#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
‘Nobody deserves your tears, but whoever deserves them will not make you cry’.
Gabriel Garcia Marquez
” আমার স্ত্রী কোনদিন আমাকে বুঝতে পারেনি !” ভদ্রলোকের বয়স অর্ধশতকের আশেপাশে; অধ্যাপনায় নিযুক্ত। ছাত্র, পাঠক এবং বন্ধুমহলে সুপরিচিত। দেশে-বিদেশ পেপার প্রেজেন্ট করতে প্রায়শই আমন্ত্রিত হন। দাম্পত্যের ফাটল এমনই জায়গায় পৌঁছেছে পেশাগত কাউন্সেলিং এর শরনাপন্ন হতে হয়েছে। অনলাইন সেশন। ভদ্রলোক ক্যামেরা খুলতে চাননি। কেউ না চাইলে চাপাচাপি করা আমার পেশাগত স্বভাব বিরুদ্ধ। স্ত্রী তীক্ষ্ণ সুন্দরী, মেধাবী এবং শিক্ষিত মহলে সুপরিচিতা। তাঁর সম্মতিতেই কাউন্সেলিং এ আসা।
আমি, ” এককথায় আপনার স্ত্রীর সাথে প্রধান সমস্যাটা কি?”
ভদ্রলোক, ” ও আমাকে বুঝাতে চায় না।”
আমি, ” বুঝতে চায় না বলতে আপনি কি বোঝেন?”
ভদ্রলোক, ” আমার কষ্টটা বুঝবে, আমার আনন্দটা বুঝবে, সমস্যাটা বুঝবে, সুবিধা – অসুবিধার খেয়াল রাখবে… এই তো একটা সাধারন মানুষ যা চায়।”
আমি, ” আপনার কি ধারণা প্রত্যেকটা সাধারণ মানুষের চাওয়া একই রকম?”
ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ কন্ঠে, ” সুস্থ সাধারন মানুষদের চাওয়া পাওয়া তো একই রকম।”
আমি, ” মোটেই না, আমাদের বেসিক ফিলিং চারটা, আনন্দ, দুঃখ, ভয় এবং রাগ। এই একেক অনুভূতিগুলো প্রত্যেকটা মানুষের মনে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার জন্ম দেয় এবং এই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাগুলি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন আচরণ দিয়ে প্রকাশ করে। ”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভারী গলায় বললেন, “বুঝিয়ে বলুন।”
আমি বললাম, ” আনন্দ বলতে আপনার কি মনে হয়?”
ভদ্রলোক বললেন, ” চমৎকার একটা গান শোনা।”
আমি বললাম, ” আমার কাছে আনন্দ মানে ‘কনে দেখা আলো’টা আমার গালে স্পর্শ করা। এটা যদি আমি না বলতাম আপনি কি জানতেন? বা আপনারটা যদি আমি না শুনতাম তাহলে কি আমি জানতাম? “
ভদ্রলোক ছোট্ট করে বললেন, ” না ।”
আমি, ” আপনি কখনো কি আপনার স্ত্রীকে বলেছেন, কিসে আপনার আনন্দ হয়, কি হলে আপনি ভয় পান, কেন আপনার রাগ উঠে অথবা কোন জিনিসটা আপনাকে দুঃখ দেয়?”
ভদ্রলোক চুপ করে থাকলেন। ক্যামেরার স্ক্রীন যেহেতু অফ আমি ভদ্রলোকের চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। শুধু ওনার পাখার ঘর ঘরে আওয়াজ ইথারে ভেসে আসছে।
কিছুক্ষন পরে আমি বললাম, ” নিজেরটা যেমন কোনদিন বলেননি বুঝতে পারছি, তেমনি কোনদিন ওনারটা কি শুনতে চেয়েছেন? “
ভদ্রলোক চুপ করে থাকলেন।
আমি বললাম, একটু কি ভেবে দেখা যায় যে, ” আপনার ডিকশনারির বুঝতে না পারার, অর্থ কি স্ত্রী আমি কি চাই আমার সেই মনের কথাটা আমি মুখ ফুটে না বললেও বুঝতে না পারাটাই মিন করে যে তিনি আমাকে কোনদিনও বুঝতে পারেননা?”
ভদ্রলোক নিশ্চুপ। আমার পোষা বিড়ালটি ম্যাও ম্যাও বলে প্রচন্ড উৎপাত জুড়েছে। এই বাদে বিশ্বচরাচরে আরেকটি ও শব্দ নেই। লকডাউনের জন্য রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় না।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” উনি সবাইকে ছেড়ে আপনার সাথে থাকতে এসেছেন ওনার দুঃখ, রাগ, ভয়ের গল্পগুলি ততটুকু কি জানেন যতটা ওনার শরীরের অলিগলি চেনেন? আমাকে মাপ করবেন যদি আমি সীমারেখা অতিক্রম করি, বা আপনাকে বিব্রত করতে এই প্রশ্ন নয়, শুধু একটু ভাবুনতো কোন দিন কি ওনার কাছে শুনতে চেয়েছেন? “
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আর দশটা ছেলের মতই ভদ্রলোক ছোটবেলা থেকে ভয় পেতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক ধারনায়। রাত্রে বাথরুমে যেতে ভয় পেলে তাকে বলা হয়েছে, ” ভয় পাচ্ছ কেন তুমি না ছেলে?” অথবা খেলার মাঠে পড়ে গেলে তাকে বলা হয়েছে’ “কাঁদছো কেন তুমি না ছেলে?”
