#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“জানেন আমি ওর জন্য যাই করি, তাতেই কম পড়ে এমনকি যদি নিজের কলিজাটাও কেটে রান্না করে দেই তাইলেও বলবে তরকারিতে লবন কম পড়েছে।” ভদ্রমহিলা পঞ্চাশোর্ধ। দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিক। জীবন দুহাত ভরে তাকে দিয়েছে। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে মনে হলো অর্থ,বিত্ত, চিত্তর মেলবন্ধন ঘটেছে তার শিক্ষা, সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তায়। অথচ জীবনসঙ্গী কখনোই ওনাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। ভদ্রলোক কিন্তু মোটেও ফেলনা নন। পোস্ট ডক্টরেটের ঝুলি কাঁধে নিয়ে বিশাল এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফল কর্ণধার।
“প্রত্যেকটা ছোট ছোট ব্যাপারে খুঁত ধরবে, সব সময় বলবে সে যা ভাবছে সেটাই ঠিক, আমি নাকি কখনোই তার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারি নাই।”
আমি বললাম, ” আপনার সাথে কি এমন কোন দুর্ঘটনা ঘটেছিল যার ফলে আপনার জীবনসঙ্গী মনে করছেন, আপনি তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারছেন না?”
ভদ্রমহিলা দৃঢ় কন্ঠে, ” কখনোই এমন কিছু ঘটেনি,আমাদের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক কোন পদস্খলন নেই। সে সব সময় আমি, আমি, আমি, করে নিজেকে নিয়ে মত্ত। তালগাছটা সব সময় তার। জীবনসঙ্গী হিসেবে আমারও যে কিছু সম্পর্কের সাথে মানানসই চাহিদা থাকতে পারে সেটা তার ডিকশনারিতেই কখনো ছিল না, এখনো নাই।”
আমি, “ওনার এই আচরণকে শুধু আপনার সাথে করে নাকি অন্যদের সাথেও করে?”
ভদ্রমহিলা, ” সবার সাথে করে, নিজের সন্তান, এমনকি নিজের বাবা মার সাথেও। আমার শাশুড়িকে হাসপাতলে আমাকে নিয়ে যেতে হয়। ওনার ডায়ালাইসিস চলছে। যার মা তার কোন খবর নেই। আবার কেউ যদি আমার খুব প্রশংসা করে তাহলে কিন্তু সে খুব জেলাস ফিল করে। প্রয়োজনে কথার সাথে সস মাখিয়ে আমি যে তাকে অদৃশ্যভাবে কতটা মেন্টাল টর্চার করি সেটাই ইনিয়ে বিনিময়ে বলে। অন্যদের সামনে ম্যানিপুলেটিভ ভাবে দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসে, বাইরের মানুষ মনে করে আহারে বেচারা কত কষ্টে আছে।”
আমি, “আপনি কখনো তাকে জিজ্ঞেস করেন নাই কেন এমন করছে?”
ভদ্রমহিলা, ” বার বার করেছি এবং প্রতিবারই সে উত্তর দিয়েছে সব তোমার দোষ, তুমি এই করো দেখেই তো আমি সেই করি। তাকে সব সময় আসরের মধ্যমণি করে অ্যাটেনশন দিতে হবে। তাকে সব সময় প্রশংসা করতে হবে, আমি যদি প্রশংসা না করি তাহলেই মুখ গোমড়া হয়ে যায়। কাহাতক তেলবাজি করা যায়?”
আমি, “তারমানে খুব ছোট ছোট প্রশংসাগুলিও উনি আপনার থেকে উনি ভীষণভাবে চান। এটা কি শুধু আপনার থেকেই চান নাকি সবার থেকেই চান?”
ভদ্রমহিলা, ” সবার থেকেই, এমন কি অফিসে যদি কেউ কাজের ভুল ধরিয়ে দেয় সেটাও সে সহ্য করতে পারে না। মোটকথা কেউ তার ভুল ধরতে পারবেনা। সে সব কিছুতে ঠিক। অন্যরা ভুল করতে পারে, কিন্তু সে পারে না। সব সময় একটাই কথা বলে, I am the best.”
আমি,” ভুল ধরলে উনি কি বলেন?”
