®রোজা রহমান
‘
নার্সের কথা শুনে তুষার সহ প্রতিটা সদস্যের মাথায় চক্কর দিল। তুষারের বুকে ব্যথা অনুভব হলো। এতক্ষন যদিও বাবা হবার উত্তেজনা ও বউয়ের অবস্থাতে অস্থির ছিল কিন্তু এখন তা পাথর সমান ভারী বস্তুু চাপানোর মতো বুকে ব্যথা অনুভবে রূপ নিল। দিশেহারা হয়ে উঠল সে। অস্বাভাবিক দেখা গেল। একটা সদ্য বাবার কী হাল হয় এই দুঃসংবাদে তা উপস্থিত সকলে দেখল!
জাকিয়ার অবস্থা কি বলব? তিনি কিছু মাস আগে স্বামী, সন্তানকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে নিজের চোখের সামনে দেখেছেন আর এখন আবার তারই প্রথম সন্তানের প্রথম আলো ঘরে প্রবেশ না-ই করতে এমন একটা দুঃসংবাদ! সহ্য করবেন কি করে তিনি? প্রথম দাদি হবার সুখ মন,প্রাণ জুড়ে বিরাজ করত আর আজ এই সদ্য দাদি হবার সুখ গ্রহণ করতে পারছেন না? আল্লাহ ওনার এক কী পরীক্ষা নিচ্ছেন! তার সংসারের এ কি হাল হচ্ছে? বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। চোখ উপচে পানি পড়া শুরু করল। নিজেকে শক্ত করার বৃথা চেষ্টা করলেন৷ ওনার বড় মানিকের দিকে তাকালেন। তুষারের চোখে স্পষ্ট ব্যথা। সেই ব্যথা যেন উপচে আসতে চাইছে।
কুয়াশার বুক কেঁপে উঠল দুঃসংবাদ শুনে। পাশে থাকা শিশিরের হাত খামচে ধরল। চোখ টলমল পানি৷ শিশির একপলক কুয়াশাকে দেখে সে নিজেও দিশেহারা হলো৷ সদ্য চাচু হওয়ার উত্তেজনায় যেন নিমেষেই ভাঁটা পড়ল৷ হাসি মুখে আসতে গিয়েও যেন এলো না৷ নীহার, তুহিন পাশ থেকে বড় ভাইয়ের কাঁধ ধরল আশ্বাসের সঙ্গ দিতে৷ দু’জনেই এক সাথে বলল,
” ভাই! আল্লাহ আছেন “
তুষার ব্যথাতুর নয়নে চায়ল নীহারের দিকে৷ এরপর মা’য়ের দিকে। অসহায়, নিস্প্রভ, নিষ্প্রাণ, অনির্ব নয়নে মা’কে তার ব্যথা বোঝাতে চায়ল৷ জাকিয়া কি বুঝলেন তা? হয়তো ছেলের কষ্ট বুঝলেন৷ একজন মা ছাড়া আর কে বা বুঝবে একটা সন্তানের কষ্ট, অসহায়ত্ব? জাকিয়া তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে ছুটে এলেন৷ অভয় দিয়ে বললেন,
” আমার আব্বু, আমার বড় মানিক! সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ আছেন আব্বু। শান্ত হ। আল্লাহকে ডাক৷ আয় বস! “
বলে ছেলেকে বসালেন। তুষারের কিছু ভালো লাগছে না৷ আম্বিয়া অন্যপাশে বসলেন। শরীরে হাত বুলাতে লাগলেন। একজন মা’য়েরা বোঝেন এই সময়ে মনের অবস্থা কতটা ব্যাকুলতা হয়! শিশির তড়িঘড়ি করে ভাইয়ের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়িয়ে বসল। ভাইয়ের দুই হাত হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
