#চেম্বার কথন পর্ব ৩১
মেয়েটি, ” ম্যাডাম আমি একজন ডিফল্টার। আপনি তো জানেনই মেডিকেলে ডিফল্টার স্টুডেন্ট হওয়া মানে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! আমার অমুক সাবজেক্টে বার বার সাপ্লি। আমার মত ফালতু, ফেলটু মার্কাদের দাম নেই। আমরা শুধুই ক্লাসের, পরিবারের লজ্জার কারণ। তাই হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট স্যার লেকচারার ম্যাডামকে বলেছে ডিফল্টারদের সমস্ত পরীক্ষা নিজেই নেবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই অফিস আওয়ারের পরে। কারণ স্যারের অনেক ব্যস্ততা থাকে।
ভাইভা হয় ওনার রুমের ভেতরে। স্যারের রুমটা এমনিই ডিপার্টমেন্টের ভেতরের দিকে করিডোরের শেষ মাথায়। অন্ধকার, পর্দা টেনে রাখে। ওখানেই ক্লাস ছুটির পরে আইটেম (ছোট ছোট টপিক বেসড ভাইভা) নেন।
কিন্তু মুশকিল হলো স্যার যেকোন ছুতোনাতায় বিশ্রী ভাবে গায়ে হাত দেয়। একা থাকলে জিজ্ঞেস করে ব্রা’র সাইজ কতো! সবার সামনে ওনার যা রাশভারী চেহারা একা হলে সেটা একদম আলাদা! কেউ বিশ্বাস করবে না।”
মেয়েটি মাথা নিচু করে বসে থাকলো। টপটপ করে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কোলের উপর জমতে থাকা অশ্রুবিন্দুগুলো মুক্তা নাকি পান্নাতুল্য? এই ঝরে পড়াই কি অশ্রুধারা?
আমি, ” এই অশ্লীল প্রশ্নগুলি কি শুধু তোমাকেই করে?”
মেয়েটি, ” না ম্যাডাম! শুধু ডিফল্টারদেরকে করে। সেটাও সবাই না। তাদের মধ্যে যারা দুর্বল শুধুমাত্র তাদের। এক আপু ছিল ম্যারেড, ওনাকে নাকি বলেছিল, ‘স্বামীর সাথে পারলে আমার সাথে পারো না কেন? তুমি তো এক্সপেরিয়েন্সড।’ ম্যাডাম আমরা যখন পিছিয়ে পড়ি তখন আমাদের ক্লাসমেটদের আচরণেও যারা রেগুলার পাশ করে যায়, কেমন জানি একটা তাচ্ছিল্য চলে আসে। আমি হয়তো ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আছে। ”
আমি, ” তোমরা প্রিন্সিপালকে কমপ্লেইন করো না কেন?”
মেয়েটি, ” প্রিন্সিপাল স্যার তো মালিকপক্ষের পুতুল! তার উপর দুই স্যারই খুব বন্ধু। প্রতিদিন একসাথে চা-নাস্তা খান। বলে লাভ নেই। এই স্যার তো প্রকাশ্যে বলে ওনাকে খুশি না করতে পারলে প্রফে পাশ হবে না। ম্যাডাম আপনি জানেন, আমাদের ডিফল্টারদের কোন দাম নেই। আমাদেরকে গরু গাধা বলে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কিছু বলতে গেলে উল্টা নিজেরাই কালার হয়ে যাব। এরপর আর পাশই হবে না। কিন্তু আমি আর পারছি না ম্যাডাম। আমাকে আগামী বৃহস্পতিবার ওনার কাছে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেছে। আমার হাত টেনে ওনার থাই-এর উপর রেখে বলেছে, ‘ওই দিন তোমার হাতের কাজ দেখব’। আমি এখন কি করব ম্যাডাম? আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে।”
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মেয়েটা দস্তুরমতো কাঁপছে।
আমি, ” তুমি ভয় পাচ্ছো?”
মেয়েটি, ” জ্বী ম্যাডাম!”
আমি, ” বলতো এই স্যার তোমাদেরকে কি দিয়ে কন্ট্রোল করেন?”
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
আমি, ” আমি বুঝতে পারছি বিষয়টি নিয়ে তুমি কখনো ভাবনি। এখন প্রথম বার একটু ভেবে বলো!”
আবার বেশ কিছু চুপচাপ মুহূর্ত।
মেয়েটি, ” ভয়!”
আমি, ” একদম ঠিক। মনে প্রচন্ড ভয় দিয়ে ঢুকিয়ে কন্ট্রোল করা হয়। একটা কোটেশন আছে, ” Fear is used to control you.” এই ভয়ের চোটে ভিক্টিমের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম অ্যাক্টিভেটেড হয়। ঘাম হয়, বুক ধরফর করে, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে। নিঃশ্বাসটা মনে হয় গলার কাছে আটকে যায়! তাই না? তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো এই ভয়ের উৎপত্তি হয় মনে, তারপর এটা ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। অর্থাৎ ভয় এর প্রভাব হয়ে যায় তখন মনোদৈহিক।”
মেয়েটি টলমল চোখে মাথা ঝাকালো।
আমি, ” আচ্ছা উনি ভয়টা কি তোমার মধ্যে ইঞ্জেক্ট করে দেন?”
মেয়েটি, ” না!”
