বিয়ের দুমাসের মাথায় শাশুড়িকে হারালাম। না, তার মৃত্যু তে আমি কষ্ট পাই নি কারণ তার সাথে আমার কখনো সখ্যতা গড়েই ওঠে নি। সত্যি বলতে কি নিজেকে কেমন যেন মুক্ত পাখির মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিলো এই গোটা সংসার টা এখন আমার, হুকুম করার কেও নেই। শশুর অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন, আর ননদ স্বামী সহ আমেরিকা প্রবাসী। অতএব সব কিছুই এখন আমার নিয়মে চলবে। সুমন মানে আমার স্বামী কে সান্ত্বনা দিলেও আমার কিন্তু কান্না পেল না। পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়েছিল তাই সুমনকে জানার খুব বেশি সু্যোগ বিয়ের আগে হয় নি, এমনকি বিয়ের পরেও তেমন একটা কাছে পেতাম না, সুমন অফিস থেকে ফিরেই মায়ের ঘরে, কারন মা অসুস্থ ছিলেন। ফোনেও মায়ের খোঁজ খবর বেশি আমার কম, রাগ উঠতো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফোন ধরতাম না। একই কথা বলবে জানি মায়ের ওষুধ, খাবার, ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট এই সব হাবিজাবি। আমিই বোধ হয় আমার বন্ধু মহলের একমাত্র ব্যাক্তি যে হানিমুনে যাই নি কারন কি, ননদের অবর্তমানে সুমন এখানে একা আর মা অসুস্থ। বলতে গেলে শাশুড়ির মৃত্যু তে আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আস্তে ধীরে সংসার গুছিয়ে নিলাম নিজের মতো। আগের কাজের মহিলা কে বিদায় করলাম। সবকিছুতেই বলে ওঠে,
“ও বৌমা তোমার শাশুড়ি এটা এভাবে করতেন সেটা সেভাবে করতেন” বিরক্ত লাগে। আবার আমাকে তুমি করে সম্বোধন করে, কত বড় সাহস! আমি এখন এই বাড়ির কর্ত্রী, আমাকে বোঝাতে আসে, দিয়েছি বিদায় করে। মাকে বলে নানুবাড়ি থেকে একটা কাজের মেয়ে নাম ফাতেমা ওকে আনিয়ে নিয়েছি, আমি যা বলি তাই সে করে।
আস্তে ধীরে সময় বয়ে চললো। বছর দুয়েক পরে আমি আমার মধ্যে একটা প্রাণের স্পন্দন টের পেলাম। কিন্তু সেই সাথে শুরু হলো প্রচন্ড রকম বমি, শারীরিক দুর্বলতা আর মেজাজটাও কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেল। সুমন আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়লো আমি প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার আমাকে কিছু ওষুধ দিলেন, সাথে বললেন এই সময়ে এরকম ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না, আমি যেন বিশ্রামে থাকি, কোন টেনশন না করি। সুমনকে বলে দিলেন ভালো করে আমার যত্ন করতে, খেয়াল রাখতে। সুমন এমনিতেই আমার কথার বাইরে যায় না, তাকে আমি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখি, রিমোট দেয়া ব্যাটারির মতো। তারপরও সারাদিন অফিস করে এসে আমার যত্ন নেওয়াটা ওর জন্য একটু বাড়তি প্রেসার হয়ে যায় বুঝতে পারছি। মা শেষ পর্যন্ত বললেন এ সময় বাড়িতে কোন মুরুব্বী না থাকলে খুব সমস্যা হয়ে যায় । আজকে আমার শাশুড়ি থাকলে কোন সমস্যা হতো না তাই সুমনের যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আমি আমার বাবার বাড়িতে থাকতে পারি, মায়ের কাছে মেয়ের যত্নের কোন অভাব হয় না। সুমন আমার স্বাস্থ্যের কথা আর বাচ্চার কথা চিন্তা করে রাজি হলো কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো ও যেন মুক্তির স্বাদ পেল। তারপরেও সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে বাবার বাড়িতে এলাম সাথে সুমনও এলো। আমার গর্ভের ভ্রূণটা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। সুমন প্রায় প্রতি সপ্তাহে এখানে এসে এক দুই দিন থাকে,এখান থেকে ওর অফিস অনেক দূর হয়ে যায়, তারপরেও আমি বলে দিয়েছি থাকতে হবে যতই অসুবিধা হোক।
মাত্র তেত্রিশ সপ্তাহে আমার প্রসব ব্যথা উঠলো। সুমন তখন অফিসের কাজে গেছে বান্দরবান। সেখান থেকে কোনোভাবেই তার আসা সম্ভব না। বাবা মা ভাই ভাবী সবাই মিলে আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। অবশেষে রাত দুটোর সময় আমার কোল আলো করে একটা পুত্র সন্তান এলো কিন্তু বাচ্চার ওজন অনেক কম তাই বাচ্চাকে কাঁচ ঘেরা একটি ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চার সাথে রাখা হলো। আমার মন তখন বিধ্বস্ত, সুমনকে বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম, ও রিসিভ করতে পারেনি। সুমন ফিরে এলো আরো চার দিন পর । ততদিনে আল্লাহর রহমতে আমার ছেলেটির আশংকা মুক্ত।
আবার বাবার বাড়ি ফিরে এলাম। এখন আর সুমন প্রতি সপ্তাহে আসে না। প্রথমতো অফিস বেশ দূরে আর তাছাড়াও ছেলেটি রাতে একেবারেই ঠিকঠাক ঘুমোতে দেয় না, এসব বাহানা তো আমার সাথে চলবে না তাই সপ্তাহ দুয়েক পর আমি নিজের সংসারে ফিরে গেলাম। গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। এ কি অবস্থা! এটা যে আমার বাড়ি চিনতেই অসুবিধা হচ্ছিলো। আমার অবর্তমানে ঐ কাজের মেয়ে টা যেভাবে খুশি ফাঁকিবাজি করে গেছে। সুমন তো পুরুষ মানুষ, ও আর এসবের কি বুঝবে? ইচ্ছে করছিল ঠাস করে ফাতেমার গালে দুইটা চড় লাগিয়ে দেই । নিজেকে কোন ভাবে সংবরণ করলাম। আমি না থাকাতে ফাতেমার যেন পাখা গজিয়েছে সবকিছুই দেখছি নিজের মতো করে করছে।
সুমন ফিরতেই অভিযোগের স্বরে বললাম,
-তুমি কি কিছুই দেখোনা? ঘর দুয়ার এরকম এলোমেলো অবস্থা নাকি আমরা ফাতেমাকে বেতন দেই না
-আরে তুমি সব বিষয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করো তুমি ছিলে না তাই হয়তো কাজে একটু ফাঁকি দিয়েছে বয়স কম বাচ্চা একটা মেয়ে এত কিছু কি বুঝে নাকি এখন তুমি এসেছো, সবকিছু বুঝিয়ে দাও তাহলেই তো হয়ে যায়।
-বয়স কম, বয়স কম বলো না ওর বয়স ১৬/১৭ হবে। এই বয়সে গ্রামের মেয়েদের বিয়ে, এমনকি বাচ্চাও হয়ে যায়।
-এখন এই রাতের বেলা ওকে নিয়ে আমাদের ঝগড়া করতে হবে ! এমনিতেই তোমার ছেলে আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। সুমন গলা উঁচু করে বললো
-আমার ছেলে মানে আমার একার ছেলে নাকি?
