল না। একই চিন্তাতো তারও হচ্ছে। আল্লাহ-ই এখন একমাত্র ভরসা, আশা৷ তিনি যা করবেন। কুয়াশাকে ফু্ঁপিয়ে কাঁদতে দেখে বলল,
” দরজা টা লাগিয়ে আয়। এসে পাশে শো, নয়তো পা মেলে বস। এতক্ষণ বসে থাকলে সমস্যা হবে। “
কুয়াশা বলল,
” লাগবে না। ঠিক আছি আমি। “
” বেশি কথা না বলে যা। এমনিতেই কোমড়ের সমস্যা আছে তোর “
কুয়াশা আর না করল না৷ পা টা সত্যি মেলানো প্রয়োজন৷ আজ এমনিতেও সে আর বাড়ি যাবে না। যদিও যেত এখন আরোই যাবে না৷ থাকতেই তো পারবে না বাড়িতে। আর রাতে তো একা আরোই ঘুম হবে না। তাই বাড়িতে যাবার প্রশ্নই আসে না৷ গিয়ে দরজাটা আটকাল কিন্তু সিটকানি দিল না৷ এসে শিশিরের পাশে শুয়ে পড়ল। বসল না আর। তার একটু প্রশান্তি দরকার৷ কিছু ভালো লাগছে না। আর সেটা এই বুকে, এই মানুষাটার কাছে পাবে। একমাত্র তার স্বামীর কাছে পাবে।
শিশিরের যে হাত ভালো সেই পাশে শুয়েছে৷ কোলের মাঝে সাবধানে শুয়ে বুকে মুখ গুঁজে রাখল। শিশির কপালে চুমু আঁকল। কুয়াশা মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
” ব্যথা করছে খুব? “
” পায়ে করছিল কিন্তু ইনজেকশন আর ঔষধ খেয়ে কমেছে একটু। “
” আর কোথাও করছে না? “
” মাথায় করছে অল্প, সবখানে ব্যথা। কিন্তু এসব আমার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আমার বাবার কষ্টটা বেশি। “
কুয়াশা নিরবে চোখের পানি ফেলছে৷ মুখ তুলে শিশিরে ক্ষত হাতটা আলতো ধরে হাতের পিঠে ঠোঁট ছোঁয়াল। উঁচু হয়ে কপালে চুমু আঁকল। নিচু হয়ে বুকে চুমু আঁকল। বলল,
” দেখো চাচু ঠিক হয়ে যাবে “
শিশির কুয়াশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এই আহ্লাদী বউটাকে এক সময় বড় মনে হয় এক সময় বাচ্চা মনে হয়। পরিস্থিতির উপর বিবেচনা করে ব্যবহার করতে যানে। এই কঠিন এই নরম। এই যে এখন, এতক্ষণ কান্না করা মেয়েটা তাকেই এখন সান্ত্বনা দিচ্ছে, আদর দিয়ে ব্যথা নিরাময় করতে চাচ্ছে। শিশিরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” বাড়িতে যাব না আমি! “
” যেতে হবে না “
কুয়াশা একটু খুশি হলো শুনে। তবে কষ্টের কাছে চাপা পড়ল৷ শিশিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলার মাঝে মুখ গুঁজে ডুকরে উঠল। শিশির কিছু বলল না। সে কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে-সকল শব্দ ভাণ্ডার তার কাছে নেই৷ শুধু মাথায় হাত বুলোতে থাকল৷
__________
রাত দশটা পাড় হতে চলল। এখনো ডক্টর জাকির মালিথার সঠিক খবর দিতে পারলেন না। চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ জ্ঞান ফেরেনি। তবে রক্তসংরোধজনিত রক্তনালি বন্ধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তুহিন ইয়াসমিনকে আর রাখল না এখানে। বলল তাকে রেখে আসবে। তুষার সকলের জন্য হালকা খাবার কিনে আনতে বলে দিল নীহারকে। বাড়ির অবস্থা ঠিক নেই। ইয়াসমিনও আর দ্বিরুক্তি করল না। বাড়ির পরিস্থিতিও জানা নেই। তুহিন ইয়াসমিনকে রেখে আসতে গেল৷ আমিনুল হকও আর এখানে থাকলেন না। কারণ ওদিকেও একটা পুরুষ মানুষ লাগবে৷
