®রোজা রহমান
‘
তপ্ত বিকেল। প্রকৃতি লালাভ রূপ নিয়েছে। সূর্য পশ্চিমাকাশে উকি দিচ্ছে। সারাদিনের রোদে এখন ভেপসা গরম নিঃসৃত হচ্ছে। গাছের পাতারা যেন আট ঘাট বেঁধে না নড়ার পণ করেছে। সুস্থির ভাবে অন্তরীক্ষ মুখো উকি দিয়ে আছে। এ ক্ষণ যেন খুব করে প্রতীক্ষায় আছে একটু সমীরণের শীতলতার। কিন্তু তার দেখা মিলা যেন বড়োই দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
‘
এমন-ই ক্ষণে ঈশাদের ছাদে আড্ডার আসর বসেছে। ছাদে ছোটরা সকলে গল্পে মজেছে। হাতে হাতপাখা কারো কারো। বড়রা ঘরে বসে আলোচনা করছে, খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে। ছাদে শিশিররা সকলে সহ ঈশা, ইয়াসমিন এবং ওদের ফুপু অর্থাৎ তুহিনের খালার দুই ছেলে ও এক মেয়ে বসে আছে। তাদের নাম অভি, অয়ন, অনি।
আম্বিয়া বেগমরা দুই বোন এক ভাই। আমিনুল সাহেব-ই সবার বড়। আম্বিয়া তার বোনের ছোট। বিয়ের দিন, তারিখ ঘরোয়াভাবেই সকলে ঠিক করছেন৷
‘
ছাদের ফ্লোর গরম বলে সকলে চেয়ার নিয়ে বসেছে। চারিদিকে বড় গাছপালা আছে। কিন্তু গাছ থেকেও কোনো লাভ নেই।
বাতাসের কোনো বালাই প্রকৃতিতে পাওয়া যাচ্ছে না৷ কুয়াশা পাখা দিয়ে বাতাস করছে আর কথা বলছে। কোথা থেকে শিশির উড়তে উড়তে এসে ওর হাত থেকে হাতপাখা নিয়ে নিল। কুয়াশা ঘুরে তাকিয়ে দেখল শিশির আরামচে একটা চেয়ার নিয়ে বসতে বসতে ওরই হাতে থাকা পাখা দিয়ে বাতাস নিচ্ছে।
এতক্ষণ শিশির, নীহার, নীহারের খালাত ভাই অয়ন ছাদের অন্যপাশে ছিল। এরা তিনজনে মাসের ছোট বড়। তাই মিলও ভালোই। অভি তুহিনের বড়। ধরতে গেলে তুষার আর অভিকে এক বয়সে ফেলা যায়। কিন্তু বিয়ে করে নি এখনো। তবে শিগগিরী-ই করবে। এদিকে অনি বয়সে কুয়াশা আর ঈশার সমান। এরা তিনজনে সেম এ্যজের কিন্তু মাসের ছোট বড়।
‘
কুয়াশা বেশ চটে গেল। আর লোক কি ছিল না এখানে? সে কি একায় এখানে আছে? নাকি পাখা তার হাতেই শুধু? আর বাতাসও সে একাই নিচ্ছে!! কতত বড় ফা-জিল হলে এমন করে সবসময়! উপস্থিত সবাই এবার হা’ঙ্গা’মা দেখার জন্য তৈরি হলো। তুষার বলল,
” দেখ এটা কিন্তু বাড়ি না, একদম মা-রা মা-রি করবি না দু’টো! “
তা শুনে অভি হেসে বলল,
” এরা এখনো সেই আগের মতোই আছে? এখনো মা-রা মা-রি করে? “
