®রোজা রহমান
‘
কাক ডাকা ভোর, মৃদুমন্দ বসন্তের বাতাবরণ, বসন্তের কোকিলের ডাক, আলোআঁধারিতে ঘেরা চারিকোণ সব মিলিয়ে পরিবেশ রোমাঞ্চকর।
চারিদিকে আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসল কুয়াশার। সারারাত ছটফট করেছে একটা শক্ত হাতের স্পর্শের জন্য, একটা শক্তপক্ত লোমশ বুকের জন্য, একটু মাদকতায় মেশানো শরীরের জন্য, একটু আফমিমের ন্যায় শরীরের গন্ধের জন্য। ছটফট করেছে বুকের মাঝের আগলে রাখা হাতের জন্য। কিন্তু হায় আফসোস! সে পায়নি ঐ সমষ্টি জিনিসের মালিকটাকে৷ চেয়েও সারারাত পায়নি সেই মানুষটাকে। বুকের মাঝের চাপা ভারী কষ্টে গলা কা–টা মুরগীর ন্যায় তড়পিয়েছে। তড়পিয়েছে কী? এখনো তড়পাচ্ছে।
ঘুম তো তার সব সময়ই হালকা। কিন্তু রাতে যেন ঘুম তার আসেই নি৷ না ঘুমানোর মতোয়৷ রাতে খাবার খেয়ে পড়তে বসেছিল৷ কিন্তু পড়া তার হয়নি। শুয়ে পড়ে ছটফট করছিল৷ এগারোটার পর শিশিরকে আবার কল দেয় সে। শিশির রিসিভ করে। কথা হয় অনেকক্ষণ। শিশিরেরও রাতে ঘুম হচ্ছিল না বিধায় গল্প করে অনেকটা রাত৷ গল্প করতে করতে সময় একটা পাড় করে। অনেক রাত হওয়াতে শিশির কুয়াশাকে ঘুমাতে বলে৷ কুয়াশা উচ্চবাচ্য করে না। ভাবে হয়তো শিশির ক্লান্ত তার ঘুমের প্রয়োজন লং জার্নি করেছে৷ এসব ভেবে সে-ও সম্মতি দিয়ে ফোন রাখে। কিন্তু ফোন রাখতেই আবার আগের মতো বুকের ব্যথা বাড়ে। কী নিদারুণ, নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে। কাউকে না দেখাতে পারে আর না বলতে পারে।
রাতে শিশিরের ঘরেই শুয়েছে সে। এই ঘর ছাড়া তার রাতে শোয়া অসম্ভব মনে হয়েছে। রাতের আঁধারে ঘরের লাইট বন্ধ করলে তাকে আরো নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে। এতগুলো মাস যে মানুষটার বুক ছাড়া ঘুমায়নি সে এই অসহ্য, কঠিন রাত পাড় করতে পারে না। শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে যে উষ্ণ ছোঁয়ায় শান্তির ঘুম দিয়েছে আজ রাত সে একা কাটাতে কষ্ট পেয়েছে৷ এই রাত যেন লেগেছে জনম জনম, বছর বছরের দীর্ঘতম রাত। বিয়ের দিন রাত থেকে শিশিরের বুকে রাত কাটায়। প্রথম প্রথম নিজে থেকে না গেলেও দূরে থাকলেও শিশির নিজেই টেনে টেনে বুকে নিত। সকালে সে শিশিরের বুকের মাঝে ছোট্ট আদুরে বিড়াল ছানার মতো করেই গুটিশুটি হয়ে ঘুমাত। খারাপ লাগত না বরং অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। আর পরে তা বদঅভ্যাসে পরিণত হলো। না শিশির থাকতে পারত আর না সে৷
ছটফট করে তিনটা পাড় করে। শিশির যেখানে যেপাশে ঘুমাত সেপাশে ঘুরে শিশিরের বালিশ আঁকড়ে ধরে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। মাঝে মাঝে বুক ডলতে থাকে হাত দিয়ে ব্যথা কমানোর জন্য। এ কী অভ্যাস করে দিয়ে গেল মানুষটা?
মানুষ সত্যি অভ্যাসের দাস। আজ যদি কুয়াশার মা’য়ের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি বলে কিছু থাকত তাহলে এতটাও কষ্ট করতে হতো না। কারণ বিয়ের পর স্বামী ছাড়া মা’য়ের বাড়ি কাটাতে পারত। কিছুটা হলেও অভ্যাস থাকত। কিন্তু কুয়াশার ক্ষেত্রে একদম ভিন্ন। সে না পেয়েছে আলাদা মা’য়ের বাড়ি আর না পেয়েছে আলাদা শ্বশুরবাড়ি। শিশিরও কখনো কাছছাড়া করেনি। শশীদের বাড়িতে একা থাকতে হবে বলে সে ছাদে পর্যন্ত থাকতে রাজি ছিল তবুও কুয়াশাকে ছাড়া থাকেনি। তাহলে কতটা কষ্ট হতে পারে চিন্তা করা যায়!!
রাতে অভাবেই কাঁদতে কাঁদতে চোখের পাতায় ঘুম নামে চারটার দিকে। এরপর কিছুক্ষণ নায় ঘুমোতে আজান কানে আসে৷ আবার ঘুম ভেঙে যায়। আজানের পরেও কতটা নিঃসঙ্গতা লাগছে একমাত্র সে জানে। রোজ হয় ও ডাকবে শিশিরকে না হয় শিশির ওকে ডাকবে৷ এরপর সালাম বিনিময় করে শিশির ও’কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে নেক স্মেল নেবে৷ যেটা তারও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নেক স্মেল না নেয়া অবধি শিশির ছাড়ত না আর সে-উঠত না। এইসবই ঘুম ভেঙে মনে পড়ল। আর পাশে শিশিরকে খুঁজল। এ-ও ভাবল শিশির আজ কোথায় পাবে তার গ্রীবাদেশের সুবাস! মিস করছে কী তাকে? সে-ও কি তার জন্য ছটফট করছে? ভাবতে ভাবতে আবার টপটপ করে পানি ফেলল চোখ থেকে৷
ভাবনার কিছুক্ষণের মাঝে ফোন ভাইব্রেট হলো। তড়িৎ পিছন ঘুরে দেখল ফোন বাজছে। শিশিরের ফোন তাও আবার ভিডিয়ো। তড়িৎ উঠে লাইট জ্বালাল। রিসিভ করল কল। সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের মুখ ভেসে উঠল। শিশির দেখল বউ তার কাঁদছিল তাকে না পেয়ে। চোখের পাপড়ি ভেজা। কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইল। শিশিরেরও চোখ মুখ লাল। হয়তো ঘুমোয়নি। কুয়াশাকে কথা বলতে না দেখে সে-ই আগে সালাম দিল,
” আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ্ আমার আহ্লাদী বউ! “
” ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ্। আসসালামু আলাইকুম আমার প্রিয় স্বামী “
” ওয়া আলাইকুমুসসালাম। বাহ্ ডাকটা নতুন মনে হচ্ছে! “
কুয়াশা ঠোঁট টিপে মুচকি হাসল। বলল,
” হুঁ, তোমার আহ্লাদী বউয়ের প্রিয় স্বামী তুমি। একদম ব্র্যান্ড নিউ ডাক! ভাবলাম বুনো ওলের জন্য নতুন কিছু ট্রাই করি!”
শিশির ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসল। বলল,
” হুঁ পছন্দ হলো বেশ। তো এটার জন্য তোকে কিছু দিতে ইচ্ছে করছে। কি দেওয়া যায় বল তোহ্? “
” তা তুমি জানো! “
” তোর ঠোঁটে পুরো দশ মিনিটের চুমু দিলাম যাহ্! “
শোনা মাত্র কুয়াশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলে কী এই বুনো ওল!! মানে এটা আবার কেমনে কি? এভাবে দশ মিনিটের চুমু! আশ্চর্য! কুয়াশার রিয়াকশন দেখে শিশির এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। আর পাশে থেকে রিজভী চেঁচিয়ে উঠল। কিছু একটা বলল যেটা কুয়াশা শুনল না। কারণ শিশির এয়ারফোন নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু শিশির বলল,
” এ্যাই বে-য়াদব তুই বউয়ের সাথে লুতুপুতু করছিস কর নাহ্ এদিকে কি তোর? কান সামলাহ্! “
রিজভীকে কিড়মিড় করতে করতে ধমকে কথাগুলো বলল সে৷ রিজভীও একই সুরে বলে উঠল,
” বউরে তুমি এইভাবেই দশ মিনিটের চুমু দিচ্ছ আর আমি কইলেই দোষ? শা-লা এখন আমি-ই যত দোষ নন্দ ঘোষ হয়ে গেলাম!”