” ভাই! সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে সামলাও “
নীহার নার্স চলে যেতে নিলে জিজ্ঞেস করল,
” ওঁ কি হয়ে দুনিয়ায় এসেছে জানতে পারি? “
” ছেলে “
কথাটা শ্রবণ হতেই তুষারের অন্তুর শীতল হয়ে উঠল। তড়িৎ তাকাল সেদিকে। যদিও আল্ট্রাসোনোতে জানতে পেরেছিল দুই মাস আগে। এখন শুনল একটা ছেলে সন্তানের পিতা হয়েছে সে। কিন্তু তার অবস্থা এখন জীবন মরণের সাথে জুড়ে আছে? অস্থির ভাবটা আরো বাড়ল। দেখার স্বাধও জাগল খুব। নার্সটা বলেই চলে গেছে। তুষার দু’ হাতে মাথার চুল খামচে ধরল। কোনো অনুভূতিই সে প্রকাশ করল না। কুয়াশা নিরবে ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখল। এই ভাইটা তার খুব প্রিয়৷ তার সব সময় ভালো মন্দের খোঁজ এই ভাইটাই রাখে। আদর যত্ন এই ভাইটার থেকে বেশি পায়। আবদার সব এই ভাই পূরণ করে। তার এমন কষ্টের সময়ে তারও বুক কাঁদছে৷
সকলে এখন শুধু আল্লহকে ভরসা মানা শুরু করল। একমাত্র আল্লাহ-ই ভরসা। তাই মন, প্রাণ দিয়ে আল্লাহকে ডাকা শুরু করল। জাকিয়া নিজের কষ্টকে দমিয়ে ছেলের কষ্টে ঢাল হলেন। ছেলের পাশে বসে বুকে, পিঠে সমানে হাত ডলতে লাগলেন। মূলত ছেলেকে অভয় দিয়ে ব্যথা, অস্থিরতা, ব্যাকুলতা কমানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। আর তার ঘরের প্রথম প্রদ্বীপের মুখে দাদি ডাক শোনার বাসনা পোষণ করে আল্লাহকে ডেকে ফরিয়াদ করতে লাগলেন।
‘
দুই ঘন্টা পাড় হয়ে গেল। কিন্তু কারো অস্থিরতার এক ছিঁটেফোঁটাও কমল না৷ কারণ এখনো ডক্টররা কোনো আপডেট দেননি। কোনো সুখ-বার্তাও পাঠাননি। তুষার সকালের বেশেই এসেছিল। টিশার্ট আর টাউজারে। তেমনই আছে৷ সকাল নয়টা বেজে আসছে কিন্তু কারো মুখে পানি পর্যন্ত তোলা হয়নি৷ বৃষ্টির বাবা ও সৎ মা আসছে হসপিটালে জানিয়েছেন।
‘
অপারেশন থিয়েটারে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ডক্টররা। তবুও তুষার, বৃষ্টির প্রথম সন্তানের রেসপন্স আশানুরূপ পাচ্ছেন না৷ শ্বাস চলছে শুধু।
সার্জারির পর ছেলেকে তুলেই বৃষ্টিকে জানানো হয়েছিল বেবির কথা। সে সজ্ঞানে ছিল। কিন্তু বেবির রেসপন্স না পাওয়ার কথা শুনে সে বড় সড় ধাক্কা খেয়েছে। বুকের পাঁজর ভেঙে আসতে চেয়েছে। কিছুক্ষণ আগে যে মরণ যন্ত্রণা হচ্ছিল সেটাও যেন বৃথা মনে হচ্ছিল। সে- যন্ত্রণার কথা ভুলে সন্তানের জন্য চোখের দুই কোল বেয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে আকুলতাময় আবদারে শুধু নিস্তেজ স্বরে বলেছিল,
” ডক্টর! আমার সন্তানকে আমার বুকের থাকার সুযোগ করে দেন প্লিজ..!”
