®রোজা রহমান
‘
বাড়িতে বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। সকলে হৈ হুল্লোড় করছে। রাতের খাবার খেয়ে সকলে বসার ঘরে ছোটরা গল্পতে মেতেছে। বিয়ে নিয়ে সব প্ল্যান হচ্ছে। নীহারের বিয়ের লগণ আগামীকাল কেউ নিয়ে যাবে না৷ কথা হয়েছে সকলের একবারের বরযাত্রী যাবে। গায়ে হলুদের তত্ত্ব গাড়িতে করে শুধু শিশির, তুহিন আর হিম গিয়ে দিয়ে আসবে। দূরের রাস্তা এত জার্নি করতে কেউ রাজি না। বড়রা মিলে এটাই ঠিক করেছেন৷ জাকিয়া বোন জিনিয়াকে এমনটাই বলেছেন। উনারা মেনেছেন৷ যদিও শশীর মন খারাপ হয়েছে তবুও শিশির আসবে শুনে খুশি হয়েছে৷ ইশশ, প্রিয় ভাইটাকে কতদিন পর দেখবে!! নীহারও অবশ্য শশীকে বুঝিয়েছে।
বসার ঘরে এইসবই সব কথা হচ্ছে। শিশির রিজভীকে আজই চলে আসতে বলেছে৷ কিন্তু সে জানিয়েছে আজ ক্লান্ত লাগছে আগামীকাল সকাল সকাল স্মৃতিকে নিয়ে চলে আসবে৷ নীহারের ভার্সিটির দুইটা ক্লোজ ছেলে বন্ধুকে শুধু বলেছে। তার মাঝে শান্ত আর নাদিম নামে যে তাদের আঙটি বদলে যেতে পারেনি। মেয়ে বন্ধুদের বিয়ে হয়ে গেছে বলে সেসব ঝামেলায় আর যায়নি নীহার।
বৃষ্টির কোলে বর্ষণ ঘুমিয়ে গেছে৷ ঘরে কেউ নেই রাতে ভয় পাবে ভেবে কোলে নিয়েই বসে আছে। সে জা, দেবরদের সাথে আড্ডাতে মশগুল। বর্ষণ এখন অবধি শিশিরকে ডাকে নি। সকলকে ডেকে ফ্যানা তুলে অথচ শিশিরকে একবারও ডাকল না বিষয়টা খুবই ভাববার বিষয়। সেই হা হুতাশা অবশ্য করেছে শিশির।
আড্ডাতে শিশির কুয়াশা একসাথে বসেছে পাশাপাশি। যেটা অয়ন, অনির কাছে অনেকটা অদ্ভুত লাগছে৷ কারণ আগেরবার এসে তাদের যা সম্পর্ক ছিল আর তারা যেভাবে চলত সেই সবই ভাবছে শুধু৷ সময় মানুষকে কতটা পরিবর্তন করে আর সময় কতটা কথা বলে, ভাবা যায়!! সময়ের সাথে মানুষ সহ মানুষের জীবনও পরিবর্তন হয়৷ এই দুইটা ঝগড়া চুলোচুলি শত্রু থেকে এখন স্বামী স্ত্রী!! অয়ন কথার ফাঁকে ফাঁকেই কুয়াশাকে দেখছে৷ মেয়েটার প্রতি মুগ্ধতা এখনো কাটেনি৷ শিশির অনেক বারই লক্ষ্য করেছে বিষয়টা৷ তবে কিছু বলল না৷ এতটা অভার পজেসিভও ভালো না৷ তার বউ তাকে ভালোবাসে আর সে যানে কুয়াশা অয়নকে একটুও পছন্দ করেনা৷ এটা অনেকভাবেই প্রমাণ পেয়েছে সে৷ তার বউ ঠিক তো সব ঠিক। বউকে কোনো কিছুতে সন্দেহ করার প্রয়েজনই ওঠে না৷ তার বুদ্ধিমতী আহ্লাদী বউ। আর রইল কথা অয়নের হয়তো আগের ভালোলাগার রেশ এখনো রয়ে গেছে! দুইদিনের জন্য এসেছে আবার চলে যাবে৷ আত্নীয়র সাথে এসব নিয়ে খারাপ ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই৷ এইসবই ভেবে শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কুয়াশার দিকে তাকাল৷ কুয়াশাও তাকাল৷ অমায়িক হাসল দু’জনেই। যেটা অয়ন, অনি দুই জনই দেখল৷ তারা সুখী দম্পতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিয়ে তাদের যেমনই হোক তারা মেনে নিয়েছে।
সকলে আগামীকাল গায়ে হলুদের প্রস্তুতি সহ প্ল্যান করে রাত এগারটা বাজাল৷ আর রাত জাগবে ঠিক করল সকলে। যা করার আগামীকাল করবে এই ভেবে সকলে উঠে পড়ল৷ একে একে সকলে ঘরে চলে গেল৷ আজকে রাতটা অয়ন নীহারের সাথে থাকবে। অনি, ঈশা কুয়াশার ঘরে চলে গেল। বাকিরা গেস্ট রুমে গেল৷