আমি,” তাহলে? উনি তোমার মধ্যে কিভাবে ভয় তৈরি করেন? তোমাদের বিভিন্ন ডিজিজের কারণ পড়তে হয় না? এই ভয় তৈরীর সাইকোপ্যাথলজি কি? ”
মেয়েটি, ” আমি জানি না।”
আমি, “বেশ! আমি হেল্প করি আরেকটা প্রশ্ন করে! অন্যের মনে এই ভয় তৈরি করাটা কি হেলদি নাকি আনহেলদি?”
মেয়েটি, ” অবশ্যই আনহেলদি।”
আমি, “উনি যদি অন্যায় ভাবে তোমার মধ্যে আনহেলথি ভয় তৈরি করতে পারেন, তুমি নৈতিক ভাবে পারো না? তুমিও তো ওনারই ছাত্রী। গুরু মারা বিদ্যা বলে কি একটা কথা বোধহয় শুনেছিলাম।”
সেইদিন এইটুকুই কথা বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেওয়া নয়। কি করবে সেটাও বলে দেওয়া নয়। কাউন্সেলিং মানে মানুষটির মনের কোথায় কোথায় জটপাকানো আছে সেটাতে আলো ফেলা। বাকিটা সে নিজেই নিজের অবস্থা অনুযায়ী বুঝবে; কোন জটটা আগে খুলবে, কোনটা পরে। কিভাবে খুলবে, কেন খুলবে, কতদিন ধরে খুলবে, কতদিন পরে খুলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই জায়গাগুলি বুঝতে সাহায্য করাই কাউন্সেলিংয়ের অন্যতম কাজ। কাউন্সেলর তো তাঁর হয়ে জট খুলে দিয়ে আসবো না। কাজেই সে নিজেই নিজের দ্বায়িত্ব নেবে। নিজের বিপদে লক্ষ স্থির করবে। হবে না বলে হাতপা না গুটিয়ে ফেলবে না।
তারপর বাকিটা ইতিহাস।
গতকাল শুক্রবার ছিল। সেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ডিফল্টার এসেছিলেন চাঁদা তুলে একটা হৃদয় আকৃতি লাল কেক নিয়ে। কেকের ওপরে লেখা ছিল আমাদের ফিনিক্স এর সেই বীজমন্ত্র, ‘We are not independent, we are interdependent. We are Phoenix.’ আমার চোখ ভিজে গেলো।
ইদানিং মনে হয় আমি এত কম বুঝি! নিজের অপারগতা, দৈন্যতাগুলো আজকাল খুব রিফ্লেক্ট হয় নিজের মনে। আজকাল প্রায়ই দেখতে পাই, আমি কি জানি না, সেটাও আমি জানিনা। কেকের সাথে তাদের ঝুলিতে একটা মন ভেজানো গল্প ছিল।
গল্পটা এরকম,
একদা কোন এক রাজ্যে এক বিবাহিত স্যার ছিল। স্যারের স্ত্রী একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান। যেখানে তাঁকে বলা হয়, অমুক দিন ডিপার্টমেন্টে এতটার সময় একা গেলে তিনি এমন কিছু দেখবেন যেটা তাঁর সংসার জীবনের জন্য খুবই জরুরী। তিনি নির্ধারিত সময়ে তাঁর স্বামীর রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান।
ব্যাস! নটে গাছটি মুড়োলো। এটুকু গেল বাহ্যিক গল্প।
আভ্যন্তরীণ গল্পটি হল,
এর একটু আগেই রুমের ভিতরে “কেউ একজন” ঢুকে। তারপর আভ্যন্তরীণ কথোপকথন নিম্নরূপ,
স্যার, ” এসেছো! তোমার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। আসো! হাতের কাজ দেখাও!
কেউ একজন, ” স্যার স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট বেশি কমফর্টেবল।”
স্যার, ” সবই তো বুঝো! কিন্তু একটু দেরিতে! আরেকটু আগে বুঝলে কবেই পাশ হয়ে যেতো। এতগুলো দিন তোমার নষ্ট হতো না।”
ফলশ্রুতিতে মাননীয় স্যার “কম্ফোর্ট” লাভের উদ্দেশ্যে আংশিক বস্ত্রহীনতায় বল্গাহীন হতে হতে, সেই অসভ্য(!) “কেউ একজন” তাঁর দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে জায়গা মতো এক বিরাশি সিক্কার ঘুষি বসিয়ে দিতে গেলে চিৎকার-চেঁচামেচি! কি একটা লঙ্কা কান্ড!
ভাগ্যিস স্যারের স্ত্রী ছিলেন। আহা! তিনিই তো দরজা খুলে, দুই হাতে আহত স্থান চেপে ধরে, কুই কুই করতে থাকা নিরীহ স্যারপ্রবরটিকে উদ্ধার করলেন। নাইলে আপনিই বলুন কলেজ ছুটির পর এই নিঃসঙ্গ করিডরে আর কোথায় কে বা কারা কারা আছে!
একটি চাণক্য শ্লোক আবছা আবছা মনে পড়ল,
“দুর্বিনীত স্ত্রী থাকলে ঘরে সুখ থাকবে কী করে! কুশিষ্যকে শিক্ষাদান করে গুরুর যশের আশা কোথায়!”
(আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতিক্রমে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