এই নিদারুণ যন্ত্রণাময় বাক্যটুুকু উপস্থিত থাকা নার্স সহ ডক্টরের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলতে সক্ষম ছিল। ডক্টররা পুরোটা ভরসা দিয়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আর বৃষ্টি ঐ বাক্যটুকু বলেই নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। সন্তানের জন্য সে জ্ঞান হারিয়েছিল। তার বুকের কষ্টটা কি কেউ বুঝেছে? নয়টা মাস পেটে রেখে এখন দুনিয়ায় এসেই এমন দুঃসংবাদ কোন মা’টা সহ্য করবে? ডক্টর বৃষ্টির জ্ঞান ফেরাতে বলে বেবির রেসপন্স দেয়ার চেষ্টায় লেগেছেন। বৃষ্টির কিছুক্ষণের মাঝে জ্ঞান এলে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়৷ সে এখনো ঘুমে।
একটা প্রাণ দেনেওয়ালার মালিক স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআ’লা। আর সেই প্রাণ বাঁচানোর ফেরেস্তা রূপই হলেন একজন ডক্টর। ডক্টররা কখনো হার মানেন না৷ তারা সর্বস্ব চেষ্টা সব সময় করেন একটা প্রাণ বাঁচানোর জন্য। আল্লাহ চাইলে তারাও সফল হোন। এই যে দুইটা ঘন্টার বেশি সময় চলে গেল তবুও ডক্টররা নানান চেষ্টা করে চলেছেন৷ হাল ছাড়তে তারা রাজি নন৷ শেষ চেষ্টা পর্যন্ত করে যাবেন৷
‘
আরো ঘন্টা দু’য়েক পর ডক্টর এসে তুষারদের কাছে জানালেন বেবি রেসপন্স করেছে। বেবি কেঁদেছে। এই যে ‘বেবি কেঁদেছে’ এই বাক্যটা যেন আনন্দ ফোয়ারা ছড়িয়ে দিল সকলের চোখে, মুখে, প্রাণে৷ কী অদ্ভুত নাহ্! এই কান্না নামক বাক্যটাও যে সুখের হতে পারে এটা ধারণা করা যায়! ভাবা যায়! অতি আশ্চর্য নাহ্! কিন্তু এটাই সত্যি এই কান্না সুখ থাকে, এই কান্নায় আনন্দ থাকে, এই কান্নায় প্রশান্তি থাকে আর সর্বশেষ এই কান্নাটায় সকলে মনে প্রাণে চায় এবং সুখকর হয়।
জন্মের পর বেবি না কাঁদলে তা আতঙ্ক বার্তা হয়ে ধরা দেয়। অথচ পরে বাচ্চাদের কান্না থামাতে আমরা কতকিছুই না করি! একেই হয়তো বলে, সব কান্না দুঃখের বার্তা হয় না কিছু কান্না সুখ বার্তাও হয়৷
‘
সকলে আশানরূপ উত্তর পেয়ে একসাথে বলে উঠল,
” আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ “
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে ভুলল না কেউ। তুষার আশানুরূপ বার্তা পেয়ে আনন্দে মা’কে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি নিরবে ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ পর নিজের বাবা হবার সুুখ, আনন্দ প্রকাশ করে দিল। তার অস্থির হৃদয়কে সে মা’য়ের কাছে প্রকাশ করতে চাইল৷ সকলের মুখে তৃপ্তিময় হাসি চোখে টলমল পানি৷ আনন্দে তাদের কান্না চলে আসছে৷ মালিথা ভিলায় এই প্রথম ছোট ছোট হাত, পা, মুখ ওয়ালা অতিথি এলো আনন্দ হবে না? সকলে কত শত ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল সব কি ভুলে গেলে চলবে? তারা মামা, চাচা, ফুপু, চাচি নিয়ে কতই না ঝগড়া করেছিল ভুলে গেলে চলবে?
জাকিয়া কেঁদে দিয়ে ছেলেকে আগলে ধরেছেন৷ আনন্দের মূহুর্তে তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেছেন৷ এই মূহুর্ত প্রকাশ করার মতো না, এই মূহুর্ত অনুভব করার মতো। কতটা আনন্দ হয় একজন মা, বাবা যখন নাতি-নাতনীর দাদা- দাদি হয়? এটা বোধহয় সে-সকল দাদা দাদিরাই বুঝে কতটা আনন্দের হয়! জাকিয়া দাদি হয়ে গেলেন এটাই যেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ছেলেকে তুলে বললেন,
” আব্বু, আমি দাদি হয়ে গেছি?”