‘
রাত এগারটা পাড় হয়েছে। কুয়াশা এসে কিছু জিনিস গুছিয়েছে আর সেগুলো হলো আগামীকালের প্রস্তুতি। শিশির এসে শুয়ে ফোন টিপছে। কুয়াশা কাজ করে এসেছে শুবার পস্তুতি নিল। কিছুক্ষণের মাঝে লাইট বন্ধ করে শুয়েও পড়ল। শিশির আরো কিছুক্ষণ ফোন টিপল। এরপর রেখে কুয়াশাকে ডাকল,
” এদিকে আয় “
কুয়াশা বিনা বাক্যে এগিয়ে গেল এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল স্বামীর ডাকের। কতগুলো রাত পর আবার এই বুক পাচ্ছে সে রাতে!! গত রাতগুলোর কথা মনে উঠলে এখনো দম আঁটকে আসে৷
কুয়াশা শিশিরের বুকের উপর মাথা রাখল। পেট জড়িয়ে ধরল। শিশির একহাতে জড়িয়ে নিল অন্য হাত অন্ধকারে কুয়াশার হাত ধরল। হাতের আঙুলের মাঝে আঙুল গলিয়ে ধরল। কুয়াশা স্বামীর বুকে এতগুলো বছর পর আবার রাত কাটাতে পেরে আবেগী হয়ে উঠল। বলল,
” আমার এই শান্তির স্থান কত যে মিস করেছি আমি! প্রথম কিছু মাস আমি ঘুমাতেই পারতাম না৷ ছটফট করে যদিও ঘুম হতো সেটাও কিছুক্ষণের মাঝে ছুটে যেত। বুক খুঁজতাম অন্ধকারে হাতরিয়ে৷ কিন্তু তোমাকে পেতাম না৷ তোমার হাতটাকে খুব চাইতাম আগলে নেবার জন্য কিন্তু তুমি ছিলে না৷ তড়পাতাম খুব। আল্লাহ আমার শান্তির স্থানকে অক্ষত রেখেছে এতেই লাখ লাখ শুকরিয়া। আমি আমার শান্তির স্থান আবার পেয়েছি, আজ আমি শান্তির ঘুম দেব৷ “
বলে শিশিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। শিশির শুনল সব। আজ নিজেও সব আবেগ ঢেলে দিল। বলল,
” আমিও খুঁজেছি। রাতে আমার বুকটা শূণ্য হয়ে পড়ে থাকত৷ হাতটা তোকে খুঁজত৷ তোর কিছু জিনিস আমার খুবই বদঅভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে৷ এই যেমন;- বুকে শুইস, নাক ডলিস, আমার মাথায় বিলি কাটিস, তোর গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে শুই এসব সবই আমার অভ্যাস। বিয়ের পর থেকে শুরু হয়েছে আস্তে আস্তে। আগে আমি কারো পাশে শুতে পারতাম না, বিছানা একারই লাগত৷ অথচ তুই যেদিন থেকে এলি সেদিন থেকে অদ্ভুত ভাবে আমার কারো সাথে শোবার অভ্যাস হয়ে গেল৷ প্রথমদিন তোকে জড়িয়ে শুয়েছিলাম। কেন যেন অদ্ভুত একটা শান্তি বিরাজ করেছিল। যেখানে তোকে কিছুঘন্টা আগেও সহ্য করতে পারতাম না৷ তোর কথা আসলেই আগে বউ কথাটা চলে আসত আর সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেত৷ এই বউ শব্দটার জন্য তোকে মানতে পেরেছি৷”
এই পর্যন্ত বলে থামল। কুয়াশা সব শুনছে মুখ বুজে। সে এবার কাৎ হয়ে শুয়ে কুয়াশার দিকে ঘুরল৷আবার বলল,
” তুই আমার সেই অমূল্য একজন যে আমার ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। ছোট থেকে মা-রা মা-রি, ঝগড়া করে বড় হয়ে সেটা রয়ে গেল যা আমার অভ্যাস। বিয়ে হলো, বিয়ের পরও তৈরি করলি অনেক অভ্যাস৷ তোর সাথে পুরো জীবনটাই আমার অভ্যাসে কাটছে, কাটবে৷ তোকে এখন যে ভালোবাসি সেটাও বোধহয় বুড়ো হয়ে গেলেও অভ্যাসই থেকে যাবে৷ কারণ তুই পুরোটাই আমার অভ্যাস৷ “
আবার থামল। কুয়াশা মুগ্ধ হয়ে শুধু শুনছে। অন্ধকারেই কুয়াশার কপালে চুমু দিল৷ বলল,
” কুয়াশা তুই আমার সেই অভ্যাস, যেটা আমি আমরণ চেয়েও ছাড়তে পারব না! তুই আমার এক চিরায়ত অমূল্য অভ্যাস।”
কুয়াশা শুনে শিশিরের বুকে মুখ গুঁজে দিল। শিহরণ হলো সর্বাঙ্গ৷ তার চিরায়ত অমূল্য ভালোবাসা এই মানুষটা। এতটা ভালোবাসা স্বামীর থেকে পাবে কখনো কল্পনা করেনি। ওভাবে থেকেই বলল,
” তুমি আমার সেই পাওয়া, যেটা আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে চাইতাম৷ আমার চিরায়ত অমূল্য ভালোবাসা তুমি। আমার প্রিয় স্বামী তুমি সর্বপরি, তুমি আমার সুখের আস্ত খনি।”
শিশির তা শুনে কুয়াশাকে যতটা পারল ততটা টেনে নিল নিজের মাঝে৷ শক্ত করে ধরল বুকের সাথে৷ কুয়াশা আবার বলল,
” বড় চাচুর মতো জীবনসঙ্গী চেয়েছিলাম আল্লাহ পূরণ করেছেন৷ বাবা মা-রা যাবার পর বাবার প্রতিচ্ছবি বড় চাচুতে পেতাম৷ তুমি বড় চাচুর মতো করে আগলে রাখতে যানো৷ তুমি আমার আস্ত একটা ভালোবাসা”
” তোর বড় চাচুই শিখিয়েছে বউয়ের দায়িত্ব, যত্ন আর সম্মান করা৷ বাবা আমার হাতে তোকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন তোকে যেন আগলে রাখি। বাবার দায়িত্ব দেয়াটা মাথা পেতে নিয়েছিলাম৷”
বলে কুয়াশার গালে চুমু দিল। কুয়াশা আবেশে নাক, মুখ ঘষল বুকে৷ টের পেয়ে হাসল সে। ফিসফিস করে বলল,
” আমার আদুরে বিড়াল ছানা “
বলে দুইহাত জড়িয়ে নিল বুকের সাথে৷ কুয়াশা গুটিশুটি হয়ে বুকে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। শিশিরও চোখ বুজল।
এদের ভালোবাসা সীমাহীন। বিয়ের আগে শত্রুতা ছিল সীমাহীন এখন ভালোবাসা সীমাহীন। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝেই তারা চিরায়ত স্বত্ত্বা দু’জনের মাঝেই ধরে রেখেছে আর সেটা ঝগড়া, চুলোচুলি যেটা আজীবন থাকবে।
___________
সকাল সকাল হৈ হুল্লোড় বেঁধে গেছে। সকালের নাস্তা খেয়ে সকলে গায়ে হলুদের আয়োজনে লেগেছে। সকল আত্নীয় স্বজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। জাহিদ মালিথা সকাল নয়টার দিকে চলে এসেছেন৷ তুহিন বাবার সাথে সকল কাজ সারছে। তুষারের আসতে আসতে দুপুর হবে৷ নীহার নিজের বিয়ে তুবুও বসে নেই। শিশির বাসর ঘর সাজানোর লোককে বলে দিয়েছে৷ দুপুরে আসবে৷ রিজভী আর স্মৃতি এসেছে সকাল দশটার দিকে। শান্তরা এখনো এসে পৌঁছায়নি।
সকাল দশটার দিকে নীহারকে মেহেদী পড়ানোর জন্য কুয়াশা সহ ঈশা, অনি, বৃষ্টি, ইয়াসমিন খুবই করসত করেছে৷ সে মেহেদী টেহেদী পরবে না বলেছে৷ কিন্তু কুয়াশা ছাড়বে না৷ শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে একমাত্র বোনের কাছে৷
বসার ঘরে বৃষ্টি এখন নীহারকে মেহেদী পড়াচ্ছে৷ বাকিরাও নিচ্ছে আবার পড়াচ্ছে। বর্ষণ খেলে বেড়াচ্ছে ফ্লোরে খেলনা নিয়ে। সে-সময়ে শিশির এলো ঘেমে নেয়ে সাথে হিম। তারা বাহিরের কাজে ছিল। এসে বসল সোফায়। কুয়াশা এখনো মেহেদী দিতে লাগেনি।
এমন সময় বর্ষণ খেলনা হাতে করে দুরদুর করে গুটিগুটি পায়ে মা’য়ের কাছে উঠে এলো৷ এসে কেঁদে জেদ করতে লাগল কোলে নেবার জন্য। বৃষ্টি বলল,
” বাবা একটু খেল চাচুকে মেহেদী দিয়ে নিচ্ছি “
তা শুনে নীহার কোলে নিতে গেল কিন্তু শিশির বলল,
” ভাই দে আমার কাছে “
বলে সে উঠে গিয়ে বর্ষণকে নিল। বৃষ্টি বলল,
” কুশু ওর খিদে পেয়েছে একটু খাইয়ে দাও। তুমি তো এখনো নাও নি মেহেদী। ডিম সিদ্ধ করে রেখেছি দেখো সকালে। “
কুয়াশা ওকে সময় পেলেই খাইয়ে দেয়। আর বৃষ্টি না পেরে উঠলে সে-ই খাওয়াই। কুয়াশা বিনা বাক্যে সম্মতি দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। শিশির আবার আগের জায়গায় বসল। হিম পাশে বসল। শিশির বলল,
“আব্বু, আমাকে তুমি একবারও ডাকলে না? আমি তোমার চাচু হয়। বলো চাচু “
বর্ষণ খেলনা হাতে করে শিশিরকে দেখছে৷ কাল যখন থেকে এসেছে শিশির তখন থেকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখেই যাচ্ছে। সবার সাথে বেশ কথা বলা, আর ডাকে কিন্তু শিশিরকে সে শুধু দেখেই যাচ্ছে। কী দেখছে কে যানে!! সে কান্না করে খুবই কম৷ নয়তো বাড়িতে এত লোকের আনাগোনা অন্য বচ্চারা হলে কান্না করে বাড়ি মাথায় করত। সেখানে সে নিরব৷ কুয়াশা বর্ষণের খাবার নিয়ে এলো৷ ডিম সিদ্ধ দিয়ে ভাত মাখিয়ে শিশিরের পাশে বসল৷ শিশির হঠাৎ ভ্রু, ম্রু কুঁচকে বলে উঠল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা, কি করেছিস তুই আমার ছেলের সাথে? কি জাদুমন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়েছিস? ও সকলকে ডাকছে অথচ আমাকে কেন ডাকছে না? “
বর্ষণ ফুপুকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিল। ডাকল,
“পুপি পুপি “
খাবার দেখেছে। ফুপু এখন খাওয়াবে সে বুঝেছে৷ কুয়শা ভ্রু কুঁচকে তাকাল শিশিরের দিকে। অদ্ভুত!! সে-ও একই স্বরে বলল,
” এ্যাই, বুনো ওল ও তোমাকে ডাকছে না এখানে আমাকে কেন টানছ? এটা তোমার ব্যর্থতা।”
বলে বর্ষণকে নিতে নিতে বলল,
” এ্যাই পুচ্চু এটা তোর কি হয় বল তো? এটা তোর ফুপা হয় বুঝলি। একবার ডেকে দে তো। বল, ফুপা! “
ব্যস তেলের উপর পেঁয়াজ দিলে যেমন ছ্যানাত করে ওঠে! ঠিক তেমন করে ছ্যানাত করে উঠল শিশির৷ কিড়মিড় করে উঠল। এদিকে কুয়াশা কথাটা বলে ফিক করে হেসে দিয়েছে। কুয়াশার সাথে হেসেছে বসে থাকা সকলে। শিশির কটকট করতে করতে কুয়াশার মাথায় চাটি বসাল জোরে সোরে৷ বৃষ্টিরা সব মুখ টিপে হাসছে৷ অয়ন, অনি অদ্ভুত ভাবে দেখছে৷ এরা এখনো মা-রা মা-রি করে? অনি ঈশাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেসও করল,
” এ্যাই ঈশা এরা এখনো মা-রা মা-রি করে? “
” তা আর বলতে! আগের মতোই করে। কিছু একটা পেলেই হয়। শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাঝে ভালোবাসাটাও ততটাই গভীর ওদের”
অনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শিশির মা-রাতেই কুয়াশা আহ্ শব্দ করে উঠে ফুঁসে উঠেছে। বলল,
” এ্যাই, বুনো ওল!…. “
শিশির আর কিছু বলতে না দিয়ে বর্ষণের উদ্দেশ্যে বলল,
” এ্যাই চাচু, শুনো এটা তোমার চাচি হয় বুঝলে। তোমার এই ফুপু নামক চাচিকে চাচি ডাকবা ওকে!”
” একদম নাহ্, ও আমাকে ফুপু ডাকবে। তোমাকে ওর চাচু রূপে পছন্দ না বিধায় চাচু ডাকেনি এখনো৷ ফুপা রূপে পছন্দ হয়েছে। তাই না রে পুচ্চু? “
শেষ কথাটা তার কোলে থাকা বর্ষণকে বলল৷ বর্ষণ ফুপুর কথা পেয়ে বলে উঠল,
” হাম “
সে খেতে চাইলে হাম বলে। কুয়াশা পাশে বাটি থেকে ভাত নিয়ে মুখে দিল। বর্ষণ বিনা বাক্যে হা করে তা নিল৷ খাবার পাগল একটা৷ খিদে লাগলে খাবে আর পেট ভরে গেলে আর খাবে না৷ জোর করেও তখন আর খাওয়ানো যায় না। কুয়াশা শিশিরের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটাল। সামনের সোফা থেকে নীহার বলল,
” বুঝলি শিশির, কুশু বোধহয় ঠিকই বলেছে। বর্ষণ তোকে ফুপা রূপেই পছন্দ করছে ওর চাচু টাচুতে তোকে পছন্দ না৷ তুই বরং ওর ফুপা হয়ে যাহ্। আর জোর করে চাচু হতে চাইস নাহ্”
ফিক ফিক করে সব হেসে দিল৷ কুয়াশাও হাসল৷ শিশিরকে সকলে মিলে নাস্তানাবুদ করছে? এটা মেনে নিতে হবে? নাকি মানবে শিশির? সে ফুঁসে ওঠে কিড়মিড় করে উঠল। নীহারে দিকে তাকিয়ে বলল,
” মজা নিচ্ছিস নে। সময় কিন্তু আমার সামনে আসছে! ভেবে চিন্তে মজা করিস! তোর বউয়ের ভাই বাদে দেবর হয়ে তোর মজা করার পাওনা মিটাব কিন্তু! তখন আবার হা হুতাশা করিস নাহ্! “
নীহারের একটুও দেরি হলো না শিশিরের কথার মর্মার্থ বুঝতে। এমনকি উপস্থিত কারোরি হলোনা৷ সকলে জোরে হেসে ফেলল। আর নীহার চোখ দিয়ে শিশিরকে গিলে খাবার মতো করে কিড়মিড় করতে লাগল। শিশির দাম্ভিকের সাথে হাসি দিল।
শিশির যে নীহারের বাসর আঁটকানোর কথা বলেছে সেটা নীহার ভালোভাবেই বুঝেছে। এ ছেলে তাই-ই পারবে৷ বড় ভাই হিসেবে বোন এনে ভাবি বানিয়ে তার বাসর করাটা ডগে তুলবে। সেটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। কখনো নাহ্। তার স্বাধের বিয়ে, স্বাধের বউ আর সে কিনা বাসর রাত থেকে বঞ্চিত হবে? এটা মানা যায়!! নীহারের কথা বন্ধ করতে পেরে শিশির হাসল। সকলে ঠোঁট টিপে এদের ঝগড়া দেখছে এক একটার। ভাই, বোনের পক্ষ নিচ্ছে তো ভাই ভাই বউ নিয়ে ঝগড়া করছে। বেশ ভালোই লাগে এগুলো। হিম শিশিরের পাশে থেকে বলে উঠল,
” নীহার ভাই ভয় পেলে নাকি? ডোজ কি একটু বেশি হলো? “
হিমের কথায় আবারও হাসির রোল পড়ল। শিশির শব্দ করে হেসে দিল। এই ছেলে যে আগা গোড়ায় শিশিরের পাগলা ভক্ত সেটা সকলেই জানে। স্বাধে তো আর কুয়াশা বলে না,
” ভাই কা চামচা! “
নীহার কটমট করে তাকাল। মেহেদী নিচ্ছে তাই উঠতে পারল না। কুয়াশা পাশে থেকে ফুঁসে উঠে বলল,
” এ্যাই ভাই কা চামচা। তোর চামচামি করা বন্ধ কর!”
হিমের হয়ে শিশির বলল,
” এ্যাই ও চুপ করবে কেন? তোরা ভাই বোন মিলে গলাবাজি করছিস আবার বলছিস চুপ করতে? ও আমার একমাত্র শা-লাবাবু ওর সম্পূর্ণ রাইট আছে আমার পক্ষ নেবার। “
কথা বলতে বলতে হিমের কাঁধে হাত দিয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরল৷ হিম পুরো দাম্ভিকের সাথে হাসল৷ কুয়াশা মুখ ঝামটা দিয়ে বর্ষণকে খাওয়াতে লাগল। বর্ষণ কোলে বসে খাচ্ছে। মুখে ভাত দিয়ে কুয়াশা শিশিরের কথার উচিত জবাব দিতে বলল,
” পুচ্চু ফুপা ডাক তো৷ তোর ফুপার নাকি আফসোস হচ্ছে খুব তোর মুখে ডাক শুনতে না পেরে “
দিল শিশির আরেকটা চাটি বসিয়ে৷ আবারও একই কথা বলে এই গোবর ঠাঁসা! ধমকে বলল,
” ফাজিল গোবর ঠাঁসা, আরেকবার ফুপা বলেছিস তোহ্! “
কুয়াশাও একটা কিল বসিয়ে বলল,
” বলব একশ একবার। ওর ফুপাই তুমি “
মানে যা তা! সে ফুপা হতে যাবে কোন দুঃখে। কোনকার না কোনকার দুঃসম্পর্কের ফুপা সেটা শুনতে হবে? ফিলিংস পর পর! বর্ষণকে কোলের উপর বসিয়ে নিল। আজ সে চাচু ডাক শুনেই ক্ষান্ত হবে৷ এই বর্ষণের হয়েছে যত দুনিয়ার জ্বালা জন্মের পর থেকে দেখেছে এই দুটো বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের ঝগড়া। এখনও দেখছে কিন্তু বেচারা বুঝতে পারছে না কিছুই৷ শুধু গোল গোল চোখ গুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। শিশির বলল,
” এ্যাই আব্বু তোর এই ফুপু নামক চাচির কথা একদম শুনিস না তোহ্। চাচু ডাক তো! “
কুয়াশা শিশিরের কোলের উপর বসে থাকা বর্ষণের মুখে ভাত দিল আবার৷ তার ভাত নিয়ে আবার ধরে রাখার স্বভাব আছে। কুয়াশা বলল,
” পুচ্চু ডেকে দে চাচু বলে। বেচারা বুনো ওল নয়তো তোরও গলা চুলকানোর কারণ হয়ে যাবে৷ জানিস তো এটা পুরোটায় আমার গলা চুলকানোর কারণ “
সকলে আবার হাসল৷ শিশির কিড়মিড় করছে৷ শিশির বর্ষণের মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল,
” আব্বু, ডাকো তো চাচু, চাচু। বলো চাচু “
বর্ষণ এবার শিশিরের কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বার কয়েক বলল,
” তাতু তাতু? “
শিশির বিশ্ব জয়ের হাসি দিল। বলল,
” হ্যাঁ চাচু “
কুয়াশা মুখ ঝামটাল। শিশির বর্ষণের গালে চুমু দিল। খাবার সময় চুমু দেয়াতে একটু বিরক্ত হলো সে৷ তবে আবার খেলনা নিয়ে খেলতে লাগল৷ বলল,
” ভুমমম “
হাতের খেলনা গাড়িটা নিয়ে বলল সে৷ শিশির তা শুনে বলল,
” তোমার জন্য যেগুলো এনেছি খেলনা সেগুলো কই? “
বলে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভাবি ওগুলো বের করে দাও নি? “
” ঘরে আছে ওগুলো। নিচে এগুলো নিয়ে খেলে “
শিশির আর কিছু বলল না৷ শিশিরের কোলের উপর বসে ফুপুর হাতে খেতে লাগল৷ কুয়াশা বর্ষণের মুখে ভাত দিতে ঝুঁকলে শিশিরও কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
” আহ্লাদী বউ আমার দেখি ভালোই এক্সপার্ট হয়েছে! খুব জলদিই বর্ষণের ভাই বা বোন আনার ব্যবস্থা করতে হবে দেখছি। বউ আমার বড় হয়ে গেছে কিনা!”
কুয়াশা শিশিরের দিকে মাথা তুলে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল৷ শিশির ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু চোখে হাসল৷ কুয়াশা কিছু বলল না। তবে রাগলও না৷
__________
দুপুর দুটোর দিকে। সকলে সাজগোছ করছে। নীহারের হলুদ সন্ধ্যার জন্য। মেয়েরা হলুদ শাড়ি পড়ে সাজছে৷ তুষার চলে এসেছে। এসেই আগে ছেলেকে কোলে নিয়ে মনের মতো আদর করল৷ বাবা, মা, ভাইদের সাথে ভালো মন্দ কথা বলল৷ শিশির, নীহারকে জড়িয়ে ধরল৷ ওরাও বড় ভাইকে পেয়ে আনন্দিত হলো৷ বড় ভাইটা কাছে না থেকে এতক্ষণ যেন অপরিপূর্ণ মনে হচ্ছিল৷ এখন মালিথা ভিলা পূর্নতা পেল৷ বৃষ্টির সাথে ঘরে গিয়ে দেখা করে গোসল করে একবারে নিচে আসল৷ খাবে দুপুরের এখন৷ জাকিয়া ছেলের যত্নআত্তি করলেন৷ বৃষ্টি তৈরি হচ্ছে তাকে আর ঝামেলা করাল না৷ জাকিয়া ছেলেকে খেতে দিল। তুষারের সাথে শিশিরা, চাচুরা সহ রিজভী, অয়ন, আমিনুল হক, অয়নের বাবাও বসল৷ বৃষ্টির বাবাদের বলা হয়েছে কাল আসবেন৷ সব পুরুষরা দুপুরের খাবার একসাথে খেল৷ অভিরা এখনো আসেনি।
কুয়াশার ঘরে সকলে রেডি হচ্ছে। কুয়াশাও তার ঘরেই এসেছে সকলের সাথে তৈরি হতে৷ সাজ প্রায় হয়ে এসেছে৷
নীহারকে তৈরি করতে সকল ভাইরা সাহায্য করল। সকল ছেলের হলুদের ড্রেসআপ, সাদা পাঞ্জাবির উপরে পেস্ট কালারের কোটি সাথে সাদা পাজামা৷ প্রতিটা ছেলেকে এই বেসে দূর্দান্ত লাগছে৷ নীহারকে তৈরি করে সব ভাই একসাথে বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ “
তুষার বলল,
“বাহ্ নেভির অফিসারকে তো এই বেসে দূর্দান্ত লাগছে! “
নীহার হাসল। ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” একজন পুলিশ অফিসারকেও এই বেসে দূর্দান্ত লাগছে৷ “
সকলে হাসল৷ তুষার পিঠ থাবড়ে বলল,
” ফাজিলগুলা সব “
হেসে ভাইকে ছাড়ল৷ মালিথা ভিলার সকল ছেলের হাইটই প্রায় সমান সমান। তবে হিম আগে ছিল না এখন হিমও অনেকটা এগিয়ে গেছে আরো হবে বয়সের সাথে সাথে৷ আর গায়ের রঙের দিক দিয়ে অবশ্য এক একজন আলাদা৷ তবে শিশির আর নীহারের গায়ের রঙটা সেম সেম একদম৷ দু’জনই হুলুদ উজ্জ্বল ফর্সা৷ তুহিন সকলের থেকে বেশি ফর্সা। ও একদম সাদা ফর্সা৷ সাদা ফর্সা হলেও তুহিনকে অনেক আকর্ষণীয় লাগে। কিছু সাদা ফর্সাকে ভালো লাগে না কিন্তু তুহিনকে তেমন লাগে না৷
নীহার ট্রেনিং থেকে আসার পর ওর বডি ফিটনেস এতটা আকর্ষণীয় হয়েছে যে কোনো মেয়ের চোখে পড়বে৷ আগে যতটা ছিল তার থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। একজন নেভি অফিসারের প্রতিটা দিক ওর চেহারা এবং শরীরে শোভা পায়। তুষার পুলিশ অফিসার হবার জন্য যেমন হবার প্রয়োজন ঠিক তেমনই। এদের মাঝে শিশিরকে ততটাই আকর্ষণীয় লাগে৷ ওর বডি ফিটনেস আগে থেকেই আকর্ষণীয় যেটা তুষার, নীহারের ছিল না৷ এখন বয়সের সাথে ততটাই পারফেক্ট হয়েছে৷
সব ভাইগুলো নামছিল আর মেয়েরা হা করে সেগুলোই নোট করছে। মুগ্ধ হলো এক একজনকে দেখে। কুয়াশারা সব রেডি হয়ে বসার ঘরেই ছিল৷ চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল সব ভাইদের একসাথে দেখে। সাদা পাঞ্জাবির সাথে পেস্ট কালার কোটিতে এতটা মানিয়েছে!!
