#চেম্বার কথন পর্ব ৩৮
ভদ্রমহিলা, ” আমার বিয়ে হয়েছে ৩ বছর। আমাদের সম্পর্কটা প্রথম থেকেই ছাড়া ছাড়া। বন্ডিং এতদিনেও তৈরি হয়নি। বিভিন্ন মেয়ের সাথে ও সেক্সটিং করে। আমি বিয়ের পর পর এটা ধরে ফেলতেই ও প্রচন্ড রেগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার গায়ে হাত তোলে। তখনই ভেবেছিলাম ডিভোর্স দেবো। কিন্তু আমার বাবা মা রাজি হন নাই। তাঁদের কথা আরো একটু চেষ্টা করো। আবার শ্বশুরবাড়ি এক কাঠি সরেস। শাশুড়ির কথা আমাদের রাগী ছেলেটাকে সংসারী করার জন্যই তো তোমাকে আনা! বিয়ের প্রথমেই যদি হাসব্যান্ডকে বশে আনতে না পারলে তাইলে আর কি মেয়েমানুষ হইলে! এখন একমাত্র বাচ্চা হলেই যদি ছেলেটার সংসারে মতিগতি ফিরে! কাজেই উভয় বাড়ির একদফা একদাবি বাচ্চা নাও। আমরাই পেলে দেব। এমনিতে কিন্তু আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি যথেষ্ট ভালো মানুষ। ওনাদের প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। ওর পছন্দ মতো আচরণ করতে। এখন আর পারছি না। আমি খুবই ক্লান্ত বোধ করি। বুঝতে পড়ছি না এই জীবনটা কোনদিকে যাচ্ছে।”
আমি, ” কাউন্সেলিং থেকে কি চান?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি নিজেই যেখানে আমার স্বামীর বেপরোয়া আচরণে সুখী নই, সেখানে আদতে কি এখন বাচ্চা নেবার দরকার আছে? “
আমি, ” আমরা ছোটবেলায় একটা ব্যাকরণ বই পড়তাম, নাম একের ভিতর পাঁচ। পড়েছেন?”
ভদ্রমহিলা মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিলেন যে তিনিও পড়েছেন।
আমি, ” স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য অশান্তি হলে বাচ্চা হওয়াটা ঠিক যেন প্রচলিত বিশ্বাসে সেই একের ভিতর পাঁচ। সমস্ত সমস্যার সমাধানের একমাত্র মহা ঔষধ। আপনি প্লেনে উঠেছেন?”
ভদ্রমহিলা চোখ গোল গোল করে অবাক হয়ে বললেন, “উঠেছি।”
আমি, ” ওখানে এয়ার হোস্টেস কি বলেন? তিনি বলেন যে, আগে অক্সিজেন মাস্ক মুখে লাগিয়ে নিজে শ্বাস নিন, তারপর বাচ্চাকে দিন! তাই কিনা?”
ভদ্রমহিলা আলতো করে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, ” হা।”
বেশ বুঝতে পারছি কথা আলোচনার গতি প্রবাহ কোন দিকে যাচ্ছে তিনি ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না।
আমি, ” আপনারা নিজেরাই নিজেদের সাথে ভালো না থাকলে, বাচ্চাকে কিভাবে ভালো রাখবেন আপনাদের সাথে? নিজেরা ভালো না থেকে বাচ্চাকে ভালো রাখবার মাত্র একটা পন্থা বলেন?”
ভদ্রমহিলা চুপ।
আমি, ” বাচ্চা পালবার দ্বায়িত্ব কিন্তু মা বাবা দুজনেরই। এবং সেটা একত্রে। আলাদা আলাদা বা বিচ্ছিন্নভাবে না। এখন আপনিই বলেন আপনারা কি দুজনে এই দায়িত্ব নেবার জন্য বাস্তবে আদতেই প্রস্তুত? কারণ আপনার মা এবং শাশুড়ির ওরা কিন্তু নাতনি বা নাতি। তাই দায়িত্ব বাবা মার উপর অনেক বেশি। সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনাদের। কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া নয়। কাউন্সেলিং মনে ভাবনা, অনুভব বা আচরণে কোথায় কোথায় জট সেটা দেখিয়ে দেয়া। গিট আপনাকেই খুলতে হবে। কাজেই আপনিই ভালো সিধান্ত নিতে পারবেন আপনার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কাউন্সিলর নয়। তাই না?”
মনে রাখা প্রয়োজন, বাচ্চার বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে বাবা এবং মা উভয়ের বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক সম্মান করার প্রচেষ্টাটা খুব দামি। এই সৌহার্দ সাংঘাতিক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
অথচ প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হলো “বাচ্চা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।” বাচ্চা মুশকিল আসন!
কিন্তু আসলেই কি তাই? আমি নিজেই যেখানে শান্তিতে নেই সেখানে বাচ্চাটিকে এনে নিজের এবং বাচ্চার অশান্তি কেন বাড়াবো? তখনই সন্তানকে নিয়ে আসবো যখন আমি নিশ্চিত হব তার শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য বিকাশের পরিপূর্ণ সহযোগিতা আমি করতে সক্ষম।
আমি বারবার বলি যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি চারা গাছের মতন। একে লালন করতে হয়। প্রতিদিন পরিচর্যা করতে হয়। বছরে একদিন অনেক পানি দিলাম, আর বাকি ৩৬৪ দিন কোন খোঁজ রাখলাম না তাহলে কিন্তু এই সম্পর্কটি ধীরে ধীরে মরে যাবে।
দাম্পত্য সম্পর্কে সব সময় যে সমান অধিকার লাগবে তাও কিন্তু নয়। এই সম্পর্কে প্রয়োজন হচ্ছে সাম্যতার। যাঁর যেখানে ঘাটতি জীবনসঙ্গী এসে সেটা পূর্ণ করে দেবেন। একজনের সীমাবদ্ধতাকে অন্যজনের স্বতস্ফূর্ত ভাবে মেটানোর দায়িত্ব নিতে হবে সসম্মানে। একজন অনেক বড় আর অন্যজন ছোটো সেটা কিন্তু না। সাইকেলের দুটি চাকা সমান না হলে কিন্তু চলবে না। দাম্পত্যও তাই!
একবার ভাবুনতো, যেখানে বাবা-মার মধ্যে অশান্তি, সেখানে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে আমরা কি পারবো বাচ্চাটার উপযুক্ত মনোসামাজিক যত্ন নিতে? এমন dysfunctional বাবা মা’র ঘরে আমি নিজেই কি বাচ্চা হয়ে জন্ম নিতে চাইবো? এমন ঘর বেছে নেব?
বাচ্চা কখনোই দাম্পত্য সমস্যা মেটানোর মেড ইজি বা বাজারের কাটতি গাইড বই নয়। যেখানে পরস্পর স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা পালনেই আটকে যাচ্ছেন। সংসারে কমরেডশিপ নেই, সেখানে স্বামী স্ত্রীর ভূমিকার সাথে সাথে বাবা মা হওয়ার বাড়তি যৌথ দায়িত্বটি নিজেরা শেয়ার করবেন কি? করলেও ঠিকঠাকমতো কোয়ালিটি বজায় রাখতে পারবেন তো? হ্যা হলে কেন, কিভাবে এবং না হলেও কেন, কিভাবে? এই ধাপগুলি দুজন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন বাচ্চা নেবার আগে।
খোলামেলা, নিরাপদ এবং স্বচ্ছ কথা বলবার পরিবেশ তৈরি করতে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
বাবা-মা, ভাইবোন অর্থাৎ বৃহত্তর পরিবারের ভূমিকাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্যে কলহে বৃহত্তর পরিবার যোগ দিলে সম্পর্ক কিন্তু আরো খারাপই হয়।
কারন মেয়ের পরিবার মেয়ের পক্ষে কথা বলবেন; ছেলের পরিবার ছেলের পক্ষে কথা বলবেন। ফলে পরিবার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে না। তাই প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নিন। কারণ তিনি নিরপেক্ষ। আবার কাউন্সেলিংয়ের মানে কিন্তু সেই দম্পতি পাগল নন। আপনি বিভিন্ন প্রয়োজনে যেই যুক্তিতে পেশাজীবীর দক্ষতার সাহায্য নেন, এটাও ঠিক তাই। ভিন্ন কিছু নয়। লজ্জার কিছু নেই। হার জিত কিছু নেই।
“বাচ্চা নাও! বাচ্চা নাও!”
অথবা,
“এতো দেরি করছো কেন বাচ্চা নিয়ে?”
“কবে বাচ্চা নেবে?”
ইত্যাদি!
ইত্যাদি!
এই কথাগুলি বলাটাও যে অভদ্রতা সেটা বুঝতে পারাটা খুব জরুরী।
কারণ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যতই আমি মা-বাবা ভাই-বোন হয়ে ব্যাপক ভালোবাসা নিয়ে ঢুকি না কেন, বাউন্ডারিটা মেইনটেন করা খুব জরুরি। আমার ছেলে বা মেয়ের জন্য আমি সব সীমা অতিক্রম করতে পারি। কিন্তু সে যখন আরেকজনের স্বামী/ স্ত্রী তখন ছেলের/ মেয়ের সেই দাম্পত্য সম্পর্কে, আমি আমার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারিনা। এটা ঠিক যেন না বলে অন্যের বেডরুমে ঢুকে যাওয়ার মতন। দাম্পত্যের প্রাইভেসি লঙ্ঘন।
এই সীমারেখা অতিক্রম করতে চাওয়াটাও কিন্তু প্রচণ্ড অভদ্রতা।
দম্পতিকেই সিধান্ত নিতে দিন যে, তাঁরা নিজের সংসার কিভাবে গুছাবেন? প্রথম বার ভুল করলে অসুবিধা কি? পরের বার না হয় শুধরে নেবেন। ঠেকে শিখতে দোষ কি?
দরকার শুধু একটুখানি পারস্পারিক সদিচ্ছা, সন্মান আর সহমর্মিতার।
( কথোপকথনের আলোচ্য অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,