” চুপ থাক বেয়াদব! “
বলে কুয়াশার দিকে ঘুরল কুয়াশা শুধু শিশিরের কথাগুলো শুনল। লজ্জায় মরিমরি সে। বলে উঠল,
” এ্যাই বুনো ওল, এসব কী হ্যাঁ? ইশশ লজ্জায় নাক কাটা গেল আমার! “
” কী আবার চুমু! তোর অয়েড এটা “
মানে কী সব কই এ! এ ভাবে তার পাওনা মেটাচ্ছে! কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” অসভ্য বুনো ওল! “
” যাক বাবাহ্ আমিই অসভ্য হয়ে গেলাম! এই জন্য বলে মানুষের ভালো করতে নেই”
” হ্যাঁ ভালো করে উদ্ধার করে দিলে নাহ্! অসভ্য ঠোঁট কাটা পুরুষ লোক! “
শিশির ঠোঁট টিপে টিপে হাসল শুধু বউ তার ঝগড়া রূপে ফিরেছে। একে স্বাভাবিক করতেই তো এমন ফাজলামিগুলো করল। সে বেশ ভালোরকমই জানে তার আহ্লাদী বউ সারারাত তার মতোই ছটফট করেছে বুকে ঘুমানোর জন্য। সে-ও তো তার বিড়াল ছানা আহ্লাদীটাকে বুকে না পেয়ে ছটফট করেছে। নেক স্মেল না নিতে পেরে বুক সহ মাথা পর্যন্ত ঝিমঝিম করছে। যেমনটা হয় নেশা সেবন করতে না পারলে! ঠিক তেমন। এজন্যই তো আজানের সময় উঠে আগে কল দিয়েছে। বুকটা তার সারারাত শূণ্যতায় পড়ে ছিল। এখন মুখটা দেখে কিঞ্চিৎ হলেও কমল। ঘড়ি দেখল৷ পাঁচটা বেজে আসছে। বলল,
” যাহ্ নামাজ পড়ে নে৷ পাঁচটা বেজে আসল৷ আমিও উঠব “
কুয়াশা দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। ধরা কন্ঠে বলল,
” সারারাত ঘুম হয়নি জানো! তোমার বুক খুঁজে বেড়িয়েছি। তোমার হাত খুঁজে বেড়িয়েছি। তোমার শরীরের স্মেল খুঁজে বেড়িয়েছি “
শিশির শুনে চুপ করে থাকল। শুধু তাকিয়ে থেকে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে লাগল। নিজেকে প্রকাশ করল না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল একটা৷ বলল,
” একটু কষ্ট সহ করে নে সোনা। আবার আগের মতো হয়ে যাবে সব “
” কবে হবে? তুমি চলে আসো না প্লিজ! “
বলেই কেঁদে উঠল। কী বাচ্চামি কথাবার্তা বোঝো তো! এই মেয়ে শুধু কাঁদে। আচ্ছা এ তো এত কাঁদত না ফেচফেচ করে! এমন কান্না কবে থেকে শিখল? ভালোবাসা এতটায় পাগল করে দিল তাকে!!
‘
এদিকে শিশিরের ভাবনার মাঝে কুয়াশার ওমন কথা আর কান্নাতে একটা গান মনে পড়ে গেল৷ আছে নাহ্ একটা গান!
— তুমি গেছ বিদেশে আমায় রাইখা বাড়িতে! ও নাহ্ থুড়ি শিশির তো ঢাকায়! কথাটা এমন হবে,
“”— তুমি গেছ ঢাকাতে আমায় রাইখা বাড়িতে!
— চইলা আসো বাড়ি আমার টাকার দরকার নাই!