ভদ্রমহিলা,” খুব সহজে হয় দুঃখ পায় না হলে রেগে যায়। বলে তোমরা কেউ আমাকে বুঝতে পারো না।”
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রলোকের নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ছোটবেলা থেকে তাঁর বেড়ে ওঠার পদ্ধতি, জেনেটিক অথবা তার মস্তিষ্কের নিউরো বায়োলজি। গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষরাই এর বেশি ভুক্তভোগী।
নার্সিসিস্টরা ধরেই নেয় বেস্টটাই তার প্রাপ্য। কোনভাবে যদি কেউ সেটা তাকে না দেয় তাহলেই দ্বন্দ্বের শুরু। কিন্তু প্রত্যেকটা সম্পর্ককে যে লালন করতে হয়, ধারণ করতে হয়, ছোট চারা গাছের মত যত্ন করতে হয়, এই শাশ্বত জিনিসটা এদের মাথায় থাকে না। এরা খালি নিতেই জানে সম্পর্ক থেকে। সম্পর্ককে কিছু দিতে জানে না। তাই অন্যকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, অন্যকে অসম্মান করা, অন্যের ব্যাপারে ঈর্ষা বোধ করা এদের সহজাত আচরণ।
নিজেকে মনে করে এরা পৃথিবীর কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত অতি বুদ্ধিমান, বাকিরা কেউ কিছুই না।
এরা এত গিরগিটির মতো রং পাল্টায় যে এদের স্বরূপ ধরতে পারাটাও বাইরের মানুষের জন্য খুবই কঠিন।
ভদ্র মহিলাকে দেখে আমার মনে হল জীবনানন্দের এই লাইনগুলো,
“নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে;
অথচ নগরী মৃত।
সে-সিঁড়ির আশ্চর্য নির্জন
দিগন্তরে এক মহীয়সী,
আর তার শিশু;
তবু কেউ নেই।”
আমার চেম্বারে আসলে ভদ্রমহিলার নয় ভদ্রলোকের আসার প্রয়োজন ছিল। এসব ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি খুব ভালো কাজ করে, কিন্তু সেখানে একটা তবে আছে। সাইকোথেরাপি চমৎকার কাজ করবে তখনই যখন ভদ্রলোক নিজেই নিজের চিকিৎসা নিতে চাইবেন। অন্যথায় তাকে বুঝিয়ে কাউন্সেলিং করে কোন লাভ হবে না। মুশকিল হলো, এ ধরণের মানুষরা কখনোই চিকিৎসার ভেতর সহজে আসতে চান না। কারণ তারা অন্যের থেকে নিজের লাভটা ষোলআনা আদায় করে নিতে জানেন। তাতে অন্যজন বাঁচল কি মরল, সেটা খুব বেশি খেয়াল করার প্রয়োজন বোধ করেন না।
এই আপাত দৃষ্টিতে হাইলি ব্র্যান্ডেড সাকসেসফুল বিয়েটাই ভদ্রমহিলার জীবনে কাল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ” বিয়ে করলে মানুষকে মেনে নিতে হয়, তখন আর গড়ে নেবার ফাঁক পাওয়া যায় না।” অথচ ভদ্রলোক প্রতিমুহূর্তে ভদ্রমহিলাকেই ব্লেইম গেম দিচ্ছেন যে, ভদ্রমহিলা দোষী, সমস্ত অশান্তির মূল। ভদ্রলোক নিজে কোনদিনই এত দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের সরি বলেননি।
“we can’t change others we can only change ourselves. ” এটা হল কাউন্সিলিং টেবিলের মূলমন্ত্র। কাজেই ভদ্রমহিলার কাউন্সেলিং এ লাভ নেই কথাটাও কিন্তু প্রযোজ্য নয়। ভদ্রমহিলা কি ভাবে এই অবহেলার কারণে সৃষ্ট নিজের feeling of Rejection এর কষ্ট থেকে selfcare নিশ্চিত করতে একটা বাউন্ডারি তৈরি করতে পারেন সেটা বুঝতেও কাউন্সেলিং সাহায্য করবে। কিন্তু ভদ্রলোকের দরকার সাইকোথেরাপি। তবে সেটা স্বেচ্ছায় আসতে হবে।
আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, মানুষ মাত্রই independent নয়, বরং একজন মানুষ, শুধু অন্য একজন মানুষই নয় বরং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং প্রকৃতির সাথে interdependent, অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই আমি ভালো থাকলে আমার চারপাশের মানুষ, প্রাণী, প্রকৃতি সবাই ভালো থাকবে। এজন্যই self-careটা খুব জরুরী।
যারা অন্যদের প্রতি সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন যেকোনো জাজমেন্টাল মতামত ছাড়াই, তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার।