#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
মেয়েটির বয়স ২৮ ছুঁয়েছে। পেশাজীবী। অসম্ভব মেধাবী, প্রখর ব্যক্তিত্বর অধিকারিণী ও ধারালো সুন্দরী।
আমার টেবিলে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” ম্যাডাম আমি নিজেই নিজেকে এতো ঘেন্না করি, আমার মনে হয় হাজার বার থুথু দেই নিজের মুখে। আত্মহত্যা যদি আল্লাহ পাক নিষিদ্ধ না করতেন তাহলে আমি আত্মহত্যাই করতাম।”
ইন্টার্নি করার সময় এক সিনিয়র অফিসারের প্রেমে পড়ে। ভদ্রলোকের বয়স ৪৫। দুই সন্তানের পিতা। হ্যাপি ম্যারেডের ছবি টেবিলে।
মেয়েটি বললো, ” আমি জানি আমি সুন্দরী, ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের এটেনশান পেতে অভ্যস্ত। কখনো পা পিছলে নাই। কিন্তু কিভাবে যে এই লোকের চক্করে পড়লাম, আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি। ইন্টার্নি প্লেসমেন্ট শেষ হবার পরেও আমাদের কথা চলতে থাকে ফোনে।” এই ফোনালাপে ভদ্রলোক মেয়েটিকে বলতেন তাঁর অসফল দাম্পত্যের করুন কাহিনী। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাওয়ার গোপন গভীরতম ইচ্ছা।
পরবর্তীতে, এই সম্পর্ক বহুবার দৈহিক সীমানায় গড়ায়, থ্রি স্টার হোটেলের নীলাভ আলোয়। প্রতিবারই সেই বীরপুঙ্গব হোটেল বিল মিটিয়ে, মেয়েটিকে রেখে আগে বেরিয়ে যেতো পাছে দুজনকে কেউ একসাথে দেখে ফেলে বলে।
এই খেলাটা তখনই ফাঁস হয়, যখন ভদ্রলোকের স্ত্রী বিষয়টি ধরে ফেলেন। কারণ দাম্পত্য সম্পর্ক এমন একটা জিনিস, যেখানে সঙ্গীর সামান্যতম পরিবর্তনও অপরজনের চোখ এড়ায় না।
ভদ্রলোক এককথার নোটিসে, মেয়েটিকে বলে দেয় এভাবে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। কারণ সে তার সংসার টিকাতে আগ্রহী। কোন গুডবাই না, কোন কারণ না বলেই এক মুহূর্তের নোটিশে পলকেই সম্পর্কের মৃত্যু।
এরপর মেয়েটি নিজেকে চরমভাবে প্রতারিত অনুভব করা শুরু করলো। পরবর্তী ছয় মাস নিজেকে বোঝাল, এই সম্পর্কে লোকটার পাশাপাশি তার নিজেরও সমপরিমাণ দূষণীয় ভূমিকা ছিল। সে নিজেকে বারবার বাণবিদ্ধ করল বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর দায়ে। প্রতিবার নিজেকে বলতে থাকলো এই শাস্তি তার প্রাপ্য।
এরপর হঠাৎ একদিন, সেই ভদ্রলোকের আবার একটা মেসেজ। যেখানে লেখা ছিল, “আমি প্রতিদিন তোমার মেসেজ এর অপেক্ষায় থাকি।”
আবার এই স্ফুলিঙ্গ সমস্ত অনুতাপের বাঁধ ভেঙে দুর্নিবার আকর্ষণের বন্যায় মেয়েটিকে ভাসিয়ে নিল লোকটার প্রতি। পরিণতিতে আবার ধরা স্ত্রীর কাছে। আবার দূরত্ব, মেয়েটির সাথে।
এইবার আর মেয়েটা সহ্য করতে পারলো না। আত্মহত্যার চেষ্টা করল।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
এদের দুজনের সম্পর্কটাকে এক কথায় যদি বলি, সেটা হল “ট্রমা বন্ডিং”। শারীরিক, মানসিক, ইমোশনাল, সামাজিক কারণে এক জন মানুষের সাথে অন্য জনের এই ট্রমা বন্ডিং থাকতে পারে। কি হয় এই ট্রমা বন্ডিং-এ?
এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে সম্পর্কটা দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলে অসাধারণ মাধুর্যে। দুজন দুজনকে অতি অল্পদিনের মধ্যে খুব স্বল্প সময়ে অপ্রতুল পরিচয়ের ব্যবধানে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে অনুভব করতে থাকে। ফলে ভিকটিম এই নতুন সম্পর্ককে সব থেকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে যেয়ে নিজের জীবনযাত্রার প্যাটার্ন এর সাথে সম্পূর্ণ আসামঞ্জস্যপূর্ণ এমন কিছু আচরণ করবে, যেটা তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা কোন কিছুর সাথেই মিলে না। এই মেয়েটি যেমন, সব লোক লজ্জা ভয় উপেক্ষা করে হোটেলে গিয়েছিল। ভিকটিম তার টাইম, এনার্জি, মানি সবকিছু পরিবার এবং বন্ধুদেরকে উপেক্ষা করে এই নতুন রোমান্টিক সম্পর্কে ইনভেস্ট করবে। সাথে সাথে সব সময় হারাই-হারাই একটা ভয় তার মনে কাজ করবে। কোন কিছুর বিনিময়েই, ভিকটিম এই মানুষটিকে হারাতে চাইবে না। কারন সে সচেতনভাবে বিশ্বাস করা শুরু করবে এই মানুষটির হাতে তার স্বপ্নলোকের চাবি, সুখ পাখিটা বাঁধা। গোটা পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটির পক্ষেই সম্ভব তার চাহিদা মেটানো। কাজেই সমস্ত দুনিয়া একদিকে, আর এই মানুষটি তার কাছে অন্য দিকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
এসব ক্ষেত্রে, ওষুধের থেকেও সাইকোথেরাপি বেশি ভালো কাজ করে। ধীরে একাধিক সেশনের মাধ্যমে ভিকটিমকে সচেতন করা হয় এই ট্রমা সাইকেলের ধাপগুলো সম্পর্কে তথ্য দিয়ে। একাধিক সেশন লাগে কারণ, ভিকটিমের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ, ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সব তলানীতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে একটা সময়ের পরে, ফিনিক্স পাখির মতন ভিকটিম ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সসম্মানে, আত্ম প্রচেষ্টায়।
যারা অন্যদেরকে এবিউসিভ সাইকেলের মধ্যে ফেলে কুক্ষিগত করেন না, যারা অন্যকে ভিন্ন মতামত থাকা সত্ত্বেও একজন মানুষ হিসেবে সসম্মানে গ্রহণ করতে পারেন, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।