#চেম্বার কথন পর্ব ৪০
পটভূমি: দুজনেই চিকিৎসক। পারিবারিক সম্পর্কে খালাতো ভাইবোন ছিলেন। ইদানিং দাম্পত্য কলহ তুমুল আকার ধারণ করেছে।
কারণ ভদ্রমহিলার মা ওনাদের পারিবারিক হুজুরের থেকে জানতে পেরেছেন, ‘মেয়ের বাড়িতে কেউ একজন এসেছেন বিগত কিছু দিনের মধ্যে, নদী পার হয়ে। এবং সেই “তিনি”টি নাকি ভদ্রমহিলাকে কালো জাদু করেছেন।
বড় হুজুরের অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি ভদ্রমহিলার মায়ের সামনে বড় একটা কলসির ভেতর হাত দিয়ে অনেকগুলো তালা তুলে এনেছেন। যেইগুলি দিয়ে সম্পর্কটাকে ব্লক বা নষ্ট করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের পিছে নাকি একজন বয়স্ক বিধবা মহিলা আছেন। যার নামের আদ্যক্ষর ভদ্রলোকের মায়ের সাথে মেলে।’ দুয়ে দুয়ে চার মেলানো হল পারিবারিক সভায় ভদ্রলোকের মা আবার বিয়ে দেবেন ছেলের বিধায় এই কালো জাদু করছেন। বান মারছেন। যাতে ছেলের বউয়ের শরীর খারাপ হয়। এবং ভদ্রমহিলার শরীর আসলেই প্রচন্ড খারাপ। ক্রমাগত মাসিক হয়েই চলেছে। দেশেবিদেশের কোনো চিকিৎসায় সুরাহা হচ্ছে না। এখন জরায়ু মেনোপজ এর আগেই ফেলে দেবার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
কথোপকথন:
ভদ্রলোক, ” সবই তো শুনলেন। আমি এখন কি করবো?”
আমি, ” শুনলাম, কিন্তু আমি এই সমস্যা সমাধানের যোগ্য মানুষ না। কারণ জাদুটোনা, বানমারা সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই। আর যেখানে জ্ঞান নেই সেখানে আমি মন্তব্য করবো না।”
ভদ্রলোক, ” আমাদের লিচু বাগান আছে। আমার মা খাবার জন্য লিচু পাঠিয়েছেন। আমার শাশুড়ি সেদিন আমাদের বাসায় ছিলেন। বিশ্বাস করবেন না, সেই লিচুর ঝুড়ি খুলে আমার শাশুড়ি মানুষের নখ বের করলেন। লিচু চুরি খোলার সাথে সাথে আমার স্ত্রীর হাত-পা ভেঙে যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। ও পড়ে গেলো মেঝেতে। আমি স্পষ্ট দেখলাম ব্লিডিং হয়ে মেঝে ভিজে গেল। আমার শাশুড়ি ও স্পষ্ট করে বললেন, যে হুজুর এটাই বলেছিল যে আমার মার পাঠানো যেকোনো জিনিস আমার স্ত্রীর জন্য প্রাণ সংশয় করবে।”
আমি, ” আপনি আমার কাছে কি চান?”
ভদ্রলোক, ” আমি মানতে পারছি না, আমার মা আমার সংসার নষ্ট করবার জন্য কুফরী কালাম করবেন! আমিতো আমার মাকে তীব্র ঘৃণা করতে পারি না! পারি কি? উনি দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। হজ্জ করেছেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসার থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের দুটো বাচ্চা আছে। মা কেন করবেন? কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।”
আমি, ” এই কুফরী কালামের ব্যাপারে আমার বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই। এই পেশেন্ট ডিল করবার স্কিলতো দূরের কথা।। কাজেই আমি এই আলাপের জন্য উপযুক্ত ব্যাক্তি নই।”
ভদ্রলোক, ” আমি খুব অসহায় বোধ করছি। আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন? আমার আজন্ম বিশ্বাস টলে উঠছে! এক দিকে আমার স্ত্রী, আমার সন্তানদের মা, অন্য দিকে আমার নিজের মা! আমি কাকে বেছে নেবো? কাকে ত্যাগ করবো? হুজুরের কথায় কি নিজের মাকে বিসর্জন দেবো? নাকি নিজের স্ত্রীর অসুস্থতাকে অগ্রাহ্য করব? আমি আর পারছিনা। বাচ্চা দুটি না থাকলে আত্মহত্যা করতাম বোধহয়!”
ভদ্রলোক হাতের তালুতে মুখ রেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। কি বিষন্ন করুন ভঙ্গি! দু’পাশের কাঁধ ঝুলে পড়েছে। আপাদমস্তক একজন পরাজিত মানুষ।
আমার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর একটা উক্তি মনে পড়ল, “A man can be destroyed but not defeated.”
আমি সেই হুজুরের পরিচয় বৃত্তান্ত কিছুই জানিনা। শুধু মনে হলো তিনি যদি আজকে এই ভদ্রলোকের দোটানার জায়গায় থাকতেন, তাহলে তিনি কীভাবে সামাল দিতেন?
আমরা কত বিভিন্নভাবে জ্ঞানত এবং অজ্ঞানত মানুষকে ভয়ংকরভাবে লক্ষণ রেখার উপর দাঁড় করিয়ে দেই।
আমি ভদ্রলোককে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “একটা পরীক্ষা করতে পারেন। পরপর তিনদিন এক সপ্তাহ পর পর বাজার থেকে লিচু কিনে আপনার মা পাঠিয়েছেন বলে বাসায় নিয়ে যেয়ে দেখেন তো। আপনার স্ত্রীর শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো খেয়াল করুন। প্রতিক্রিয়াগুলো কি একইরকম মনোদৈহিক যেটা আপনার মা পাঠানোর পরে হয়েছিল? যেখানে মানুষের নখ পাওয়া গিয়েছিল! নাকি আপনার আনা লিচুতে কোনরকম দৈহিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না! আমি কিন্তু আপনার বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র পড়েছি। আপনি নাল হাইপোথিসিস এক্সেপ্টেড অথবা রিজেক্টেড হচ্ছে কিনা এই রিসার্চ কোয়েশ্চেন মাথায় নিয়েই এই ছোট্ট পরীক্ষাটি কি করবেন? এই প্রভাবটা কি আসলেই জাদুটোনার শারীরিক বহিঃপ্রকাশ তাহলে আপনার আনা লিচুর ঝুড়িতে ওনার কিছুই হবে না। নাকি আপনার আপনার মায়ের নামে পাঠানো যে কোন জিনিসের দেখলেই আপনার স্ত্রী দৈহিক ভাবে রিয়াক্ট করছেন?”
তিন সপ্তাহ পরে ভদ্রলোক জানান যে তাঁর স্ত্রীর ঠিক একই রকম মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়া হয় বাজারের কেনা লিচু দিয়ে। অর্থাৎ ভদ্রলোকের মা যেই লিচু পাঠাননি সেই লিচুর ঝুড়ি মা পাঠিয়েছেন বলে বাসায় ঢুকার সাথে সাথে ভদ্রলোকের স্ত্রীর একই রকম বুক ধড়ফড়ানি, পড়ে যাওয়া, ইত্যাদি শারীরিক লক্ষণ দেখা যায়। দ্বিতীয়বার লিচুর ঝুড়িতে ভদ্রলোকের শাশুড়ি চুল পান। তৃতীয়বার লিচুর ঝুড়িতে কাপড়ের টুকরা পান। প্রতিবারই হুজুর এগুলোকে ভদ্রলোকের মা কুফুরি কালাম করেছে বলে চিহ্নিত করেন।
লাফ দিয়ে মন্তব্য করে ফেলাটা কিছু কিছু মানুষের অবচেতন প্রবণতা। তাদেরকে কিছু একটা যেনো বলতেই হবে। যেখানে জিনিসটার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝার আগেই তাদের জিভের ডগায় উত্তরটা রেডি। সুপারফিসিয়াল লেভেলের তথ্য বিচার করে উত্তর না দিয়ে, একবার ভাবুন তো, এই ঘটনাটা ভিন্ন আঙ্গিকে আমার জীবনে ও তো হতে পারে! তখন আমি কি করবো? কিভাবে এটাকে সামাল দেবো সেই ভাবনার আয়নাটা নিজের চোখের সামনে ধরা জরুরী।
আমি এত কম বুঝি ইদানিং সেটা বার বার মনে হয়। নিজেকে শুধু একটাই প্রশ্ন করলাম, ” বিশ্বাস এবং অন্ধবিশ্বাসের পার্থক্য আমি নিজে নিজের জীবনে কিভাবে বুঝব?”
(কথোপকথনের আলোচ্য অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে মনোদৈহিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে প্রকাশ করা হলো।
* পুনশ্চ: কালো জাদু, বান মারা, কুফরী কালাম আছে কি নেই সেই আলোচনার জন্য এই লেখা নয়। আশা করি সে বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন।
* শুধু নিজেকে একটু প্রশ্ন করা যে বিশ্বাস এবং অন্ধবিশ্বাসের পার্থক্য আমি কিভাবে করি?)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার