মেয়ে তো দেখছি ঝাড়ুর কাঠির মতো চিকন, পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছি কেউ একজন কথা টা বলায় নিচু মাথা উঁচু করে সেই ভদ্রলোকের মুখটা দর্শন করতে ইচ্ছে করছে আমার।
কিন্তু আমি মেয়ে তারা দল বেঁধে এসেছে আমাকে যাচাই করার জন্য, তাই মাথা নিচু করে থাকতে হবে আমায়। এতদিন তাই করে আসছি আজ সহ দশবার পার হয়ে গেছে এভাবে পাত্র পক্ষের সামনে বসাটা আমার। এতবার দেখতে আসে আমায় বিয়ে হয়না তা নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের কম কথা শুনতে হয় না আমাকে।
মা, মুখটা একটু তোলো আমরা সবাই দেখবো তোমায় কথাটা শুনে মনে হলো কোনো বৃদ্ধ মানুষের। মুখ উপরে তুললেও চোখ তুলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না আমার। চোখ দিয়ে তাকাচ্ছি না জন্য একজন মহিলা কণ্ঠ বলে উঠলো, মেয়ের কি চোখের সমস্যা নাকি?
আমি অবাক হচ্ছি না তেমন এসব অভ্যাস আছে আমার।
এবার দাঁড়িয়ে হেঁটে দেখানোর পালা, স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে দেখালাম তাদের।
একেই তো এতো পাতলা তারউপর লম্বা কি বিদঘুটে দেখতে লাগবে আমাদের ছেলের সাথে এই মেয়েকে, এই কথা বলে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিলেন।
.
আমার বাকশক্তি এখন জড় পদার্থের ন্যায় আচরণ করছে, আমার পরিবারের গুরুজনেরাও উপস্থিত আছেন সেখানে। এভাবে আমাকে অপমান করা হচ্ছে এতে তাদের কোনো প্রতিবাদ এর নমুনা দেখতে পেলাম না আমি।
আবার বসতে বলা হলো আমায়, বসলাম এবার নানান ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম আমি। আমার চোখ ছোট, কান বড়, নাকের সমস্যা এমন নানান কথা ভেসে আসছিলো কানে।
শেষে একজন বললেই ফেললো নতুন ভাবির যা চেহারা মোমবাতির আগুনে যেমন একটা ফু দিলে দপ করে নিভে যায়, তেমনি একটা ফু দিলে পড়ে যাবেন তিনি।
পাশ থেকে আরও একজন বলে উঠলো শুনেছি অতিরিক্ত চিকন মেয়েরা নাকি সন্তান জন্ম দিতে পারে না।
এবার আর চুপ করে থাকলাম না, সন্তানের বিষয়টা আমার মাতৃত্বে আঘাত হানে সোজা।
–কাকে ভাবি সম্মোধন করছেন আপনি, আমি তো আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করবো না। আপনারা এতক্ষণ আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করে আপনাদের মন মানসিকতার পরিচয় পরিস্কার ভাবে দিয়ে গেছেন।
এতো পরিস্কার যাদের মন এতো সরল, তাদের সাথে আত্নীয়তা করতে নারাজ আমি, কারন আমি এতটা সহজ সরল নই। এই জন্য নই যে আমি আপনাদের মতো এতো আয়োজন করে একঘর মানুষের সামনে শুধুমাত্র একজন মানুষকে হেয় করতে পারবো না, প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন এর দোষ- ক্রটির হিসেব গুনতে পারবো না।
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সে মানুষ, তার সম্পর্কে কোনো ছোট বড় কথা বলতে দ্বিধা লাগবে আমার তাই।
আব্বা তনুকা বলে ডাক দিলেন পাশ থেকে চলে যেতে বললেন, কিন্তু গেলাম না আমি। এতদিন অনেক সহ্য করেছি আজ কিছু কথা না বললেই নয়।
উপস্থিত সকলের মুখে অন্ধকার আর রেগে আছেন, উঠে চলে যাচ্ছিলেন একজন। পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম, এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন যে। আমাকেও আপনাদের সকলকে একটু পর্যবেক্ষণ করতে দিন, আমিও খুঁজে বের করি আপনাদের কত খুঁত আছে। কিংবা সৃষ্টিকর্তা কতটা নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছেন আপনাদের, সেটা দেখি একটু। চিন্তা করবেন না শারীরিক ক্রটি না থাকলেও, ফুরিয়ে যাওয়া টুথপেষ্ট এর থেকে যে কৌশল অবলম্বন করে পেষ্ট বের করা হয়, আমিও তেমন পন্থা অনুসরণ করবো। আপনারা তো এক্ষেত্রে ট্রাকের চাকা ব্যবহার করেছেন আমি না হয় সাইকেলের চাকা ব্যবহার করবো।
.