‘
মালিথা ভিলায় জা’য়েরা সকলে নামাজে বসে আছেন। জাকিয়ার জ্ঞান ফেরার পর সুস্থতা আসলেই নামাজে বসেছেন। স্বামীর জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন। স্বামী যেন সহিসালামত থাকেন৷ বাড়ির কর্তা যেন বাড়িতে ফিরে আসেন৷ সেজদারত হয়ে কেঁদে চলেছেন তিনি। একটায় চাওয়া স্বামী যেন আবার ফিরে আসে এই বাড়িতে। তারবেশি আর কিচ্ছুটি চাওয়ার নেই৷ স্বামীর সাথে এখনো কয়েকবছর একসাথে পাড় করার আছে৷ দম ফাটা কান্না করছেন তিনি সেজদারত হয়ে।
‘
রাত এগারটার দিকে আম্বিয়া, ইয়াসমিন, আজমিরা, মনিরা, বৃষ্টি সকলে মিলে জাকিয়াকে বুঝিয়ে, শুনিয়ে তুলে ধরে বেঁধে অল্প একটু খাওয়ালেন। তিনি খেতেও নারাজ৷ সকলে হালকা পাতলা খেল। গলা দিয়ে খাবারও নামছে না। কিন্তু নিজেদের সব দিক সামলাতে হলে সুস্থ থাকতে হবে।
ইয়াসমিন এসে শিশিরের কথা শাশুড়ীকে আর মা কে বলেছে শুধু। আর কাউকে বলেনি। আজমিরাকেও না। তিনি এমনি একটু দূর্বল প্রকৃতির। এতকিছু শুনলে আরো ভেঙে পড়বে। কাল জানলে জানবে। আজ আর কষ্ট দেবার প্রয়োজন নেই৷ আর জাকিয়াকে তো আরোই জানাল না৷ স্বামী, সন্তানের এই অবস্থা শুনলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। বৃষ্টিকেও আর টেনশন দিতে চাইল না। ইয়াসমিন বৃষ্টির কাছে শুলো রাতে। কুয়াশা আসবে জানিয়েছে। জাকিয়ার কাছে মা’য়েদের দিল। হিমকে আজমিরা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাতে কারোর চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না৷ জাকিয়া জেগে জেগে চোখের পানি ফেলছেন৷ জা’য়েরাও কেউ ঘুমাতে পারছেন না।
_______
হসপিটালে সকলে বসে আছে৷ শিশির কেবিনে আছে। কুয়াশা সেখানেই আছে৷ তুষাররা বাবার এদিকে আছে। রাত বারটা বাজতে চলল অথচ বাবার কোনো খোঁজ মিলছে না। জাহিদ মালিথা শুধু ডক্টরকে বলে চলেছেন সব রকম চেষ্টা করতে। না পারলে বলতে ভাইকে তারা ঢাকায় নেবে। ডক্টর কিছুটা আশ্বাস দিয়েছেন৷ মস্তিষ্ক ব্লক অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। এটুকু শুনে কিছুটা শান্ত হতে পেরেছে সকলে৷ কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হচ্ছে না। বিপদের সময় ঘড়ির কাটাও বোধহয় বেঈমানী করে৷
‘
রাত একটা। কুয়াশা শিশিরের বুকে ঘুম এসে গেছে। বারটা পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে একটু আগে ঘুমিয়ে গেছে৷ শিশিরের চোখে ঘুম নেই। এক শরীরের যন্ত্রণা, ব্যথা এক বাবার জন্য চিন্তা। সব মিলিয়ে শরীরটাই পিষে যেতে চাইছে৷ চোখ ঢেকে পড়ে আছে৷ শুধু একটা চাওয়া আপাতত বাবাকে বাড়িতে সহিসালামত নিয়ে যাওয়া। মস্তিষ্ক ব্লক হলে অনেক রকম সমস্যা হয়৷ সেসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে শেষ তো হচ্ছেই সাথে ঘুম ধরা দিচ্ছে না৷