এই করতে করতে ভদ্রলোকের ভেতরের ছোট্ট শিশুটি ছোটবেলা থেকেই তার নিজস্ব বিবেচনাবোধের উপর সিল মোহর এঁটে দিয়েছেন। বড় হয়ে ওঠার ক্রমবিন্যাসের ধাপগুলোতে তাঁর ভাবনার জায়গাটাতে বিশাল বড় করে একটা কাটা চিহ্ন পড়েছে, ‘ভাবা যাবে না’ এই নিষেধাজ্ঞার। একে আমরা ‘DON’T THINK’ INJUNCTION বলি মনস্ততের ভাষায় । সাথে যুক্ত হয়েছে ‘DON’T FEEL’, ‘DON’T BE YOU’; এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তার মা। কারণ ছেলের কি লাগবে মুখ খোলার আগেই মা রেডী করে রাখেন অতিরিক্ত স্নেহের আতিশ্যযে । ছেলেকে কোনদিন মুখ ফুটে চাইতে হয়নি যে তাঁর ক্ষিদে লেগেছে কিম্বা জিনিস পছন্দ হয়েছে। মা সম্ভাব্য সব থরে বিথরে সাজিয়ে রেখেছেন। কেবল ছেলের তুলে নেবার অপেক্ষায়। এখন বউ কিভাবে বুঝবে এই কথা? বউতো আর জামাইকে পেলে পুষে বড় করেন নাই। তার উপর উভয়ের বয়সের পার্থক্যজনিত ইমম্যাচিউরীটি আছে।
‘Nobody is a villain in their own story. We’re all the heroes of our own stories.’ George R. R. Martin
আমি ভদ্রলোককে বললাম, ” আপনি সহজে না বলতে পারেন না তাই না?”
ভদ্রলোক খুব অবাক হয়ে বললেন, ” আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
আমি, ” আপনার ছোটবেলা থেকে কখনো তো কাউকে ‘না বলতে’ হয়নি বা ‘না শুনতে’ হয় নাই তাই না?”
স্ক্রিনের ওইপাশে নীরবতা। বুঝলাম ভদ্রলোক ভাবছেন।
কিছুক্ষণ পরে বললেন, ” আমার আসলে কখনো কোন কিছু চাইতেই হয়নি। এক মাত্র ছেলে তো।”
আমি, ” সম্ভবত আপনার মা শিখিয়েছেন, চাইবার আগেই সবকিছু হাতের কাছে রেডি থাকে, তাই না?”
ভদ্রলোক এক কথায় উৎসাহী গলায় হাঁ বলে দিলেন।
আমি, ” আপনি মা আর স্ত্রীর চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে ব্যালেন্স করে চলতে পারেন?”
ভদ্রলোক বেশ খানেক ক্ষণ নীরব থেকে বড় অসহায় কণ্ঠে বললেন, “না!”
আমি, ” একটু ভেবে দেখবেন তো কখনো কি দুই জনকে ব্যালান্স করে চলার চেষ্টা করেছেন? বলেছেন যে এটা তোমাদের বউ শাশুরির দ্বন্দ্ব তোমরা মেটাও আমি এর মাঝে নেই? নাকি কোন একটি বিশেষ পক্ষকে বরাবর অধিক প্রায়োরিটি দিয়েছেন?”
নিরবতা ক্ষেত্রবিশেষে হিরন্ময়।
ভদ্রলোকের নিরবতা আমাকে ভাবালো, ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলে।’
আমি চুপ করেই থাকলাম। বাইরে চমৎকার রোদ উঠেছে। আমার জানলার ফাঁকে টবে ঝোলানো গাছের পাতায় রোদ্দুর পিছলে পড়ছে। আমি একমনে তাকিয়ে আছি। ভদ্রলোকও বেশ চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম, ” আপনার স্ত্রীর সাথে বয়সের পার্থক্য কত?”
ভদ্রলোক, ” তিনি বেশ কয়েক বছরের ছোট আমার থেকে।”
আমি নরম গলায় বললাম, ” আপনার মা আপনাকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি আপনার শারিরিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাতিক সমস্ত নাড়ি-নক্ষত্র বোঝেন, আপনি কি করে আশা করেন যে, আপনার থেকে কম বয়সী একজন মানুষ, যিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছেন, তাঁকে আপনি নিজে থেকে না বললে, তিনি কিভাবে আপনার মনের কথা বুঝবেন? তার থেকে বরং বয়সে বড় হয়েও তো আপনি নিজেই বোঝেন না তার সব কথা! তাই না?”