শিশিররা নিচে নামলে নীহারকে সোফায় বসানো হলো। ভাইরাই বসাল। সেসময়ে নীহারের ফোনের হুয়াট্সআপে কিছু ছবি এলো। ফোন হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখে আপনাআপনি হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। আওড়াল,
” সো বিউটিফুল মাই বেবি প্রিন্সেস! ইঁচড়েপাকা পাখিটা আমার। আজকের দিনটা শুধু অপেক্ষা করো আগামীকাল আসছি আমি। “
শব্দগুলো আওড়াল কিন্তু হুয়াট্সআপে লিখে সেন্ডও করে দিল৷ ওপাশ থেকে লজ্জা পাবার ইমোজি এলো। তা দেখে নীহার আবার হাসল।
‘
শিশির কুয়াশার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল,
” আমার অপ্সরা আহ্লাদী বউ “
কুয়াশা অমায়িক হাসল। সে-ও বলল,
” আমার সুদর্শন প্রিয় স্বামী। দূর্দান্ত লাগছে তোমায়। “
বলে শিশিরের ডান হাতটা তুলে কনিষ্ঠ আঙুলে আলত কামড় দিল। শিশির ভ্রু কুঁচকাল। সে বলল,
” এটা তোমার নজর টিকা৷ কারোর বদ নজর না লাগুক। কাল থেকে ঐ হা করা অনিটা অনেকবার চোখ দিয়ে গিলেছে তোমায় হুহ্! “
শিশির হেসে ফেলল। আগের ন্যায় স্বরেই বলল,
” অভার পজেসিভ! গোবর ঠাঁসা একটা “
বলেই চাটি বসিয়ে চলে গেল। কুয়াশা মাথা ডলতে লাগল ফুঁসে উঠে। সকলে সকলের কাজে মন দিল৷ জাকিয়া এসে তুহিনকে বললেন,
” গাড়িতে সব ত্বত্ত্ব তুলে দেয়া হয়েছে তোড়া বেড়িয়ে পর “
তা শুনে তুহিন সম্মতি দিল৷ তুহিন শিশির আর হিমকে নিয়ে চলে গেল৷ তারা বাইক নিল। আর মাইক্রোতে ত্বত্ত্ব দেয়া হলো। সকলকে বলে ওরা বেড়িয়ে গেল। বাড়িতে তুষার জাহিদ মালিথার সাথে এদিকটা সামলাতে লাগল৷ জাকির মালিথা বসেই সব তদারকি সহ নির্দেশনা দিচ্ছেন।
| চলবে |
আমি বার বার বলেছি আমার গল্প কেউ কপি করে অন্য গ্রুপ বা পেইজে না দিতে৷ তবুও এটা করছে। কথা বললে কেউ বুঝে না। আমি তো গল্প ডিলিট দিচ্ছি না তো আমার পেইজ থেকে লিংক শেয়ার করলেই তো হয় নাকি!!
আমি ভুল হলে এডিট করি বার বার বলেছি। নতুন লেখিকা। লেখালেখির জগৎে একদম নতুন। শব্দভাণ্ডার, জ্ঞান সব স্বল্পপরিমাণ। তবুও খুব চেষ্টা করি ভুল দিয়ে যেন কিছু না লিখি। ভুল হলে ধরিয়ে দিতে বলি। কটু কথা না বলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলে বিশ্বাস করেন আমি সাথে সাথে ঠিক করে নিই। সবজান্তা তো সকলে হয়না নাহ্!!
তাই রিকুয়েষ্ট কেউ কপি করবেন না৷ লিংক শেয়ার করবেন পেইজ থেকে।
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click