-আরে আশ্চর্য সব কথায় ভুল ধরো কেন? আমি পাশের রুমে যাচ্ছি ঘুমানোর জন্য । আমাকে ঘুমাতে হবে, কালকে একটা প্রেজেন্টেশন আছে, অফিসের প্রচুর প্রেসার । অবশ্য তুমি বুঝবে কি করে সারাদিন তো ঘরেই বসে থাকো। সুমন কখনোই আমার সাথে এভাবে কথা বলে না।
-আমি ঘরে বসে থাকি তাহলে তোমার সংসারটা চালায় কে? মেজাজ হারালাম
-কয়টা কাজ করো তুমি? সব কাজ তো ফাতেমাই করে। তুমি তো সারাদিন পায়ের উপর পা তুলে বসেই থাকো আর টিভি সিরিয়াল দেখো আর কোন কথা বলবেনা যদি আমি মিথ্যা কথা বলে থাকি তবেই কথা বলবে
আমি চুপ করে থাকলাম কারণ আমি সত্যিই শুধুমাত্র ফাতেমাকে কাজগুলো কিভাবে করতে হবে তা বুঝিয়ে দেই এমনকি রান্না বান্নাও।
সুমন আস্তে ধীরে কেমন যেন দূরে চলে যাচ্ছে। ছেলে হবার পর তার বিছানা আলাদা হয়েছে।আমার সংসারটাও যেন আমার নেই। ফাতেমা মাঝেমাঝে জিজ্ঞেস করে,
– আপা কি রান্না করবো?
আমি ভাবলেসহীনভাবে বলি,
– তোর যা ইচ্ছা কর । ছেলের কান্নাও বিরক্ত লাগে।
এক রাতে চমকে উঠলাম । পানি খেতে ডাইনিং রুমে গিয়েছিলাম ।সুমনের রুমে লাইট জ্বালানো দেখলাম, টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। ভেতর থেকে ফিসফিস শব্দ শুনতে পাচ্ছি, কথাগুলো স্পষ্ট না। আমার মাথায় কি যেন কি বুদ্ধি খেলে গেল, আমি দ্রুত ফাতেমার বিছানার দিকে গেলাম সেখানে ফাতেমা নেই । ডাইনিং রুমে চুপচাপ বসে থাকলাম অন্ধকারে ।ঘন্টা খানেক পর ফাতেমা অগোছালো পোশাকে এলোমেলো চুলে বের হয়ে আসলো আমি সঙ্গে সঙ্গে বাতি জ্বালালাম। মেয়েটা পুরোপুরি ভড়কে গেছে , সুমন নিজেও বের হয়ে এসেছে। ঘেন্নায় আমার গলার কাছে এক দলা থুথু উঠে আসছে, শেষ পর্যন্ত একটা কাজের মেয়ের সাথে! আমি সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফোন করলাম। ভোরের আলো ফোটার আগেই সবাই এসে উপস্থিত হলো।
-আমার বাড়িতে এইসব নিয়ে আর কোন কথা হবে না। কেউ কিছু বলার আগেই সুমন স্পষ্ট গলায় বললো। আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন , আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো
সবাই প্রায় চমকে উঠলাম । যেখানে আমরা তাকে কথা শোনাবো সে উল্টো কথা বলে চলেছে
-তুমি এরকম কথা কেন বলছো সুমন? আমার মা বলে উঠলেন
-শুনুন না আপনার মেয়েকে আমার আর এখন ভালো লাগে না, আমি তার হুকুমের গোলাম নই। সারাক্ষণ সে আমাকে শুধুমাত্র কন্ট্রোল করার চেষ্টায় থাকে, আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছে আর তাছাড়া যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে এরপরে তার সাথে আমার সংসার যদি টিকেও থাকে সেটা কখনোই সুখের সংসার হবে না হ্যাঁ আমি মানছি ভুল করেছি কিন্তু ওর সাথে সংসার আমি আর করবো না।
-তুমি কি তবে ওই কাজের মেয়েটাকে বিয়ে করে সংসার পাতবে ?আমি এবার বেশ রাগী গলায় বলে উঠলাম
