#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“Before marriage, a man will lie awake all night thinking about something you said; after marriage, he’ll fall asleep before you finish saying it.” — Helen Rowland
” ও সম্পুর্ন বদলে গেছে বিয়ের পরে। আগে আমার জন্য কি কি না করতো। আর এখন? মাঝেমাঝে আমার মনে হয় বিয়ের আগের ও বিয়ের পরের ও এ দুটো মানুষের আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি এই দুইজনকে একদম চিনতে পারিনা।” মেয়েটির বয়স ২৭ পেশাজীবি। দীর্ঘদিনের প্রেম তারপর পরিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে। দুই পরিবারের মধ্যেও চমৎকার বোঝাপড়া। কিন্তু গোলমাল বাঁধলো দম্পতির পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে। দুজনের মনে হচ্ছে দুজন দুজনকে চেনেন না।
“কি হয়?” আমি জানতে চাইলাম।
” কি হয় না? কথায় কথায় না। না হলে বসে মোবাইল টিপে, না হলে ঘুম থেকে উঠেছে টেলিভিশন দেখতে বসে যায়। ও এত খেয়াল রাখতো আমার ভালো মন্দের জায়গাটা অথচ এখন মনে হয় আমাকে চেনেই না। সেদিন চুল কেটে জিজ্ঞেস করলাম কেমন লাগছে না দেখেই বললো ভালো। আমি তো এই মানুষটিকে বিয়ে করিনি। আমাদের টাকা পয়সার অভাব নাই, আমাদের কোন কিছুর অভাব নেই, দুই পক্ষের শ্বশুরবাড়ির কোনো চাপ নেই, আমাদের বিজনেস চমৎকার চলছে, তারপরও আমার মনে হয় যে দুজনের মাঝখানে একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। বিয়ের দুই বছর এই যদি এরকম হয়, তাহলে বাকি দিনগুলো কেমন হবে?।” মেয়েটি বললো।
” তুমি কাউন্সেলিং থেকে কি চাও?” আলতো করে জানতে চাইলাম।
” বিয়ের দু বছর হয়ে গেছে, আমার মা শাশুড়ি দুই জনই বলছে বাচ্চা নেবার কথা। কিন্তু আমার আর ওর সাথে থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমি কেন বাচ্চা নেব যে সংসারে আমার নিজেরই মন টিকছে না?” মেয়েটার চোখ উঠছে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভালোবাসা বিয়ের আগে ও পরে পাল্টে যায়। কারন বিয়ের আগে ভালোবাসতেন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে। আর বিয়ের পরে ভালোবাসেন স্ত্রী অথবা স্বামীকে। দুটো আলাদা সম্পর্ক। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ হয়ে যায়। কেন এই পরিবর্তন? এটাকে চারটা ভাগে ভাগে ভাগ করব সামাজিক, পারিবারিক, মানসিক এবং শারীরিক।
সামাজিক দিয়ে শুরু করি। বিয়ের আগে দায়িত্ববোধের ভাগাভাগি থাকে না। বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি যেখানে কাবিন নামের দলিলে সই করতে হয়, এবং এই চুক্তির সাথে সাথে দায়িত্ব ভাগাভাগি শুরু হয়ে যায়। এই দায়িত্ব পারস্পরিক অন্ন যোগান থেকে শুরু করে, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা সন্তান পালন সবকিছুতে ঢুকে পরে।
দ্বিতীয়তঃ পারিবারিক। কারণ আমাদের দেশে দুটো মানুষের মধ্যে বিয়ে হয় না; বিয়ে হয় দুটো পরিবারের মধ্যে এবং ঝগড়াগুলো কিন্তু আমার বাড়ি তোমার বাড়ি নিয়েই শুরু হয়। তুমি, আমি নিয়ে নয়। কাজেই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়ের আগের ভালোবাসার নৌকা অনুকূলেও বইতে পারে প্রতিকূলে বইতে পারে। কাজে বিয়ের আগে ভালোবাসাটা শুধু একটা মানুষে আবদ্ধ ছিল, বিয়ের পরের ভালোবাসার মানুষটির সাথে সাথে তার পরিবার এমনকি যদি তার কুকুর থাকে কুকুরটিকেও সেই ভালবাসায় সংযুক্ত করে নিতে হয়।
এবার আসি মানসিক। প্রথমেই মনে রাখা দরকার বিয়ের আগে আমি তার নিরবিচ্ছিন্ন অ্যাটেনশন পেলেও বিয়ের পর সেটা পাবো না। এটাই বাস্তব; এটা মেনে নিলে অর্ধেক দাম্পত্য কলহ এমনি কমে যাবে। কারণ বিয়ের পর তখন আর শুধু আমি তুমি থাকি না, তখন আমরা হয়ে যাই অন্যান্য পারিবারিক সদস্যদের সাথে। সেখানে পরিবার প্রথমে আসবে। আমি, তুমি কাপল পরে আসবে। ফলে উন্মাতাল প্রেমের দিনে আমি, তুমি যা খুশি তাই করতে পারলেও বিবাহিত অবস্থায় পারিবারিক সম্মতির সীমারেখা প্রয়োজন। বিয়ের আগে যতগুলো আই লাভ ইউ, লাল গোলাপ আর গিফট আদান-প্রদান হয়েছে বিয়ের পর কিন্তু সেটা হবে না। আবার ঠিক বিয়ের আগে আমি যতোটুকু সুন্দর করে সেজেগুজে তার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করব (কারণ সেটা নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য) বিয়ের পর যখন 24 ঘন্টা একসাথে থাকব তখন কিন্তু সে আমার আলুথালু চেহারা প্রতিদিন দেখবে।
রবীন্দ্রনাথ চমৎকার বলেছেন,
” ওগো বর, ওগো বঁধু, জান জান তুমি–ধুলায় বসিয়া এ বালা তোমারি বধূ।
রতন-আসন তুমি এরি তরে রেখেছ সাজায়ে নির্জন ঘরে,
সোনার পাত্রে ভরিয়া রেখেছ নন্দনবনমধু– ওগো বর, ওগো বঁধু।”
একটু ভাবতে বলব যে বিয়েটা কি আমাকে তার কাছে taken for granted করে নিচ্ছে নাকি তাকে আমার কাছে taken for granted করে নিচ্ছে?
এর জন্যই বলে, “Don’t ever stop dating your wife and don’t ever stop flirting with your husband.”
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বিয়ের আগে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তার সাথে কেমন করে একটু দেখা করা যায় সেজন্য আমরা অস্থির হই। আর বিয়ের পর কি করে একটু পার্সোনাল স্পেস খুঁজে বের করা যায় এত দুইজনের ঘেঁষাঘেঁষি ভালো লাগছে না তার জন্য আমরা অস্থির হই। বিয়ের আগে পরস্পর পরস্পরের ছোট ছোট জিনিসগুলো খেয়াল রাখি বিয়ের পর রাখি না। কারণ বিয়ের পর দুজন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের জায়গাগুলো খোলাখুলি বের হয়ে আসে একসাথে থাকতে গিয়ে। তখন নিজের দোষ গুণ কিছুই আর ঢেকে রাখা যায় না।
কটা কথা স্পষ্ট মনে রাখতে হবে বিয়ের পর জীবন বদলাবে। অনেকে বর্তমান জীবন থেকে বোর ( bore) হয়ে বিয়ে করে। এই কাজটি ভুলেও করা যাবেনা।
“Life will be sorted after marriage, said who? A new set of challenges await you. While you may think marriage is the solution to all your single-life problems and now your life will be a cakewalk, we are sorry to break it to you, but it’s not really like that. Yes, there’s going to be a lot of love-filled moments, but if someone told you life changes after marriage only in an arranged marriage, that person just told you a lie. Things do change after marriage, even if you’re married to the love of your life. Read on and you will relate to every bit of it.” Anannya Chatterjee.
