#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“Secrets, silent, stony sit in the dark palaces of both our hearts: secrets weary of their tyranny: tyrants willing to be dethroned.” –James Joyce, Ulysses
“আমার শাশুড়ি সবার সামনে মুখে এক কথা বলে, কিন্তু কেউ বুঝে না আমি ঠিকই বুঝি সেই কথার মধ্যেই খোঁচাটা কোথায় দেয়। আমার হাজব্যান্ডকে যখন বলি তখন সে বলে কেউ বুঝলো না শুধু তুমি বুঝলা? কই আমিও তো শুনলাম আমারতো খোঁচা মনে হয় নাই। কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারিনা।” ভদ্রমহিলার বয়স ৩৫, পেশাজীবী। বাচ্চা রেখে অফিস করতে হয়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই প্রাক্তন সহপাঠী, বর্তমান সহকর্মী। পারস্পরিক বোঝাপড়া সমস্যা হয় না কিন্তু যখনই ছেলের মা এর প্রসঙ্গ আসে, তখনই ভদ্রলোক পুরোদস্তুর ভদ্রমহিলাকে স্পষ্ট করে বলে দেন ভদ্রমহিলা ভুল বুঝছেন।
” ম্যাডাম বিশ্বাস করেন আমার শাশুরির ছেলের সামনে একরকম আমার সামনে আরেকরকম।” ভদ্র মহিলা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন।
আমি চুপ করে থাকলাম।
” আপনি জানেন না ছেলে আসলে ওনার আচরণ একদম পাল্টে যায়, কথার সুর পাল্টে যায়। এমনকি ধরেন সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে তখনই আমাকে একটা খোঁচা দেবেন যেটা কেউ না বুঝলেও শুধু যে আমাকে উদ্দেশ্য করে সেটা আমি বুঝি।”
আমি, ” কিভাবে বোঝেন যে শুধু আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি দশ বছর ধরে ওনার ছেলের বউ। উনি যেমন আমাকে চেনেন, আমিও ওনার নড়াচড়া দেখলেই বুঝতে পারি উনি কি বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু মুশকিল হল কি জানেন, যেহেতু একমাত্র ছেলের বউ আমার আর কোন অপশন নেই ওনাকে ছেড়ে থাকার। আমি চাইও না। আমি কৃতজ্ঞ ওনার কাছে উনি আমার বাচ্চাটা দেখছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে এত তীব্র খোঁচা দেন যে আর নিতে পারিনা। তখন আমিও পাল্টা আঘাত করি। এখন এমন তিক্ততা হয়েছে, আর সহ্য হচ্ছে না। আমার হাজব্যান্ড যদি একটু বুঝতো তাহলে কষ্টটা কম হতো। ও ভালো মানুষ সবই বোঝে শুধু এই জায়গাটা বুঝতে পারেনা। বলে আমারি নাকি মাথায় সমস্যা। আমার ছোট মন। আমি ওর মা’কে ভুল বুঝি।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
হুমায়ূন আহমেদের একটা গল্পে পড়েছিলাম নায়ক-নায়িকা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছেন, “আমার সোনার বাংলার পরের লাইনটা কি? অর্থাৎ জাতীয় সংগীত এর পরের লাইনটি কি?” অপর পক্ষের উত্তর আসে, “আমি তোমায় ভালোবাসি।” সরাসরি ভালোবাসি বলাও হলো না কিন্তু ইঙ্গিত দেয়া হয়ে গেল। সোশ্যাল লেভেলে জাতীয় সংগীত এর পরের লাইন বোঝানো হলেও মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ভালবাসার কথাই জানানো হল। এটাই হলো আল্টিরিওর ট্রানজেকশন (ulterior transaction)।
এটা এক ধরনের কথোপকথন প্রক্রিয়া। এখানে একই সাথে একই কথার দুই রকম অর্থ হবে। ধরুন সবাই দলেবলে গল্প করছেন একসাথে। এই আড্ডার মাঝে একজন একটি কথা বললেন। এই কথাটার দুটো মানে থাকবে। প্রথম অর্থটি হবে সামাজিক পর্যায়ে যেটা সবাই শুনবে এবং সবাই একই মানে বুঝবে। এটাকে আমরা বলব সোশ্যাল লেভেলের মেসেজ। সবার কাছে এই কথা অর্থ নির্দোষ। কিন্তু একই কথার দ্বিতীয় একটা গোপন অর্থ থাকবে। যেটা সোশ্যাল লেভেলের সবাই বুঝবেন না। সেটা শুধুমাত্র বিশেষ একজনকেই উদ্দেশ্য করে বলা হবে। এবং শুধুমাত্র তিনি এর অর্থ অনুধাবন করবেন। এটাকে বলা হয় সাইকোলজিকাল লেভেলের মেসেজ। বা সিক্রেট মেসেজ।
এবার আলোচ্য শাশুড়ির প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তার প্রথম সোশ্যাল লেভেলের মেসেজ নির্দোষ। ফলে তার ছেলে বলছেন, “মা তো খারাপ কিছু বলেনি।”
ভদ্রলোক বুঝতেই পারছেন না যে সোশ্যাল লেভেলের মেসেজের আড়ালে গোপনে একটি মনস্তাত্ত্বিক মেসেজও আছে। এবং যার উদ্দেশ্য করে এই মেসেজের তীরটি ছোড়া হয়, শুধুমাত্র এটা তাকেই বিদ্ধ করে। এবং এই ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক মেসেজটি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে। এখন যদি সাইকোলজিকাল গোপন মেসেজটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা যায় তবে কিন্তু এই কথোপকথন শেষ হয়ে যাবে। না হলে এই মনস্তাত্ত্বিক কিংবা খেলা দিনের পর দিন চলতেই থাকবে। বউ শাশুড়ির সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকবে। এবং এই ধরনের গেম অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসুস্থ। কারণ এটা সাংঘাতিক ভাবে আমাদের এনার্জি খরচ করায়।
“Psychological-level (ulterior) transactions are transmitted by nonverbal communication. Using communication theory (Buda, 1988), six alternative mechanisms transmitted by verbal messages and actions are described. By recognizing these mechanisms, it is possible to bring ulterior transactions into full awareness and to prevent games. Strategies for dealing with ulterior transactions are suggested based on bringing covert messages into full awareness.”(1)
এ ধরনের ঘটনা কিন্তু হরহামেশা আমাদের জীবনে প্রতিদিনই ঘটছে। যেমন ধরুন একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ধরুন দোকানে গেছেন।
আপনি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই শাড়িগুলোর দাম কত?” দোকানদার, ” এইগুলো দামি শাড়ি। কত রেঞ্জের মধ্যে দেখাবো?” আপনি, ” যেটা দেখাতে বলছি সেটাই দেখান।”
এই কথোপকথনে মেসেজ স্পষ্ট। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক লেভেলে, প্রথমে দোকানদার আপনাকে খোঁচা মারলো যে, ” আপনি যেটা দেখাতে বলছেন সেটা দামি শাড়ি আমার মনে হয় না আপনি এটা কেনার যোগ্য, কাজেই আপনি আপনার বাজেট বলেন।”
এই মনস্তাত্ত্বিক লেভেলের খোঁচার জবাবে আপনি একটু রেগে বললেন, ” যেটা দেখাতে বলেছি সেটাই দেখান, অর্থাৎ, ওই মিয়া তুই জানিস আমার বাজেট কত?”
আশেপাশের সবাই কিন্তু মনে করলো এটা একটা নির্দোষ কথোপকথন। কিন্তু এর ভেতরে ছোট্ট একটা মনস্তাত্ত্বিক খোঁচা দেয়া নেয়া হয়ে গেল। সব সময় যে এটা শুধু কথা বললেই হবে অর্থাৎ ভার্বাল হবে তা কিন্তু নয়। অনেক সময় কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে ও শুধুমাত্র তাকানো দিয়ে অথবা অঙ্গভঙ্গি করেও এই খোঁচা দেওয়া যায়। যেমন বাঁকা চোখে তাকানো, মুখ ভেটকানো, চোখ ছোট ছোট করে তাকানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিভাবে ধরবেন যে এখানে আল্টিরিওর ট্রানজেকশন হচ্ছে? আপনি যদি সোশ্যাল লেভেলের মেসেজ শুনেন তাহলে বুঝতে পারবেন না। আপনাকে খেয়াল করতে হবে নন ভার্বাল ক্লু। ভাষা ছাড়া অঙ্গভঙ্গি কি তথ্য আদান প্রদান করছে। ” In an ulterior transaction, the social level message is given by words To ‘think Martian’ at the psychological level, you need to observe nonverbal clues. These are found in voice tones, gestures, postures and facial expressions. There are also more subtle clues in breathing, muscle tension, pulse rate, pupil dilation degree of sweating and so on. We have referred to psychological level message as ‘secret messages’. In fact they are not secret at all if you know what to look for. The nonverbal clues are there for you to read. ” (2).
আমরা কেন এ ধরনের আচরণ করি? এর মূল প্রোথিত আছে আমাদের শৈশবের বেড়ে ওঠায়। ছোটবেলায় যে বাচ্চাগুলোকে তাদের মনের কথা খোলামেলা ভাবে বলতে উৎসাহিত করা হয়নি, অর্থাৎ অনুমতি দেয়া হয়নি, তারাই এ ধরনের আল্টিরিয়োর ট্রানজেকশন বেছে নেয়।
“Ulterior transactions originate in early childhood. People who practice this behavior learned early that they were not able to express themselves freely. It was not OK to not be OK.”(3)
রবীন্দ্রনাথ চমৎকার বলেছেন, “অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি..”
যারা তাদের কথাবার্তার মধ্যে সততা, খোলাখুলি, স্পষ্টতা বজায় রাখেন, কোন গোপন ইঙ্গিত দেন না তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
তথ্যসূত্র:
1. Mechanisms for Transmission of Ulterior Transactions Attila VandraFirst Published January 1, 2009 Research Article. Sage Publication
2. TA Today. Ian Stuart, Vaan Join. Reprint 2008, page 62.
3. Ulterior Transactions: The Hidden Depths of Our Relationships. Holly Hartley.
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।