#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“Sexual desire in women is extremely sensitive to environment and context,” Dr. Edward O. Laumann ( The Social Organization of Sexuality: Sexual Practices in the United States.)
” আমার জীবনে কখনো অর্গাজম হয়নি। আমি জানতামই না মেয়েদেরও যৌনতৃপ্তি আছে।”
ভদ্রমহিলার এটাই ছিল প্রথম কথা।
ওনার বয়স ৫৯। সুন্দরী, মার্জিত, বুদ্ধিমতী, সদ্য রিটায়ার্ড। ৪ কন্যার জননী। শেষেরটি বাদে বাকি তিন জনের বিয়েও সুসম্পন্ন। স্বামী পেশাজীবী। দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র।
কিছু কিছু মানুষের মুখ অভিব্যক্তিহীন হলেও বিধাতা চোখের দৃষ্টিতে ভাষা দেন। ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টির বোবা অসহায়ত্বই প্রথম বিশেষত্ব হিসেবে আমার চোখে ধরা পরল।
ভদ্রমহিলা বললেন, ” আমি আমার স্বামীর সাথে আর থাকতে চাই না। আমার ২২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে, জানেন এখন পর্যন্ত একটা দিনও আমার স্বামী আমাকে জড়িয়ে ধরেনি। নিতান্তই জৈবিক প্রয়োজনে মিলিত হয়েছে। প্রয়োজন শেষে ব্যবহৃত বস্তুর মতন ফেলে রেখে উঠে গেছে। আমার বিয়ের কয়েক বছর পরে, আমার অফিসের এক সহকর্মীর সাথে আমার ভাললাগা তৈরি হয়। তিনি সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আমার স্বামীর কাছে। কিন্তু, আমার স্বামী আমাকে তালাক দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। ততদিনে আমার দুই কন্যা হয়ে গেছে। আমি তৃতীয় বারের মতন মা হতে যাচ্ছি।”
আমি, ” ওনাকে বিয়ে করলেন না কেন?”
ভদ্রমহিলা,” মনে হল বাচ্চাদের রেখে যাব, সংসার ভাঙবো? তাই আর আগালাম না। কিন্তু এই নতুন ভদ্রলোক কোনদিন আমার আমার হাতটা পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। আমরা ধর্মীয়ভাবে কখনো আমাদের সীমা অতিক্রম করেনি। আমি কখনোই কোনো পরকীয়ায় আবদ্ধ হইনি। আজ আমার মেয়েরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার, অথচ তারা আমাকে চরিত্রহীনতার দোষে আখ্যায়িত করে। বিন্দুমাত্র সম্মান তারা আমাকে করে না। “
আমি, ” আপনি কি সন্তানদেরকে বলেছেন যে কখনোই আপনাদের বিবাহিত জীবনে স্বাভাবিক যৌন মিলন হয়নি?”
ভদ্রমহিলা, ” এই লজ্জার কথা বাচ্চাদের কি করে বলি? তবে বোনকে বলেছিলাম। উল্টো বোন তাচ্ছিল্য করে বলেছে তোর কি সেক্স বেশি?”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
সেক্স মানুষের জীবনে একটি খুব স্বাভাবিক চাহিদা। প্রকৃতি এটা তাঁর সৃষ্টিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন হরমোনের খেলা হিসেবে মানুষের শরীরে প্রোথিত করেছে। কাজেই নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনেই যৌন তৃপ্তি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
ভদ্রমহিলার সন্তানরা শুধু জানে যে মা পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। তারা কিন্তু জানে না যে ২২ থেকে ৬৯ বছরের পর্যন্ত একজন রমণীর শরীরের অতৃপ্ত যৌন চাহিদার করুন কাহিনী।
সন্তানরা কিন্তু একবারও ভাবেনি মা যদি তাঁর সংসার জীবনে তৃপ্ত থাকতেন, তাহলে তৃতীয় পক্ষের ছায়া কখনোই পরতো না। পরিণত বয়সেও সন্তানরা কখনও জানতেও চায়নি,” মাগো তোমার কি কষ্ট ?”
আমরা যেমন বলি স্বামীকে বেঁধে রাখতে হয়। স্ত্রীকে কী বেঁধে রাখতে হয় না? স্বামীর কি সেখানে দায়িত্ব নেই? “সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।” কাজেই সংসার টেকানোর দায়িত্ব শুধু মায়ের কি একার? গুনবান পতির কোনো ভূমিকা নেই এক্ষেত্রে?
গরু আর জরু ঢাকের বাড়ির উপর রাখতে হয় এই আদি বাক্য এখন অচল। পুরুষদের যৌনজীবন দীর্ঘজীবী। এখানে উল্লেখ্য নারীদের যৌনজীবনও কিন্তু মেনোপজ পরবর্তী শেষ হয়ে যায় না।
ভদ্রমহিলার সন্তানরা এটাও কিন্তু মায়ের দিকে আঙুল তোলার আগে জানে না যে পরকীয়া (কারণ দ্বিতীয় ভদ্রলোক বিয়ে করতে চেয়ে ছিলেন গোপনে লিটনের ফ্ল্যাটে যেতে না) নয় সম্মানজনক ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মাতৃত্বের তাগিদে সন্তানের মুখ চেয়ে এই সংসারে মায়ের থেকে যাওয়ার বিস্মৃত আত্মত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নারীরা দু’রকম হয়। প্রিয় মুখী এবং মাতৃ মুখী। ভদ্রমহিলা যদি তার দিয়ে প্রিয়ামুখী রূপটাকে প্রাধান্য দিতেন, নতুন সংসারেও কিন্তু তিনি অনায়াসে মা হতে পারতেন। তিনি কিন্তু এই পথে পা বাড়াননি। তিনি তার সন্তানদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। বিয়ে না করাটা তার নীরব আত্ম বলিদান।
কাজেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই সন্তানরাই যখন মায়ের দিকে আঙুল তুলে স্বাভাবিকভাবেই ভদ্রমহিলা সেটা নিতে পারেন না। বিশেষ করে রিটায়ারমেন্ট এর পরে এখন তাঁর অফুরান অবসর। ফলে প্রতিদিন স্বামীর অসম্মান,সন্তানদের অপমানের গ্লানি ভদ্রমহিলাকে আমার চেম্বার অবধি টেনে এনেছে।
যৌন ক্ষুধা আর যৌনতা দুটো আলাদা জিনিস। চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাষা, স্পর্শ ইত্যাদি নানা রকম ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যৌনতার শুরু যেটা শেষ হয় যৌন ক্ষুধা নিবৃত্তির মাধ্যমে বিছানায়। এটা খুব স্বাভাবিক একটা চাহিদা নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কের। যৌনসঙ্গম পরবর্তী যে হরমোন রিলিজ হয় যেটা মানুষকে পরিতৃপ্ত করে, সোজা ভাষায় রিচার্জ করে। এটা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
নারীদের যৌন চাহিদা পুরুষদের তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। অথচ প্রকৃতিগতভাবে পুরুষদের মতন নারীদের এত চট করে যৌনতার উত্থান পতন হয় না। নারীদের ক্ষেত্রে ফোরপ্লেটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
ঠিক যেরকম পদাবলীতে জ্ঞানদাস বলেছিলেন,
“রূপ লাগি আখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগ্নি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর,
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে,
পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে।”
যারা যৌনতা স্থাপনের সময় স্ত্রীর মানসিক, শারীরিক, সামাজিক (এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্পিরিচুয়াল) প্রয়োজনীয়তাগুলোকে খেয়াল করে যথাযথ ব্যবস্থা নেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।