তুষার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে মাথা উপর নিচ বার কয়েক ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ উত্তর বুঝাল৷ শিশির আনন্দে মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” এ্যাই ভাই, তুমি বাবা আর আমি চাচু হয়ে গেছি! “
তুষার ভাইয়ের দিকে ফিরে একই ইঙ্গিতে একই ভাবে উত্তর করল। নীহার, তুহিন একসাথে জোড়া কথা বলে উঠল,
” ভাই, ভাতিজা চলে এসেছে আমাদের পরিবারে! “
আবারও একই ভাবে উত্তর করল তুষার। সাথে সাথে তিন ভাই তুষারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তুষার হেসে তিন ভাইকেই আগলে ধরল৷ আনন্দ যেন কানায় কানায় পূর্ণ হতে লাগল৷ জাকিয়া, আম্বিয়া প্রাণ ভরে দেখলেন৷ ওরা তিন ভাই জড়িয়ে ধরে একসাথে সব বলে উঠল,
” অভিনন্দন, অভিনন্দন, অভিনন্দন ভাই তুমি বাবা হয়েছ। “
তুষারও একই ভাবে তিনজনের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোদেরও অভিনন্দন, তোরা চাচু হয়েছিস “
বলতেই তিনজন ছেড়ে অমায়িক হাসল৷ ওরা ছাড়তেই এবার কুয়াশা যা বলে উঠল তা শুনে শিশির আহত হলো। আনন্দের মুখটা তৎক্ষনাৎ পাংশুটে মুখে ধারণ করল। বউ তার আনন্দে আটখানা হয়ে বড় ভাইয়ের বুকে গিয়ে পড়ে বলে উঠল,
” এ্যাই বড় ভাইয়া, আমি ফুপু হয়ে গেছি! “
তুষার হেসে বোনকে আগলে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, সকল ছানাপোনাদের একমাত্র ফুপু তুই “
শিশির তা শোনা মাত্র-ই মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো করে চুপসানো ভাব ধরে আহত স্বরে বলে উঠল,
” দ্যাট’স নট ফেয়ার ভাই! আমার ছানাপোনাদের অন্তত ফুপু বানিয়ে দিয়ো না! ওরা মা’য়ের অভাবে ভুগবে। এই জন্য বলেছিলাম এইসব আউল ফাউল বোন টোনের সাথে বিয়ে টিয়ে দিয়ো নাহ্। যত্তসব! “
বলেই মুখটা শুটকি মাছের মতো শুকিয়ে চূড় করে ফেলল। আর সকলে? সকলের শিশিরের অবস্থা ও কথা শুনে দম ফাটা হাসিতে মত্ত হলো। আম্বিয়া হাসতে হাসতে সাবধানি বাণী দিলেন এটা হসপিটাল। কুয়াশা একে তো লজ্জা পেল সাথে শিশিরের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার যোগার৷ নীহার, তুহিন হাসতে হাসতে শিশিরকে দুই পাশ থেকে কাঁধ জড়িয়ে বগল দাবা করল। শিশির কুয়াশার হাসি সহ্য করতে পারছে না৷ সেটা যেন জ্বলা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে৷ সে কটমট নজরে কিড়মিড় করতে লাগল কুয়াশার দিকে তাকিয়ে৷ মনে মনে আওরাল,
” ফাজিল, গোবর ঠাঁসা একটা। ফুপু হবার শখ দেখো! “
নীহার হেসে নিয়ে বলল,
” থাক ভাই আর দুঃক্ষ প্রকাশ করিস না৷ পাবলিক তোর অবস্থা দেখলে হাসতে হাসতে শহীদ হবে। কুশু তোর ছানাপোনাদের মা-ই হবে। হ্যাপি? “
আবার হাসল সকলে। কুয়াশা কী করবে বুঝছে না তার লজ্জা লাগছে প্রচুর। শিশির কিড়মিড় করে উঠল নীহারের উপর। বলল,
” ভালোয় সব মজা লাগছে তোদের নাহ্? “
” বিশ্বাস কর, সেই মজা লাগছে! “
নীহারের কাটা ঘায়ে নূনে ছিটা দেয়া উত্তর শুনে আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শিশির। আর সেই আ-গুনে যেন কুয়াশাকে জ্বালিয়ে দিয়ে ভ-স্ম করে দেবে ভাবটা এমন তার৷
‘
