®রোজা রহমান
‘
শীতের ঋতু আবহাওয়া বদলে এসেছে বসন্ত ঋতু। কানায় কানায় বসন্তের ছোঁয়া। প্রকৃতিতে ফাল্গুনী হাওয়া। সেজেছে রঙবেরঙের ফুলে, ফলে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ ফুলে প্রকৃতি রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর। লালে, সবুজে পরিপূর্ণ চারিকোণ৷ এক অনবদ্য, অপরূপ সৌন্দর্য্যের ছোঁয়া প্রকৃতির মাঝে।
‘
ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে৷ শীতল সমীকরণে বেঁধে রেখেছে চারিদিক। শিশির নামাজ পড়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল। তাকাল পাশে তার আহ্লাদী বউয়ের দিকে। সারারাত জেগে থেকে ঘন্টা খানেক আগে ঘুমিয়েছে। আজকাল ঘুম হয় না কুয়াশার। সাত মাসের ভরা পেট তার। অনেক কষ্ট হয় মেয়েটার। প্রথম প্রেগন্যান্সিতে সাফার করতে হচ্ছে খুব৷ একটা মেয়ের মা হওয়া যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার যারা মা হয়েছে একমাত্র তারাই বোধহয় বুঝবে এটার মর্ম!!
মাথায় হাত রেখে আলতো করে বুলিয়ে দিল। এই মেয়েটা তারই জন্য কষ্ট করছে। তারই সন্তানের জন্য কষ্ট করছে। তার বাবা হবার সুখের জন্য কষ্ট করছে। সে নিজে চোখে দেখছে তার সেই ছোট্ট আহ্লাদী বউটা কতটা কষ্ট করছে। মুখের দিকে তাকানো যায় না আর। সারারাত জেগে থেকে থেকে চোখের নিচে কালি পড়িয়েছে। শরীররটাও একটু ফুলেছে। তার জন্য হাঁটাচলা করতে হয়। নিচে নামা একদম বন্ধ করে দিয়েছে শিশির। নামলেও দশে পাঁচে একদিন। তার সবকিছু এখন উপরেই হয়। খাওয়া দাওয়া শিশিরই যেটুকু জোড় জুলুম করে খাওয়ায়। ওর খাবার তালিকার মধ্যে বৈয়াম বৈয়াম বিভিন্ন টক জাতীয় আচার আর অতিরিক্ত ঝাল কিছু। যেগুলো শরীরের একাংশেরও উপকার না।
মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল। বুকটা চিঁড়ে আসে তার বউটার কষ্ট দেখলে। দিন রাত এক প্রকার যুদ্ধ করে চলেছে শরীরের সাথে। তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেল কিঞ্চিৎ। এক কাৎ হয়ে ঝুঁকল কিঞ্চিৎ কুয়াশার মুখের উপর। কাছ থেকে পুরো বদনে অবলোকন করল। প্রেগন্যান্সির পর থেকে ক্রমেই মুখে চেঞ্জ এসেছে। মুখটা অনেকটা ফুলেছে। এখন ঘুমের মাঝে ফোলা চোখের পাতা, ফোলা ঠোঁট জোড়া, তেলে চিপচিপে নাকের ডগা, পুরো বদনজুড়ে তেলতেলে আভাস ইশশ তার অপ্সরা আহ্লাদী বউ!! এই লুকেও তার সেই আগের অপ্সরাই লাগছে। মুখে কেমন মা হবার ছোঁয়া লেগেছে।
তাকিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখে কপালে চুমু আঁকল। বিছানা থেকে যে গালটা উপরে সে গালে চুমু আঁকল। নাকের ডগা সহ ঠোঁটেও চুমু দিল। সাবধানতা বজায় রেখে আরেকটু গভীর হলো। কুয়াশার গলার মাঝে মুখ গুঁজে নিঃশ্বাস টানল। চুমু দিল ঘারের উপর। কুয়াশার শরীর ক্লান্ত বলে গভীর ঘুমে আছন্ন সে। তাই সজাগ হলো না। মুখ তুলে তাকিয়ে মুচকি হাসল। পাতলা কাঁথাটার নিচে হাত গলিয়ে দিয়ে ফোলা পেটটার উপর আলতো হাত রাখল। মুখটা একটু নিচে এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” বাবা জেগেছ কী তুমি? “
প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজ মনেই হাসল। কারণ সে পেটে বেবির নড়াচড়া টের পাচ্ছে। আহ্ কী অনুভূতি!! যেদিন প্রথম নড়াচড়া টের পেয়েছিল কুয়াশা সেদিন আনন্দে আত্নহারা হয়েছিল। শিশির পাশেই ছিল চিল্লিয়ে উঠে শিশিরকে বলেছিল৷ কিন্তু শিশির অনুভব করতে পারে নি। এরপর আস্তে আস্তে দিন গেলে কুয়াশা হঠাৎই রাতে শোবার সময় হাতটা নিয়ে পেটের উপর ধরায়। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে তার অন্তর, কায়া, মন, মস্তিস্ক৷ ঝঙ্কার তুলে জানান দেয় তার মস্তিষ্কে তার অস্তিত্বের, তার সন্তানের অবস্থান। খুশিতে দিশেহারা হরে অজস্রবার চুমু আঁকে পেটে৷ কত বকবক করেছিল ঐদিন বাবুর সাথে৷ কুয়াশা হেসে কুটিকুটি হয়েছিল৷ ভেবে হাসল। বলল,
” আমার বাবা, জলদি বাবার কাছে চলে আসো তোহ্! বাবার যে আর তর সইছে নাহ্! আর আম্মুকেও একটু কষ্ট কম দাও কেমন? জানো তো তোমার আম্মুটা আমার একমাত্র আহ্লাদী বউ, তাহলে তোমার আম্মুর কষ্ট সহ্য করি কী করে বলো তোহ্! “
ফিসফিস করে আবার বলল কথাগুলো। বলে আরেকটু পেটের দিকে ঝুঁকে চুমু দিল পেটে। এরপর কাঁথাটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে সে নিচে চলে গেল।
শুক্রবার আজ। জাহিদ মালিথা সহ সকলেই বাড়িতে। সকাল ভোর ছয়টার দিকে বসার ঘরে সকলে চা নাস্তা করছে। শিশির গিয়ে তুহিন, হিমের পাশে বসল। জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা গল্প করছেন নিজেদের মতো করে৷ জাকির মালিথা এখন নিয়ম করেই নিচে ওঠা, নামা করেন। যদিও অসুস্থতা এখনো আছে৷
শিশির কফি ঢেলে খেতে লাগল। হিম বলল,
” বুবুর শরীর কেমন আছে ভাই? “
” আগের মতোই৷ সারারাত জেগে একটু আগে ঘুমিয়েছে৷ “
হিম শুনে আর কিছু বলল না৷
শশী, ইয়াসমিন, বৃষ্টি এখন রান্না ঘরে সাহায্য করে শাশুড়ীদের সাথে। তুষার এসেছিল মাস খানেক আগে। একদিন থেকে দেখা করে গেছে৷
‘
দুপুর বারটার দিকে৷ কুয়াশা বসে আছে বিছানায়৷ তার এত শুয়ে বসে আর এ-ঘর ও-ঘর সহ বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। বাহিরে যদিও বের হয় তো সেটা হসপিটালে বা দরকারের জন্য যাওয়া হয়। পড়াশুনোর চাপ নেই অবশ্য এখন৷ আর ভালো লাগে না এমন থাকতে৷ একটু বাহিরে ঘুরতে মন চায়৷
দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠলে আজমিরা খাবার এনেছিল। হাতেই খায় অবশ্য যেদিন নাকচ করে সেদিন আজমিরা জোর করে খাওয়ায়।
শিশির এলো বারটার দিকে। এসে গোসলে ঢুকবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ জিজ্ঞেস করল নরম, আদুরে স্বরে,
” খেয়েছিলি সকালে সোনা? “
” হুঁ “
” কি হয়েছে? ওমন করে আছিস কেন? “
” কিচ্ছু ভালো লাগছে না। “
শুনে শিশির পাশে গিয়ে বসল৷ শরীরের টিশার্ট খুলেছিল মাত্রই। কুয়াশা আধশোয়া হয়ে বসে আছে। শিশির পাশে বসে গালের উপর হাত রাখল। কুয়াশা আদুরে হয়ে কাঁধে মাথা রাখল। সে জিজ্ঞেস করল,
” কেন ভালো লাগছে না আমার আহ্লাদী বউয়ের? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? “
” উহু “
” তো? “
শুনে কাঁধ থেকে মাথা নামিয়ে স্বামীর নগ্ন বুকে মুখ রাখল৷ নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
” ঘুরতে নিয়ে যাবে আজ একটু? “
কথাটা খুবই করুন লাগল শিশিরের কাছে। মেয়েটার সত্যি একটু ফ্রেস হাওয়ার প্রয়োজন। প্রতিদিন এক রুটিনে চলতে কার ভালো লাগে? বলল,
” বিকেলে রেডি থাকিস “
কুয়াশা খুশি হয়ে হাসল৷ বুকে চুমু দিয়ে শিশিরের গালে চুমু দিল৷ হাসল নিঃশব্দে শিশির আহ্লাদীর আহ্লাদীপনা দেখে৷ বলল,
” কোথায় যাবি? “
” রেনউইক বাধে “
” এই অবস্থায় অতটা দূর যাবি? “
” কতদূর? “
” ওটাই দূর এখন তোর জন্য “
কুয়াশা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। গাল ফুলিয়ে বসল। শিশির তা দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” তৈরি হয়ে থাকিস “
মুচকি হাসল শুনে। গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” পুচ্চুকে নিয়ো “
” বলে দিস ভাবিকে “
সম্মতি দিল কুয়াশা। আবার বলল,
” আজ দুপুরে নিচে খেতে যাব! “
” আমি এসে নামিয়ে নিয়ে যাব। পাকনামো করতে গেলে মা-র একটাও মাটিতে ফেলব না! “
কুয়াশা ভেঙচি কাটল। শিশির চলে গেল গোসলে। কুয়াশাও গোসলে যাবে শিশির এলে।
‘
দুপুর দুইটার পর খাবার খেল সকলে একসাথে। খাবার টেবিলে শশীকেও ঘুরতে যাবার কথা বলল কুয়াশা। শশী রাজি হলো না। তার কোথাও ভালো লাগে না যেতে। আনন্দ, আহ্লাদ কেন যেন বিষাদের নিচে চাপা পড়ে গেছে। মনের মানুষটা নেই সেখানে ঘুরতে যেয়েও তার বড্ড একা একা লাগে। আনন্দরা যেন পানসে রূপ নেই। কুয়াশাও আর জোর করল না৷ কারণ এ মেয়ের যাওয়ার হলে একবারেই রাজি হতো৷ না যখন করেছে তো কিছুতেই আর রাজি হবে না। বর্ষণকে রেডি করিয়ে দিতে বলল তিনটার পর।
‘
বিকেল চারটার দিকে কুয়াশা কফি কালারের বোরকা পরল আর মাথা ওড়না পেঁচালো। এর বেশি কিছু করল না। মুখটা ধুয়ে শুধু স্নো দিয়েছে তাও কতদিন পর তার হিসেব নেই। শিশির রেডি হয়ে বিছানায় বসে আছে। পরনে কালো শার্ট হাতা ফোল্ড করা, কালো প্যান্ট, কালো ঘরি। চুলগুলো চিরুনী করে উপরে তোলা, তবুও অবাধ্য কিছু চুল কপালের উপর পড়েছে। কে বলবে এই ছেলে এক সন্তানের পিতা হতে চলেছে? বাহিরে এই লুকে গেলে তো মেয়েরা গিলে খাবে!!
কুয়াশা মিররে তা দেখে বিরক্ত হলো৷ এত সাজার কি আছে? অসহ্য! তার স্বামীকে বাহিরের মেয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখে হাজারো কমেন্ট করবে? হা হুতাশা করবে? এটা বউ হয়ে নিজের চোখে দেখে সহ্য করতে হবে? বলল,
” এত সাজার কি আছে? “
শিশির শুনে আগ্রহ নিয়ে চায়ল। বলল,
” আমাকে বলছিস? “
” তো আর কাকে? “
” আমি সেজেছি? কোথায়! মেকাআপ করেছি? কাজল নিয়েছি? লিপস্টিক নিয়েছি? “
” নাহ্ এসব কিছুই নাও নি। কিন্তু তোমায় তবুও জোশশ লাগছে “
শিশির এবার তাকিয়ে থেকে দুষ্টু চোখে হাসল। এই ব্যাপার!! ভেবে নিয়ে বলল,
” আচ্ছা? “
” হুঁ “
বলে থেমে শিশিরের দিকে ঘুরে কাছে যেতে যেতে বলে উঠল,
” এ্যাই তুমি বোরকা পরো তো, বোরকা পরো! ওঠো! “
শিশির পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিস্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল৷ মানে!! কী বলে এই গোবর ঠাঁসা? ভাবনার মাঝে আবার কুয়াশা বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,
” এ্যাই ওঠো তোহ্ তুমিও পরো বোরকা! “
শিশির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রয়েছে। নিজেকে সামলে বাস্তবে ফিরে দিল একটা ধমক। মানেহ্ যা তা!! বলল,
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা! মাথা কি তোর আছে না গেছে? মনে তো হচ্ছে সম্পূর্ণই গেছে? আর একবার এ নিয়ে কথা বলবি তোহ্! “
কুয়াশা ধমক খেয়ে চুপ করে থাকল৷ মুখটা আমসত্ত্ব করে দাঁড়িয়ে পেটে হাত দিয়ে বলল,
” বাবু দেখলি কেমন করে ধমকটা দিল? ভয় পেয়েছিস সোনা? তোর পঁচা বাবা এটা। দেখ কি সেজেগুজে ঘুরতে যাচ্ছে আমি বলেছি বলে দোষ। যাব নাহ্ কারো সাথে হুহ্! “
বলেও আবার বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য বৃষ্টিদের ঘর। শিশির হাসবে নাকি কিছু বলবে সেটাই ভুল গেল। তবে হাসলই সে। মেয়েটা বাচ্চা হয়ে গেছে। জেদ আরো দ্বিগুণ বেড়েছে। সামলাতেও হিমশিম খেতে হয়৷ প্রমিস করেছে মা-রবে না এই জন্য স্পর্ধা আরো বেড়েছে। উঠে সে-ও বেরিয়ে গেল।
বসার ঘরে বর্ষণকে নিয়ে এলো বৃষ্টি। সব বসার ঘরেই আছে। বর্ষণ আনন্দে আটখানা। সে ঘুরতে যাবে শুনেছে তাও আবার চাচু আর ফুপু নামক চাচির সাথে। দৌড়ে শিশির কোলে উঠল,
” তাচুু….. “
বলে চিল্লিয়ে৷ সকলে হাসল। কালো থ্রি কোয়াটার প্যান্ট সাথে সাদা টিশার্ট পড়েছে সে। এইটুকু বয়সেই মেয়েরা তাকে তুলে নিয়ে যাবে বোধহয় ভাবটা এমন। জোশ লুকে আছে, গুলুমুলু দেখতে এত্ত কিউট!!
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তারা বেরিয়ে গেল। বাইক নিল শিশির। সামনে বর্ষণকে বসাল। কুয়াশাকে বলল,
” সাবধানে উঠবি। “
বলে পেছনে কুয়াশা উঠে বসল। শিশির সাহায্য করল যদিও প্রয়োজন ছিল না। শিশির বর্ষণের চোখে কালো সানগ্লাস পরিয়ে দিল। এবার পুচ্চুকে আরো জোশ লাগছে। বলল,
” ফুপি দেকো! “
কুয়াশা বেজায় বিরক্ত হলো। সামনের এই দুইটা জোশ জোশ ছেলের মাঝে সে পুরোই ক্ষেত টাইপ লুকে আছে৷ শিশির বাইকের মিররে কুয়াশার অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বাইক স্টার্ট দিল। বলল,
” ভালো করে ধরে বোস “
‘
সাড়ে চারটার দিকে তারা কুষ্টিয়া রেনউইক বাধে পৌঁছাল। বাধটা কুষ্টিয়া গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত। এটা রেনউইক বাধ নামে পরিচিত লাভ করলেও এই প্লেসটির নাম রেনউইক বিনোদন পার্ক ও রিসোর্ট লোকমুখে রেনউইক বাধে পরিচিত।
শিশির বাইক রেখে বর্ষণকে কোলে নিল। কুয়াশাকে বলল,
” আস্তে হাঁটবি অনেক ইটের টুকরো আছে কিন্তু! “
কুয়াশা হাসল। এত দিকে খেয়াল রাখে মানুষটা। সে এর আগেও ভাইদের সাথে ভাবিদের সাথে এসেছে। জানেও সব৷ শিশির বাহিরে থেকে প্রবেশের জন্য ফর্মালিটি পূরণ করে এক সাইটে বর্ষণকে নিয়ে অন্য হাতে কুয়াশার হাত ধরল। আস্তে আস্তে তারা হেঁটে ভিতরে ঢুকল৷
ভিতরটা একদম শান্ত, নিরিবিলি জায়গা৷ বিকেলে এখানে সময় কাটানোর জন্য অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। চারিদিকে সবুজ বড় বড় গাছপালা আছে। ঢুকতেই মাঝ দিয়ে চলাচল রাস্তা আর দুই পাশে ছোট, বড় গাছপালা। বসন্তের সবুজ প্রকৃতি আরো সুন্দর লাগছে। বসার জন্য ছাউনি তৈরি করা আছে।
ওরা আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। বর্ষণ আজ প্রথম এলো। সে এখন এটা ওটা প্রশ্ন করছে দেখে দেখে৷ ঢুকেই সামনে মুর্তির দুইটা পরী আছে রাস্তার দুই পাশে৷ শিশির বর্ষণকে বলল,
” আব্বু দেখো পরী! “
” পলী…? “
কুয়াশা হেসে বলল,
” হ্যাঁ পরী। তোকে বিয়ে দেব পরীর সাথে বুঝলি! “
বর্ষণ কি বুঝল কে জানে! সে খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল,
” পলীল কাতে দাব তাচু!”
শিশির শুনে এগিয়ে গেল। ছবি উঠাল চাচু ভাতিজা মিলে। কুয়াশা হেঁটে এগিয়ে গেল। আহ্ কতদিন পর এমন সুন্দর সবুজ নিরিবিলি পরিবেশে আসতে পারল!! বাড়িতে থেকে একদম বোর লাগছিল। ফ্রেশ হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পেরে শান্তি লাগছে। মনটা পুরোই ফুরফুরে হয়ে গেল।
শিশির পেছনে বর্ষণের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে৷ কুয়াশা কিছুটা দূর থেকে চটপটি, ফুসকা দেখে পেছন ঘুরে বলল,
” এ্যাই..! ঝাল ঝাল ফুসকা, চটপটি খাব “
এখানে ভেতরে যারা ঘুরতে আসে তারা খায় ওগুলো। অনেক কিছুই বিক্রি হয় মুখরোচক সব খাবারের মাঝে৷
শিশির জানতো এই গোবর ঠাঁসা এগুলো দেখলে নিজেকে আটকাবে না। এগুলো একটুও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না৷ বিরক্ত হলো খুব। বলল,
” এখন এগুলো খাবি তুই? “
” হ্যাঁ, তো? ঘুরতে এলাম আর চটপটি, ফুসকা খাব নাহ্? “
শিশির বলল,
” খাবি ভালো কথা, আমার বাবার এসবে সমস্যা হলে তোর অবস্থা আমি কী করি দেখে নিস। “
বলে হাঁটতে লাগল৷ আশে পাশে অনেক লোকজনই আছে। তারা শুধু তাকাচ্ছে ওদের দিকে। কুয়াশা এই জিনিসটা খুবই অসহ্য লাগে। এই বাঙালিদের কৌতুহলের শেষ নেই তারা যদি হাজার ইম্পরট্যান্ট কাজও করে তবুও কে এলো, কে গেলো, কার কি হলো সবটা হা করে দেখা লাগবে৷ আরে ভাই তোরাও ঘুরছিস ঘোর নাহ্! নিজেদের গল্প, ঘুরা, প্রেমালাপ বাদ দিয়ে অন্যদিকে এত খেয়াল করতে হবে কেন?
