®রোজা রহমান
‘
সময় চলে গেছে স্রোতের ন্যায়। ঘড়ির কাঁটা তার আপন গতিতে চলতে চলতে সময় পাড় করে এক একটা দিন গিয়েছে। দিন গিয়ে মাস গেছে, মাসের পর মাস গিয়ে গেছে বছর। হ্যাঁ বছরও চলে গেছে। আর সেটাও একটা না! দুই দুইটা বছর সকলের জীবন থেকে পাড় হয়ে গেছে। শুধুই দুইটা বছর না দুইটা বছর গিয়েও গেছে আরো কয়েকটা মাস৷ মালিথা ভিলার প্রতিটা সদস্য তাদের ছেলেদের দূরে রেখে পাড় করে এসেছে দিন, মাস, বছর। খুব সহজ ছিল না দিনগুলো! অতিশয় কঠিন তা। আদর যত্নে বড় করা ছেলেগুলোকে দূর থেকে বহুদূরে দিয়ে তারাও ভালো দিন কাটাননি।
সকলে পেছনে ফেলে এসেছে দুইটা বছরের বেশি সময়। এই দুইটা বছরের বেশি সময় গিয়ে পাল্টেছে অনেক কিছু। সময়, দিন, মাস, বছরের সাথে অনেক কিছুই পাল্টেছে। মালিথা ভিলার প্রায় প্রতিটা সদস্যের জীবন একটু না একটু হলেও পাল্টেছে।
বিগত বছরগুলোতে মনের মাঝে চাপা কষ্ট রেখেও হাসিখুশি মালিথা ভিলা হেসেখেলে দিন পাড় করেছে৷ আগের মতো সকলে মিলেমিশে হাসিখুশি পরিবার থেকে দিন পাড় না করতে পারলেও নিজেদের স্বত্ত্বাকে তারা ধরে রেখেছে। মুটিয়ে যেতে দেয়নি দিনগুলোর সাথে। রঙিন দিনগুলো কখনো সখনো ফিরে পাবার আশা বুনেছে। অপেক্ষা করেছে কেউ কারো জন্য।
‘
আজ মালিথা ভিলা সাজছে। সাজছে মালিথা ভিলার সদস্যদের মন৷ গত দুইটা বছরের বেশি সময় কাটিয়ে সাজছে এক নতুন রূপে। অপেক্ষা প্রহর তাদের কাটতে চলেছে৷ আপন মানুষের থেকে দূরে গিয়ে রয়েছে এক একটা ছেলে। জীবনের রঙ পাল্টিয়ে তারা এখন অন্যরূপে রঙিন।
সেই শুরুর মতো নিয়ম করে চলেছে দিন। কুয়াশা শিশিরকে দিনের পর দিন মিস করেছে। দুইটা বছরের বেশি সময় স্বামী ছাড়া কাটানোটা কিন্তু মুখের কথা না! এটা যারা থাকে তারাই একমাত্র বোঝে। দুইটা বছর গিয়ে সাথে কয়েকটা মাসও সে স্বামীর অপেক্ষায়। তার প্রিয় স্বামীর, তার জীবন সঙ্গী, তার অর্ধাঙ্গ, তার ঝগড়া, চুলোচুলির সাথী তার ভাষায় বুনো ওলের৷ এক একটা রাত নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা নিয়ে কাটিয়ে গেছে। কাটিয়েছে একাকিত্ব দিন৷ নির্জীব প্রাণ তার কারণ ছাড়া হাসেনি। পড়াশুনো সহ বাড়ির সকলের সাথে কাজকর্ম আর একটু আড্ডার মাঝে হাসি, মজা এই তার জীবনের গতিপথ ছিল।
শিশিরের রোজ সকালের এবং রাতের ভিডিয়ো কল সহ সময় সুযোগ বুঝে দিনে একটু আধটু কল দিয়ে কথা বলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তারা অধিক ভালোবাসার মাঝে একটা জিনিস ধরে রেখেছে সেভাবেই আর সেটা হচ্ছে, ঝগড়া। মা-রা মা-রি, চুলোচলি করতে না পারলেও ঝগড়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের স্বত্ত্বাকে নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছে। কথার মাঝে বাঁধিয়ে দিত ঝগড়া।
কুয়াশা এভাবেই হাসিখুশির মাঝে স্বামীর সঙ্গছাড়া হয়ে, তাকে পাশে না পেয়ে, একাকিত্বে নিজের অন্তরের সুপ্ত, সুক্ষ্ম বেদনাটাকে দমিয়ে রেখেছে। শিশিরের সাথে কয়েক সপ্তাহ পর থেকে নরমালি কথা বলত। সাথে পড়াশুনোর একাধারে সময় দিত৷
কুয়াশা এখন এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষে। অবশ্য দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা সামনে তৃতীয় বর্ষে উঠবে। শিশির যে ল’ কলেজে এলএলবি করেছে সেখানেই ভর্তি হয়েছে। শিশিরের সম্পূর্ণ সাপোর্ট এবং ভালোবাসার শক্তিতে স্বপ্ন পূরণের পথে এগুচ্ছে। শুধু সে না স্মৃতিও হয়েছে এলএলবিতে ভর্তি। রিজভী তাকে অভয় দিয়ে ভর্তি হতে বলেছিল। শ্বশুরের সাথে সে নিজে কথা বলেছিল। কুয়াশা স্মৃতির সাথে এখন চলাফেরা করে। ঈশা অনার্স করছে সরকারি কলেজ থেকে। সে ম্যানেজম্যান্ট ডিপার্টমেন্টে। কুয়াশাদের সাথে বন্ধুত্ব সে ধরে রেখেছে৷
মালিথা ভিলায় দুইটা ছেলে সন্তানের বাস এখন। তুহিন আর হিম ছাড়া সকলে বাহিরে। শিশির, নীহার যাবার পর তুষারেরও পোস্টিং পাল্টায়। কুষ্টিয়া থেকে সে পোস্টিং পায় খুলনায়। শিশিররা যাবার মাস ছয়-সাতেক পরেই তার বদলি হয়। তুষার খুলনায় যাবার পর বৃষ্টিকে শাশুড়ীরা তুষারের সাথে চলে যেতে বলে খুলনাতে। কিন্তু বৃষ্টি রাজি হয়না।
তার কথা, সে এই মালিথা ভিলা ছেড়ে কোথাও যাবে না। তার সংসারের লোকজন ফেলে সে একা দিন কাটাতে পারবে না। শাশুড়ীরা হাজার বুঝিয়েও কাজ হয়নি। সে বাড়িতেই থাকে বর্ষণকে সাথে নিয়ে। তুষারও বউয়ের কথায় আর জোর করেনি। মেয়েটা তার পরিবার আঁকড়ে ধরে যদি চলতে পারে তো চলুক! তাই তুষার খুলনাতেই কোয়াটারে থাকে। ছুটি অবশ্য পায় না। যদিও কখনো সখনো পায় তাতেই আসার চেষ্টা করে বউ, ছেলে ও পরিবারের কাছে। বাড়ির বড় ছেলেটাই এখন বাহিরে থাকে।
বর্ষণ এখন বড় হচ্ছে। আধো বুলিতে সে কথা বলা শিখেছে। বয়স তার দুই বছর পাড় হয়েছে তো কথা শিখবে না? আধো আধো বুলিতে পাকনা পাকনা কথা বলার চেষ্টা করে। আর খুবই দুষ্টু হয়েছে। সারা মালিথা বাড়ি সে একাই মাথায় করে নিয়ে বেড়ায় ভাবটা এমন। তবে মা’য়ের খুব বাধ্য সন্তান হচ্ছে আর ফুপু ভক্ত একটা আদুরে। কুয়াশা বলতে সে পাগল৷ গুলুমুলু, দুষ্টু, দুরন্ত স্বভাবের ছেলে হয়েছে। কুয়াশার বর্ষণের সাথে দিন বেশি কাটে।
তুষার চলে যাবার পর তুহিন এবাড়ির অধিকাংশ দায়িত্ব একা পালন করে। বলতে গেলে সেই এখন পরিবারের ঢাল৷ বাবা জাহিদ মালিথার চাকরির বয়স ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। জাহিদ মালিথা এখনো পাবনাতেই আছেন। বাবা সেখানে থাকে, তুষার নেই, জাকির মালিথাও সংসারের দায়িত্ব থেকে দূরে তাই তুহিনেরই সব করতে হয়। তুষার সাহায্য করে দূর থেকে। এছাড়া মা’য়ের, বাবা, চাচুদের সাহায্য সে পেড়ে ওঠে।
ইয়াসমিন সংসার জীবনে অনেক সিরিয়াস। সে সংসার করে মন দিয়ে। তার জেদ অনুযায়ী অনার্স করার পর আর পড়েনি সে। এর পরেই বেবি নিয়েছিল। আল্লাহ দিয়েও ছিলেন কিন্তু ইয়াসমিনের মিসক্যারেজ হয়ে যায়। পাঁচ মাস গিয়ে ছয় মাসের মাঝে। মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছিল এতে৷ বাড়ির সকলের আশ্বাস ও শক্তিতে সে নিজেকে আবার প্রকাশ করে। তবে প্রথম প্রেগনেন্সি মিসক্যারেজ হবার পর এখনো তার জীবনে সুসংবাদটি আসেনি। মেয়েটা এটা নিয়ে মন খারাপ করে থাকে। তুহিন সব সময় অভয় দেয় বলে,
” আল্লাহ দিয়ে আবার নিয়েছেন তিনিই আবার দেবেন দেখো “
ইয়াসমিন নিজেও এটা মনে করে এবং স্বামীর সাপোর্টে ভালো থাকার চেষ্টা করে।
হিম এখন বড় হয়েছে অনেক। সে এখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে। ছেলেটা উচ্চতায় যেমন বেড়েছে তেমনই বেড়েছে বুদ্ধিতে। বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সকল ভাইদের থেকে বোধহয় এগিয়ে আছে ভাবটা এমন। বাড়ির সকলে বলত শিশির সকলের থেকে বেশি বুদ্ধিমান কিন্তু সেটার নাম এই হিম ঘুচিয়ে দিয়েছে। হবে না-ই বা কেন? ভবিষ্যত ডক্টর বলে কথা! বুদ্ধিমান না হলে চলে? হ্যাঁ তার স্বপ্ন সে-ও আর ভাইদের মতো কিছু হয়ে দেখাবে এবং সেটা আলাদা কিছু৷ আর সে স্বপ্ন বুনেছে ডক্টর হবে। তার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হয়েছে বাড়ির প্রতিটা সদস্য। আজমিরা হিমের এসএসসির রেজাল্ট দেখে কেঁদে দিয়েছিলেন৷ ছেলেটা এত ভালো রেজাল্ট করেছিল যে সকলের আনন্দে প্রাণ ভরেছিল৷ জাকির মালিথা তখন জানতে চেয়েছিলেন হিমের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। তখনই আজমিরা জানিয়েছিলেন ছেলে তার ডক্টর হবার স্বপ্ন দেখে। সকলে অনেক খুশি হয়েছিল। জাকির মালিথা, জাহিদ, তুষার, তুহিন, শিশির, নীহার সকলে সম্পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিল। তবে আজমিরা তার সাথে একটা কথা সকলের কাছে জানিয়েছিলেন আর সেটা হচ্ছে, তার স্বামীর অংশ থেকে যেন হিমকে পড়ানো হয়। এমনিতেও ওটা হিমের ভবিষ্যতেই কাজে লাগবে৷ আরো নানান কথা বলেছিলেন। সকলে এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি। বলেছিলেন এর বাইরে যদি প্রয়োজন হয় তো উনারা দেবেন৷ আজমিরা আর কথা বলেননি। সকলের মতামত নিয়ে হিম জীবনে এবং স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সে আগের মতোই প্রয়োজন ছাড়া চঞ্চলতা দেখায় না।
দেখতে শুনতে হয়েছে মাশাআল্লাহ। আজমিরা বাড়িতে ছেলে ও মেয়েকে আগলে রেখে দিন পাড় করছেন।
সকলের জীবনের সাথে পাল্টিয়েছে জাকির মালিথাও। তিনি এখন টুকটাক হাঁটতে পারেন৷ আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি দিন দিন সুস্থতা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন৷ প্যারালাইসড পা’টা টেনে টেনে ফেলে হাঁটেন। আর হাতটা এখন ভালো মতোই নাড়াচাড়া করতে পারেন সবে কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে এখনো। তিনি নিজে থেকে হাঁটতে পারলেও সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেন না। সেটাতে সাহায্য করা লাগে। এসব সব কৃতিত্ব জাকিয়া, কুয়াশার। তারা বউ, মেয়ে মিলে অনেক খেঁটেছে৷ ডক্টর জানিয়েছেন আরো কয়েক বছর গেলে আরো সুস্থতা পাবেন। তখন পা’টাতে কিঞ্চিৎ হলেও সমস্যা থাকবে কিন্তু অনেকটাই কমে যাবার সম্ভবনা আছে।
এছাড়া বাড়িতে আম্বিয়াও আগের মতো তার স্কুল এবং সংসার দুইদিকেই সমানভাবে চালিয়ে যান৷ সাথে জা’য়েদের সঙ্গ।
____________
মালিথা ভিলা গতকাল থেকে সাজানো শুরু হয়েছে৷ সাজানো বলতে ডেকোরেশন করা হচ্ছে। অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই সাজানো হচ্ছে। সাজানো তো লাগবেই! বাড়িতে বিয়ে বলে কথা!! আশ্চর্য হবার কথা বললাম তো? কিন্তু এটাই সত্যি। মালিথা ভিলাতে আনন্দ আবার ফিরছে। বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে ফিরেছে এবং ফিরছে৷
গত দুইদিন হলো নীহার এসেছে। সে এতগুলো দিন ট্রেনিংয়ে ছিল। তার জবের পদও কনফার্ম হয়েছে। সে এখন নেভির কমিশন্ড অফিসার। সব ঠিকঠাক করে বাড়িতে এসেছে। তার তিন সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। এই তিনটা সপ্তাহের ছুটিতে সে বিয়ে করে রেখে যাবে শশীকে। তেমনই কথা হয়েছে৷ এরপর আবার কবে সময় সু্যোগ হবে না হবে জানা নেই। তাই এই সিদ্ধান্ত। তবে এই বিয়ে তার কর্মস্থল থেকে সম্পূর্ণ গোপন রেখে করবে। যেটা ওর ডিপার্টমেন্ট জানবে না। কারণ সে বিয়ের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। অনুমতিবিহীন বিয়ে করবে।
সাধারণত ডিফেন্স জবে বিয়ের জন্য অনুমতি হয় জব শুরু হবার তিন বছর পর থেকে।
এদিকে তিনটা বছর হয়ে এলো শশীর সাথে তার আংটিবদল হয়েছে। এতগুলো বছর পাড় করে আর অপেক্ষা করাবে না শশীকে। গ্রামের একটা মেয়ের জন্য এটাও বেশ অস্বস্থিকর। শশী গ্রামে থাকে বিষয়টা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে৷
এছাড়া শশীও এখন অনেকটা বড় হয়েছে। লোকজনের চোখে পড়ে। গ্রামে এই জিনিসটা খুবই বাজে। এসব সব জিনিয়া জাকিয়াকে জানিয়েছেন যার জন্য বাড়ির সকলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীহার বাড়িতে এলে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে৷ নীহার সম্পূর্ণ মত দিয়েছে।
শশী এখন সবে অনার্স প্রথম বর্ষে উঠেছে। নীহারের কথা সে মেনেছে। সুধু এসএসসিতে না। এইচএসসিতেও সে ভালো রেজাল্ট করেছে। প্লাস অবশ্য দুইটার একটাতেও জোটেনি। তবে খারাপও করেনি৷ পড়াশুনো সহ নীহারের বউ হবার আশা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দিন পাড় করেছে৷
