#ইশরাত_জাহান_জেরিন
পর্ব ২১
“বা.. না মানে চুল পাকার পরও তো দেখি হাবাইত্তাগিরি ছাড়েন নি। এখন কি আমার রুমের বাহিরে ডু নট ডিস্টার্ব লিখে রোমান্স করতে হবে? নাকি অন্যের ভালুপাসা দেখে এলার্জি হচ্ছে? কিরমিতে চুলকায়? আমার কাছে কিন্তু ঔষধ আছে। আমি আবার কিরমির ডাক্তার।”
ফারাজ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে তার আগে চিত্রা তার মুখ চেপে ধরল। লোকটার মুখ তো মুখ নয় একেবারে অবাধ্য বন্দুকের নল। যখন-তখন গুলি ছোড়ার স্বভাব। মার্জিয়ার প্রতিবেশী নাহারের মা বিবি হাসুনি। হাসুনি বুড়ির বয়স হয়েছে। লাঠিতে ভর দিয়েই চলাফেরা করেন। কিন্তু বয়েস তাকে শান দিতে পারেনি। যদিও কানের সমস্যাটা বড্ড বেড়েছে। তিন-চারবার একই কথা বলার পর বোঝে। আর সে-ই কি না আজ সকাল সকাল হাজির হয়েছে চিত্রার বর দেখতে! দরজা ঠেলে ঢুকেছে বটে কিন্তু যে পরিস্থিতিতে পড়তে হলো, তা হয়তো কল্পনাতেও ছিল না। ফারাজের কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া এতক্ষণে আগুনের ফুলকির মতো হওয়ার কথা ছিল। তবে হয় নি। কারন সে বেচারি কানেই শুনতে পান না। ফারাজের মুখের কথা শুনে চিত্রা লজ্জায় খাটের কোণে গিয়ে দাঁড়ায়। বুড়ির সামনে এমন নির্লজ্জ কথা বলার পরও সে দিব্যি হাসছে!
হাসুনি ফারাজের সামনে এসে বলল,
” শরীর তো এক্কারে ফিটফাট তোর বেডার চিত্রা। এক্কারে খাসা জোয়ান মরদ পাইছোত।”
ফারাজ চিত্রার দিকে তাকাল। চিত্রা চোখের ইশারায় হাসুনির কানে না শোনার ইঙ্গিত বুঝিয়ে দিতেই ফারাজ হেসে বলে উঠল,
“ওরে বুড়ি তোমার শোনায় সমস্যা? মাগার তুমি কিন্তু আমাকে ঠিকই চিনেছো। পুরাই খাসা আমি। তোমার নাতনি তো লোড নিতে পারে না। ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলো তোমার সঙ্গে হার্ড রোমান্সটা সারি।”
“কি? খাসির মাংস খাইবা?” হাসুনি হতভম্ব হয়ে চিত্রার দিকে ফিরল। “এই চিত্রা, তোর মামী এমন খাটাশ কেন? তোর বেডারে মাংস রাইন্ধা খাওয়ায় না কেন?”
ফারাজ হাসি আটকে রাখতে পারল না। সে বলল খাসা আর শুনলো খাসি। ফারাজ হো হো করে হেসে বলে উঠল,
“ওনাকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে বুঝিয়ে ঘর থেকে বিদায় করো প্রিয়তমা। আমার এখনো তোমার সঙ্গে লাভ ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে খেলা করা বাকি।”
চিত্রার আর কিছু বলতে হলো না। হাসুনি নিজেই উঠে গেল। উঠে চিত্রার কানের কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে কিছু একটা বলে তওবা কাটতে কাটতে রুম থেকে বিদায় নিলো। লজ্জায় চিত্রা মরি মরি।
“কিরে বউ থেরাপির সময়ও তো এমন লজ্জা পাও না। আর ওই বুড়ি কি এমন বলল যে মুখে ন্যাচালার ব্লাসন চলে এসেছে?”
“ওমা আপনি ব্লাসনও চিনেন? খুব অভিজ্ঞতা আছে মনে হয়?”
” অভিজ্ঞতা তো মানুষের কত কিছুতেই থাকে না বউ। আস্তে আস্তে সব কিছুতেই অভিজ্ঞতা লাভ করতে করতে মানুষ অভিজ্ঞ হয়ে যায়। এটা পারফরম্যান্স দেখলেই তো বুঝে যাওয়ার কথা।”
“ফারাজ।”চিত্রা চোখ রাঙিয়ে তাকাল। কিন্তু ফারাজ দমল না।
“এভাবে ডেকে অবলা ছেলেকেটাকে আর উত্তেজিত করবেন না বিবিজান। পড়ে আমি ধরলে আপনার ফরটিন জেনারেশন এসেও আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।”
ফারাজ উঠে যায়। শরীর ব্যাথা করছে। গোসল করতেই হবে। সে ট্রাউজারের ফিতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” আমার ফিতাটা ঠিক আমার জবানের মতো। হুটহাট খুলে যায়। তুমি আবার অন্য কিছু ভেবো না। ফিতার চাবি তোমার হাতে কিন্তু জন্মের আগেই দিয়ে রেখেছি। অন্য নারী দেখে খুলে যাওয়ার আশঙ্কার তো দূরের কথা আশঙ্কার ‘অ’ অব্ধি নেই।”
“বেশি খারাপ আপনি।”
” হুম জাস্ট ফর ইউ। একটা চুমু দাও কসম বউ ভালো হয়ে যাবো।”
–
ট্রলারের দমবন্ধ পরিবেশ। ছাদ ঢেকে রাখা, বাতাস আসার সুযোগ নেই। সেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো মেয়ে পড়ে আছে। ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা তাদের চোখে স্পষ্ট। এরা সবাই পাচার হবে। এদের মধ্যকার একেকজনের ভাগ্য একেক রকম। এই যে… যেমন কেউ কেউ সাধারণ নারী থেকে দেহ ব্যবসায়ী কেউবা দাষী আবার ভাগ্য ভালো থাকলে কেউ উপরেও উঠতে পারে। এই ধরো কোনো ক্রেতা এদের মধ্যকার কাউকে পছন্দ করে ফেলল,ভালোবেসে বিয়ে করে ফেলল তখন কি মেয়েটার কপাল খুলবে না? সোহান একবার সবগুলো মেয়েকে গুনে নিল। এরপর সিফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রাতে যেইতারে আনা হইছে ওইটা কোনডা?”
সিফাত আঙ্গুল তুলে ইশারা করল একেবারে শেষের দিকে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে। সোহান সেদিকে তাকায়। চোখের সামনে চুল পড়ে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না মেয়েটার।
” ওরে তুল। চেহারাটা দেখি।”
সিফাত গিয়ে মেয়েটাকে টেনে হেঁচড়ে জাগায়। কাঁদতে কাঁদতে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিল। হুশ ফিরতেই পিটপিট করে একবার তাকায় মেয়েটা। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। আকুতি করে বলল,
“আমারে ছাইড়া দেন ভাই। ভিক্ষা দেন। আমার নানিটা রাস্তায় পইড়া আছে। আমার মা নাই। বাপে এক্সিডেন্ট করছে। নানিরে নিয়া ঢাকা যাইতে হইবো। ছাইড়া দেন।” কাঁদতে কাঁদতে ভিতরটা শুঁকিয়ে আসছে মেয়েটার। গলা অসাড় প্রায়।
“কি নাম?”