কাজেই মনে রাখতে হবে বিয়ের আগের সম্পর্ক তৈরিতে যে রকম যত্ন নিতে হবে, সেই যত্নে বিবাহিত সম্পর্ক চলবে না। বিবাহিত সম্পর্কের যত্নের ব্যাকরন আলাদা। সুন্দর বিবাহিত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দুইজনেরই আলাদা যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।কারণ বিবাহিত সম্পর্ক একটি চারা গাছের মতন। একে নিয়মিত রোদ বাতাস পানি দিতে হবে। সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে গুণবান প্রতি যদি থাকে তার সনে।
ঘুরে ফিরে আবার রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরতে হয়, তিনি বলেছেন, “ লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই ” আসলে ব্যক্তিজীবনে কয়জনেই আর্টের সমঝোদার? দুজনের মধ্যে যদি একজন সমঝদার হন অন্যজন না হন তাহলে কিন্তু কোন লাভ নেই।
শারীরিকভাবে নিউরোসাইন্স কিভাবে ব্যাখ্যা করে বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরের ভালোবাসাকে? গবেষণা বলছে রোমান্টিক ভালোবাসার তিনটি হরমোনের সাথে সম্পৃক্ত, dopamine, oxytocin এবং vasopressin. এদের মধ্যে ডোপামিন রোমান্টিক অনুভূতি এবং যৌন উত্তেজনা তৈরিতে ব্রেইনের রিওয়ার্ড সেন্টার নামে একটা জায়গা আছে সেটাকে ব্যাবহার করে। তখন এক পলকের একটু দেখাতেও কিংবা একটুকু ছোঁয়া লাগেতেও ব্রেইনের রিওয়ার্ড সেন্টার ডোপামিনের বন্যায় ভেসে যায়। এবার আসি oxytocin’ এবং vasopressin এর কথায়। এই দুইটা হরমোন মূলত বিয়ের পরে যখন বাচ্চা হয় তখন কাজ করে। এরা নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কজনিত যে বন্ডিংটা সেটা তৈরি করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা যে বলি প্রেম পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এটা কিন্তু সত্যি হয়। কি হয়? আমরা যখন প্রেম-টেম চোখে তাকিয়ে থাকি তখন ব্রেইনের কোন কোন এলাকার কাজ সীমিত হয়ে যায়। এই এলাকাগুলোর নাম amygdala, frontal cortex, parietal cortex, middle temporal cortex, ইত্যাদি। Amygdala ভয় তৈরীর সাথে সম্পৃক্ত। প্রেমে পড়লে oxytocin এবং vasopressin hormone amygdala’র উপরে কাজ করে ভয় কমিয়ে দেয়। ফলে ভালোবাসার মানুষটির দুই বাহুর মধ্যে আমরা নিজেদেরকে সব থেকে নিরাপদ মনে করি। যৌন মিলনেও amygdala’র কাজ একদম কমে যায়। ফলে আমরা ভয় একদম পাইনা। একটা কথা একটা কথা প্রচলিত যে প্রেম অন্ধ। আসলেও কিন্তু তাই। এবার যদি ব্রেইনের পাড়া বেড়াই। তাহলে দেখব যে ব্রেইনের যে অংশটা বিবেচনাবোধ যুক্তি এসব নিয়ে কাজ করে সেই অংশটার নাম frontal cortex এবং oxytocin vasopressin সেই জায়গার কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরে সম্পর্ক পরিবর্তিত হয় ফলে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ ভিন্ন আচরণ করে। যারা জীবনসঙ্গীর বিভিন্ন পরিবেশে বদলানোর সাথে সাথে নিজের আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন না করে স্বচ্ছতার সাথে নিজের অনুভূতিগুলো খোলাখুলি আলোচনা করবার সৎ সাহস রাখেন তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা ।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।