-সেটা দেখা তোমার দায়িত্ব না। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে মোহরানা পরিশোধ করে দিবো, ছেলের খরচ দিবো, কথা শেষ আর যদি চাও ছেলেকে রেখে যেতে পারো কোন সমস্যা নেই আমার। সুমন একপ্রকার জোর করে আমাদেরকে বের করে দিলো।
আমি কেস করলাম কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না কারন সুমন নিজেই তো মোহরানা দেয়ার জন্য প্রস্তুত এমনকি ছেলের দায়িত্ব নিতেও প্রস্তুত, কোন শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও নেই , কাজের মেয়ের সাথে সম্পর্কের কোন প্রমাণ আমার কাছে নেই তাহলে কোর্ট কি করবে? বুক ঠেলে কান্না আসছিল। যে সংসার এত কষ্ট করে তিল তিল করে সাজালাম সেটা ভেঙে গেলো একটা কাজের মেয়ের জন্য আমার ভাবতেই কেমন ঘেন্না লাগছে, নাকি আমার নিজের জন্য আজকাল কেমন যেন কনফিউজড হয়ে যাই। আমার অতিরিক্ত শৃংখল বেঁধে দেয়াটাই কি আসল কারণ ছিল? জানি না, জানি না কিছুই আমি।
আজকাল আর রাতে ঘুম হয় না। রাত প্রায় দুটো বাজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, ভাবী গেছে তার বাবার বাড়িতে উনি নাকি অসুস্থ। উচ্চ স্বরের কথা শুনে এই রাত দুটোর সময় আমি একটু চমকেই গেলাম।
-তোর মত কুলাঙ্গার ছেলের আমার দরকার নেই। কথাগুলো আমার মা বলছে আমার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। ঘরে এত সুন্দর লক্ষ্মী একটা বউ রেখে তুই বাইরে ঘুরে বেড়াস অন্য মেয়ের সাথে! তোর বাবা নিজে দেখেছে আর একবার যদি দেখি সত্যি কথা বলছি থানা পুলিশ কিছু লাগবেনা আমি নিজে থেকে বিষ খাইয়ে তোকে মেরে ফেলবো। বউয়ের বাচ্চা হয় না তো কি হয়েছে ,তোকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে ?তোর নিজের যদি সমস্যা থাকতো তাহলে কি করতি, বৌকে আরেকটা বিয়ে দিতি? অসভ্য বর্বর ছেলে, তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি
-সরি মা আর কখনো এরকম হবে না, আমার ভুল হয়ে গেছে আর কোনদিন হবে না সত্যি বলছি, পায়ে পড়ি তোমার মাফ করে দাও। ভাইয়া মাথা নিচু করে বলে চললো
আমি খোলা আকাশের দিকে তাকালাম সেখানে একঝাঁক তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে । পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়া আমার শাশুড়ির কথা খুব মনে পড়লো আজ যদি উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমাকে এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হতো না। হ্যাঁ অবশ্যই সুমন দোষী, একই দোষে দোষী আমার ভাই নিজেও কিন্তু আমার ভাই ভাবীর সংসারটা ভাঙবে না ভাবী কিছু জানার আগেই মা সেটা সংশোধন করে দিয়েছেন বটবৃক্ষ হয়ে। হয়তো সুমনের বেলাতেও আমার শাশুড়ি মা ঠিক একই কাজটাই করতেন, আমাকেও হয়তো বোঝাতেন কিভাবে সংসার গোছাতে হয়। জানি সব ছেলে এক হয় না, কেউ কেউ তো হয় সুমন আর আমার ভাইয়ের মতো, এজন্যই মাথার উপর একটা ছায়া থাকা খুব জরুরী, যেটা আমি হারিয়েছি পাঁচ বছর আগেই। বুকের ভেতর থেকে কেমন একটা আফসোস আর হাহাকার মেশানো অনুভূতি বের হয়ে এলো।
Kobitor কবিতর