বেয়াদব মেয়ে, ইঁচড়েপাকা সহ আরও বিভিন্ন উপাধি পেলাম। সেই সময় চলে গেছেন তারা সকলে, যে দুই একজন আত্মীয় এসেছিলেন তারা-ও চলে গেছেন। এতক্ষণে আমার আজকের প্রতিবাদের কথা বেয়াদব এর সম্মাননা পাচ্ছে হয়তো অনেকের মুখে মুখে।
তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই।
ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি, এতোদিন কেঁদেছি আজ আর নয়। আমি তো বিধাতার সৃষ্টি, নিজেই তো আর নিজেকে সাজাইনি, তবে কেনো লোকে শারীরিক গঠন নিয়ে এতো কটু কথা বলবে।
খুঁত কম বেশি সকলেরই থাকে, কেউ সঠিক ভাবে পূর্ণ হয়তো নয়। বর্তমান সুন্দর একটা মনের মূল্য কেউ বুঝতে চায় না।
অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধুই বাহ্যিক সৌন্দর্যের। আমি মনে করি বোকারাই এভাবে বাহ্যিকতা কে বেশি প্রাধান্য দেয়, যা ক্ষণস্থায়ী। বাহ্যিক সৌন্দর্যের যে একেবারেই কোনো প্রয়োজন নেই তা বলছি না আমি, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকতার সমন্বয়ে বিবেচনা করা উচিত একজন মানুষকে। একটা বয়সে এসে মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য থাকে না, কিন্তু অভ্যন্তরীণ মনটা ঠিকি থাকে।
.
কিছু সময় পর আব্বা নিজে আমার ঘরে এসে বসলেন। বললেন মা রে দেখ তোর মা আর আমাকে কতটা ভিন্নতা বিরাজমান আমাদের মাঝে, তারপরেও আমরা সুখি কারন আমাদের মনের মিলটা অনেক। পৃথিবীতে একজন মানুষ কত বছরেই বা বেঁচে থাকে, এই ছোট্ট সময়ের জন্য পৃথিবীতে এসে সৌন্দর্য নিয়ে এতো পাগলামি করারও কিছু নেই। মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করলে সবকিছু শেষ। এতোদিন শুনে এসেছি স্বাস্থ্য বেশি হলে, শরীরের রঙ কালো হলে কিংবা উচ্চতায় ছোট হলে বিয়েতে সমস্যা হয়। এখন দেখছি সেই সাথে লম্বা ও চিকন মেয়েরাও যুক্ত হয়েছে।
যাই হোক আমার মেয়ে তুই, কেউ তোকে ছোট করবে কটু কথা বলবে তা আমি কিছুতেই মানবো না এবং সহ্য করবো না। মা’রে (আমার মাথায় হাত বুলিয়ে) তুই তো অনেক ভালো ছাত্রী, অনার্স এ বেশ ভালো রেজাল্ট ও করেছিস এইতো সপ্তাহ খানেক আগে তোর ফলাফল শুনে ভেবেছিলাম এবার মেয়ের বিয়ে দিই পড়াশোনা তো শেষ প্রায়। কিন্তু না, এখনো অনেক বাকি। তুই এমন কিছু হতে পারবি না রে মা, যার ফলে কেউ তোকে একটা টু কথা বলারও সাহস পাবে না। আলহামদুলিল্লাহ, পারবো আব্বা সেই সাথে আমার টেবিল ভর্তি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার বইগুলো দেখালাম আব্বাকে।
(সমাপ্ত)
গল্প : আত্মসম্মান
লেখা : Hawa Mania