“মনিরা।”
সোহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মেয়েটার ভয়ার্ত চোখের দিকে একবার দেখে বলল,
“ওরে ছাইড়া দিস। মুক্তি দিয়া দিস।”
সিফাত হতভম্ব।”ভাই কি বলতাছেন? রাতে ডিলার আসবো। মাল বুঝাইয়া দিতে হইবো।”
সোহান মৃদু হেসে বলল,”সেটাই তো। রাতে তো এই মাইয়া আমাগো হাত থেকে মুক্তি পাইবোই। পড়ে কই কার হাতে পড়লো গুনার সময় নাইগা।”
“ওহ সেটা কইবেন তো। আচ্ছা ভাই মাল তো রাতে ডেলিভারি দিমু , দিনে না হয় ওর লগে আপনে একটু…”
সোহান তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল।
“বারবার এইসব ক্যান কস? নারী পাচার করি বইলা কি নারীর প্রতি দুর্বল? সোহান বারো ঘাটের পানি খায় না। যারে মনে ধরবো, কেবল তার প্রতিই দুর্বল হইব। কুত্তার মতো সবখানে মুখ দেওয়ার স্বভাব আমার নাই।”
সোহান চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে সিফাতকে বলল,
“কাজ যেটা করতে বলছি সেটা হইছে?”
“জে।”
“তাইলে এবার ফারাজ এলাহীর সঙ্গে সাক্ষাৎটা কইরাই ফেলাই। কি কস?”
” ভা..ই সত্যি কর..বেন?”
–
সকালের স্নিগ্ধ ঝলকানিতে নদী পাড়ের প্রশান্ত এক দৃশ্য উদ্ভাসিত হয়েছে। নদীর জলের পৃষ্ঠে সূর্যের মৃদু প্রতিফলন। শীতল হাওয়া নদীর গায়ে মৃদু স্পর্শ দিয়ে বয়ে চলেছে। ওপারে সুপারি গাছের সারি সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নৈসর্গিক সেই দৃশ্য। বাতাসের দোলনে পাতা গুলো মাঝে মাঝে হয়তো নেচেও উঠছে। আকাশে বকের দল স্বচ্ছনীড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক যেন হাওয়ায় ভাসানো শুভ্র মেঘমালা। নৌকায় থাকা জেলেরা তাদের পরিশ্রমী হাতের টানে মাছ ধরার কাজে নিমগ্ন। একটি মাছরাঙ্গা পাখি নিঃশব্দে নৌকার এক কোণে বসে আছে। হয়তো ক্ষুধা নিবারণের অপেক্ষা।
ঘোড়াউত্রা নদীর তীরে লাশ পাওয়া গিয়েছে। লোকজন লাশ দেখার জন্য ভিড় করছে। মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। মিজান সাহেবের লা*শ বলে কথা। কারা তাকে খু*ন করেছে কিংবা এসব কাদের কাজ গ্রামের লোকেদের তা জানা নেই। চিত্রার বাড়ি শিমুলতলা। বাড়ির কাছ দিয়েই ঘোড়াউত্রা নদী বয়ে গিয়েছে। চিত্রা মিজান সাহেবকে শেষবারের মত দেখতে আসবে না তা কি কখনো হয়? শত হলেও তো মিজান সাহেব সেই রাতে এমন কান্ড না ঘটালে কারো আসল রুপ চিত্রার সম্মুখে উন্মোচন হতো না। ফারাজকে একবার বলা মাত্রই সে চিত্রাকে নিয়ে এখানে এসেছে। চিত্রা একবার দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছে। কাছে যাওয়ার সাহস তার হয়নি। ভয়ানক মৃত্যু। এমন মৃত্যু যেন শত্রুরও না হয়। জবাই করা লাশ। মাথা আর শরীর আলাদা হয়ে পড়ে আছে। জিহ্বা বেড়িয়ে আছে তাতে পেরাক গেঁথে দেওয়া হয়েছে। রাতে বোধহয় লাশ এখানে ফেলে রাখা হয়েছে তাই দেহটা ইতিমধ্যে পোকায় খাওয়া শুরু করেছে। কি গন্ধ! চিত্রা শুধু দূর থেকে পা দু’টো দেখতে পেয়েছে। তবে ফারাজের ভয় ডর নেই। সে একেবারে কাছে গিয়ে লা*শটা দেখেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। অভ্র গিয়ে লা*শ দেখেনি। তার নাকি এসব দেখলে খারাপ লাগে। রাতে অস্তিত্ববোধ হয়। ঘুম আসে না। তাই সে গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। চিত্রা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ফারাজ পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কি সব কথা বলছে। চিত্রার সেইসব বিষয়ে আগ্রহ নেই। তবে এখন তার ভয় হচ্ছে। হুট করে খু*নের পর খু*ন। এসবের অবসান কোথায়? এসব বন্ধ হবে কবে থেকে শেষ থেকে? ফারাজ একবার দূর থেকে চিত্রার দিকে তাকাল। তারপর আবার পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
চিত্রা অস্থির হয়ে অভ্রকে বলল, “এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে?”
