#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৩২
জাফরিনের সমস্ত চিন্তাভাবনা কেবল মাত্র তার বাবার মৃত্যুকে নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। এই মৃত্যুর জট না খুললে নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।বাবার মৃত্যুটা না হলে হয়তো তার জীবনটা অন্য রকম হতো।ঈশানের সাথে একটা সংসার হতো।এই সংসারটা আর তার করা হলো না।মাঝে মধ্যে তার কাঁদতে ইচ্ছে হয়। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু পারে না। বয়স হিসেবে সে এক জন নিতান্তই কম বয়সী একজন মানুষ। তার এই বয়সে বাকী মেয়েরা কি সুন্দর জীবন যাপন করছে। কপালের দোষে হয়তো আজ তাকে এখানে থাকতে হচ্ছে।বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ খুব একটা নেই।
ঈশানকে ভালোবাসতে গিয়ে কখনো বন্ধুদের দিকে তার খেয়াল যায়নি।একজন মানুষ হলেই তো জীবন পার করা যায়।সেই একজন মানুষটা জাফরিনের জীবনে ছিল ঈশান।বন্ধু, প্রেমিক কিংবা ভালোবাসা।মাঝেমধ্যে অবচেতন মনে তার ইচ্ছে হয় ঈশানের সাথে কথা বলতে।বেখেয়ালি মন চায় তাকে কল দিতে।কিন্তু শেষ অবধি জাফরিন পারে না।তার চোখের সামনে ভেসে উঠে আশার মুখটা।
যে মুখটা মায়ায় ভরা।আশাকে জাফরিন খুব ভালোবাসে।ছোটো বেলায় খেলতে গিয়ে যখন জাফরিনের খেলাপাতির জিনিস ভেঙ্গে ফেলতো তখন ভীষণ অভিমান হতো কিন্তু কিছু বলতো না সে।কারণ জাফরিনের বিশ্বাস ছিল তার বাবা তার জন্য আরো একটা খেলনার সংসার এনে দিবে।প্রতিবার এমনি হতো।জাফরিনের জন্য কেনা খেলনা আশার পছন্দ হতো।ইনিয়েবিনিয়ে তাকে সেই খেলনা দিয়ে দিতে হতো আশাকে। পরবর্তীতে তার থেকেও অধিক সুন্দর খেলনা এনে দিতো জাফরিনের বাবা। বিদেশ থেকেই সে কীভাবে কীভাবে যেন বুঝে যেত জাফরিনের পছন্দ কিংবা ভালো মন্দ। লোক মারফত সেসব পৌঁছে যেত আদরের মেয়ের কাছে।
পায়চারি করতে করতে এসব ভাবছিল জাফরিন।তার হুট করেই মনে হলো
আশাকে খেলনার সংসার দিয়ে দিতাম বলেই কী আশা তার এ জীবনে চাওয়া বাস্তবতার সংসারটাও কেড়ে নিলো?বাবা তো নেই।আমায় কে এনে দিবে পুনরায় সেই সুখ?আচ্ছা বাবা কী বুঝেছিল তার মেয়েটা সুখী হবে না?সে কি লুকিয়ে রেখে গেছে আমার জন্য এক ফালি চাঁদ কোনো এক অন্ধকার আকাশে।যে আকাশের সন্ধান এখনো আমি পাইনি।
কট করে দরজা খোলার শব্দ হলো।ড্রেসিং করার জন্য সেবিকা এসেছে।জাফরিনের হাত ড্রেসিং হয়ে গেলে সে জিজ্ঞেস করল,
“এখন আমি ছুটি পাবো?মানে রিলিজ কবে নাগাদ?”
“ম্যাম আপনার নিরাপত্তা জন্যই এখানে রাখা।পোড়া ক্ষতে ইনফেকশন দ্রুত হয় বলেই আপনাকে থাকতে হবে কিছু দিন।”
“কত দিন লাগবে?”
“সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে।”
আবারো আনমনা হয়ে গেল জাফরিন।হিসেব মতে সে আজ পাঁচ দিন যাবত হাসপাতালে।কেবল একটা মাত্র দিন সে ক্লাস করেছিল।নিশ্চয়ই পড়া থেকেও পিছিয়ে যাবে সে।এখানে তার বাবার নামে যা কিছু আছে তা দিয়ে মাসিক একটা খরচ এসে যায় তার।কোম্পানি থেকেও পে করবে তার লেখাপড়ার খরচ কিন্তু লেখাপড়া টা তো হতে হবে।বাবার জন্য হলেও তাকে লেখাপড়া করতে হবে।
মন খারাপের দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।সেই সময় কেবিনে প্রবেশ করলো এমিলি।তাকে রুমে প্রবেশ করার পূর্বে তিন দফা সিকিউরিটির থেকে সম্মতি পেতে হয়েছে। সে বলেছিল তাকে মাশহুদ আসতে বলেছে। কিন্তু কোনো কথা শোনা হয়নি।তার ব্যাগ টাও প্রথমেই রেখে দেওয়া হয়েছে। জাফরিনের জন্য নিয়ে আসা জিনিসপত্র গুলোও তারা রেখে দিয়েছে। এসব দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠেছে এমিলির মুখে।জাফরিন নিশ্চয়ই কোনো ভি আই পি নয়,কিন্তু মাশহুদ তাকে রাজকন্যার মতো কেন ট্রিট করছে সে বুঝতে পারে না।অবশ্যই মাশহুদ তাকে ভালোবাসে।সেই ভালোবাসার ছিটেফোঁটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সে।কিন্তু কত দিন?এমিলি জানে মাশহুদের শত্রুকে। না তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই কিন্তু এটাও ঠিক যে মাশহুদের ক্ষতি হতে দেখলে সে চুপ থাকবে না।তবে জাফরিনকে বাঁচানোর বা শেল্টার দেওয়ার কোনো প্রয়োজন সে অনুভব করেনি।
এমিলিকে দেখে জাফরিনের চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ল।তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলল,
“একমাত্র আপনিই আছেন যার সাথে আমি কথা বলতে পারবো।”
“কেন?আর কেউ কথা বলেনি?অবশ্য তুমি কী জানো এই ফ্লোরে কেবল রোগী হিসেবে রাখা হয়েছে? তাই হয়তো কারোর সাথে কথা হয়ে উঠেনি।”
“একা মানে?”
“হ্যাঁ। এই ফ্লোরে তুমি একাই আছো।আর কেউ নেই।তোমার উপর এট্যাক হওয়ার পর স্যার তোমার নিরাপত্তার জন্যই তো এসব করলেন।”
“বাহ,তবে এতো নিরাপত্তার কারণ?”
“তোমাকে এখানে কেন নিয়ে আসা হয়েছে তুমি জানো?”
” না।”
“জানো।এতোটা বোকা মেয়ে তুমি নও জাফরিন।তুমি ভাবছো তুমি নিজ থেকে এখানে এসেছো।অথচ তুমি নিজেই জানো না তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তোমার বাবার সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক সেটা এই কোম্পানি কিছু সংখ্যক মানুষ বেশ ভালো জানে।জাফরানি রঙের জাফরিন নামের মেয়েটার কথা তার বাবা সব জায়গায় ব্যবহার করতেন।এই কোম্পানির ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ তোমার বাবার হাতে ছিল।বলতে পারো পুরো বিজনেস হয় ডুববে না হয় বাঁঁচবে।সেটাই তোমার বাবা সামলানোর দায়িত্ব পালন করছিল কিন্তু তার হঠাৎ মৃত্যু ধোঁয়াশা তৈরী করেছে।যারা এসব জানতেন তাদের ধারণা তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এসবের সমাধান করতে পারবে।তাই তুমি এতোটা প্রয়োজনীয়।আবার এটা ভেবে বসো না যে তোমার প্রেমে পড়ে স্যার তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।বা এমন রাজকন্যার মতোন ব্যবহার করছে।”
এমিলির দিকে স্মিত হেসে তাকিয়ে রইল জাফরিন।তার কথাতে ক্ষোভে বৃষ্টি হচ্ছে।সে দিব্যি বুঝতে পারলো এই সুদর্শনা রমনী মাশহুদকে ভালোবাসে।তার ভীষণ করে বলতে ইচ্ছে করলো।শোনো বোন আমি তোমার ভালোবাসাকে ভালোবাসি না।এক জীবনে ঈশান নামের গল্পটাই না হয় আমার থাকুক।কাউকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে পরবর্তীতে কী কাউকে ভালোবাসা যায়?
কিন্তু জাফরিন বলল না।কেন যেন তার এই ক্ষোভটা ভীষণ পছন্দ হলো।এবং সে বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো মাশহুদের মুখোমুখি হওয়ার।পাঁচটা দিন হয়ে গেল অথচ আজ অবধি একটা বাক্য বিনিময় হয়নি তাদের। কিন্তু কেন?
চলবে….