ভদ্রলোক চুপ করে থাকলেন।
আমি মৃদু কন্ঠে বললাম, ” আপনি কি একটু ভেবে দেখবেন, যিনি আপনি না চাইলে আপনাকে জিনিস গুছিয়ে দেয় না বলে বা আপনার কথা বুঝে নিতে চেষ্টা করে না আপনি তাঁর প্রতি এটাচড ফিল করেন না? আসলে এই ভাবনাটা কতটুকু যুক্তি সঙ্গত? তিনি যদি একই কাঠগড়ায় আপনাকে দাঁড় করায় তাহলে আপনি একই অভিযোগে কতোটুকু অভিযুক্ত হবেন?”
ভদ্রলোক বললেন, ” মানে? ও বউ হয়ে বুঝে না আর আপনি একজন বাইরের মানুষ হয়েও থিকই ঠিকই আমাকে বুঝলেন।”
আমি, ” এই যে আপনি আমাকে বললেন আমি আপনাকে বুঝলাম। এর কারণ ৩টা। প্রথমতঃ আমার পেশাগত প্রশিক্ষণ। আন্তঃসম্পর্কগুলো তো কাউন্সেলিং সেশনের মতো মাত্র দেড় ঘন্টা নয়। সেখানে বিন্দুমাত্র ফাঁক চলে না। দ্বিতীয়তঃ আমি বয়স্ক তাই অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী। তৃতীয়তঃ বউ হিসেবে আমার দাঁত নখের ধার মোটেও কম না। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে এখানে আপনি আমাকে ভিজিট দিচ্ছেন। লক্ষ্মী হয়ে তর্ক না করে কথা শুনছেন, বউএর সাথে কি এমন করেন?”
সাধে কি আর বাঙ্গালির হৃদয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
‘ নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে,
যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।‘
গবেষণায় বলছে ৯০% বিবাহিত দম্পতি মানসিক ও শারীরিকভাবে পরস্পর এতো বেশি বিচ্ছিন্ন অনুভব করে যে, তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যিকারের তালাকের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এই জটিলতার একমাত্র কারন পারস্পরিক সম্পর্কের শ্রদ্ধাবোধের অভাব। এই করোনা কালে দাম্পত্য ফাটল বহুলাংশে বেরেছে।
এই অবস্থাতাকে আমি বলব বৈবাহিক আবেগ শূন্যতা।
ফলশ্রুতিতে বিবাহিত সম্পর্ক থেকে আবেগ চলে যায়, এবং দম্পতি বুঝতে পারেন না যে তাঁরা আসলে বিবাহিত জীবন যাপন করেন নাকি তালাকপ্রাপ্ত জীবন। একটা সম্পর্কে যখন শ্রদ্ধাবোধ চলে যায় তখন ভালোবাসা থাকলেও সম্পর্কটি শ্বাস নিতে পারে না। যার কারণে রেডলাইট এরিয়াতে ভালোবাসা থাকলেও সেই সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃতি দেয় না। কারন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যেকোনো সম্পর্কর প্রান ভোমরা।
“…এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনায়
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ
তাই মান অভিমান, তাই এত হায়
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেলো অবসান
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রজল…”
সম্পর্ক ভাল করতে হলে দুজনেরই সেটি সারিয়ে তোলার জন্য প্রবল ইচ্ছা থাকাটাই একমাত্র উপায়। যদি একজন অন্য জনকে কোণঠাসা করে ফেলেন, তাহলে সেটি খারাপই হবে। তাদের খোলামেলা কথা বলতে হবে এবং সেসময় শব্দ চয়ন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তা নাহলে সম্পর্কটি পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। অনেক সময় শুধু এক পক্ষই সব কিছু ঠিক করতে চান অন্য পক্ষ নিরব । এতে লাভ নেই। দুই পক্ষকেই শিখতে হবে যে কিভাবে কোন ঘটনা বাড়তে না দেয়া যায়। উভয়কেই কথা বলতে হবে সমস্যা সমাধানে, আপত্তিকর কোন শব্দ বলা যাবে না।
যদি স্বামী তার স্ত্রীকে কোন উপহার না দেন তবে স্ত্রীই বসে না থেকে শুরু করুক না।
গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কখনোই হাল ছাড়া যাবে না। তবে মনে রাখতে হবে এক পক্ষ যদি শুধু হাল ধরে রাখে এই সমস্যার জীবন ও সমাধান হবে না। হাল ধরার দায়িত্ব উভয়পক্ষের। তাইতো আবহমানকাল থেকে কথায় আছে, ‘সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে,
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’।
আন্তঃসম্পর্কে দহন কাল আসবেই। তখন যেনো পরস্পরকে চোখের দিকে তাকিয়ে ট্রান্সপারেন্সি বা সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে বলা যায়,
‘ রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব-
চাই না শান্তি, সান্তনা নাহি চাব ।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব
তুমি আছ আমি আছি ।।‘
যেসব দম্পতি পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামতের ভিন্নতাকে সম্মান করে একজন অন্যজনের সমস্যাকে স্বচ্ছতার সাথে ঝগড়ার পরেও জীবনসঙ্গীর জুতোয় পা দিয়ে জীবনসঙ্গীর রাগ, ভয় এবং আনন্দ বেদনার কাব্য বুঝতে চেষ্টা করেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।