তুহিন, নীহার, শিশির, তুষার খাবার আনল মা’দের জন্য ও বোনের জন্য৷ ওরা বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছে৷ বাড়িতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সুসংবাদটি। সকলে টেনশনে ছিল বেবির রেসপন্স করা নিয়ে। তুষারদের এখনো দেখতে দেয়নি। বেবির রেসপন্সের পর একটু মায়ের কাছে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডক্টররা৷
বারটার দিকে বৃষ্টি ঘুম থেকে উঠল। বাচ্চার ফিডারিং করাতে নার্সরাই সাহায্য করেছে বৃষ্টি তখনো ঘুমে ছিল। উঠে সন্তানকে কাছে পেয়ে সে কেঁদে দিয়েছে। নার্স অভয় দিয়ে ডক্টর ডাকলে ডক্টর জানালেন আপাতত আর কোনো অসুবিধা নেই আর হবেও না ইনশাআল্লাহ। তুষারদের ভেতরে ঢুকারও অনুমতি দিয়ে গেলেন।
‘
ডক্টরের অনুমতি পেয়ে কুয়াশা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। শিশির বিরক্ত চোখে তাকাল। সবখানে এই গোবর ঠাঁসার পাড়াপাড়ি। কুয়াশা ঢুকলে একে একে সকলে ঢুকল৷ কুয়াশা ঢুকেই ছোট্ট ছানাটাকে তোয়ালের মাঝে শুয়ে ঘুমাতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। আনন্দে এক লাফে বাচ্চাটা কাছে চলে গেল৷
আসলে ও কখনো এমন বাচ্চার সান্নিধ্যে বড় হয়ে ইস্তক আসেনি৷ হিম যখন হয়েছিল তখন ও অনেকটাই ছোট যার জন্য এই এখনকার অনুভূতিটা তখন পায়নি। এই যে এখন এত্তটুকু একটা বাচ্চা যার- ছোট্ট হাত, ছোট্ট পা, ছোট্ট নাক, ছোট্ট মুখ, ছোট্ট চোখ এগুলো একদম নিষ্পাপ। যা দেখলে যে কারোরি আদর আদর লাগবে। আর তুষার, বৃষ্টির ছেলেটা হয়েছেও কিউটের ডিব্বা। যেটা দেখে ও আরোই নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না৷ এখনকার সম্পর্ক বাদ দিয়ে ওর মাঝে ফুপুর সত্ত্বা জেগে উঠেছে৷ তুষারকে ও সব সময়ই ভাই হিসেবে দেখে। সেক্ষেত্রে তুষারের বাচ্চাকে ওর আপন আপন লাগছে। খুবই আদর পাচ্ছে ওর। ভাইদের সন্তানের উপর একটা ফুপুর কতটা টান হয়? আদর আসে? ভালোবাসা জাগে?
চোখ টলমল করে বাচ্চাটার কাছে হাঁটু মুড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছে। এই প্রাণটাকে নাকি হারাতে যাচ্ছিল তারা! ভাবলেই এখনো হাত পা কাঁপছে, বুক কাঁপছে। যদি সত্যি হারিয়ে ফেলত? ডান হাত তুলে বাচ্চাটার গালের উপর রাখল আলতো করে৷ আহ্ কী সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো! ভেতরটা উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। তাদের পরিবারে ছোট্ট একটা প্রাণ এসে গেছে। তার ফুপু হয়ে এতটা আনন্দ লাগছে তাহলে এই সময়ে তুষার আর বৃষ্টির কেমন লাগছে? ভেবেই বৃষ্টির দিকে এতক্ষণ পর ভালোভাবে দৃষ্টি দিল। ইশশ! মুখটা শুকিয়ে আছে কিন্তু মুখে প্রশান্তিময় হাসি। বৃষ্টিও অমায়িক হেসে তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। কুয়াশা বাচ্চাটার গালের উপর হাত রেখেই পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা জাকিয়ার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু, দেখো কত্তটুকু! আর কী কিউট হয়েছে দেখো! “
জাকিয়াও টলমল চোখে তাকিয়ে পাগলামী দেখছেন আর দাদি হবার আনন্দ উপভোগ করছেন৷ উপস্থিত সকলে ঠোঁটে হাসি ঝুঁলিয়ে কুয়াশার বাচ্চামি দেখছে৷ আর শিশির? ওঁ তো বউয়ের কাছে বাচ্চাটাকে কতটা সুন্দর লাগছে সেটা দেখেই আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে৷ বাচ্চা নিয়ে বউয়ের পাগলামি দেখছে আর ঠোঁটে হাসির রেখা ঝুলিয়ে রেখেছে৷
বৃষ্টি এতক্ষণ পর তুষারের দিকে তাকাল৷ তুষার ঢুকে পর্যন্ত বউ আর তার কোলের মাঝে শুয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণটাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল। তার যেন চোখই সরছে না আর না মন,প্রাণ জুড়াচ্ছে। তুষারও তাকাল বৃষ্টির দিকে। অমায়িক হাসল দু’জন। এই অনুভূতি কি করে প্রকাশ করবে দু’জন? সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতক আর সদ্য হওয়া মাতা-পিতা তারা! কেউ কি এই অনুভূতি অনুভব করতে পারছে? নাকি অনুমান করতে পারছে? পারছে কি অনুধাবন করতে?
বৃষ্টির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। তুষারের চোখে পানির আভাস। হৃদয় জুড়ানো অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে গেল বউ, বাচ্চার কাছে। সে পাশের টুলে বসল৷ বৃষ্টির কপাল সহ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিল৷ বলল,
” কেঁদো না সব ঠিক আছে। আমরা হারায়নি ও’কে “
এরপর ঘুমিয়ে থাকা ছেলের গালের উপর হাত রাখল৷ অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল অন্তর, কায়া তার। মা’য়ের দিকে তাকিয়ে মা’কে ডাকল,
” আম্মু..! “
জাকিয়া হাসলেন। ছেলের অনুভূতি তিনি ঠিক ধরতে পারছেন৷ উনারাও যে এই অনুভূতি পাড় করে এসেছেন! বললেন,
” কেমন অনুভূতি? আমি আর তোর বাবাও তোর সময় এমন অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়েছিলাম “
তুষার অমায়িক হাসল আবার। শিশির গিয়ে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। জাকিয়া হেসে ডান হাতটা ছোট ছেলের গালে রাখলেন৷ জাকিয়া তুষারকে বললেন,
” কোলে নে “
তুষার কেঁপে উঠল কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই। তড়িৎ বৃষ্টির দিকে তাকাল৷ বৃষ্টিও নিতে বলল৷ ফের মায়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
” আম্মু যদি পড়ে টরে যায়! “
জাকিয়া সহ আম্বিয়ারা সকলে হেসে ফেলল৷ বৃষ্টিও হেসে ফেলেছে। এই লোকটা সেই শুরু থেকে পাগলামি করত। এখনো করছে। একটা পুলিশ অফিসারও ছোট্ট বাচ্চাতে পরিণত হয়েছে বাবা হবার আনন্দে। নীহার বলল,
” ভাই, তুমি স’ন্ত্রা’সি ধরে বেড়াও অথচ ছেলেকে কোলে নিতে ভয় পাচ্ছ? পড়ে যাবে কিনা? ইন্টারেস্টিং! “
সকলে মুচকি হাসল। তুষার একটু লজ্জা পেল বটে এভাবে সরাসরি কথাটা বলাতে। তারই বা কি দোষ? সে সত্যি আনন্দে পাখির ন্যায় উড়ছে। ধমক দিল তুষার একটু নীহারকে। বলল,
” তুই চুপ থাক! আমার সত্যি ভয় হচ্ছে “
সকলে আবার হাসল। জাকিয়া বললেন,
” কিছু হবে না। কোলে নে। “
তুষার তা শুনে বৃষ্টিকে একবার দেখে কাঁপা শরীরে উত্তেজনা নিয়ে আলতো করে কোলে তুলে নিল। অদ্ভুত ভাবে নবজাতকটি নড়ে তো উঠলোই সাথে একটু কান্না করল। বোধহয় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল বাবা তার। তুষার আনন্দে হেসে উঠল৷ শব্দ বের করল মুখ দিয়ে,
” ও…..!”
বৃষ্টি হাসল। কুয়াশা ঐ ভাবেই বসে থেকে ভাইয়ের কোলের উপর থেকে নবজাতকের শরীরের উপর হাত দিল। তুষার তা দেখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কুশু.. দেখ কী সুন্দর! “
কুয়াশাও আহ্লাদে বলল,
” হ্যাঁ, পুচ্চু পুচ্চু একদম “
শিশির ভড়কে তাকাল। এটা আবার কি বলল এই গোবর ঠাঁসা? ধমক দিল মৃদু। বলল,
” এ্যাই! ওভাবে নোংরা জায়গায় বসে আছিস কেন? ওঠ! আর ওটা কি বললি? পুচ্চু পুচ্চু মানে কী? “
কুয়াশা ধমক খেয়ে উঠে দাঁড়াল। বিরক্ত নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। বলল,
” পুচ্চু পুচ্চু মানে বাচ্চা বাচ্চা। ওসব তুমি বুঝবে না তাই চুপ থাকো!”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল শিশির৷ জাকিয়া হেসে এগিয়ে গেলেন নাতিছেলের কাছে৷ ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন৷ তুষার তাকিয়ে বলল,
” ও আম্মু, কেমন কিলবিল করছে দেখো!”
জাকিয়া আবার হাসলেন। তুষার বলল,
” আম্মু কোলে নাও! “
বলে এগিয়ে দিল। জাকিয়া কোলে নিলেন৷ অনুভূতির জোয়ারে ভেষে গেলেন। আহ্ তিনি দাদি! প্রথম নাতিছেলে তার! জাকিয়াকে কোলে নিতে দেখে কুয়াশা বলে উঠল,
” আম্মু আমিও নেব কোলে! “
জাকিয়া কুয়াশার কথাতে তাকালেন। বললেন,
” এগিয়ে আয় “
জাকিয়ার কথা শুনতেই শিশির বলে উঠল,
” একদম না আম্মু, ও ফেলে দেবে। এমনি নিজেই তিড়িং বিড়িং করে বেড়ায়!”
কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” এ্যাই, বুনো ওল থামবে তুমি? “
বলে এগিয়ে গেল৷ শিশির আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল৷ জাকিয়া কোলে দিলেন। কুয়াশা কোলে নিতেই আবার কোলের মাঝে কিলবিল করে উঠল নবজাতকটি। কুয়াশা উত্তেজিত হলো। হাসল অমায়িক৷ শিশিরের কাছে এগিয়ে গেল কোলে নিয়ে উত্তেজনার সাথে। আনন্দে আটখানা হয়ে গদগদ স্বরে বলল,
” এ্যাই দেখো দেখো কী সুন্দর! আবার নড়ছেও “
শিশির কুয়াশার কার্বার দেখে হাসল৷ ওর কোলে কী সুন্দর লাগছে! শিশির আর কুয়াশা বাচ্চাটাকে নিয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। সকলে দেখল ওদের কোলে বাচ্চা সমেত। মনে হচ্ছে মা বাবা তার বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাকিয়ে মনে মনে বললেন,
” আল্লাহ আমার ছোট মানিকের ঘরও আলোকিত করুক এভাবেই। আমিন “
বৃষ্টি নিষ্প্রাণ স্বরে বলল,
” দেবরজী, কুশু! তোমাদেরও আসবে এমন পুচ্চু পুচ্চু “
দু’জনেই তড়িৎ বৃষ্টির দিকে তাকাল। এরপর নিজেদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল। কুয়াশা লজ্জা পেল শিশিরের দিকে তাকাতেই। শরীরে অদ্ভুত শিহরণ হলো৷ শিশিরেও একই অবস্থা হলো। সকলে মুচকি হাসল ওদের অবস্থা বুঝতে পেরে৷ কুয়াশা লজ্জাটাকে হটিয়ে বলল,
” এ্যাই দেখো আমার মতো লাগছে নাহ্! ওর নাকটা একদম আমার মতো হয়েছে। এই জন্যই এত কিউট হয়েছে।”
শিশির ভ্রু ম্রু কুঁচকে তাকাল৷ দিল একটা মাথায় চাটি বসিয়ে। কুয়াশা আহ্ করে উঠল৷ তার আনন্দের ব্যন্ড বাজিয়ে দিল এই বুনো ওলটা৷ আহ্লাদী কথাটার মূল্যই দিল না। ভ্রু কুঁচকে রেগেমেগে তাকাল। কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ শিশির বলল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা ও’কে তোর মতো কোন দিক দিয়ে লাগছে? ও হয়েছে একদম চাচুর মতো৷ দেখ কী সুন্দর কিউট হয়েছে চাচুর মতো। নাক, চোখ, ঠোঁট সব আমার মতো। বড় হলেও চাচুর মতো হবে একদম”
” ওরে..আমার কিউট রে! বুনো ওল তুমি একটা তোমার আবার সৌন্দর্য আছে নাকি? হুঁহ্! “
বলেই সরে আসল শিশিরের থেকে৷ নীহার বলল,
” এ্যাই তোরা ঝগড়া কর যত করার। তার আগে আমার কাছে দে ও’কে “
বলে কুয়াশার থেকে নীহার কোলে নিল৷ একে একে আম্বিয়া, তুহিনও নিল৷ সর্বশেষ শিশির কোলে নিল৷ শিশির কোলে নিয়ে নিজের গালের সাথে গাল লাগাল বাচ্চাটার৷ কুয়াশা দেখে হাসল৷ বাচ্চাটা শিশিরের ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পেয়ে কেঁদে উঠল। কুয়াশা বলল,
” এ্যাই তোমার দাঁড়িতে বিঁধছে ওর “
শিশির তা শুনে ভাবল সত্যি হয়তো৷ তুষার, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভাই, ভাবি! নাম কি রাখবে বেবির?”
কথাটা শোনা মাত্র কুয়াশা বলে উঠল,
” বর্ষণ মালিথা “
তুষার অদ্ভুতভাবে তাকাল কুয়াশার দিকে। বৃষ্টিও তাকাল অবাক চোখে। তারা কখনো বেবির নাম নিয়ে সকলে মিলে আলোচনা করেনি। ওরা দুজন শুধু ঘরে বলাবলি করত৷ তুষার, বৃষ্টি দু’জনই বলে উঠল।
তুষার বলল,
” আরেহ্ এটা আমিও বলেছিলাম!”
বৃষ্টি বলল,
” আরেহ্ এই নামটাই তোহ্ তোমার ভাই রাখতে চেয়েছিল “
কুয়াশা আনন্দে আহ্লাদী হয়ে উঠল নাম মিলে গেছে বলে৷ শিশির নাম শুনে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আওরাল,
” তুষার বৃষ্টি, তুষার বর্ষণ!”
নীহার তা শুনে বলল,
” বৃষ্টির বিশেষ্য বর্ষণ! “
এরপর শিশির, নীহার দুইজনই এক সাথে বলে উঠল,
” আরেহ্ বাহ্ সেই তোহ্! দুই জনের নামের সাথেই বর্ষণ মিলে! “
কুয়াশা বলল,
” হ্যাঁ “
তুষার, বৃষ্টি হাসল৷ জাকিয়া, আম্বিয়া একসাথে বললেন,
” মাশাআল্লাহ “
সকলে অমায়িক হাসল। বাচ্চাটা সকলের মুখে আনন্দের ফোয়ারা তুলে দিয়েছে। একটি বাচ্চা ঘরে কতটা আনন্দ আনতে পারে চিন্তা করা যায়! সকলের মুখে যে আনন্দটা বিরাজমান একটু আগে তা আমাবশ্যা রূপে ছিল৷ মালিথা ভিলায় কখনো দুঃখ মানায় না৷ সব সময় হাসিখুশিতে পূর্ণ থাকবে তেমন টাই মানায়৷
| চলবে |
৬১নং পর্বটা এডিট করা হয়েছে বিস্তারিত নোটও করে দিয়েছি
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click