#চেম্বার কথন
পর্ব ৪৩
ভদ্রমহিলা, “আমার প্রতিদিন ঘরে ঢুকতেই ইচ্ছে করে না। স্বামীর গাড়ি থেকে নামলে স্যালুট পাই। অথচ, আমি জানি আমার স্বামী বহুগামী! আমার শরীরে হীরের অলংকার ঝকঝক করে। তবুও প্রদীপের নিচে অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারেই আমার বিছানা। বহু বছর স্বামী আমাকে স্পর্শ করেন না। কিন্তু বড় বড় দাওয়াত, পার্টি সবখানে আমাকে হাসিমুখে অভিনয় করতে হয় আদর্শ স্ত্রীর। আমার স্বামী দয়া করে আমার মত আনস্মার্ট মহিলাকে সামাজিকতার চাপে আশ্রয় দেন। বাচ্চারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ওদেরও ধারণা মা আনস্মার্ট। ওদের কোন বন্ধুদের ফার্মহাউস পার্টিতে আমাকে নেয়া হয় না। আমার শাশুড়ি আমার থেকে বাড়ির কাজের লোককে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রচন্ড গরিব ঘরের মেয়ে ছিলাম। বাংলা সিনেমার মতন বাবা প্রাইমারি স্কুল মাস্টার। আমার শ্বশুরের বন্ধু। একরকম বাবা যখন মৃত্যু শয্যায় আমার শ্বশুর জোর করেই কারো মতামত না নিয়ে ছেলের এই বিয়েটা দেন। আমার ফাইভে, এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি ছিল। বিয়েটা হয়ে যায় ক্লাস টেনে। বাবা মারা যান বিয়ের দুদিন পরে। আমার শ্বশুর পরম মমতায় আমাকে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাকিরা কেউ এই বিয়েটা মেনে নেন নাই। আমি অদ্ভুত রূপসী ছিলাম। আমার নানী বলতেন দুধে আলতা গায়ের রং, মুখের কাটিং। আমার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকের রং মিসমিশে কালো। আমার জন্য আলাদা এক সেট কাপড় তোলা থাকতো। বাসায় মেহমান আসলে শাশুড়ির কাছ থেকে সেই কাপড় পরে সবার সামনে আসতে হতো। সবাই বলতো কপাল বটে! এত সুন্দর বউ। কিন্তু কেউ জানতো না যে সেই কাপড় খুলে আমাকে আবার ত্যানা পড়ে রান্না ঘরে ঢুকতে হতো।”
এইটুকু বলে ভদ্রমহিলা চুপ করে থাকলেন। আমি এমনিতেই কম কথা বলি। কারণ যিনি এসেছেন, তিনি নিজেই তো বলতে এসেছেন। আমার থেকে উপদেশ শুনতে আসেন নাই। মতামতও চাইতে আসেন নাই। কিন্তু মানুষটির একটাই প্রশ্ন থাকে, “আমি এখন কি করবো।”
একজন শিশু বেহালা বাজাচ্ছে এমন একটা পেন্সিল স্কেচ আমার চেম্বারে আছে। আমার মনে হয় “ভেতরের আমি” যেন মূর্ত হয়ে জীবন বীণায় সেই সুর তুলছে।
ভদ্রমহিলা উঠে সেই ছবির সামনে বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাড়ালেন।
স্মৃতি কাতর গলায় বললেন, ” জানেন, আমার একটা বেহালা ছিল। বাবা শেখাতেন। বেশ দামী, অ্যান্টিক। বাবা শত অভাবেও বিক্রি করেন নাই সেটা। ওটাই ছিল আমার বিয়ের একমাত্র যৌতুক। প্রথম প্রথম খাটের তলে ঠাঁই হয়েছিল সেই বেহালার। পরে যখন জানতে পারলো শাশুড়ী এটা অ্যান্টিক, তখন বসার ঘরে কাচের খোলসে। ওনার ছেলে মেয়েরা পড়তে লাগলো। আমি রান্না শিখতে লাগলাম। বাচ্চা কাচ্চা দ্রুতই হয়ে গেলো। শাশুড়ির পরামর্শে আমার লাইগেশন করানো হলো। যাতে ওনার ছেলের সুবিধা হয়। আমার শাশুড়ি প্রত্যেক ছেলেমেয়ের সংসারে মতামত দিতেন। সবাই বলতো মা’র কত বুদ্ধি। কত্ত ভালোবাসে সবাইকে। কিন্তু সেই ভালোবাসায় আমি কোথাও ছিলাম না। এর মধ্যে বাচ্চা হওয়া, নিজের অযত্ন এই সবে আমার শরীর ঝুলে পড়ছে, তাই আমার স্বামীর মন উঠে গেলো আমার থেকে। না আমি ঘরওয়ালি, না আমি বাহারওয়ালি। বাড়ির অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাও রোজ আমার থেকে বেশি যত্ন পায়।”
ভদ্রমহিলা আবার চুপ করলেন। আমার চেম্বারে প্রচুর গাছ। এর মধ্যে একটা হলো বাঘডোরা গাছ। ইংরেজিতে বলে স্নেক প্লান্ট।
ভদ্রমহিলা স্নেক প্লান্ট গাছে তাঁর আঙ্গুল ছোঁয়ালেন , “এই গাছে আরেকটা নাম নাকি, মাদার ইনলস টাং!” অদ্ভুত সুরে হাসলেন। হাসি কখনো কখনো কান্নার প্রতিচ্ছবি হয়।
আমি, “কাউন্সেলিং থেকে কি চান?”
ভদ্রমহিলা, ” মুক্তি! এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি।”
আমি, ” নিজেকে ধন্যবাদ দিয়েছেন যে এটা সে চায়?”
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে, ” নিজেকেও ধন্যবাদ দেয়া যায়?”
আমি মৃদু হেসে, ” হা! আপনার ভেতরে একটা অংশ সব সময়ই তো মুক্তি চেয়ে এসেছে। কিন্তু অন্য একটা অংশ রাজি হয় নাই। এখন যখন সেই অংশটি ও রাজি হয়েছে, সে মুক্তিযোদ্ধা অংশের থেকে একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারে তাই না?”
ভদ্রমহিলা, ” সত্যিই আমি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য?”
আমি, ” যিনি ‘মেনে নাও’ আর ‘মানিয়ে নাও’ এই বৃত্ত ভেঙে ফেলতে পারেন তিনি অবশ্যই স্যালুট পাওয়ার যোগ্য।”
আমার রবি ঠাকুরের বনের পাখি আর খাচার পাখির উপাখ্যান মনে পড়লো। খাঁচার পাখি “বাইরে আমি।” আর বনের পাখি, “ভিতরে আমি।”
“….দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা—কাতরে কহে, ‘কাছে আয় !’…”
আমরা বাস্তবের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে করতে ‘ভিতরের আমি’কে কোথায় কালাপানি পার করে নির্বাসনে পাঠাই! নিজেই সেই খোঁজ রাখি না। নিজের চোখে নিজে তাই আয়না ধরতে আমাদের এতো অনীহা।
আমি, ” এদ্দিন কোন কোন আচরণ করেছিলেন যার জন্য মুক্তি অধরা ছিল?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি নিজেকে নির্ভরশীল মনে করতাম। কিন্তু জানেন, আমি এতদিন যত কাজ ওই বাসার জন্য করেছি তাতে গ্রামে একটা বাড়ি, পুকুর হয়ে যেত। মানে ওই বাড়ির কাজের লোকদের বেতনের টাকায় তাই হয়েছে। ভেবে দেখেছি, শুধু টাকা নেই বলে আমি ওখানে আছি। নাইলে মন বহু আগেই উঠে গেছে।”
আমি, ” থাকুক না পুরনো গল্প। বেহালায় নতুন কি সুর তুলবেন সেটা বলেন? কি কি স্কিল আছে আপনার যেটা কাজে লাগাবেন আত্মসম্মানের সাথে অর্থ উপার্জনে?”
ভদ্রমহিলা বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবলেন। তারপর বললেন, ” রান্না আর বেহালা!”
এর মাঝে বহুদিন দেখা নেই। হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
সেই ভদ্রমহিলা আজ দাওয়াত দিয়ে গেলেন। বড়ো একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। শুরুতে ঘর ছেড়ে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল উঠেছিলেন বেহালা বাজানো ২টো টিউশন পেতেই। শাশুড়ি বলেছিলেন একবার চৌকাঠ পেরুলে আর যেন না ফেরে। স্বামী অবশ্য এসেছিলেন মহিলা হোস্টেল, তবে সেটা ফিরিয়ে নিতে নয়। পুলিশ নিয়ে। ওনার নাম খোদাই করা দামি রোলেক্স ঘড়ি চুরির অভিযোগে। বাচ্চারা বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার টাকায় পড়ে। আপাত প্রতিবাদে অক্ষম। খুব আগ্রহীও বোধহয় ছিল না। কারণ চিরজীবন দেখে এসেছে মাকে অসম্মান করা হয়। এবং সেখানে দাদী, ফুফু, চাচা ও বাবার পূর্ণ সায়। কাজেই বাচ্চারা যা দেখে তাই তো শেখে।
এখন ভদ্রমহিলা একটা বড় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। যেখানে আরো ৭ জন এমন ভদ্রমহিলা থাকেন। যাঁরা প্রত্যেকেই নিজের সংসারে তীব্র অপমানিত। নিজেরাই রান্না করেন। নিজেরাই খাবার সাপ্লাই দেন। বেশ যূথবদ্ধ জীবন। দারুন sisterhood. এনাদের মধ্যে একজনের স্বামী এখনো ত্রিভূবন দেখাচ্ছে বলে, এই প্রতিষ্ঠানের নামটা উহ্য থাক।
হত্যা একটি সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু প্রতিদিন যখন কেউ অন্য একজনকে মানসিক যাতনা, অতিরিক্ত দায়িত্বভার, অবহেলা ইত্যাদির চাপে একটু একটু করে অদৃশ্যভাবে খুন করে তখন এর কোন বিচার নাই।
আইনের আসলেই চোখ বাঁধা। আইন অন্ধ।
এইসব অপরাধীদের সামাজিক সুশ্রী মুখোশের আড়ালে যে ভীষণ কুৎসিত অসুস্থরূপ সেটা বেশিরভাগ মানুষই তলিয়ে দেখে না।
আবার ভদ্রমহিলাদের কাছে ফিরি। এই মহারথীরা আমাকে একটা হোম ওয়ার্ক দিয়েছেন। ওনাদের এই ঘরের একটা নাম ঠিক করে দিতে। ভেবেছি একটা কাঠের সাইনবোর্ডে ছোট্ট করে খোদাই করে দেবো।
কিন্তু নামটা কি হবে?
আপনাদের সাহায্য চাইছি।
(কথোপকথনের এই অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে, মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাক্টিশনার।