উত্তরটা বৃষ্টি দিল। বলল,
” তা আর বলতে! বলেন কোন দিন আর কোন ওয়াক্ত মিস গেছে। আমি ছয় মাস ওবাড়িতে এসে পর্যন্ত দেখি দিনে নামাজের মতো এরা নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত চুলোচুলি করে। খেতে গেলে, উঠতে গেলে, বসতে গেলে, শুতে গেলে সব সময় লেগেই থাকবে৷ “
সকলে তা শুনে হাসল। শিশির ইতোমধ্যে ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে৷ কুয়াশা কাউকে পাত্তা না দিয়ে শিশিরের দিকে তেড়ে গেল। উদ্দেশ্য ওর হাত থেকে পাখা নেবে। কিছুটা দৌড়ে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শিশিরের কোলের উপর। শিশিরের মাথার সাথে বারি খেল কুয়াশার মাথা। এরপর কুয়াশার হাতের কনুই গিয়ে শিশিরের পেটে লাগল। বেশ জোরেই লেগেছে। শিশির ‘আহ’ করে উঠল চোখ মুখ খিঁচিয়ে। শিশির অজান্তেই কুয়াশার কোমড়ের পাশে বাম হাত দিয়ে চেপে ধরেছে।
আসলে সম্পূর্ণ ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হয়ে গেছে৷ কুয়াশা ওর গায়ের উপর পড়ার দরুণ সে নিজের ব্যালেন্স ঠেঁকাতে কুয়াশাকে ধরেছে। নয়তো দু’টোই উল্টে পড়ত ছাদের শানের উপর ঠাঁস করে। কুয়াশা সেদিকে পাত্তা দিল না। সে মাথা ঘষতে ঘষতে পাখা নেবার জন্য এক হাত দিয়ে কাড়াকাড়ি করছে অন্য হাতে মাথা ঘঁষছে। শিশিরের শক্ত হাত এখনো কুয়াশার কোমড় ধরা। অন্য যে হাতে পাখা সেটা শরীরের জোর দিয়ে ধরে রেখেছে।
পুরুষ মানুষের শরীরের জোরের কাছে কি আর নারীর জোর খাটে? তাদের শরীরের একাংশ জোরও বোধহয় নারীদের শরীরে থাকে না। আর তা যদি হয় নরম, কোমল দেহের নারী। তেমন-ই শিশিরের শরীরের জোরের সাথে কুয়াশা কিছুতেই পারছে না তবুও হার মানবে না এবার দু’হাত লাগাল কাড়াকাড়িতে। শিশির তা দেখে ব্যাঙ্গ হাসি দিয়ে বলল,
” এই সময় সহ সারারাত দিলাম, পারলে নিয়ে দেখা “
কুয়াশা আরো ক্ষেপে গেল৷ এদিকে শিশির কুয়াশার কোমড় আরেকটু জোর দিয়ে চেপে ধরল। ব্যথা পেল এবার সে। শিশির হাতটা একদম কুয়াশার কোমড়ের বাঁকা খাঁজের মাঝে। নরম শরীরে হাত দিয়ে খিঁচে ধরেছে লাগার-ই তো কথা। এটা বোধহয় শিশির ইচ্ছে করেই ধরেছে ওকে ব্যথা দেবার জন্য। কিন্তু বোধ নেই আসলে জায়গাটা কোথায়!