________
ভোর সাড়েচারটার দিকে আল্লাহর কৃপায় জাকির মালিথার জ্ঞান ফিরল। একটা নার্স সর্বক্ষণ ছিল সাথে। সে জানাল। বড় ডক্টরকে ডাকা হলো৷ জাহিদ মালিথা সহ তুষাররা অস্থির হয়ে উঠল৷ ডক্টর দেখে জানাল জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু কিছু টেস্ট করতে হবে এখন। এরপর সকল হালচাল জানাবেন। তুষারদের অস্থিরতা কমল না। তাই সকলে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে নামাজ পড়তে চলে গেল।
‘
কুয়াশার ঘুম ভাঙল চারিদিকে আজানের ধ্বনি কানে এসে। তাকিয়ে দেখল শিশিরের বুকেই আছে৷ তড়িঘড়ি করে উঠতে গেল। কিন্তু বাহুতে চাপ পড়ল। সে সারারাত এখানে এভাবে ছিল শিশিরতো নড়তেও পারে নি বোধহয়! এই ভেবে তড়িঘড়ি করে উঠতে গেছিল৷ কিন্তু শিশির আঁটকে দিল। বলল,
” শুয়ে থাক আমি ঘুমব একটু৷ বলে ঘুরে কুয়াশার গলায় মুখ গুঁজে দিল। “
” নামাজ পড়ব না? “
” এখানে কোনো ব্যবস্থা করতে পারবি না৷ বাড়িতে গিয়ে কাজা পড়ে নিস “
কুয়াশা আর কিছু বলল না৷ শুয়ে স্বামীকে সঙ্গ দিল। একহাত শিশিরের চুলে চালাতে লাগল। কপালে চুমু আঁকল। বলল,
” এতক্ষণ জেগে ছিলে?”
” হ্যাঁ “
কুয়াশার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবার জন্যই হয়তো ঘুম আসছিল না। সে-ও চিন্তায় ডুবল।
‘
সকাল আটটার দিকে ডক্টর জাকির মালিথার রিপোর্ট দিলেন। জানালেন ব্রেইন স্ট্রোক করার ফলে জাকির মালিথার কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেগুলো হলো উনার ডান সাইটটা অবশ হয়ে গেছে অর্থাৎ প্যারালাইসিস, মস্তিষ্ক কিছুটা অচল হয়েছে মানে আপনজনদের চিনতেও একটু সমস্যা হবে আর কথা আঁটকে আঁটকে আসছে।
সব শুনে জাহিদ মালিথা সহ সকলে আবার ভেঙে পড়ল৷ জাহিদ কেঁদে উঠলেন আবার। তুষার হাউমাউ করে এবার কেঁদে উঠল। আর সহ্য হলো না। নীহার, তুহিন নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ তাদের মাথার উপরে শক্ত হাত রাখা মানুষটার হাত আজ অচল? তাদের পরিবারের শক্ত মেরুদণ্ড আজ অচল? যে পায়ে পা মিলিয়ে দিন পাড় করে সে পা অচল? যার বুলিতে সকলের দিনের রুটিন পাড় হয় সে বুলি অচল? বাড়ির এক একটা সদস্য যার কাছে মূল্যবান তাদের চিনতে পারবে না? সেই শক্ত মেরুদণ্ডের মানুষটা আর শক্ত রইল না? অচল হয়ে গেল? তা হলে মালিথা ভিলা সচল থাকবে কী করে এখন? তারাও তো অচল হয়ে গেল!
রিজভী একা সকলকে সামলাতে হিমশিম খেতে লাগল৷ শিশিরকে এখনি জানাল না কেউ৷ কুয়াশা সেখানে আছে থাকুক।
| চলবে |
আমিও তোমাদের মতো কষ্ট পাচ্ছিলাম৷ হাসিখুশি পরিবারটা একেবারে ভাঙতে আমারও কষ্ট হলো
নোট- মস্তিষ্ক স্ট্রোক করলে উল্লেখিত সমস্যাগুলো হয়। তাই সেগুলো আমার দিতেই হলো। উপায় ছিল না।
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click