আর মাত্র দুইদিন পর শুক্রবারে তাদের বিয়ে। সেই খুশিতে মেয়েটা লাফিয়ে বেড়ায়। মানে, নিজের বিয়ে নিয়ে এমন বাচ্চামি এবং লাফালাফি কেউ করে? কেউ করে না তো কি হয়েছে? শশী করে। এই মেয়ে আলাদা সকলের থেকে৷ যেমন বাচ্চামি করবে তেমনই চঞ্চল। আগের মতোই একদম আছে। একটুও পাল্টায়নি নীহারের ইঁচড়েপাকা। নিজের স্বভাব বজায় রেখেছে।
মিহির এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে আছে। তার আর ঈশার প্রেম এখন মাখোমাখো টাইপ৷ বাড়িতে অবশ্য আজো বলেনি কেউ।
‘
শিশির আসছে আগামীকাল বুধবার। তার পড়াশুনো শেষ হয়েছে। হয়েছে অপেক্ষার শেষ। বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরছে নিজের সফলতা নিয়ে। আপনদের কাছে আসছে। প্রত্যক সদস্য তার প্রতিক্ষায় বসে। সে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেও আসেনি বাড়িতে। নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থেকেছে৷ হাজার বলেও সে বাড়িতে পা দেয়নি। তার সিদ্ধান্ত সে একবারে বাড়িতে ফিরবে৷ বলা চলে জেদ। ইচ্ছে করলে আসতে পারত। বাড়ির সকলের সাথে দেখা করে যেতে পারত।
সে তার সফলতা পেয়েছে। আজ তার নামের আগে অ্যাডভোকেট যোগ হয়েছে। সে হয়ে উঠেছে দেশের মানুষের কাছে, সমাজের কাছে অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা৷ তাকে এখন সকলে চিনবে তার অর্জন করা নামে। ডাকবে অ্যাডভোকেট শিশির মালিথা। বার কাউন্সিল পরীক্ষায় সে এবং রিজভী সব থেকে ভালো নাম্বারে উত্তীর্ণ হয়েছিল৷ এরপর তারা বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়৷ বিসিএস এর জন্যও যথেষ্ট খাটাখাটুনি করেছে। আল্লাহ সফলতা শিশিরকে দিলেও রিজভী সফলতা পায়নি। শিশির বিসিএস টিকেছে। রিজভী এই একটা জায়গাতে হেরে গেছে। যদিও চেষ্টা কম করেনি সে!
মাস খানেক আগে বিসিএসের রেজাল্ট পায় তারা৷ ক্যাডারদের মাঝে শিশিরের নাম পেয়ে আনন্দের ফোয়ারা ঝরে সকলের৷ রিজভী নিজের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে বন্ধুকে নিয়ে মেতেছিল। সকলে তো সফলতা পায়না তাই না? তো সে-সব কি ধরে রাখলে চলে? এবার হয়নি সমস্যা কী? সে আবার চেষ্টা করবে প্রয়োজনে৷ কিন্তু আগে সে বন্ধুর সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করেছে। সে-ও একজন অ্যাডভোকেট৷
শিশির ম্যাজিস্ট্রিট পদ গ্রহণ করেনি৷ ভাবনা অনুযায়ী অ্যাডভোকেটেই আছে৷ সেসব ঠিকঠাক করার জন্য তার কিছু সময় চলে গেছে বিধায় আগামীকাল তারা বাড়িতে ফিরছে।
নীহার বাড়িতে এসে এক আনন্দ এনেছে তো আগামীকাল শিশির আসাতে আরেক আনন্দ নিয়ে আসছে। বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে আসছে সবার আনন্দ এসে এসে ধরা দিচ্ছে মন কুঠুরিতে। তুষার বৃহস্পতিবার আসবে দুইদিনের ছুটিতে।
___________
” তাতু তাতু..! “
বর্ষণের আধো আধো তোতলানো ডাকে নীহার বসার ঘর থেকে উত্তর নিল,
” হ্যাঁ, চাচু!”
নীহার উত্তর নিতেই সে হাত বাড়িয়ে দিল। অর্থাৎ কোলে নিতে হবে তাকে৷ গুটিগুটি পা’য়ে কিলবিলিয়ে বেড়ায় এখন৷ সে আদুরে হয়েছে শিশিরের মতো। জাকিয়া বৃষ্টিকে বলে শিশির এই ভাবে আদুরে হয়ে সকলের আদর নিত। আর দুষ্টুমিও ঠিক চাচুর মতো করে। বর্ষণ দেখতে অনেকটা শিশিরের মতোই হয়েছে।
নীহার বর্ষণকে হেসে কোলে নিল। এসে পর্যন্ত এই দুষ্টুর দুষ্টুমি দেখছে। নীহার আসলে বৃষ্টি একবার শুধু বলেছে,
” এটা তোমার চাচু হয়।”
ব্যস তাকে আর পায় কে? তার আদর করার লোক বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা? তুহিন, হিমকে তাতু তাতু বলে ফ্যানা তুলবে। কুয়াশাকে পুপি বলে। ফুপি আসে না। দাদা টা স্পষ্টই আসে মুখ থেকে৷ জাকিয়াকে দিদি বলে। দাদি আসে না। শুধু জাকিয়া, জাকির মালিথাকে না আজমিরা, আম্বিয়া, জাহিদ মালিথাকেও ওভাবেই ডাকে।
নীহার বর্ষণকে কোলে নিলে সে নীহারের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধের উপর মাথা এলিয়ে দিল। নীহার মুচকি হাসল। বলল,
” আমার চাচুর কি হয়েছে? “
” কিতু না “
নীহার আবার হাসল। বলল,
” সকালে খেয়েছে আমার চাচু? “
” হুম কেয়েতি “
বলে সে নীহারের টিশার্টের সামনের বোতাম নিয়ে খেলা ধরল৷ ইশশ বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা হয়েছে৷ কী সুন্দর কথা বলছে! ভাবতে ভাবতে নীহারের ফোন বেজে উঠল। শশী ফোন দিয়েছে৷ সে রিসিভ করে কথা বলতে লাগল।
‘
কুয়াশার ঠোঁটের কোণা থেকে আজ হাসি সরছেই না যেন৷ আনন্দের ফোয়ারা ঝরছে। আনন্দ হবে না? তার স্বামী তার ভালোবাসা আসছে। কতদিন পর আসছে! ইশশ এই অনুভূতি কি প্রকাশ করা যায়!! কখন যে আসবে কালকের দিনটা! আজকের এই দিনটা যেন যাচ্ছেই না।
কুয়াশার হাসিখুশি মুখ সকলে লক্ষ্য করছে। আজ কতদিন পর তার আনন্দ দেখছে সকলে? এমন আনন্দ আজ কতদিন পর দেখছে! আজমিরা মেয়ের আনন্দে তিনিও আনন্দিত হচ্ছেন।
জাকিয়া দুইটা ছেলেকে কাছ ছাড়া করে শূণ্য হয়ে পড়ে থাকেন৷ ছেলে আসার খবরে তিনিও আনন্দে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে বিয়ের কাজ সহ ছেলে আসার আনন্দ উপভোগ করছেন৷
‘
সারাটাদিন গিয়ে রাত এসেছে৷ নয়টার পর খাওয়া দাওয়া করে বসার ঘরে সকলে বসে গল্পগুজব সহ বিয়ের কথাবার্তা বলছে। এমন সময় শিশির ভিডিয়ো কল দিল কুয়াশার ফোনে। কুয়াশা রিসিভ করতেই নীহার পাশে থেকে কথা বলল। জানতে চাইল কখন রওনা দেবে৷ শিশির জানাল ভোর ছয়টায় গাড়িতে উঠবে। এরপর সকলের সাথে আড্ডা দিল। সবার সাথে কথা বলা হয়ে গেল কুয়াশা ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরে চলে এলো।
ঘরে এসে বিছানায় আয়েশ করে বসল৷ শিশির বউয়ের দিকে তাকিয়ে৷ দিন দিন তার আহ্লাদী বউটা কি আরো অপূর্ব সুন্দরী হচ্ছে? ভেবে সে বউকে জ্বালানোর জন্য বলে উঠল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা! এত সুন্দর হচ্ছিস কেন বলত? দেখ এখনো পুরো রাতটা কাটাতে হবে আমার এই ঢাকাতে! এখনই এখানে এমন নিয়ন্ত্রণ হারা হতে পারব না।”
কুয়াশা শুনে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল৷ কটমট করতে করতে বলল,
” অসভ্য বুনো ওল একটা। এ্যাই তোমার মুখে কিছু আটকায় নাহ্? মন চাই চুলগুলো ছিঁড়ে দিতে। একবার আসো শুধু!”
শিশির ভিতরে ভিতরে হাসল। মুখে প্রকাশ করল না। বলল,
” বিশ্বাস কর এই দুইটা বছর আমার চুলগুলো শান্তি তো পেয়েছেই সাথে গজিয়েছেও অনেক। এই দেখ “
শেষ কথাটা বলতে বলতে সত্যি সে মাথা নিচু করে কুয়াশাকে চুল দেখাল। কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” খুব মজা লাগে নাহ্? আসো কাল সব ছিঁড়ব “
” কি কি ছিঁড়বি তুুই আমার? দেখি লিস্ট দেখা! “
কন্ঠে এবং কথায় স্পষ্ট দুষ্টুমিতে ভরা তার। সে কথাটা বলতে বলতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুলো। রিজভী পাশে নেই সে বাহিরে গেছে কিছু দরকারে। তাই এখন এমন ফাজলামোগুলো করে মজা পাওয়া যাবে৷ রিজভী থাকলে সে কুয়াশার সাথে ডিপলি মজা করে না৷ যতইহোক বউ তার! হাজার রিজভী বন্ধু হোক না কেন সে চায় না বউ তার অন্য পুরুষের সামনে আনইজি ফিল করুক।
কুয়াশা আবার রাগল। বলল,
” ঠোঁট কাটা পুরুষ লোক৷ সত্যি তোমার সব ছিঁড়ব “
” আচ্ছা দেখা যাবে তোর জোর কতটা হয়েছে৷”
কুয়াশা চোখ গরম করে তাকাল৷ সামনে থাকলে এক চালান বেঁধে যেত নির্ঘাত! চুল শিশিরের থাকত না আর। শিশির, কুয়াশা এগুলো এই বছরগুলোতে হাজারবার মিস করেছে। শিশির এবার আদুরে ভোল ধরল। বলল,
” এ্যাই সোনা! “
কুয়াশার মূহুর্তের মধ্যে রাগ পড়ে গেল। এটাও হয়ে আসছে বিগত দিনগুলোতে। কুয়াশা রাগ করলে এইভাবে ডাকবে আর কুয়াশার তৎক্ষনাৎ রাগ উধাও হয়ে যাবে। স্বামী তার এত সুন্দর করে এই ডাকটা দেয় একদম বুকে এসে বাড়ি দেয়। কুয়াশা তাকাল শুধু কথা বলল না। শিশির মুচকি হেসে বলল,
” ভালোবাসি আমার আহ্লাদী বউকে “
” তোমার আহ্লাদীও ভালোবাসে তার প্রিয় স্বামীকে “
তারা এখন দুই সময়ে দুই ধরনের নামে সম্মোধন করে একে অপরকে। ঝগড়ার সময় ডাকে বুনো ওল আর গোবর ঠাঁসা বলে কিংবা রাগানোর জন্য বলে ডাকে নয়তো মুড একদম ফুরফুরে আর ঝগড়া করার মুডে থাকলে এগুলো বলে ডাকাডাকি করে। আর যখন দু’জন দু’জনের প্রতি ভালোবাসা এক্কেবারে উতরে উতরে ওঠে! তখন এই যে, এমন আহ্লাদের ডাক ডাকে।
শিশির হাসল কুয়াশার কথায়। বলল,
” কখন সকাল হবে বলত? কখনই বা তোর কাছে পৌঁছাব? তড় যে আর সইছে না রে আহ্লাদী বউ!”
কুয়াশা লজ্জায় নূয়ে পড়ল৷ ঠোঁটে এবং মুখে লজ্জাময় হাসি। লালাভ হয়ে উঠল কোপলজোড়া। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। শিশির তাকিয়ে দেখল তা। আবার বলল,
” বুকে অনেক আদর জমেছে বুঝলি! গিয়ে কিন্তু সব ঢেলে মুছে দেব! মানা করতে পারবি না! প্রস্তত হ। আসছি আমি।”
কুয়াশা আরো নূয়ে পড়ল৷ তবে উত্তর করল,
” আমি প্রস্তুত। মানা করব না একটুও। জলদি আসো৷ আমি অপেক্ষা করব৷ “
বলে থামল৷ এরপর সে-ও বিছানায় শুলো৷ তার শোবার ধরন টা বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে বই পড়ার মতো৷ আবার বলল সে,
” তোমার ঐ বুকটা আমার বড্ড প্রয়োজন। প্রতিটা রাত খুঁজেছি আমার শান্তির জায়গা। আজকের এই রাতটাও খুঁজে বেড়াব৷ কাল থেকে পাব তো? “
” হুম পাবি৷ আর কিছু ঘন্টা কষ্ট করে নে সোনা। এরপর তোকে বুকে নেব। আমিও যে জ্বলছি আমার আহ্লাদী বউয়ের জন্য।”
কুয়াশার চোখ টলমল হয়ে উঠল৷ ভালোবাসা এক ছিটেফোঁটাও কমায়নি তার স্বামী৷ বরং বেড়েছে আরো৷ দূরত্ব এতটা ভালোবাসা বাড়াবে তার ধারণা ছিল না। আচ্ছা সকল দম্পতিদেরই কি এমন হয়? থাকে কি তাদের ভালোবাসা অটুট দূরে গেলে? নাকি শুধু তাদের আছে? শুধু শিশির বলে এমন? এ ছেলে বলে গেছিল বাড়িতে তিন কবুলের বউ রেখে অন্য মেয়ের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না। সত্যি সে কথা রেখেছে। তার একমাত্র আহ্লাদী বউ ছাড়া সে কোনো মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়নি৷ হলে কি এতটা ভালোবাসা থাকতো তাদের? উহু থাকত না৷ একদম খাঁটি পুরুষ, খাঁটি তার ভালোবাসাও ভেবে নিয়ে বলল,
” ইনশাআল্লাহ, তুমি ভালোভাবে আসো আমার কাছে। “
শিশির এবার নিজের আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল৷ দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বলল,
” রাখছি এখন৷ খাওয়া হয়নি এখনো৷ ফ্রি হয়ে কল দেব আবার “
” আচ্ছা, আল্লাহ্ হাফেজ”
” আল্লাহ হাফেজ “
বলেই কল কাটল শিশির। আবার একটা জোরে শ্বাস নিল আর ফেলল৷ শুধু রাতটা গেলেই হয়। বাড়িটার প্রতি মনটা ছটফট করছে৷ এতগুলো দিন, মাস কাটিয়ে দিল অথচ আজকের রাতটা মনে হচ্ছে অনেক বড়। শেষই হবে না যেন৷ তবুও জলদি শেষ হোক এ রাত।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click