— চইলা আসো বাড়ি আমার টাকার দরকার নাই! “”
ঠিক এই গানটায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যায়হোক এদের এমন ইমোশনাল মোমেন্টে গান টান আর না গাই!
‘
শিশির এবার একটু কঠিন ভাবে বলল,
” শক্ত, হ কুয়াশা। এমন তো ছিলি না তুই? বুঝদার থেকে এমন পাগলামি কেন করছিস? কী সব পাগলামি কথা বার্তা বলছিস! আমি যেন আর কাঁদতে না দেখি তোকে। আর একবার চোখের পানি দেখলে ফোন টোন আর দেব না৷ তখন থাকিস তোর ফেচফেচ কান্না নিয়ে৷ গোবর ঠাঁসা একটা! “
কুয়াশা কান্না থামিয়ে দিল৷ মনটা একটু খারাপ হলো এমন রূঢ় আচরন আর কথা শুনে তার। তবে কিছু বলল না৷ শক্ত হয়ে চোখ মুছে নিল। বলল,
” রাখলাম৷ নামাজ পড়ব৷ ভালো থেকো, আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই শিশিরকে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিল। শিশিরের একটু খারাপ লাগল। তবে নিজের খারাপ লাগাটা দমিয়ে নিয়ে বড় একটা শ্বাস ফেলল।
ওভাবে বলতে চায়নি সে। না বললেও হচ্ছিল না৷ আর কতই বা কাঁদবে? কাল থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। দূরে থেকে এসব দেখলে খারাপ লাগা আরো বাড়বে না?উঠে পড়ল। নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রিজভী অনেকক্ষণ আগেই উঠে গেছে। সে ওজু করে বেড়িয়েও এসেছে। শিশির ঢুকল। কিছুক্ষণের মাঝে বের হয়ে নামাজ আদায় করে নিল।
__________
মালিথা ভিলায় সকাল আটটার দিকে সকলে নাস্তা করছে৷ জাকিয়া জাকির মালিথার জন্য খাবার রেডি করে নিয়ে উপড়ে চলে গেলেন৷ ইয়াসমিন, বৃষ্টিও একসাথে বসেছে। চেয়ার পড়ে আছে আজ। জাহিদ মালিথা নেই, জাকির মালিথা ঘরে খান, শিশির নেই তো চেয়ার পড়ে থাকবে না? সকলেই শিশিরকে মিস করল৷
নীহার বার বার শিশিরের চেয়ারটাতে তাকাতে লাগল৷ চেয়ারটায় আজ কেউ আর বসে নি। নীহার খুব করে মিস করছে শিশিরকে। ভাইটার সঙ্গ সে অধিকাংশ সময়ই পেত। খাবার টেবিলেও চুপচাপ, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। যারা ঝগড়া, চুলোচুলি করে জমিয়ে রাখত তারাই তো নেই! তারা বলতে একটা মানুষই তো নেই! তাই অপরজনও নিরব। বাড়িতে শিশির, কুয়াশাই ছোট দের মতো মাতিয়ে রাখত। তারাই ছোট ছিল মনে হতো। হিম আগাগোড়া-ই নিরব। প্রয়োজন ছাড়া চঞ্চলতা দেখায় না।
কুয়াশা চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল৷ কলেজে যাবে সে আজ। বাড়িতে আর থাকতে পারছে না। এই কলেজে যাওয়া নিয়েও শিশিরকে মনে পড়ল। তারই তো বাইকে যেত!! ঐ ছেলেটা তার সব কিছুতে জড়িয়ে আছে।
সাড়ে আটটার দিকে কুয়াশা বের হয়ে গেল৷ সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিরব কুয়াশাকে মানাচ্ছে না একটুও৷ শিশির ভিডিয়ো কল দিল সেসময়ে বাড়িতে মায়ের ফোনে৷ তুষার, তুহিন, আম্বিয়া বের হবে একটু পর। শিশিরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তারাও চলে গেল৷ সে বসার ঘরে নীহার, হিম, বৃষ্টি, ইয়াসমিন, আজমিরা আর জাকিয়ার সাথে কথা বলতে লাগল৷ আড্ডা দিল অনেক সময়। কুয়াশার কথা জিজ্ঞেস করলে জাকিয়া জানালেন কলেজে চলে গেছে৷ শিশির কিছু আর বলল না কুয়াশাকে নিয়ে৷ বউয়ের জায়গা বউয়ের জায়গায়৷ এখন সময় পরিবারের। একসময় বাবার কাছে নিয়ে যেতে বলল। জাকিয়া নিয়ে গেলেন৷ বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখল। বাহিরে বের হতে হবে। এই বলে ফোন রাখল।