ওরা ফুসকা ওয়ালার কাছে গেল। কুয়াশা বলল,
” মামা ঝাল ঝাল করে ফুসকা দেন তো এক প্লেট “
বলে শিশিরকে বলল,
” খাবে তুমি? “
” নাহ্৷ তুই খা তোর ফুসকা “
বলে বর্ষণকে নিয়ে পাশে চলে গেল। ওখান থেকে ওকে চিপস কিনে দিল। কুয়াশা পাত্তা দিলনা। সে বসল গিয়ে৷
কুয়াশা অতিরিক্ত ঝাল খেয়ে দাপাচ্ছে। একবারে ফুসকা, চটপটি খেয়েছে সে। শিশিরের বেজায় রাগ উঠল। কিন্তু লোকের মাঝে কিছু বলল না। বর্ষণ কে নিয়ে সে বসে আছে। বর্ষণ চিপস খাচ্ছে আর বিভিন্ন কথা বলছে।
ওরা এক ঘন্টা মতো ঘুরে বেরিয়ে এলো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে নয়তো। কুয়াশাকে নিয়ে শিশির রেস্টুরেন্টে ঢুকল। সেখানে ওরা তিনজন হালকা পাতলা খেল আর বাড়ির সকলের জন্য নিল।
বিকেলটা সুন্দরমতো ঘুরে বাড়ির পথ ধরল। মনটা ফুরফুরে হয়েছে বেশ।
‘
রাত নয়টার পর খাওয়া দাওয়া করে শিশির এলো। কুয়াশা ঘরে খাচ্ছে। সে পাশে বসল। আজমিরা আছেন। কুয়াশার খাওয়া হয়ে গেলে চলে গেলেন। শিশির উঠে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করে এসে লেপটপ নিয়ে বসল৷ কুয়াশা ফুঁসে উঠে বলল,
” রাখো তোহ্! সারাদিন শুধু কাজ দেখায়! আমাদের জন্য একটুও সময় নেই?”
শিশির চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। এত সময় দেয় কাদের তাহলে? কুয়াশা তা দেখে লেপটপ কেঁড়ে নিল৷ রেখে বলল,
” একটু জড়িয়ে ধরো ভালো লাগছে না আমার। ভয় করছে “
শিশির তড়াক তাকাল৷ বলল,
” কিসের ভয়? কি হয়েছে? কেমন ভয় করছে?”
” জানি নাহ্”
শিশির শুনে কুয়াশাকে বলল,
” এদিকে এগিয়ে আয় “
কুয়শা বিনা বাক্যে এগিয়ে গেল। দু’জনেই আধশোয়া হয়ে বসা৷ বুকে নিলে কুয়াশার মাথা টা। বলল,
” এখানে থাকতে ভয় কিসের তোর? “
” আমার শান্তির জায়গা এটা “
” শান্তি লাগছে এখন? “
” হুঁ “
হাসল শিশির। বলল,
” চল একটু হাঁটবি। খেলি মাত্র “
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে নামল। শিশির ঘর সহ বেলকনিতে ধরে হাঁটাল আর গল্প করল। দশ-পনের মিনিট হেঁটে হাঁপিয়ে উঠছে কুয়াশা। এসে বসল। শিশির বলল,
” পা ধরে গেছে? “
” হ্যাঁ “
শিশির শুনে দুই পা তুলে দিল বিছানায়৷ আলতো করে করে ম্যাসাজ করে দিতে লাগল। কুয়াশা এতে অভস্ত্য। প্রায় দিনই হাঁটতে গেলে পা লেগে গেলে শিশির টিপে দেয়। রাতে সে এভাবেই নানান কাজে বউয়ের সেবায় নিয়োজিত থাকে৷ কত রাত অবধি জেগে থাকবে তার দিক ঠিকানা নেই৷ কুয়াশা না নিজে ঘুমোয় আর না তাকে ঘুমোতে দেয়৷ ঘুম এলেও আবার ভেঙে যায়। একটু করে ঘুমোয় আবার জেগে ওঠে। খিদে লাগে কিন্তু খেতে ইচ্ছে হয় না। নানান ফল, খাবার থাকে কিন্তু খেতে পারে না৷ তবুও শিশির রাতেও খেতে বলে।
কিছুক্ষণ পা ম্যাসেজ করার পর কুয়াশা বলল ওয়াশরুমে যাবে। শিশির পা নামিয়ে দিল। কুয়াশা নেমে ওয়াশরুমে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে পানি খেল৷ বসল আবার। হেলান দিয়ে বসল৷ শিশির উঠে পা’য়ের নিচে বালিশ দিয়ে দিল। ওর সাইটে গিয়ে বসে এগিয়ে এলো কুয়াশার দিকে। কাঁধের উপর মাথা নিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” মেয়েরা এই সময়টা কতটা সাফার করে আমি এখন হারে হারে বুঝছি। তোকে দিন, রাত নিজের চোখের সামনে এভাবে কষ্ট করতে দেখে “
কুয়াশা মলিন হেসে বলল,
” এই কষ্টেই অনেক সুখ গো। এত এত কষ্ট করছি যখন ওর মুখটা দেখব চোখের সামনে তখন বোধহয় সব মিটে যাবে৷ মনটা শুধু বলে একবার শুধু ও’কে দেখব “
শিশির কপালে চুমু আঁকল। পেটে হাত রাখল আর তখনই নড়াচড়া টের পেল৷ শিশির তড়াক তাকাল কুয়াশার দিকে। কুয়াশাও তাকাল। বলল,
” নড়ছে ও!. “
” হ্যাঁ, এই দেখ নড়ছে! “
কুয়াশা হাসল। বলল,
” ও-ও বাবা, মায়ের মাঝে আসার জন্য উতলা হয়ে আছে বুঝলে “
শিশির মুচকি হেসে হাত বুলাল৷ পেটে চুমু দিল। বলল,
” জলদিই আসবে আমাদের কাছে “
কুয়াশা বলল,
” আমাকে দাও চুমু। শুধু বাবুকে দাও!
” হিংসুটে হয়ে যাচ্ছিস তুই গোবর ঠাঁসা! “
” হ্যাঁ তাই, আমার ভালোবাসা কমলে তোমাকে কাঁচায় খাব বলে রাখলাম। “
শিশির তা শুনে হাসল। কুয়াশা আদুরে বিড়াল ছানার মতো বুকে গুটিশুটি মে-রে শুলো। শিশির হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
______________
দেখতে দেখতে সপ্তাহ গিয়ে মাস চলে গেছে। এগারটার দিকে কুয়াশাকে নিয়ে সকলে চিল্লা চিল্লি শুরু করে দিয়েছে। সে সহ বাড়ির সকলে হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। কুয়াশা ব্যথা উঠেছে৷ ডেট ছিল এখনো সপ্তাহ খানেক পর। তার আগেই ব্যথা শুরু হয়েছে।
শিশির দিশেহারা হয়ে উঠেছে। কুয়াশার অবস্থা দেখে৷ জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা সহ বৃষ্টি, ইয়াসমিন, শশীও পাগল প্রায়। কারণ বৃষ্টির থেকে কুয়াশার অবস্থা বেশি করুণ। গগনবিদারী চিল্লানিতে শিশিরের পাঁজর পর্যন্ত ভেঙে আসছে। বলল,
” আম্মু ওর তো খুবই কষ্ট হচ্ছে। হসপিটালে নিতে হবে! “
” এম্বুলেন্স ডাক জলদি”
শিশির তখনি ফোন দিল। কথা শেষ করে কুয়াশা আরেকপাশে বসে জড়িয়ে ধরল। কুয়াশা শিশিরের হাত, টিশার্ট সব ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। সেদিকে শিশিরের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার একটাই লক্ষ্য বউয়ের কষ্ট কমানো৷ সামনে থেকে এমন করুন অবস্থা দেখে সে নার্ভাস হয়ে গেছে৷ কী সব বলছে তার দিক ঠিকানা নেই! চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে তার৷
কুয়াশার পেইন এতটায় যে রীতিমতো সকলে ভয় পেয়ে যাচ্ছে। শশী তো কেঁদেই দিয়েছে কুয়াশার অবস্থা দেখে। তুহিনরা বাহিরে।
” সোনা! খুব কষ্ট হচ্ছে? কিছু হবে না। এখনই হসপিটালে যাব একটু সহ্য কর! “
কুয়াশার চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। ব্যথায় এতটাই কাঁতর যে সে বলে উঠল,