কুয়াশার এবার টনক নড়ল। বিস্ময় নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। তারপর সেই বিস্ময় চাহনি আস্তে আস্তে কেমন অদ্ভুত চাহনিতে গিয়ে রূপ নিল। হয়তো লজ্জা পেল কুয়াশা৷ এতক্ষণে মাথা কাজ করল, আসলে শিশিরের হাতটা কোথায়৷
ছাদে উপস্থিত থাকা সকলে ওদের কাড়াকাড়ি দেখছে৷ কিন্তু ওদের ভেতরকার গভীর ঘটনাটা শুধু তিনজনের চোখে লাগল। অয়ন, ঈশা, অনি তিনজনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে৷ কোথাও একটা তোলপাড় হচ্ছে বোধহয়।
শিশির তাকিয়ে আছে কুয়াশার দিকে। নজর তার তাচ্ছিল্যের এবং জেদের৷ তাচ্ছিল্য নজর যেটা হচ্ছে, কুয়াশা কখনো তার হাত থেকে পাখা নিতে পারবে না। আর জেদ হচ্ছে, সে কখনোই পাখা কুয়াশাকে দেবে না। এই দু’ইয়ের মাঝে যে, সে কি অদ্ভুত কাজ করে বসে আছে এখনো মস্তিষ্ক ধারণ করে নি। এবার কুয়াশার অদ্ভুত নজরের দিকে নজর পড়ল শিশিরের। ধক করে উঠল বুকে। টনক তখনি নড়ল, তার হাত কোথায়। এবার কুয়াশা বেশ স্বাভাবিক ভাবে আস্তে করে বলল,
” লাগছে আমার ”
সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল শিশির। একটু অপ্রস্ত হলো তবে সেটাকে বেশি পাত্তা দিল না। পুরো নরমালি নিল। সেই সুযোগে কুয়াশা পাখা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল নিজের জায়গায়।
এদের নিয়ে আর হয় না। ভাই বোনেরা চুপ করে দেখছিল এদের দৌড় কতদূর যায়৷ শিশির আবারও উঠতে যাবে তুষার এবার ধমক দিল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
” এ্যাই লাগায়ছিস কি? এটা বাড়ি না তোদের বললাম না? চুপ করে বস ওখানে৷ আর ধর আমার থেকে পাখা নে৷”
শিশির বিরক্ত হলো। ওর নিজের ভাই-ই ওর শত্রু সেখানে এই গোবর ঠাঁসার তো সাহস হবেই তার সাথে ঝগড়া, মা-রা মা-রি করার। মনে মনে কথাগুলো আওড়াল। তারপর তুষারকে বলল,
” দেখো ভাইয়া এখানে আমাকে একদম বকবা না৷ এখানে তোমরা আমার বড় আর অভি ভাইয়ারা আমাদের আত্মীয়, ঈশাদের আমরা এখানে আত্নীয় সেখানে আমি ওদের কারো থেকেই পাখা নিতে পারি না। আর গোবর ঠাঁসা আমার ছোট সাথে বোন তাই ওর থেকে নিয়েছি। ওর কর্তব্য বড় ভাইকে সম্মান করার। আপ্যায়ন করে নিজে থেকে পাখা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলার, এই নাও ভাইয়া আমার থেকে পাখা নাও তোমার গরম লাগছে। তা না করে ও আমার সাথে কাড়াকাড়ি করল পাখা নিয়ে! এখান উল্টে তুমি আমাকে বকবে না। “
হুয়াট এ্যা লজিক!! এমন লজিকও তৈরি করে ফেলেছে? মানে, মা-রা মা-রি করার জন্য যা তা অবাস্তব লজিক খারা করে দেবে! এটা বোধহয় এই শিশির মালিথার পক্ষেই সম্ভব। অদ্ভুত লজিক দিয়ে কথা বন্ধ করার। ওর এই লজিকে কে আর কি বলবে? কিছুই বলতে পারল না। সবাই শুধু তাকিয়ে রইল। পরক্ষুণে অভি শব্দ করে হেসে দিল। ছেলেটা হাসে খুব। অনেক হাসি খুশি প্রকৃতির মানুষ। অভির হাসিতে মিটমিট করে হাসল সকলে। কুয়াশা ভেঙচি কাটল শিশিরের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টি বলল,
” দেবরজী তোমার লজিক যুক্তিসম্পন্ন। আমরা বিশ্বাস করলাম “
শিশির শুনে বাহাদুরি একটা হাসি দিয়ে বলল,
” থ্যাঙ্কিউ বেবিগার্ল “
শিশিরের পক্ষে নিয়ে যখন বৃষ্টি কথা বলে তখন সে এটা বলেই সম্মোধন করে বৃষ্টিকে। উত্তরে বৃষ্টি বলল,
” মোস্ট ওয়েলকাম কিউট দেবরজী”
সবাই হাসল এদের ভাবি, দেবরের মজা করা দেখে৷ আর কুয়াশা জ্বলে পু’ড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। বিড়বিড়াল,
” আদিক্ষেতা “
শিশির তা বোধহয় টের পেল। সে বৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলল,
” ভাবি..! কিছু একটা পুড়ছে বোধহয়? “
এই বলে সে নাক টানতে লাগল। ভাবটা এমন যেন, গন্ধের উৎস খুঁজছে। দু-একবার নাক টেনে কন্ঠে মৃদু মেকি বিস্মিত ভাব নিয়ে আবার বলল,
” ইয়াকক, এ তো দেখি আস্থ গোবর ঠাঁসাই পু’ড়’ছে! ছিহ! এই জন্য বলি এত দূর্গন্ধ কেন!! ”
সবাই থতমত খেয়ে হা করে তাকিয়ে আছে শিশিরের কথায়৷ আর শিশির কথাটা বলে হাত দিয়ে নাকের উপর বাতাস করতে লাগল। ভাবটা এমন, বাতাস করে দূর্গন্ধ সরাবে। কুয়াশা আবার ক্ষেপে গেল। এতক্ষণ সে চিল মুডে ছিল জিততে পেরে। ফুঁসে উঠে বলল,
” এ্যাই..! এ্যাই বুনো ওল…”
এই পর্যন্ত বলে সে থেমে গেল। বিষয়টা মাথা এলো যে ভুল জায়গা এটা। এখানে অনেক মানুষ সামনে৷ ভড়কে গেল একটু৷ সবার দিকে একবার করে দৃষ্টি দিয়ে তুষার আর তুহিনের দিকে তাকিয়ে ভুল বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে ছোট্ট করে বলল,
” স্যরি “
বলা শেষে আবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” না মানে, কে পু’ড়ছে হ্যাঁ? আমি তোমাকে কখন বললাম আমি পু’ড়ছি? দেখো একদম লাগতে আসবা না “
” মানছিস তাহলে, তুই আস্থ গোবর ঠাঁসা? “
ঠোঁটে যেন বিশ্ব জয় করা হাসি তার।
নিজের কথায় যে নিজেই ফেঁসে গেছে বুঝল কুয়াশা৷ কি বলবে? বুঝে আসল না৷ রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সকলে বেশ এনজয় করছে এদের ঝগড়া। বিনা পয়সায় লাইভ ঝগড়া মা-রা মা-রি দেখতে কার না ভালো লাগে!! সাথে একটু পপকর্ন হলে তো আর কোনো কথায় নেই।
ইয়াসমিন তুহিনের পাশে বসা ছিল৷ তুহিন একটু ঝুকে বলল,
” এগুলো তোমারও রোজ সহ্য করতে হবে। তাই এখন থেকে অভ্যেস করো একটু একটু করে। আর এমন চুপ করে থাকতে হবে নয়তো বিপদ! ফুলে টুলে ঢোল হয়ে ত্যানারা আবার কথা বলবেন না৷”
কথাটা তুহিন আস্তে করেই শুধু ইয়াসমিনের শোনার মতো করেই বলেছে। ইয়াসমিন তা শুনে শব্দ করে হেসে দিল।
অয়ন এবার চেয়ার সহ কুয়াশার কাছে উঠে গেল। পাশে বসে কুয়াশাকে শান্ত করতে খোস-গল্প ধরল। ছেলেটা যে কুয়াশাকে পছন্দ করে সেটা নিঃসন্দেহে যে কেউ দেখলে বুঝবে৷ সবাই এবার টুকটাক গল্পে ব্যস্ত হলো৷
_____
এখানে বড়রা সকলে ঠিক করল তুহিন ইয়াসমিনের বিয়ে কোরবানির ঈদের পর হবে। যেহেতু সামনেই ঈদ৷ তাই ঈদটা বের হলে বিয়ের কাজকর্ম শুরু হবে৷ তারিখ ঠিক হলো জুলাইয়ের ৭ তারিখ৷
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part )