“ভাই এলেই রওনা হবো,” অভ্র আশ্বস্ত করল।
চিত্রা অস্বস্তি বোধ করছে। অভ্র তা বুঝতে পেরে বলল, “আপনি চাইলে গাড়িতে গিয়ে বসতে পারেন। অথবা চলুন, ওই পাশে বসার জায়গা আছে।”
চিত্রা একটু ভেবে রাজি হয়ে মাথা নাড়ল। অভ্রও সঙ্গে চলতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে এক বৃদ্ধা হুড়মুড়িয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল!
“কালুর বাপ! আমি আর এমন করুম নেভার। ইউ গো হাউস পিলিজ।”
অভ্র পুরোপুরি হতভম্ব! এই মহিলা কে? কেন তাকে এমন করে ধরেছে?
“এই… ছাড়ুন! আমি কুদ্দুসের বাপ, কালু-ফালুর কিছু না!”
বৃদ্ধা কান্না জুড়ে দিল। অভ্রর হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, “লেটেল এগরি করছি বইলাই কি ইউ আরেক ওমেনকে বিয়া কইরা কুদ্দুসের ফাদার হইয়া যাইবা? গো হাউজে!”
চারপাশের লোকজন হইচই শুনে তাদের দিকে তাকাল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে অভ্র আর বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। অভ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চিত্রার দিকে তাকাল, “ভাবী, এই ইংলিশ পাগলের হাত থেকে আমাকে বাঁচান!
চিত্রা হতভম্ব! এই বৃদ্ধা এমন করছে কেন? সে শান্তভাবে বলল, “দাদু, নিশ্চয়ই আপনার ভুল হচ্ছে।”
বৃদ্ধা মুহূর্তেই ক্ষেপে উঠল। ভ্রু কুঁচকে চিত্রাকে ধমক দিল, “ছেটআপ ইস্টুপিট গার্ল! দিচ ইচ মাই কালুর বাপ। ইউ দূরে গিয়া মর।”
কি একটা বিপদ। মানে দুনিয়ার সব বিপদ কি অভ্রর কাঁধেই ঝুলে?
“ফারাজ ভাই! হেল্প মি। পুলিশ বাঁচান আমাকে। আমার এখনো বিয়ে হয় নি। এই বুড়ি ছাড়। ছাড় কইলাম।”
ফারাজ আসার আগেই সেখানে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে সেখানে উপস্থিত হয়। বৃদ্ধাকে পেছন থেকে ধরে বলে,
“আরে দাদু বাড়ি চলো। কালুর বাপ বাড়িতে গেছে। জলদি চলো।”
অভ্র মেয়েটার দিকে তাকায়। মহিলার পেছনে থাকায় দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটার অন্যদিকে খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত মহিলাটাকে নিয়ে।
“নু এডাই মাই কালুর ফাদার।”
“আরে আপা জলদি আপনার মেন্টেল দাদিকে আমার হাত ছাড়তে বলেন। আমার আবার এক নম্বর ধরেছে।”
“আসলে আমার দাদুর মাথায় একটু সমস্যা। যাকে না তাকে দেখলেই কালুর বাপ মনে করে।”
মেয়েটা এবার সামনের দিকে এগিয়ে আসতেই অভ্র তার দিকে তাকায়। মেয়েটাও তার দিকে তাকায়। দুজনের চক্ষুচড়কগাছ। উভয়ের মুখ থেকেই এক সঙ্গে বের হয়,
“শালা তুই”
“শালী চুন্নি?”
চলবে?
(আজকে কি সব লিখছে নিজেও জানি না। লিখতে ইচ্ছে করছিল না। কষ্ট করে পড়েন থাক।)