” এ্যাই শুনো আমি যদি আর না ফিরি তুমি কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করবা না! আমি মানতে পারব নাহ্ একটুও। তোমাকে ছাড়া আমি দূরে থাকব কিন্তু অন্য কারো কাছে দেব না। আমি সন্তান নিতেও রাজি ছিলাম তবুও তোমায় কাউকে দেব না “
কতটা নির্মম যন্ত্রণা হলে মানুষ এই সময়ে মৃত্যুর কথা ভাবে!! এতটায় যন্ত্রণা হচ্ছে যে সে মৃত্যুর কথাও বলে ফেলছে অবলীলায়। শিশির সহ সকলে কেঁপে উঠল। শিশির এই সময়ে এমন কথা শুনে বলে উঠল ভারী স্বরে,
” কুয়াশা..! “
” আমি বোধহয় বাঁচব না গো। মরে যাচ্ছি আমি। এ্যাই দেখো! “
বলতে বলতে চোখমুখ উল্টে ফেলার মতো করে উঠছে। শিশিরের কেন জানি আর সহ্য হলো না। সে কুয়াশাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল৷ নিয়ে নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দিল৷ যেটা আজ অবধি কেউ দেখে নি৷ এই মেয়েকে ছাড়া তার একটা মিনিট চলে না৷ যুগ যুগ এই মেয়েটার সাথে কাটিয়ে এসেছে সে। তার ভালোবাসা সে, তার আহ্লাদী বউ সে, তার ঝগড়া, চুলোচুলির সঙ্গী সে। এই আহ্লাদীকে ছাড়া সে নিঃস্ব। একে ছাড়া একটা মিনিটও পাড় করা তার কাছে হাজার বছর লাগে। আর সেই মেয়ে তার সামনে এভাবে মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে সাথে মৃত্যুর কথা বলছে কেউ সহ করতে পারবে?
কত শত পরিস্থিতিতে এই শিশির শক্ত থেকেছে। সব বাঁধা অতিক্রম করছে নিজেকে শক্ত রেখে। অথচ আজ আর সহ্য করতে পারল না। একটা স্ট্রোং পার্সোনালিটির পুরুষকে ভালোবাসা ভেঙে দিচ্ছে। বউয়ের গগনবিদারী চিৎকার তার পাঁজর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। তার সন্তানের মুখ দেখার সুখের থেকে এই মেয়েকে তার আগে প্রয়োজন। এই মেয়ে তার বুকে না থাকলে তার বুকই শূণ্য। শশী সহ আজমিরা হাউমাউ কেঁদে দিল এবার।
জাকিয়া চোখের পানি ছেড়ে দিলেন৷ একমাত্র মেয়ে কুয়াশা। আদরে, আহ্লাদে বড় করেছেন সকলে মিলে। তার কষ্ট মা’য়েরা কি করে সহ্য করবে? মেয়ে তাদের সামনে মৃত্যুর কথা বলছে। কুয়াশা ছেলে বউয়ের আগে বাড়ির মেয়ে। অন্তর তো পুড়বেই সকলের!!
কুয়াশা হাড় ভাঙা কষ্ট নিয়ে শিশিরকে খামচে ধরে আছে৷ শিশির ওভাবে বুকে জড়িয়ে রেখেই বলল,
” দেখ সোনা তুই শান্তির জায়গাতেই আছিস। এই দেখ তোর শান্তির জায়গা। পাচ্ছিস না শান্তি সোনা? বল পাচ্ছিস না?”
জাকিয়া ছেলেকে সাহস সহ আশ্বাস দিলেন৷ বৃষ্টি, ইয়াসমিন শিশিরকে ধরে বলল,
” শিশির বাহিরে এম্বুলেন্স এসে গেছে। “
শিশির শোনা মাত্র কুয়াশাকে ছেড়ে দিল। চোখ মুছে বলল,
” আর একটু সহ্য করে নে সোনা! “
বলে কোলে তুলে নিল। বেড়িয়ে গেল। সকলে গেল৷ আজমিরা প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরোল।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click
তোমাদের এত এত ভাবনা যদি উল্টে দিই!!