___________
দুপুর আড়াইটার দিকে কুয়াশা বাড়িতে এলো। কলেজে স্মৃতির সাথে গল্প করে মনটা হালকা করেছে৷ সাথে ঈশা, রনিও ছিল৷ আড্ডা, হাসাহাসি হয়েছে। ঈশা আর রনি স্মৃতিকে আর ওকে বেশ রাগিয়েছে আর মজা নিয়েছে। তারাও বলেছে স্বামী তাদের বিদেশ। এই নিয়ে ঈশা আর রনি অনেক মজা উড়িয়েছে। তারাও ধাপধুপ পি-টিয়েছে দুটোকে। বেলাটুকু বেশ ভালোই গেছে৷
বাড়িতে এসে আবার নিঃসঙ্গতা কুঁড়ে ধরেছে। ঝগড়া না করতে পারলে ভালো লাগছে না বুনো ওলটার সাথে। চুলোচুলি, কেঁচাকেঁচি মিস করছে। মালিথা ভিলায় তারা শালিক পাখির ন্যায় কিচিরমিচির করত। এমন নিরবতা কেমন ভূতের বাড়ি লাগছে।
কুয়াশা এসে গোসল করে নিল। সারাদিন শিশিরের ঘরে ঢুকছে না সে। শুধু রাতে থাকবে ওর ঘরে মনস্থির করেছে৷ নিজের ঘরেই গোসল সহ সারাদিনের কাজ করছে৷ দরকারি জিনিস ডাবল করে নিয়েছে দুইঘর মিলে। গোসল করে নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে এলো। কিছুক্ষণ ঘরে থেকে বৃষ্টির ঘরে চলে গেল৷ বর্ষণের সাথে সময় কাটাবে। সকালের পর আর কল করেনি শিশির। সে-ও করেনি। তার ইমোশনটাকে একটুও মূল্য দিল না সে? অভিমান করল আর সব বউদের মতো সে-ও। আর দেখাবে না ভালোবাসা হুহ্। থাকুক সে একা৷
‘
বেলা ক্ষয়িষ্ণু আলোয় লালিত। চৈত্র মাসের সূর্যের তাপ সারাদিন প্রচণ্ডরকম তেজে ছিল। এখন তার তাপ কমেছে, তেজও কমেছে৷ নেতিয়ে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। লালাভ আলো প্রকৃতিতে বিরাজমান। বিকেলের দিকে কয়েকটা কোকিলের ডাক শোনা গেল। কুয়াশা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছাদ থেকে কিছুটা দূরে একটি শিমুল ফুলগাছ আছে সেটাই দেখা যাচ্ছে যেটাতে লাল শিমুলে টকটক করছে পুরো গাছে ডালপালা। কুয়াশা সেদিকেই তাকিয়ে রইল।
কী যে একা একা লাগছে! এই বিকেলটাতেও সে শিশিরকে পেত৷ আজ আর পাচ্ছে না। তাই ছাদে চলে এসেছে। শিশির এখনো আর কল দেয়নি৷ ফোন হাতে করে এসেছে৷ যদি দেয়!! তারও তো একটা ভাবা উচিত এই সময় কতটা মিস করতে পারে তার আহ্লাদী বউ!!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। সূর্য ডুবে গেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে বেড়াচ্ছে। ফোন বাজল সে-সময়ে। শিশির কল দিয়েছে সারাদিন পর! অভিমান হলো খুব৷ সে তাকে কতটা মিস করছে প্রতিটা ক্ষণে জানে কী! তবুও রিসিভ করল। রিসিভ করে ফোন কানে ধরে সালাম দিল। সালামের জবাব নিতে শোনা গেল ওপাশ থেকে। কুয়াশা আর কথা বলল না। শিশিরই ওপাশ থেকে বলল,
” অভিমান হয়েছে আমার আহ্লাদী বউয়ের? ”
কুয়াশা কোনো উত্তর করল না৷ ওপাশের শিশির মুচকি হাসল। বলল,
” সোনা..! “
এই ডাকটা সে প্রত্যাক্ষাণ করতে পারবে না। বলল,
” হুঁ “
শিশির আবার হাসল। বলল,
” ইশশ, আমার বউটার গাল ফুলানো দেখতে পারছি না তো!”
কুয়াশা কথা বলল না৷ সে আবার বলল,
” সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম৷ বাসার সন্ধ্যান করছিলাম৷ এতদিন হোটেলে থাকা যাবে না৷ অনেক টাকা খরচ হবে। অযথা টাকা খরচ করার ইচ্ছে নাই৷ এছাড়া আমি পারলে রিজভী পেরে উঠবে না৷ দু’জনকেই সবটা ম্যানেজ করে চলতে হবে বছরগুলো। তাই ওর এই উত্তরাই চাচতো খালার ফ্ল্যাটে গেছিলাম৷ ওনারা তিন তালার উপর ভাড়া থাকেন পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে। আমাদের জানালেন চারতালাটা নাকি এখন ফাঁকা পড়ে আছে। বেশ ভালো সুবিধাই আছে ওখানে। পরশু ওখানে চলে যাব৷ আপাতত দুই-তিন মাস বাসাতেই থাকব। এইসবের জন্য ব্যস্ত ছিলাম। “
” হুঁ, বুঝেছি “
” খেয়েছিলি দুপুরে? “
” হ্যাঁ, তুমি খেয়েছিলে? “
” হ্যাঁ, দুপুরে খেয়ে এসেছিলাম ওখান থেকে৷ ওনারা বেশ ভালোই সমাদর করেছেন৷ চারটার দিকে এসে একটু ক্লান্ত লাগছিল তাই গোসল করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ একটু আগে উঠে নামাজ পড়েছি। “
” আচ্ছা, নিয়মমতো সব কোরো। “
” গেছে অভিমান আমার আহ্লাদীর? “
” হুঁ “
শিশির হাসল ঠোঁট টিপে। ডান কান থেকে বাম কানে ফোন নিয়ে বলল,
” কি করছিস এখন? “
” ছাদে আছি। তুমি কি করছ? “
” বসে আছি৷ এখন বাহিরে বের হব একটু ঘোরাঘুরি করতে “
” আচ্ছা। দেখেশুনে চলবে কিন্তু! “
” পাকনি বউ আমার। আমাকেই উপদেশ দেয়! “
কুয়াশা হাসল কিঞ্চিৎ। শিশির বলল,
” সন্ধ্যা নেমে গেছে নিচে যা সোনা৷ রাতে কল দেব৷ “
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে বলল,
” আল্লাহ হাফেজ “
” আল্লাহ হাফেজ “
বলে শিশির কল কাটল। কুয়াশাও শান্তির একটা নিঃশ্বাস টানল আর ফেলল গোধূলির আকাশে তাকিয়ে। এরপর নিচে নেমে গেল।
__________
কেটে গেল একটা সপ্তাহের বেশি। মালিথা ভিলা একদম শান্তশিষ্ট হয়ে গেছে। কেমন যেন মৃ-ত্যুপুরি মনে হয়। কবে যে সব আবার আগের মতো হবে! আদৌ কি আর আগের মতো হবে? নাকি দিন পাল্টে, মাস পাল্টে, বছর পাল্টে সব রঙও পাল্টে যাবে? পাল্টে যাবে কী আড্ডা মজায় মেতে থাকা মালিথা ভিলা? সকলে কি চিরকাল এক থাকে? চাইলেই কি সম্ভব চিরকাল এক থাকা? উহু সম্ভব না। সময়, দিন, মাস, বছরের সাথে সাথে মানুষেরও পরিবর্তন আসে। বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বাড়ে ব্যস্ততা। হয়তো সেই ব্যস্ততা কাটিয়ে সময়টা কিঞ্চিৎ আগের মতো করে কাটানো সম্ভব হয় তবুও সেটা ক্ষণিকের জন্য।
এতকাল মালিথা ভিলার সকল সদস্য মিলেমিশে একে অপরের সাথে থেকে দিন, মাস, বছর পাড় করেছে। এখন সময় আসছে সবার সবটা নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেবার। ভবিষ্যতের পেছনে দৌড়বার৷ তেমনই দৌড়েছে নীহারও। শিশির গেছে তার ভবিষ্যত গোছাতে। নীহারও চলে গেছে তার ভবিষ্যত গোছাতে।
সে ঢাকায় গেছে আজ চারদিন হলো। সেখানে নেভি স’শ’স্ত্র কমিশন অফিসার ক্যাডেট ব্যাচের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার কেন্দ্রস্থল ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক সাক্ষাৎকার ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়া লাগবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের আইএসএসবি (ISSB) কর্তৃক পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার আন্তবাহিনী নির্বাচন পর্ষদ আইএসএসবি কর্তৃক পরীক্ষা এবং চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে পার্থী বাছাই করা হবে। এরপরই তাদের প্রশিক্ষণ৷
‘
নীহার যাবার পর থেকে আরো খা-খা করে মালিথা ভিলা। সকলের দিন যাচ্ছে ঠিক কিন্তু রসকষহীনভাবে। শিশির নিজের ব্যস্ততার মাঝে কুয়াশার সাথে সহ বাড়ির সকলের সাথে সময় কাটায়। ঢাকায় নীহার পরীক্ষার দুইদিন আগে গেছিল৷ শিশিরের সাথে সেখানে গিয়ে আগে দেখা করেছে।
ভোর থেকে রাত পর্যন্ত শিশির বউকে আগের মতো করে সময় দেয়। আজানের পর ভিডিয়ো কল সহ সকালে মায়েদের সাথে কথা বলা এবং একদিন দুইদিন পর পর ভিডিয়ো কল করে। রাতে কুয়াশার সাথে গল্প করতে করতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
কুয়াশা আগের থেকে অনেক নরমাল হয়েছে। এখন আর কান্নাকাটি করে না। কিন্তু হাসিখুশিও বেশি থাকে না। থাকবেই বা কার সাথে? সেই মানুষগুলোই তো নেই৷ বৃষ্টি, ইয়াসমিনের সাথে ও বর্ষণকে নিয়ে যেটুকু হাসাহাসি করে৷ হিম বন্ধুদের সাথে আজকাল ঘুরাঘুরি সহ খেলাধুলা করে। পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই দিনগুলি কাটছে সবার৷
| চলবে |
নোট – [ উপরোক্ত নেভির ডিটেইলস আপডেট গুগল থেকে নেয়া ]
গুরুত্বপূর্ণ কথা,
বার বার আমি এসব নিয়ে কিছু বলতে পারছি না। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করি প্রচুর। না জেনে কিছু লিখি না আমি৷ যারা নেভি নিয়ে আমাকে বলেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে কথা,
সেদিনও বলেছি আজও বলছি, আমি ডিটেইলস দিতাম না উপরোক্ত ঐ টুকু দিলাম তাদের জন্য। আইএসএসবি পরীক্ষাটার নাম শুধু উল্লেখ করেছিলাম না। আর বয়স নিয়ে আর কিছু বলবেন না কেউ। গুগল দেখেন তারা, ক্যাডেট অফিসারের জন্য ২৫ বছর পর্যন্তও করা যায়। এ বিষয়ে আর কোনো কথা না বললেই খুশি হব।
গল্প বিষয়ে কথা,
সেদিও পোস্ট করেছি আজও বলছি, পোস্টটা অনেকে দেখেনি। আমি বলেছিলাম নীহারের কোন পদ বা কীভাবে কী হচ্ছে নেভিতে কিচ্ছু এই গল্পে লিখব না৷ আমি নীহার, শশীকে নিয়ে গল্প আনব। আই রিপিট আমি আনব এবং চেষ্টা অবশ্যই করব। এসব নিয়ে আর কেউ কোনো প্রশ্ন করবেন না৷ তারা আলাদা ভাবে আসবে আলাদা গল্পে। তাই হাইড রাখা হবে। এখন বুনো ওল বাঘা তেঁতুলে পড়েন শুধু৷
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click